মুক্তিযুদ্ধে রাজৈর উপজেলা (মাদারীপুর)
রাজৈর উপজেলা (মাদারীপুর) রাজনৈতিক ঐতিহ্যমণ্ডিত একটি এলাকা। ব্রিটিশ আমল থেকেই এ এলাকা ভারতীয় উপমহাদেশের বহু বিখ্যাত রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের জন্মভূমি হিসেবে সুপরিচিত। এখানে জন্মগ্রহণ করেছেন ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের এক সময়ের সর্বভারতীয় নেতা ও সভাপতি এডভোকেট অম্বিকাচরণ মজুমদার, নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসুর ব্যক্তিগত সচিব ও পরবর্তীকালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর ঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক সহকর্মী ফণীভূষণ মজুমদার, তফসিলি ফেডারেশনের নেতা ও হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মন্ত্রিসভার সদস্য দ্বারিকানাথ বারুরী প্রমুখ। এছাড়া খালিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেছিলেন ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের বিখ্যাত বিপ্লবী নেতা পূর্ণচন্দ্র দাস। উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান-এ রাজৈর উপজেলার জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণ ছিল। ১৯৭১ সালের ২রা মার্চ থেকে শুরু হওয়া অসহযোগ আন্দোলন-এও তারা সক্রিয় ভূমিকা পালন করে। বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক সাতই মার্চের ভাষণ-এর পর এখানে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি শুরু হয়।
৭ই মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে দেয়া বঙ্গবন্ধুর দিকনির্দেশনামূলক ভাষণের পর রাজৈর থানায় সর্বদলীয় সংগ্রাম কমিটি গঠিত হয়। এ কমিটির আহ্বায়ক ছিলেন সরদার সাজাহান (স্বরমঙ্গল) এবং সদস্য ছিলেন শওকত আলী হাওলাদার
(স্বরমঙ্গল), আব্দুল মোতালেব মিয়া (স্বরমঙ্গল), হারুন-অর-রশীদ মোল্লা(স্বরমঙ্গল), আবদুল ওহাব মোল্লা (স্বরমঙ্গল), সেকান্দার আলী শেখ (ঘোষালকান্দি), সামসুদ্দিন আহমেদ (হাসানকান্দি), প্রফুল্ল কুমার বারুরী (চৌয়ারীবাড়ি) এবং উপেন্দ্রনাথ বৈদ্য (ভেন্নাবাড়ি)। এ কমিটির উদ্যোগ ও তত্ত্বাবধানে মুক্তিযুদ্ধের কার্যক্রম পরিচালিত হয়।
রাজৈর থানা সর্বদলীয় সংগ্রাম কমিটির উদ্যোগে টেকেরহাট ডাকবাংলোর সামনের মাঠ, রাজৈর হাইস্কুল মাঠ ও রাজৈর হজখোলা মাঠে বাঁশের লাঠি নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের প্রাথমিক প্রশিক্ষণ শুরু হয়। কর্নেল শওকত আলী এবং স্টুয়ার্ড মুজিবের উদ্যোগে ১৬ই এপ্রিল মাদারীপুর নাজিমউদ্দিন কলেজ মাঠে মুক্তিযোদ্ধা বাছাইয়ে অংশগ্রহণকারীদের মধ্য থেকে বেশ কয়েকজন মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ গ্রহণের জন্য ১৭ই এপ্রিল ভারতের উদ্দেশে যাত্রা করেন। ভারতে গমনকারী এই প্রথম দলে রাজৈর উপজেলার মীর আব্দুল কাইয়ুম, মো. সেকান্দার আলী শেখ, মো. শাহ্জাহান খান, জাহাঙ্গীর হোসেন, মো. শহীদুল ইসলাম, আলী আহমেদ ফকির, মো. হাফিজুর রহমান মিয়া, মো. রফিকুজ্জামান, আহম্মদ আলী মিয়া, আব্দুল মোতালেব বেপারী, ক্ষিতীশ চন্দ্র দাস, মো. রুস্তম সরদার, মঞ্জুরুল ইসলাম, বিধান বিশ্বাস, সত্যেন বিশ্বাস, আলমগীর হোসেন প্রমুখ ছিলেন।
রাজৈর উপজেলায় মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকদের মধ্যে ছিলেন ফণীভূষণ মজুমদার এমপিএ, গৌরচন্দ্র বালা এমপিএ, শওকত আলী হাওলাদার (খালিয়া ইউনিয়ন), প্রফুল্ল কুমার বারুরী, সফিজ উদ্দিন ফকির, সাহেবালী মিয়া, আব্দুস ছাত্তার মিয়া (রাজৈর ইউনিয়ন), সখিচরণ বিশ্বাস, কিরণ গাইন, নারায়ণ বৈদ্য (কদমবাড়ী ইউনিয়ন), ভগীরথ মণ্ডল, জলিল বেপারী, বাবু চ্যাটার্জী, মীর মাহতাব উদ্দিন (আমগ্রাম ইউনিয়ন), শশীভূষণ বিশ্বাস (আমগ্রাম), আনোয়ার হোসেন বয়াতি, খোকন চৌধুরী (বাজিতপুর ইউনিয়ন), ছমির উদ্দিন মোল্লা, আনোয়ার হোসেন তারা মিয়া, নুরুজ্জামান মুফতি (বদরপাশা ইউনিয়ন), সামসুদ্দিন মিয়া, মালেক মিয়া, নুরুল ইসলাম মাতুব্বর, হাফিজ উদ্দিন মাতুব্বর, মতিউর রহমান মিয়া, আব্দুর রশীদ মোল্লা, চারুচন্দ্র বোস (ইশিবপুর ইউনিয়ন), এদোন মাতুব্বর (হোসেনপুর ইউনিয়ন), রজ্জব আলী মাতুব্বর, হাবিবুর রহমান খলিফা (পাইকপাড়া ইউনিয়ন) প্রমুখ।
রাজৈর উপজেলায় ২নং সেক্টর কর্তৃক নিয়োগপ্রাপ্ত মুক্তিবাহিনীর থানা কমান্ডার ছিলেন আব্দুল কাইয়ুম মীর। সেপ্টেম্বর মাসের দিকে ৮নং সেক্টর কর্তৃক রাজৈর থানা কমান্ডার হিসেবে নিয়োগ লাভ করেন এম এ কাদের মোল্লা। মুজিব বাহিনী-র রাজৈর থানা কমান্ডার ছিলেন হারুন-অর-রশীদ মোল্লা। এ উপজেলার সরদার সাজাহান ছিলেন মুজিব বাহিনীর ফরিদপুর জেলার ডেপুটি কমান্ডার। সরওয়ার হোসেন মোল্লা ছিলেন মুজিব বাহিনীর মাদারীপুর মহকুমা কমান্ডার। মুক্তিবাহিনীর প্লাটুন কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন সেকান্দার আলী শেখ, আমিন উদ্দিন বাওয়ালী, নজরুল ইসলাম পান্না (মুজিব বাহিনী), এ কে ফজলুল হক মোল্লা, শেখ মো. আক্কাছ আলী, এস এম তোতা মোল্লা, শরৎ কুমার বৈদ্য, অশোক কান্তি বিশ্বাস, জবেদ মাস্টার, সেকেন্দার আলী হাওলাদার প্রমুখ। ২৪শে এপ্রিল পাকবাহিনী ফরিদপুর-বরিশাল মহাসড়ক হয়ে রাজৈর উপজেলায় প্রবেশ করে এবং টেকেরহাট বন্দরের ফেরিঘাট সংলগ্ন ডাকবাংলোয় ক্যাম্প স্থাপন করে।
মাদারীপুর মহকুমায় রাজাকার বাহিনী গঠিত হওয়ার পর রাজৈর উপজেলায়ও এ বাহিনী গঠিত হয়। রাজৈর থানার রাজাকার কমান্ডার ছিল মহিউদ্দিন মনি হাওলাদার এবং সহকারী কমান্ডার ছিল মো. রফিক হাওলাদার ও আবদুল ওহাব খাঁ। থানার বিভিন্ন গ্রামে সংঘটিত গণহত্যা, অগ্নিসংযোগ ও লুটতরাজে পাকবাহিনীর সঙ্গে রাজাকার বাহিনীও অংশগ্রহণ করে। তারা বিভিন্ন সড়ক-মহাসড়কের ব্রিজে পাহারা দেয় এবং মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধেও লিপ্ত হয়। রাজৈর উপজেলায় আলবদর বাহিনীও গঠিত হয়। এর কমান্ডার ছিল মো. সাহাবুদ্দিন শেখ। রাজৈর থানার শান্তি কমিটি-র গুরুত্বপূর্ণ সদস্য ছিল মতলেব খন্দকার ও আবুবকর শেখ (মন্টু শেখ), কমল শেখ, ফজলু মিয়া, গোলাম চৌকিদার, হাসেম চৌকিদার, ফায়েজ আকন প্রমুখ। রাজৈর উপজেলা সদরের কাছে অবস্থিত সাহাপাড়া এবং কুণ্ডুপাড়ায় এপ্রিল মাসের শেষদিকে পাকসেনা ও রাজাকারদের ৫০ জনের একটি দল লুটপাট ও হত্যাকাণ্ড চালায়। এ-সময় তারা নিলু সাহা ও তার ছেলে কার্তিক সাহাকে গুলি করে হত্যা করে।
১০ই মে রাজৈর ইউনিয়নের শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান মো. সাহাবুদ্দিন শেখের নেতৃত্বে কমল শেখ, ফজলু মিয়া, গোলাম চৌকিদার, হাসেম চৌকিদার, ফায়েজ আকনসহ ১৪-১৫ জনের একটি দল গোবিন্দপুর গ্রামের আব্বাস মৃধার বাড়িতে হামলা করে এবং তার বসতঘরে আগুন দেয়। ২৩শে মে দক্ষিণ রাজৈরের যাদব ঠেটাকে পাকসেনারা গুলি করে হত্যা করে। পাকসেনা ও রাজাকাররা হিন্দুপ্রধান আমগ্রাম ইউনিয়ন চারবার আক্রমণ করে। প্রতিবারই তারা এখানে হত্যাকাণ্ড চালায় এবং সাধারণ মানুষের ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে। রাজাকার কমান্ডার মহিউদ্দিন মনি হাওলাদার টেকেরহাটের রাজাকাররা পাকসেনাদের নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মী ও হিন্দুদের বাড়িঘর পোড়ানোর অভিযান শুরু করে। মনি হাওলাদার প্রায় একশ পাকসেনা ও রাজাকার নিয়ে বদরপাশা ইউনিয়নের আওয়ামী লীগ সভাপতি ছমিরুদ্দিন মোল্লার বাড়িতে হামলা করে। তারা ছমিরুদ্দিন মোল্লার বাড়িসহ হিন্দু সম্প্রদায়ের দুশজনের ঘরবাড়িতে লুটপাট শেষে অগ্নিসংযোগ করে। ১৯শে নভেম্বর পাকসেনারা দুর্গাবর্দী গ্রামের চারু বোসের বাড়িতে আগুন দেয়। পাকবাহিনী পান্না মিয়ার বাড়ি পুড়িয়ে দেয় এবং তার ভাইকে হত্যা করে।
২০শে মে পাকবাহিনী ও তাদের স্থানীয় দোসররা সেনদিয়া গ্রামে অভিযান চালিয়ে ১২৬ জন নারী-শিশুকে নির্মমভাবে হত্যা করে, যা সেনদিয়া গণহত্যা নামে পরিচিত পাকবাহিনী ব্যাপক অগ্নিসংযোগের মাধ্যমে এলাকার ১০- ১২টি গ্রামকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করে। একই দিন তারা কদমবাড়ী গ্রামের মৃধাবাড়িতে আক্রমণ চালায় এবং ১০ জনকে হত্যা করে। এ হত্যাকাণ্ড মৃধাবাড়ি গণহত্যা নামে পরিচিত। এদিনই হানাদাররা ছাতিয়ানবাড়ি গণহত্যা সংঘটিত করে। এতে অনেক নিরীহ মানুষ নিহত হয়। ২০শে ও ২৭শে মে সংঘটিত হয় খালিয়া গণহত্যা। এতে বহু হিন্দু নর-নারী প্রাণ হারায়। কদমবাড়ী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মন্টু মিয়ার নেতৃত্বে মে মাসের শেষদিকে আনন্দপুর গ্রামটি লুণ্ঠিত হয়।
টেকেরহাট ফেরিঘাট সংলগ্ন ডাকবাংলো ছিল পাকবাহিনীর নির্যাতনকেন্দ্র ও বন্দিশিবির। এখানে হানাদার বাহিনী লঞ্চঘাট ও ফেরিঘাট এলাকা থেকে ধরে আনা কিশোরী ও যুবতীদের ওপর পাশবিক নির্যাতন চালাত। রাজৈর থানাভবনে স্থাপিত পাক মিলিশিয়া ক্যাম্পে মুক্তিযুদ্ধের সমর্থক ও সহযোগীদের ধরে এনে অত্যাচার করা হতো।
রাজৈর উপজেলার বধ্যভূমি ও গণকবরগুলো হলো— মৃধাবাড়ি গণকবর, পশ্চিম সেনদিয়া বধ্যভূমি ও গণকবর, সেনদিয়া গণকবর, সেনদিয়া গণকবর এবং ছাতিয়ানবাড়ি গণকবর। ২৪শে এপ্রিল পাকবাহিনীর হাতে টেকেরহাটের পতন হওয়ার পর মো. আবদুল কাইয়ুম মীরের নেতৃত্বে ভারত থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রথম দল ফিরে না-আসা পর্যন্ত রাজৈর-টেকেরহাট এলাকায় কোনো যুদ্ধ হয়নি ঐ মুক্তিযোদ্ধা দল ফিরে আসার পর পাকবাহিনী ও তাদের দালালদের প্রায়ই আক্রমণের সম্মুখীন হতে হয়। মুক্তিযোদ্ধারা ছাগলছিড়া গ্রামের কাছে বিলের মধ্যে টেলিফোন লাইনের ১৬টি পোস্টের তার কেটে দক্ষিণবঙ্গের সঙ্গে মাদারীপুরস্থ পাকসেনাদের টেলিযোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন। কমান্ডার আবদুল কাইয়ুম মীরের নির্দেশ ও উপস্থিতিতে মুক্তিযোদ্ধা রুস্তম সরদার এ কাজ সম্পন্ন করেন। ২৮শে জুন রাতে ২০ জন মুক্তিযোদ্ধার একটি গেরিলা দল টেকেরহাটে পাকসেনাদের অবস্থানের ওপর আক্রমণ চালায়। এতে ১০ জন পাকসেনা নিহত হয়। এটি টেকেরহাট অপারেশন হিসেবে পরিচিত। ১০ই আগস্ট মুক্তিযোদ্ধারা ইসিবপুরের তহসিল অফিস জ্বালিয়ে দেন।
পাকবাহিনী ও রাজাকারদের বিরুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের সংঘটিত যুদ্ধের মধ্যে হাজীখাল যুদ্ধ -, রাজৈর বড় ব্রিজ যুদ্ধ, টেকেরহাট নৌ-অপারেশন, রাজৈর থানা দখল যুদ্ধ- পাখুল্ল্যা যুদ্ধ -, আমগ্রাম ব্রিজ যুদ্ধ, বৈলগ্রাম ব্রিজ যুদ্ধ- এবং টেকেরহাট ক্যাম্প যুদ্ধ- উল্লেখযোগ্য। ৮ই ডিসেম্বর রাজৈর উপজেলা হানাদারমুক্ত হয়।
উপজেলার খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধারা হলেন- আব্দুল আজিজ, বীর বিক্রম (পিতা খলিল মোল্লা, মাছকান্দি) ও শেখ সোলায়মান, বীর প্রতীক (পিতা শেখ সবদু, নারায়ণপুর)। রাজৈর উপজেলার শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে যাঁদের নাম জানা গেছে, তাঁরা হলেন- মো. শেখ শাজাহান (পিতা দলিল উদ্দিন শেখ, স্বরমঙ্গল), বিজয় মৃধা (পিতা বিনোদ বিহারী মৃধা, আমগ্রাম), মানিক সরদার (পিতা নাসের উদ্দিন সরকার, স্বরমঙ্গল), সাইদুর রহমান মুন্সী (পিতা আব্দুল হামিদ মুন্সী, স্বরমঙ্গল), মো. আওলাদ হোসেন (পিতা মো. আলতাফ হোসেন, মহিষমারী), আলাউদ্দিন শেখ (পিতা হালিম উদ্দিন শেখ, দক্ষিণপাড়া, বান্ধব-দৌলতপুর) এবং শাজাহান শেখ (পিতা মোকছেদ শেখ, গোবিন্দপুর)। এছাড়া পাংশা উপজেলার মুক্তিযোদ্ধা খবিরুজ্জামান মৃধা, বীর উত্তম (পিতা আব্দুল জব্বার মৃধা, বাহাদুরপুর; নৌকমান্ডো) এ উপজেলায় যুদ্ধ করে শহীদ হন। [শেখ নাছিমা রহমান]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৯ম খণ্ড