You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.03.26 | রাজশাহী পুলিশ লাইন্স যুদ্ধ (রাজশাহী সদর) - সংগ্রামের নোটবুক

রাজশাহী পুলিশ লাইন্স যুদ্ধ (রাজশাহী সদর)

রাজশাহী পুলিশ লাইন্স যুদ্ধ (রাজশাহী সদর) সংঘটিত হয় ২৬, ২৭ ও ২৮শে মার্চ। এতে অর্ধশতাধিক পুলিশ সদস্য ও সাধারণ মানুষ শহীদ হন।
১৯৭১ সালের ২৬শে মার্চ রাজশাহী উপশহরে অবস্থিত সেনা ছাউনির পাকিস্তানি সৈন্যরা (২৫ পাঞ্জাব রেজিমেন্ট) রাজশাহী পুলিশ লাইন্সের ভেতর গুলিবর্ষণ করলে পুলিশ লাইন্সে অবস্থানরত বাঙালি পুলিশ সদস্যগণ পাল্টা গুলিবর্ষণ করেন। পঁচিশে মার্চ রাতে ঢাকার রাজারবাগ পুলিশ লাইন্স আক্রমণের ধারাবাহিকতায় রাজশাহী পুলিশ লাইন্সও আক্রান্ত হতে পারে এমন আশঙ্কা থেকে রাজশাহী পুলিশ লাইন্সের বাঙালি সদস্যগণ প্রতিরোধযুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হন। তাঁরা পুলিশ লাইন্সে কয়েকটি বাঙ্কার তৈরি করেন। তখন পুলিশ লাইন্স অস্ত্রাগারের দায়িত্বে ছিলেন বাঙালি হাবিলদার রমজান আলী। পুলিশ লাইন্সের মূল নেতৃত্ব গ্রহণ করেন বাঙালি হাবিলদার আতিয়ার রহমান। তিনি অস্ত্রাগারের চাবি হস্তগত করেন এবং সেখানকার অস্ত্র ও গোলাবারুদ সমমনা সকল বাঙালি সিপাহির হাতে তুলে দেন। সে-সময় পুলিশ লাইন্সে অবাঙালি পুলিশ সদস্যরা ছিল সংখ্যায় কম এবং মনস্তাত্ত্বিকভাবে দুর্বল। পুলিশ লাইন্সের বাঙালি পুলিশ সদস্যদের তৎপরতা রাজশাহীতে থাকা পাকিস্তানি বাহিনীর অজানা ছিল না। তাই তারা ২৬শে মার্চ পুলিশ লাইন্স আক্রমণের পূর্বেই পাকিস্তানি সেনা ছাউনির বাঙালি কমান্ডার রাজশাহী পুলিশের ডিআইজি মামুন মাহমুদকে পুলিশ লাইন্সের বাঙালি পুলিশ সদস্যদের আত্মসমর্পণ ও অস্ত্রাগারের চাবি সেনাবাহিনীর নিকট হস্তান্তরের নির্দেশ দেয়। কিন্তু মামুন মাহমুদ সে নির্দেশ উপেক্ষা করেন। প্রতিরোধযুদ্ধের জন্য প্রস্তুত বাঙালি সৈন্যরা ২৬শে মার্চ পাকিস্তানি সৈন্যদের গুলিবর্ষণের সঙ্গে-সঙ্গে পাল্টা গুলিবর্ষণ করলে পাকিস্তানি সৈন্যরা ফিরে যায়। উভয় পক্ষের পাল্টা গুলি বর্ষণের ফলে বেশকিছু নিরীহ ব্যক্তি নিহত হন। ২৬শে মার্চ সন্ধ্যায় ডিআইজি মামুন মাহমুদকে রংপুর ব্রিগেড সদরে
আলোচনার জন্য ডেকে নিয়ে যাওয়া হয়। এরপর তাঁর এবং তাঁর ড্রাইভারের আর কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি ২৭শে মার্চ পাকিস্তানি সৈন্যরা পুলিশ লাইন্সের চারদিকে অবস্থান নেয় এবং দুপুরে পুলিশ লাইন্স আক্রমণ করে। এ-সময় রাজশাহীর জেলা প্রশাসক নওগাঁ ইপিআর-এর সহকারী উইং কমান্ডার ক্যাপ্টেন গিয়াস উদ্দিন চৌধুরীর সঙ্গে ওয়ারলেসের মাধ্যমে যোগাযোগ করে তাঁর সাহায্য কামনা করেন। কিন্তু সে-সময় যোগাযোগ ব্যবস্থা খারাপ হওয়ায় এবং নওগাঁ- রাজশাহী সড়কে সৃষ্ট প্রতিরোধ যোদ্ধাদের ব্যারিকেড অতিক্রম করে ৬০ মাইল পাড়ি দিয়ে দ্রুত রাজশাহী আসা সম্ভব হয়নি। এমতাবস্থায় পুলিশ লাইন্সের বাঙালি পুলিশ সদস্যরা তাদের হালকা অস্ত্র দিয়েই পাকিস্তানি বাহিনীকে মোকাবিলা করেন। সারারাত গুলি বিনিময় চলে। ২৮শে মার্চ সকালে পাকিস্তানি সৈন্যরা শঠতার আশ্রয় নেয়। তারা ঐদিন সকাল ১০টায় সাদা পতাকা উড়িয়ে গোলাগুলি বন্ধের জন্য মাইকে আহ্বান জানায় এবং সেনা ছাউনির দিকে রওনা দেয়। এতে পুলিশ সদস্যগণ বিভ্রান্ত হয়ে অনেকেই ব্যারাকে ফিরে যান। কিছু পুলিশ সদস্য বাঙ্কারে থেকে যান। দুপুরে তারা যখন আহারের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন, সেই সুযোগে পাকিস্তানি বাহিনী অকস্মাৎ পুলিশ লাইন্স আক্রমণ করে ও মর্টার শেলিংসহ মেশিনগানের গুলিবর্ষণ করে। একটি শেলের আঘাতে পুলিশ লাইন্সের ওয়ারলেস টাওয়ার ভেঙ্গে পড়ে। ব্যারাকে আগুন লেগে যায়। পাকিস্তানি বাহিনীর এই অকস্মাৎ আক্রমণ প্রতিরোধ করতে চেষ্টা করেও পুলিশ সদস্যগণ ব্যর্থ হন। তারা পুলিশ লাইন্সের পেছনের পথ দিয়ে ঐ স্থান ত্যাগ করেন। পুলিশ লাইন্স যুদ্ধে ৪২-৪৩ জন বাঙালি পুলিশ ও কর্মচারী শহীদ হন। তবে ১৮ জন পুলিশ সদস্যের নাম জানা যায়।
তাঁরা হলেন– আলী হোসেন, এ কে এম সায়েম উদ্দিন, মো. ওসমান আলী, মো. আব্দুর রহমান, মো. আক্কাস আলী, মো. রইজ উদ্দিন, মো. জয়নাল আবেদিন, মো. আব্দুল মালেক, মো. সিরাজুল ইসলাম, মো. আলাউদ্দীন, মো. আলীমুদ্দীন, মো. আব্দুল হামিদ, মো. আব্দুল আজিজ মোল্লা, মো. ছাদেকুল ইসলাম, মো. নিজাম উদ্দিন, মো. আলাউদ্দিন, মো. রাজু ফজর এবং মো. এনায়েত খান। শহীদদের গণকবর দেয়া হয়। তাঁদের স্মরণে রাজশাহী পুলিশ লাইন্সে একটি স্মৃতিসৌধ নির্মিত হয়েছে। রাজশাহী পুলিশ লাইনস্থ স্কুল ও কলেজের নামকরণ করা হয়েছে শহীদ মামুন মাহমুদের নামে। এছাড়া কয়েকজন শহীদ পুলিশ সদস্যের নামে পুলিশ লাইন্সের কয়েকটি সড়কের নামকরণ করা হয়েছে। সেগুলো হলো— শহীদ পুলিশ সুপার শাহ আব্দুল মজিদ সড়ক (রাজশাহী কেন্দ্রীয় উদ্যানের পূর্বদিকের সড়ক), শহীদ কনস্টেবল রমজান আলী সড়ক, শহীদ কনস্টেবল রাজু ফজর সড়ক, শহীদ হেড কনস্টেবল তাজেম আলী সড়ক, শহীদ এসআই বাবর আলী সড়ক, শহীদ আমর্ড এসআই এনায়েত খান সড়ক এর শহীদ কনস্টেবল মোসলেম উদ্দিন সড়ক।
পুলিশ লাইন্স সংঘর্ষের সময় একটি মর্টার শেল লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে পুলিশ লাইন্স স্কুলের পশ্চিম পাশে জনৈক গোলাম মোস্তফার বাড়িতে আঘাত করলে তিনি, তাঁর পুত্র ও ভাগ্নেসহ ৫ জন শহীদ হন। [মো. মাহবুবর রহমান]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৯ম খণ্ড