মুক্তিযুদ্ধে রাজনগর উপজেলা (মৌলভীবাজার)
রাজনগর উপজেলা (মৌলভীবাজার) রাজনগরের মানুষ ঐতিহাসিকভাবে সংগ্রামী ও বিপ্লবী। অগ্নিযুগের বিদ্রোহ, ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন এবং পাকিস্তান আমলে স্বায়ত্তশাসন ও স্বাধীনতা সংগ্রামে রাজনগরের মানুষ গৌরবময় অবদান রাখে। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ-এর প্রার্থী দেশের অন্যান্য স্থানের মতো রাজনগরেও বিজয় লাভ করেন। বিজয়ী দল আওয়ামী লীগের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর না করলে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে যে প্রচণ্ড বিক্ষোভ দেখা দেয়, তার ঢেউ রাজনগরেও এসে পড়ে।
১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে দেয়া বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর ঐতিহাসিক ভাষণের পর বাংলার স্বাধীনতাকামী মানুষ যার-যার অবস্থান থেকে সশস্ত্র যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে থাকে। রাজনগর থানায় তখন শতশত ছাত্র, তরুণ ও রাজনৈতিক কর্মী যুদ্ধের জন্য সক্রিয় কার্যক্রম শুরু করে। মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের প্রস্তুত করতে সে-সময় মো. জাফর মিয়া, আব্দুল লতিফ (টেংরা ইউপি-র চেয়ারম্যান), ইসরাইল মিয়া (উত্তরভাগ), আছকির খান (বর্তমান উপজেলা চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক), তোয়াবুর রহিম এমপিএ, আব্দুল জব্বার চৌধুরী ওরফে মায়া মিয়া, আব্দুল বারী (ঘরগাঁও), মো. আমীর হোসেন, কুতুবুর রহমান, কুবের প্রসাদ কালোয়ার (রাজনগর চা-বাগানের শ্রমিক নেতা), আছকান মিয়া, মো. ছয়ফুল আলম, বিমলেন্দু দাশরায় (বাণী বাবু), মোস্তাফিজুর রহমান মানিক, মকবুল আহমদ, জালাল খান, জমসেদ আলী সাহা, আব্দুল ওয়াহিদ ছবুর, আতাউর রহমান চৌধুরী, কাপ্তান মিয়া (ফতেহপুর), ইছাক আলী চৌধুরী, আব্দুর রশীদ খান, কটু মিয়া, ডা. রণজিৎ দে, মো. ফরমুজ আলী মাস্টার, আব্দুল হাই ফটিক মিয়া (কামারচাক), শওকতুল ইসলাম, নজাবত আলী, রসরাজ দেবনাথ, অবনী কুমার দাস প্রমুখ রাজনগর থানায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। রাজনগরের অনেক লোক উপজেলার বাইরেও সশস্ত্র যুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করতে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ক্যাপ্টেন আব্দুল আহাদ চৌধুরী, ক্যাপ্টেন মুহিবুর রহমান, রফিক উদ্দীন চৌধুরী রানা প্রমুখ। রাজনগরের সন্তান অর্থনীতিবিদ ড. কাজী খলীকুজ্জামান আহমদ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকালে মুজিবনগর সরকার-এর কেন্দ্রীয় পরিকল্পনা দপ্তরে কাজ করেন।
১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চের পর রাজনগর পোর্টিয়াস উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ শুরু হয়। পুলিশের লতিফ দারোগা মাঝে-মাঝে মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র সরবরাহ করতেন। দেড়শত স্বেচ্ছাসেবককে এখানে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। প্রশিক্ষণ। পরিচালনা করেন অবসরপ্রাপ্ত ও প্রাক্তন বাঙালি আনসার ও ইপিআর সদস্যরা।
১০ই এপ্রিল তাজউদ্দীন আহমদ স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে সর্বস্তরের মানুষকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের আহ্বান জানান। ১৬ই এপ্রিল রাজনগর ইউনিয়ন – পরিষদে মুক্তিকামী তরুণরা বৈঠকে মিলত হন। এ বৈঠকের পর তারা মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য মৌলভীবাজার সদরে অবস্থিত পিটিআইতে সমবেত হন। তাদের উদ্দেশ্য ছিল এখান থেকে ভারতে গিয়ে প্রশিক্ষণ গ্রহণ। রাজনগর থেকে এ-সময় মো. আমীর হোসেন, মো. আছকির খান, মকবুল আহমদ, ইউনুস আহমদ, আব্দুল মোত্তালিব, আব্দুল বারী, কুতুবুর রহমান, সাইফুল আলম, গোলাম মোস্তফা, সামসুল আলম খান, আব্দুল হাই, আব্দুল ওয়াহিদ ছবুর, মোস্তাফিজুর রহমান মানিক, জমসেদ আলী শাহ, আব্দুল মুনীম, মখদ্দছ আলীসহ ২২ জনের একটি দল মৌলভীবাজারের প্রথম এবং বাংলাদেশের দ্বিতীয় দল হিসেবে ভারতে প্রশিক্ষণ নেয়। পরে রাজনগরের অনেক তরুণ মৌলভীবাজারের অন্যান্য দলের সঙ্গে ভারতে প্রশিক্ষণ নিয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে সশস্ত্র যুদ্ধে গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা রাখেন। এছাড়া বিভিন্ন উপায়ে অনেকে ভারতে গিয়ে শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় ও প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন।
রাজনগর উপজেলায় মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি আতাউল গণি ওসমানীর নামে একটি বিশেষ বাহিনী ছিল, যার কমান্ডার ছিলেন রাজনগরের ক্যাপ্টেন আব্দুল আহাদ চৌধুরী। রাজনগরের কোথাও প্রতিরোধযুদ্ধ হয়নি। তবে রাজনগরের মুক্তিযোদ্ধারা দেশের অন্যত্র বিভিন্ন প্রতিরোধযুদ্ধে অংশ নেন। এপ্রিলের মাঝামাঝি সময়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী রাজনগর থানায় অনুপ্রবেশ করে এবং ডাকবাংলোয় অস্থায়ী ক্যাম্প স্থাপন করে। মৌলভীবাজার মহকুমা সদর রাজনগরের নিকটবর্তী হওয়ায় পাকবাহিনী এখানে স্থায়ী কোনো ক্যাম্প স্থাপন করেনি। মৌলভীবাজার সদর থেকে এসে বিভিন্ন স্থানে হত্যা, অগ্নিসংযোগ ও নির্যাতন করে স্থায়ী ক্যাম্পে ফিরে যেত। রাজনগর ইউনিয়ন অফিসে রাজাকারদের স্থায়ী ক্যাম্প ছিল।
মুসলীম লীগ ও জামায়তে ইসলামীর নেতা-কর্মীরা রাজনগরে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সহযোগী হিসেবে রাজাকার ও আলবদর বাহিনী গড়ে তোলে। এ দুই বাহিনী মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থান, গতিবিধি, মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয়দানকারী ব্যক্তি ও তাদের বাড়িঘর সম্পর্কিত তথ্য পাকিস্তানি বাহিনীর কাছে পৌঁছে দিত। পাকিস্তানি সৈন্যদের সকল অপকর্মে রাজাকাররা গাইড হিসেবে কাজ করত। তাদের মধ্যে অনেকে হত্যা, অগ্নিসংযোগ ও লুণ্ঠনেও জড়িত ছিল। রাজনগরে আব্দুল গফুরকে আহ্বায়ক করে রাজাকার বাহিনী গঠিত হয়। অন্য রাজাকারদের মধ্যে ছিল- আব্দুল জব্বার (উত্তরভাগ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান), শাহ আমজদ আলী (বড়তল), আব্দুল জব্বার (ফতেহপুর), আলাউদ্দীন চৌধুরী (পাঁচগাঁও), আব্দুল মতিন (খারপাড়া), আবুল মিয়া (মনসুর নগর), আনাই মিয়া, পাখি মিয়া, লেবাছ মিয়া (কামারচাক) প্রমুখ। আলবদর বাহিনীর নেতা ছিল উজের মিয়া (বর্তমানে মৌলভীবাজার সরকারি কলেজের বাস চালক)। এ উপজেলায় স্বাধীনতাবিরোধী অন্যদের মধ্যে ছিল- আবুল মিয়া (অশ্ৰাকাপন), শামসুল হক (বাগাজুড়া), নেছার আলী (জামুরা), ইউনুস মৌলভী (সোনাটিকি), উজের আহমদ (গয়াসপুর), মখদ্দছ মৌলভী (ফরিদপুর), নূর মিয়া (বাগাজুড়া), মনির মিয়া (ধুলিজুড়া), আব্দুর রইছ (বেতাহুনজা), ইসরাইল মিয়া (মেলাগড়), আব্দুল মছব্বির (কালাইকোণা), আনর মিয়া (খলাগাঁও), দুদু মিয়া (গয়াসপুর), বারিক মিয়া (গয়াসপুর), আব্দুল গণি প্রমুখ। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে রাজনগর থানায় পাকবাহিনী ও তাদের সহায়তাকারী দেশীয় দালালরা বিভিন্ন স্থানে হত্যা, গণহত্যা, নারীনির্যাতন, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগসহ নানা অপকর্ম চালিয়ে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করে। রাজনগর সদর থেকে তিন মাইল দূরে অবস্থিত একটি গ্রামের নাম পাঁচগাঁও অগ্নিযুগের অনেক বিপ্লবীর জন্মস্থান এ গ্রাম। বিপ্লবী নারী লীলা নাগের পিতৃভিটা দখলকারী কুখ্যাত রাজাকার আলাউদ্দীনের সহযোগিতায় ৭ই মে পাঁচগাঁও গ্রামের ৮৩ জন নিরীহ মানুষকে পাকবাহিনী হত্যা করে। গ্রামের একটি দীঘির পাড়ে তাদের জড়ো করে পাঁচগাঁও গণহত্যা চালানো হয়। হত্যাকাণ্ডের পর লুণ্ঠন করা হয় সারা গ্রাম। এরপর হানাদাররা রাজাকারদের সহায়তায় পুরো গ্রাম জ্বালিয়ে দেয়। ব্রিটিশ আমল থেকে ভারতখ্যাত পাঁচগাঁও গ্রাম ভস্মীভূত হয়। গ্রামের নারী ও শিশুদের ওপর চালানো হয় অমানবিক নির্যাতনI
রাজনগর থানার শরণার্থীদের ভারত যাওয়ার একটি নিরাপাদ রুট ছিল চাটুরা-কামারচাক-তারাপাশা-কটারকোণা-নমৌজা রাস্তা। কামারচাকের রাজাকার আব্দুল মছব্বির দুষ্কৃতিকারীদের নিয়ে শরণার্থীদের মালামাল ও টাকা-পয়সা লুট করত। এপ্রিলের প্রথমদিকে চাটুরা ব্রিজে রাজাকাররা একজন অপ্রকৃতিস্থ লোককে হত্যা করে। এদিন দুপুরে হানাদার বাহিনী চারজন নিরীহ মানুষকে এখানে গাড়ি থেকে নামিয়ে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করে।
মনসুরনগরের রাজাকার আবুল মিয়া পঞ্চেশ্বর গ্রামের জিতেন্দ্র নারায়ণ বিশ্বাস (মনি বিশ্বাস) ও তার চাচা নগেন্দ্র নারায়ণ বিশ্বাসকে তাদের বাড়ি থেকে পাকসেনাদের হাতে তুলে দেয়। পাকিস্তানি ঘাতকরা দুজনকে নিয়ে লঙ্গুর পুলের ওপর হাত-পা বেঁধে গুলি করে হত্যা করে। পরে লাশ লঙ্গু ছড়ায় ফেলে দেয়৷
৬ই মে রাজাকার আবুল ও অন্যদের সহযোগিতায় পাকহানাদাররা আওয়ামী লীগ নেতা ও মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক আব্দুল বারীর বাড়িতে হানা দেয়। তাঁকে না পেয়ে তাঁর ১৫ মাস বয়সের শিশুকন্যা ও অসুস্থ স্ত্রীকে ধরে নিয়ে যায়। তাঁর ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয়। এক মাস বন্দি থেকে আব্দুল বারীর অসুস্থ স্ত্রী শিশুটিসহ মরণাপন্ন অবস্থায় মুক্তি পান। ৭ই মে গোবিন্দবাটী গ্রামের শামসুল আলম নামে রাজনগর পোর্টিয়াস স্কুলের দশম শ্রেণির ছাত্রকে ধরে নিয়ে কুলাউড়া রেলস্টেশনের পাশে পাকবাহিনী হত্যা করে।
১৪ই মে রাজাকাররা মুন্সিবাজার থেকে বাদশা মিয়া, রফিক মিয়া, নজাবত আলী, সনৎ ঠাকুর, খোকাদেব, ছায়াশীল ও বনমালী ডাক্তারকে পাকসেনাদের হাতে তুলে দেয়। একই দিনে পাকিস্তানি জল্লাদরা করিমপুর শাহজি বাড়ির বনমালি দাস, ভবতোষ দাস (মতি বাবু) ও মহিতোষ দাস (মুকুল বাবু)- কে ধরে নেয়৷ পাকহায়েনারা তাদের মৌলভীবাজার ক্যাম্পে হত্যা করে। তাদের অনেকের লাশ পর্যন্ত পাওয়া যায়নি।
২৬শে নভেম্বর ৫০-৬০ জন পাকসেনা মুক্তিযোদ্ধাদের হত্যার জন্য বালিগাঁও গ্রামে আক্রমণ করে। কিন্তু আগের রাতে তাঁরা পইতোরা গ্রামে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যাওয়ায় পাকহানাদাররা এ গ্রামের দানু মিয়ার বাড়িসহ পার্শ্ববর্তী কয়েকটি বাড়িতে হানা দিয়ে লুণ্ঠন, নারী-শিশু নির্যাতন ও অগ্নিসংযোগ করে। তারা বৃদ্ধ দানু মিয়াকে বেঁধে তার ওপর অমানবিক নির্যাতন চালায়। চাদর দিয়ে বেঁধে প্রায় ১ মাইল জায়গা টেনে-হিঁচড়ে মসুরিয়ায় নিয়ে জিপে তোলে। তারপর সেনা ক্যাম্পে নিয়ে গুলি করে হত্যা করে। একই দিন পাকহানাদাররা বালিগাঁও জমাদার বাড়িতে এবং মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয়দাতা ছমদ উল্লার বাড়িতে আগুন দেয়। তাজু মিয়া ও তমিজ উল্লার বাড়িতেও কিছু মুক্তিযোদ্ধার থাকার ব্যবস্থা হয়েছিল। পাকসেনারা তাদের বাড়িতেও নির্যাতন করে।
২৭শে নভেম্বর পাকবাহিনী মুন্সিবাজারের সুরিতী মোহন ধরের বাড়িতে এক নারকীয় হত্যাকাণ্ড ঘটায়। স্থানীয় রাজাকার দুদু মিয়া, বারিক মিয়া, মতিউর রহমান চৌধুরী, করিমপুর চা-বাগানের বিহারি দোকানদার আলী বক্স, আলবদর নেতা উজের মিয়ার নেতৃত্ব ও সহযোগিতায় পাকসেনারা মুন্সিবাজারের ধরের বাড়ি ঘেরাও করে বাড়ির লোকজনকে বেঁধে ফেলে। সুরিতী ধরের পুরান বাড়ি ও নিশি রঞ্জন ধরের বাড়ি থেকেও অনেককে ধরে আনে। পার্শ্ববর্তী ঘোষের বাড়িসহ আশপাশে হানা দিয়ে লোকজনকে এ বাড়িতে ধরে আনে। এরপর খালের পাড়ে দাঁড় করিয়ে তাদের গুলি করে হত্যা করে। মুন্সিবাজার গণহত্যার পর স্থানীয় দালালরা বিভিন্ন বাড়িতে লুটপাট করে।
পাকবাহিনী ও রাজাকাররা খলাগ্রামের বাম প্রগতিশীল আন্দোলনের নেতা শশাংক শেখর ঘোষের বাড়িতে আক্রমণ চালিয়ে তাঁকে না পেয়ে বাড়িতে অগ্নিসংযোগ ও নারী- শিশুদের নির্যাতন করে। রাজাকারদের সহযোগিতায় ঘরগাঁও-এর মালাকার বাড়িতে হানা দিয়ে পাকসেনারা বিভিন্ন ঘরে আগুন দেয়। অগ্নিসংযোগের পর তারা বাড়িতে হত্যাকাণ্ড চালায়।
রাজনগর থানায় ধরে এনে লোকজনের ওপর নির্যাতন চালানো হতো। পাকবাহিনী রাজনগর থেকে মুক্তিযোদ্ধা ও সাধারণ মানুষকে ধরে মৌলভীবাজার সদরের ক্যাম্পে নিয়ে নির্যাতন করত। মৌলভীবাজার পিটিআই বাংকার আজো পাকিস্তানি হানাদারদের নির্যাতনের সাক্ষী হয়ে আছে।
পাঁচগাঁও গ্রামে ৬৯টি মৃতদেহ সমাহিত করা হয়। এখানে একটি বধ্যভূমি রয়েছে। মুন্সিবাজারের ধর বাড়ি, ঘরগাঁও মালিবাড়ি, পঞ্চেশ্বর নগেন্দ্র নারায়ণ বিশ্বাস ও জিতেন্দ্র নারায়ণ বিশ্বাসের বাড়িতে গণকবর রয়েছে। এছাড়া রাজনগরের লুয়াইউনি চা-বাগানের নির্জন স্থানে স্বাধীনতার পর অনেক মানুষের হাড়, মাথার খুলি ও কঙ্কাল পাওয়া গেছে।
রাজনগর উপজেলায় পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের কোনো যুদ্ধ না হলেও এ উপজেলার মুক্তিযোদ্ধারা দেশের। অন্যান্য স্থানে যুদ্ধে অংশ নেন। মৌলভীবাজারের মনু ব্রিজ . ভাঙ্গার অপারেশনে এ উপজেলার বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. আমীর হোসেনসহ অন্যরা সাহসী ভূমিকা পালন করেন। ৬ই ডিসেম্বর রাজনগর উপজেলা হানাদারমুক্ত হয়।
রাজনগরের যেসব মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন, তাঁরা হলেন- সুদর্শন দেব (পিতা সারদা চরণ দেব, টেংরাবাজার), শিশির রঞ্জন দেব (পিতা শশী মোহন দেব, চাটুরা), মনির মিয়া (পিতা ইসমাইল মিয়া, তাহারলামু), অরুণ দত্ত (পিতা অবনী দত্ত, শ্বামহল), সত্যেন্দ্র চন্দ্র দাশ (পিতা সুরেশ চন্দ্র দাশ, ধুলিজুড়া), বাতির মিয়া (পিতা আনফর উল্লা, গোবিন্দপুর), প্রদীপ চন্দ্র দাশ (পিতা পরেশ চন্দ্র দাশ, টেংরা), শামসু মিয়া (পিতা মোজাম্মেল মিয়া, সাদাপুর), দিলীপ কুমার দেব (পিতা অতুল চন্দ্র দেব, রাজখলা), দানু মিয়া (পিতা জামিল মিয়া, বালিগাঁও), কনর মিয়া (পিতা লিয়াকত মিয়া, খারপাড়া), মুদারিশ আলী (পিতা ইউনুস আলী, বকশিকোণা) ও তরণী দেব (পিতা নর্মদা চরণ দেব, মহংসখলা)।
শহীদ দানু মিয়ার স্মরণে রাজনগরের মসুরিয়া-বালিগাঁও রাস্তার নাম দেয়া হয়েছে শহীদ দানু মিয়া সড়ক। তাঁর নামে একটি তোরণও নির্মাণ করা হয়েছে। লামুতে শহীদ মনির মিয়া স্মরণে রাস্তার নাম দেয়া হয়েছে শহীদ মনির মিয়া সড়ক। তাঁর নামেও এ সড়কে একটি তোরণ নির্মিত হয়েছে। পাঁচগাঁও গণহত্যার স্থলে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মিত হয়েছে। শহীদ সুদর্শনের নামে টেংরাবাজারে একটি স্কুলের নামকরণ করা হয়েছে শহীদ সুদর্শন উচ্চ বিদ্যালয়। [জয়নাল আবেদীন শিবু]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৯ম খণ্ড