রাঙ্গামাটিয়া যুদ্ধ (ফুলবাড়িয়া, ময়মনসিংহ)
রাঙ্গামাটিয়া যুদ্ধ (ফুলবাড়িয়া, ময়মনসিংহ) সংঘটিত হয় ৬ ও ৭ই আগস্ট। এখানে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে পাকহানাদার বাহিনীর এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ হয়। এতে অনেক পাকসেনা নিহত হয়। পক্ষান্তরে মুক্তিযোদ্ধাসহ ৬ জন গ্রামবাসী শহীদ হন। এক পর্যায়ে পাকসেনারা তাদের সহযোদ্ধাদের মৃতদেহ, অনেক অস্ত্র ও গোলাবারুদ ফেলে পালিয়ে যায়। পরের দিন তারা আরো শক্তি নিয়ে এসে বহু ঘরবাড়িতে আগুন লাগিয়ে পরাজয়ের প্রতিশোধ নেয়। ফুলবাড়িয়া উপজেলা সদর থেকে ১০ কিমি দক্ষিণে রাঙ্গামাটিয়া গ্রামের অবস্থান। ফুলবাড়ীয়া সিএন্ডবি ডাকবাংলো (বর্তমান জেলা পরিষদ ডাকবাংলো)-য় পাকবাহিনী ঘাঁটি স্থাপন করার কিছুদিন পর রাঙ্গামাটিয়া প্রাইমারি স্কুলে তারা ক্যাম্প স্থাপন করে। পাশেই মাদ্রাসায় ছিল রাজাকারদের ক্যাম্প। পাকবাহিনী রাঙ্গামাটিয়া বাজার সংলগ্ন গুদাম ঘরের ছাদে মর্টার শেল বসায়। আর এখান থেকে রাঙ্গামাটিয়া, নাওগাঁও গ্রামসহ বিভিন্ন এলাকার মানুষের ওপর তারা অমানবিক নির্যাতন চালাত। রাজাকার বাহিনী পাকবাহিনীকে এসব কাজে সহায়তা করত। রাজাকার কমান্ডার বরকত আলী, আমজাত আলীসহ বেশকিছু আলবদর- সদস্য পাকসেনাদের পথ চিনিয়ে বিভিন্ন জায়গায় নিয়ে যেত। ৬ই আগস্ট রাঙ্গামাটিয়া নামক স্থানে পাকবাহিনীর সঙ্গে মুক্তিবাহিনীর তুমুল যুদ্ধ হয়। ৭২ ঘণ্টা স্থায়ী এ-যুদ্ধের প্রথম দিনে পাকবাহিনী মুক্তিবাহিনীর আক্রমণে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হয়।
যুদ্ধের ২য় দিন অর্থাৎ ৭ই আগস্ট পাকহানাদার বাহিনী দ্বিগুণ শক্তি নিয়ে মধুপুর-টাঙ্গাইল-রসুলপুরের দিক থেকে সাগরদিঘীর দিকে অগ্রসর হতে থাকে। এ-সময় তারা গ্রামের পর গ্রামে বহু বাড়িঘর আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়। ঐ পথে রাঙ্গামাটিয়াতে মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার মনির ও তাঁর বাহিনী একটি শক্তিশালী ঘাঁটি নিয়ে অবস্থান করছিলেন। অগ্রসরমাণ পাকিস্তানি বাহিনীর সংবাদ পেয়ে কাদের সিদ্দিকী, বীর উত্তম তাঁর কয়েকজন দক্ষ ও সিনিয়ির মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারকে হানাদারদের মোকাবেলার জন্য প্রেরণ করেন। তাঁদের মধ্যে কমান্ডার মুনিরের নেতৃত্বে ৩ শত, কমান্ডার হাকিমের নেতৃত্বে ২ শত এবং ক্যাপ্টেন লাল্টুর নেতৃত্বে আরো ১ শত মুক্তিযোদ্ধা পাকবাহিনীর ওপর মরণপণ আক্রমণে ঝাঁপিয়ে পড়েন। এখানে এক ভয়াবহ যুদ্ধ সংঘটিত হয়। তাতে বহু পাকসেনা নিহত হয়। অপরদিকে মুক্তিবাহিনীর সদস্যসহ ৬ জন গ্রামবাসী শহীদ হন। তাঁরা হলেন- মো. ফহিম উদ্দিন সরকার (পিতা বরিস মণ্ডল, রাঙ্গামাটিয়া), মো. দিলা শেখ (পিতা এদ শেখ, রাঙ্গামাটিয়া), মো. জসীম উদ্দিন (রাঙ্গামাটিয়া), মো. হযরত আলী (পিতা সাবু মণ্ডল, আক্তা), বলরাম চন্দ্র কর্মকার (পিতা সুধন্য চন্দ্র কর্মকার, ফুলবাড়িয়া) ও হরিমোহন দে (পিতা রমেশ চন্দ্র দে, নাওগাঁও, ফুলবাড়িয়া)। পাকসেনারা তাদের সহযোদ্ধাদের মৃতদেহ, অনেক অস্ত্র ও গোলাবারুদ ফেলে পালিয়ে যায়। পরদিন তারা এসে বহু ঘরবাড়িতে আগুন লাগিয়ে পরাজয়ের প্রতিশোধ নেয়।
রাঙ্গামাটিয়া যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী মুক্তিযোদ্ধাগণ হলেন- মুনির (কোম্পানি কমান্ডার), আব্দুল হাকিম (কোম্পানি কমান্ডার), আলী হোসেন লাল্টু (কোম্পানি কমান্ডার), আব্দুল গফুর (কোম্পানি কমান্ডার), ইদ্রিস আলী (কোম্পানি কমান্ডার), রিয়াজ উদ্দিন (কোম্পানি কমান্ডার), নুরুল ইসলাম (টাঙ্গাইল), নুরুজ্জামান (টাঙ্গাইল), কাশেম আলী (টাঙ্গাইল), ফাহিম উদ্দিন (রাঙ্গামাটিয়া), রিয়াজ আহম্মেদ চৌধুরী, লিয়াকত আলী খান, আব্দুল হালিম মাস্টার, রোস্তম আলী প্রমুখ। [শফিকুল ইসলাম কাদির]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৯ম খণ্ড