You dont have javascript enabled! Please enable it! রাধানগর যুদ্ধ (গোয়াইনঘাট, সিলেট) - সংগ্রামের নোটবুক

রাধানগর যুদ্ধ (গোয়াইনঘাট, সিলেট)

রাধানগর যুদ্ধ (গোয়াইনঘাট, সিলেট) একাধিকবার সংঘটিত হয়। এ-যুদ্ধে ভারতীয় মিত্রবাহিনীর ৩৬ জন সদস্য শহীদ ও ৫০ জনের অধিক আহত হন। অপরদিকে বহু সংখ্যক পাকিস্তানি সৈন্য হতাহত হয়।
সিলেট-তামাবিল-ডাউকি-শিলং মহাসড়কটি ভারতীয় উপমহাদেশে ইংরেজ শাসনামল থেকেই যথেষ্ট গুরুত্ব বহন করে আসছে। ভারতের আসাম, মেঘালয়, মণিপুর, নাগাল্যান্ড ও মিজোরামের সঙ্গে স্থলপথে ব্যবসা-বাণিজ্য ও যাতায়াতের একমাত্র মাধ্যম হচ্ছে এ সড়কপথ। গোয়াইনঘাট উপজেলার পূর্ব জাফলং ইউনিয়নে সিলেট- গোয়াইনঘাট সড়কের শেষ প্রান্তে রাধানগরের অবস্থান। গোয়াইনঘাট উপজেলা সদর থেকে ৬ কিমি এবং তামাবিল থেকে এর দূরত্ব ১০ কিমি। মুক্তিযুদ্ধের সময় রাধানগর ৫নং সেক্টরের ডাউকি সাব-সেক্টরের অন্তর্ভুক্ত ছিল এবং এর পাশেই ছিল ভারতের ডাউকি বিএসএফ-এর বিওপি রাধানগরের দক্ষিণে ছোটখেল, এরপর সালুটিকর বিমানবন্দর ও সিলেট শহর। এপ্রিল মাসের শেষদিকে পাকিস্তানি বাহিনী রাধানগরে প্রবেশ করে এবং ১লা মে তারা তামাবিল বিওপি দখলে নেয়। ইপিআর বাহিনী ৫ই মে পাল্টা আক্রমণ করে তামাবিল বিওপি আবার তাঁদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেন। ২৩শে জুন পাকিস্তানি মেজর হামিদ ও ক্যাপ্টেন নাসিরের নেতৃত্বে গোয়াইনঘাট-রাধানগর সড়ক ধরে পুনরায় রাধানগর দখল করে। এরপর তারা রাধানগর বাজার, ইসলামপুর, ছোটখেল, কাফাউড়া, কুমিল্লা বস্তি, মুরা বস্তি, জাফলং চা বাগান ফ্যাক্টরি ও স্টাফ কোয়ার্টার এলাকা জুড়ে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তুলে রাধানগরকে একটি দুর্ভেদ্য ঘাঁটিতে পরিণত করে। এ ঘাঁটিতে ৩১ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের একটি কোম্পানি, ইস্ট পাকিস্তান সিভিল আর্মড ফোর্স (ইপিসিএএফ)-এর একটি কোম্পানি, স্কাউট ও রাজাকারআলবদররা প্রতিরক্ষায় নিয়োজিত ছিল। ২৭শে জুন সুবেদার মজিবুরের বাহিনী এবং মুক্তিযোদ্ধারা রাধানগর পাকিস্তানি ক্যাম্পে আক্রমণ চালান। কিন্তু পাকিস্তানি বাহিনীর ভারী অস্ত্রের মুখে টিকতে না পেরে তাঁরা পিছু হটতে বাধ্য হন। এখানে অবস্থান করে হানাদার বাহিনী রাধানগরের আশপাশের এলাকায় হত্যা, নির্যাতন, লুণ্ঠন ও অগ্নিসংযোগ চালিয়ে যেতে থাকে। অপরদিকে মুক্তিযোদ্ধারা প্রতিনিয়ত রাধারনগরের আশপাশে এম্বুশ, রেইড ও গেরিলা আক্রমণ করে হানাদার বাহিনীকে ব্যতিব্যস্ত করে রাখেন। এসব আক্রমণে ক্যাপ্টেন মোতালিব, সুবেদার মজিবুর, সুবেদার মেজর বি আর চৌধুরীর নেতৃত্বে ইপিআর ও মুক্তিযোদ্ধাদের ৪-৫টি কোম্পানি অংশ নেন। এ কাজে ভারতের বিএসএফ-এর মেজর রাও এবং জাফলং চা বাগানের ম্যানেজার নাজিম কায়েস চৌধুরী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। ৪ঠা নভেম্বর ৩য় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টকে ডাউকি এলাকায় পোস্টিং দেয়া হয়। মিত্রবাহিনীর ২টি ইউনিট, ৩য় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা রাধানগর-গোয়াইনঘাট-সালুটিকর- সিলেট এলাকায় অভিযানের উদ্দেশ্যে শত্রুঘাঁটি দখলের পরিকল্পনা করেন। ৫ই নভেম্বর ৩য় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অধিনায়ক মেজর শাফায়াত জামিলের নেতৃত্বে এ রেজিমেন্টের আলফা কোম্পানি, ডেলটা কোম্পানি, ইকো কোম্পানি ও সদর দপ্তর কোম্পানিকে তামাবিল বিওপিতে একত্রিত করা হয়। ভারতের ৫/৫ গুর্খা রেজিমেন্টও তাঁদের সঙ্গে যোগ দেয়। যৌথ বাহিনীর সার্বিক তত্ত্বাবধানে ছিলেন মেজর জেনারেল গুলবক্স সিং। মেজর শাফায়াত জামিল ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈনিক ও মুক্তিবাহিনী-র কোম্পানিগুলো নিয়ে প্রথমে ৩ দিক দিয়ে রাধানগর অবরোধ করার সিদ্ধান্ত নেন। ৬ই নভেম্বর এক পর্যায়ে রাধানগরে যুদ্ধ শুরু হয়। লেফটেন্যান্ট এস আই এম নুরুন্নবী খান ডেল্টা কোম্পানি নিয়ে জাফলং চা বাগান সংলগ্ন লুনি গ্রামে, লেফটেন্যান্ট মঞ্জুর আহমেদ তাঁর আলফা কোম্পানি নিয়ে রাধানগর পুলের উত্তর-পূর্ব প্রান্তে কাফাউড়া গ্রামে অবস্থান নেন। প্রতাপপুরে ৩য় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ব্যাটালিয়ন সদর দপ্তর স্থাপন করা হয়৷ ইতোমধ্যে সুবেদার মোশাররফ তাঁর কোম্পানি নিয়ে লুনি গ্রামের দক্ষিণ-পশ্চিম প্রান্তে এবং লেফটেন্যান্ট মতিউর তাঁর কোম্পানি নিয়ে রাধানগরের উত্তরে অবস্থান গ্রহণ করেন। এছাড়া রাধানগরের উত্তর-পূর্ব দিকে কাফাউড়া গ্রামকে পশ্চিমে রেখে মুজাহিদ ক্যাপ্টেন দাউদের কোম্পানি এবং ইপিআর সুবেদার রফিকের কোম্পানি পূর্ব থেকেই লুনি গ্রামের পাশে অন্য একটি গ্রামে অবস্থান করছিলেন। ৭ই নভেম্বর লুনি গ্রামে মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানি বাহিনীর একটি টহল দলের ওপর আক্রমণ করলে উভয় পক্ষের মধ্যে প্রচণ্ড গোলাগুলি হয়। ৮ই নভেম্বর হানাদারদের একটি দল লুনি গ্রামে মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর আক্রমণ করলে লেফটেন্যান্ট এস আই এম নুরুন্নবী খানের কোম্পানি কৌশলগত কারণে পিছিয়ে এসে ঘোরা ও সত্তারগাঁও গ্রামে অবস্থান নেন। ১৪ই নভেম্বর ৩য় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ২টি প্লাটুন এবং ছাত্র কোম্পানির একটি প্লাটুন ছাতক থেকে এসে লেফটেন্যান্ট নুরুন্নবীর সঙ্গে যোগ দেন। অপরদিকে গোয়াইনঘাট থেকে যাতে হানাদার বাহিনী রাধানগরে রিইনফোর্সমেন্ট করতে না পারে সেজন্য লেফটেন্যান্ট নুরুন্নবীর নির্দেশে লেফটেন্যান্ট ইয়ামিন খাইরাই-কোম্পানিগঞ্জ-সালুটিকর ঘাট, লেফটেন্যান্ট খালেদ খাইরাই ও গোয়াইনঘাট সড়ক, লেফটেন্যান্ট রউফ ও লেফটেন্যান্ট তাহের আখঞ্জি তাঁদের দল নিয়ে সালুটিকর-চালিতাবাড়ি-জল্লারপাড়ে অবস্থান নেন। ২৬শে নভেম্বর মুক্তিবাহিনীর একটি কোম্পানি শিমুলতলা গ্রামে অবস্থান নিলে রাধানগর ঘাঁটিতে অবস্থানরত পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে সদর দপ্তরের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এ রাতেই ভারতীয় ৫/৫ গুর্খা রেজিমেন্ট হানাদার বাহিনীর রাধানগর ও ছোটখেল ঘাঁটিতে আক্রমণ চালায়। সুবেদার বদিউর রহমানের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দলও এ আক্রমণে অংশ নেয়। উভয় পক্ষের মধ্যে প্রচণ্ড যুদ্ধ শেষে গুর্খা রেজিমেন্ট ছোটখেল দখল করে। এ রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে ৩৬ জন গুর্খা সৈনিক শহীদ এবং ৫০ জনের অধিক আহত হন। কিন্তু ৬ ঘণ্টা পরেই হানাদার বাহিনী পাল্টা আক্রমণ চালিয়ে ছোটখেল পুনর্দখল করে নেয়। ছোটখেলে গুর্খাদের বিপর্যয়ের পর তা পুনরুদ্ধারের পরিকল্পনা করা হয়।
মিত্রবাহিনীর অনুরোধে ৫ নম্বর সেক্টরের অধিনায়ক মেজর মীর শওকত আলী ৩য় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টকে ছোটখেল দখলের নির্দেশ দেন। তাঁর নির্দেশনা পেয়ে মেজর শাফায়াত জামিল নিজেই আক্রমণ পরিচালনার কথা জানান। এতে মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবল আরো বেড়ে যায়। ২৮শে নভেম্বর রাতে মেজর শাফায়াত জামিলের নেতৃত্বে ছোটখেলে ৩য় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ডেল্টা কোম্পানির মুক্তিযোদ্ধারা আক্রমণ চালান। পাকিস্তানি বাহিনী পাল্টা আক্রমণ চালালে উভয় পক্ষের মধ্যে প্রচণ্ড যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এ-যুদ্ধে বহু সংখ্যক পাকিস্তানি সৈন্য হতাহত হলে তারা পিছু হটে এবং ছোটখেল মুক্তিযোদ্ধাদের দখলে আসে। অপরদিকে হানাদার বাহিনীর গুলিতে মেজর শাফায়াত জামিল আহত হন। সহযোদ্ধারা তাঁকে ভারতের তুরা হাসপাতালে পাঠান। আহত অবস্থায় থেকেও তিনি লেফটেন্যান্ট এস আই এম নুরুন্নবী খানকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে রাধানগর থেকে উৎখাত করার নির্দেশ সম্বলিত পত্র দেন। অধিনায়কের অবর্তমানে এস আই এম নুরুন্নবী খান ভারপ্রাপ্ত অধিনায়কের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এরপর ২৯ ও ৩০শে নভেম্বর লেফটেন্যান্ট নুরুন্নবীর নেতৃত্বে লেফটেন্যান্ট মতিউর, মুজাহিদ, মঞ্জুর আহমেদ, ক্যাপ্টেন দাউদ, হাবিলদার রফিক, সুবেদার মোস্তাক প্রমুখ তাঁদের কোম্পানি নিয়ে হানাদার বাহিনীর রাধানগর ঘাঁটিতে আক্রমণ করেন। ২ দিনের এ ভয়াবহ যুদ্ধে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী মুক্তিযোদ্ধাদের প্রচণ্ড আক্রমণে টিকতে না পেরে রাতের অন্ধকারে গোয়াইনঘাটের দিকে পালিয়ে যায়। রাধানগর হানাদার ঘাঁটির পতনের মধ্য দিয়ে ডাউকি সাব-সেক্টর হানাদারমুক্ত হয়। এ-যুদ্ধে ভারতীয় মিত্রবাহিনী-র ৩৬ জন সদস্য শহীদ ও ৫০ জনের অধিক আহত হন এবং বহু সংখ্যক পাকিস্তানি সৈন্য হতাহত হয়। [মনিরুজ্জামান শাহীন ও শফিউদ্দিন তালুকদার]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৯ম খণ্ড