You dont have javascript enabled! Please enable it! বিশিষ্ট ব্যবসায়ী, সমাজসেবী, শিক্ষানুরাগী ও মুক্তিযুদ্ধকালে শহীদ রণদা প্রসাদ সাহা - সংগ্রামের নোটবুক

বিশিষ্ট ব্যবসায়ী, সমাজসেবী, শিক্ষানুরাগী ও মুক্তিযুদ্ধকালে শহীদ রণদা প্রসাদ সাহা

রণদা প্রসাদ সাহা, রায়বাহাদুর (১৮৯৬-১৯৭১) বিশিষ্ট ব্যবসায়ী, সমাজসেবী, শিক্ষানুরাগী ও মুক্তিযুদ্ধকালে শহীদ। আর পি সাহা নামে তিনি সমধিক পরিচিত। তাঁর জন্ম ১৮৯৬ সালের ১৫ই নভেম্বর ঢাকা জেলার সাভার উপজেলার কাছুর গ্রামে মাতুলালয়ে। তাঁদের পৈতৃক নিবাস টাঙ্গাইল জেলার মির্জাপুর গ্রামে। তাঁর পিতার নাম দেবেন্দ্রনাথ সাহা এবং মাতার নাম কুমুদিনী সাহা।
রণদা প্রসাদ ছিলেন তাঁর পিতা-মাতার চার সন্তানের মধ্যে দ্বিতীয়। তাঁদের পরিবারটি ছিল অতি দরিদ্র। তাই রণদা প্রসাদ লেখাপড়ার তেমন সুযোগ পাননি। স্থানীয় মির্জাপুর স্কুলে তিনি চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত অধ্যয়ন করেন। মাত্র ৭ বছর বয়সে তিনি তাঁর মাকে হারান। তাঁর মা কুমুদিনী দেবী সন্তান প্রসব করতে গিয়ে একপ্রকার বিনা চিকিৎসায় মারা যান। পিতা দ্বিতীয় বিবাহ করলে রণদা প্রসাদকে সৎ মায়ের অত্যাচার সহ্য করতে হয়। ফলে অতি দুঃখ-কষ্টে তাঁর শৈশব ও কৈশোর অতিবাহিত হয়। এক পর্যায়ে পিতা তাঁকে মামার বাড়িতে পাঠিয়ে দেন। কিন্তু ১৯১২ সালে ১৬ বছর বয়সে তিনি পালিয়ে কলকাতা চলে যান। সেখানে শুরু হয় তাঁর কষ্টসহিষ্ণু জীবন। অনাহারে- অর্ধাহারে তাঁর দিন কাটতে থাকে। তিনি কিছুদিন খবরের কাগজ বিক্রয় করেন। এ-সময় তিনি স্বদেশী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হন এবং কিছুদিন জেল খাটেন।
১৯১৪ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে রণদা প্রসাদ ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে যোগ দেন এবং বেঙ্গল এম্বুলেন্স কোর-এর সদস্য হিসেবে প্রথমে ইরাক ও পরে করাচিতে যা ইরাকের বাগদাদে বেঙ্গল এম্বুলেন্স কোর-এর একটি হাসপাতাল ছিল, যেখানে যুদ্ধাহত সৈনিকদের চিকিৎসা প্রদান করা হতো। একদিন ঘটনাক্রমে ঐ হাসপাতালে আগুন লাগলে রণদা প্রসাদ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ২০ জনের মতো আহত সৈন্যকে হাসপাতাল থেকে বের করে আনেন৷ আহতদের সেবা-শুশ্রূষা, সাহস ও বীরত্বপূর্ণ কাজের জন্য তিনি তাঁর কমান্ডিং অফিসার ক্যাপ্টেন কুক-এর সুদৃষ্টিতে পড়েন। যুদ্ধশেষে ১৯১৬ সালের ২৬শে সেপ্টেম্বর কলকাতায় ফিরে তিনি বেঙ্গলি ডাবল কোম্পানিতে যোগদান করেন, যা পরবর্তীকালে ৪৯ বেঙ্গল রেজিমেন্ট নাম ধারণ করে। নবপ্রতিষ্ঠিত এই বেঙ্গল রেজিমেন্টে তিনি কমিশন লাভ করেন। ১৯২০ সালের ৩০শে আগস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট ভেঙ্গে গেলে তিনি রেলওয়ে বিভাগে চাকরিতে যোগ দেন। কিন্তু ষড়যন্ত্রের কারণে ১৯৩২ সালে তিনি চাকরিচ্যুত হন। চাকরিচ্যুতির ক্ষতিপূরণ হিসেবে সরকারের নিকট থেকে তিনি যে সামান্য অর্থ লাভ করেন, তা দিয়ে তিনি কলকাতায় লবণ ও কয়লার ব্যবসা শুরু করেন। প্ৰথমে বাড়ি-বাড়ি, পরে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এবং শেষে জাহাজে কয়লা সরবরাহ করতে থাকেন। এর পরের ইতিহাস তাঁর সাফল্য ও প্রতিষ্ঠার ইতিহাস।
কয়লার ব্যবসায় প্রচুর লাভ হলে রণদা প্রসাদ ‘বেঙ্গল রিভার’ নামে একটি জাহাজ ক্রয় করেন। ১৯৪২-৪৩ সালে তিনি সরকারের খাদ্যশস্য ক্রয়ের অন্যতম এজেন্ট নিযুক্ত হন এবং নারায়ণগঞ্জ, ময়মনসিংহ ও কুমিল্লায় ইংরেজ মালিকানাধীন ৩টি পাওয়ার হাউজ ক্রয় করেন। এছাড়া তিনি নারায়ণগঞ্জের জর্জ এন্ডারসন কোম্পানি ক্রয় করেন। এখানে পাটের গাইড বাঁধা হতো। একই সময়ে তিনি চামড়ার ব্যবসাও শুরু করেন।
আর্থিক স্বচ্ছলতা আসার পর রণদা প্রসাদ সমাজসেবায় আত্মনিয়োগ করেন। তিনি একের পর এক জনহিতকর কাজ করতে থাকেন। প্রথমেই তিনি আর্ত-মানবতার সেবার জন্য ১৯৩৮ সালে নিজ গ্রাম মির্জাপুরে ২০ শয্যাবিশিষ্ট একটি দাতব্য চিকিৎসালয় স্থাপন করেন। এর পেছনে অবশ্য বিনা চিকিৎসায় মা কুমুদিনীর অকাল মৃত্যুর দুখঃবোধ অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করেছিল। পরবর্তীকালে এটিই তাঁর মা কুমুদিনী দেবীর নামানুসারে কুমুদিনী হাসপাতাল নামে দেশব্যাপী খ্যাতি লাভ করে। ১৯৪৪ সালের ২৫শে সেপ্টেম্বর বাংলার তৎকালীন গভর্নর আর জি কেসী (R G Casey) আনুষ্ঠানিকভাবে ৭৫০ শয্যাবিশিষ্ট এ হাসপাতালের উদ্বোধন করেন (বর্তমানে এর শয্যাসংখ্যা ১০৫০)। এখানে প্রায় বিনা পয়সায় উচ্চ মানের চিকিৎসা দেয়া হয়। সমাজের অবহেলিত, দরিদ্র, বিধবা এবং স্বামী-পরিত্যক্তা নারীদের প্রশিক্ষণ দিয়ে তিনি এ হাসপাতালে তাদের নার্স হিসেবে নিয়োগ দিতেন। এভাবে তিনি নারীর অর্থনৈতিক মুক্তি ও ক্ষমতায়নের কাজ শুরু করেন। ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালের প্রসূতি বিভাগ তাঁর আর্থিক সহযোগিতায় প্রতিষ্ঠিত। ১৯৪৩ সালে মহাদুর্ভিক্ষের সময় রণদা প্রসাদ ৮ মাসব্যাপী ২৭৫টি লঙ্গরখানা পরিচালনা করেন।
আর্ত-মানবতার সেবার পাশাপাশি রণদা প্রসাদ শিক্ষা প্রসারের দিকেও দৃষ্টি দেন। নারীদের মধ্যে শিক্ষা বিস্তারের লক্ষ্যে তিনি ১৯৪২ সালে তাঁর প্রপিতামহী ভারতেশ্বরী দেবীর নামে ‘ভারতেশ্বরী বিদ্যাপীঠ’ প্রতিষ্ঠা করেন, যা ১৯৪৫ সাল থেকে ‘ভারতেশ্বরী হোমস’ নামে খ্যাতির সঙ্গে নারীদের মধ্যে জ্ঞানের আলো বিতরণ করে আসছে। শিক্ষা, খেলাধুলা, নিয়ম-শৃঙ্খলা প্রভৃতি কারণে এ প্রতিষ্ঠানটি অনন্যসাধরণ। দেশে শিক্ষা বিস্তারে তিনি আরো যেসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেন, সেগুলো হলো— টাঙ্গাইল শহরে মায়ের নামে কুমুদিনী মহিলা কলেজ (১৯৪২; এটি দেশের প্রথম মহিলা মহাবিদ্যালয়), মানিকগঞ্জে পিতার নামে দেবেন্দ্রনাথ কলেজ (১৯৪৬), ১৯৪৭ সালের পর পর্যায়ক্রমে প্রতিষ্ঠিত মির্জাপুর পাইলট বালক বিদ্যালয়, মির্জাপুর পাইলট বালিকা বিদ্যালয় এবং মির্জাপুর ডিগ্রি কলেজ। মাগুরায় প্রতিষ্ঠিত হোসেন শহীদ সোহ্রাওয়ার্দী কলেজেও তিনি আর্থিক সহায়তা দান করেন। হোসেন শহীদ সোহ্রাওয়ার্দী যখন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী (১৯৫৬- ১৯৫৭), তখন একবার মির্জাপুরের কুমুদিনী কমপ্লেক্স দর্শনে এসে ভিজিটরস বুক-এ রণদা প্রসাদ সম্পর্কে লিখেছিলেন, ‘A poor man became a millionaire, and the millionaire voluntarily became a poor man, spending his all in the service of humanity, for the suffering and the distressed, for the furtherance of education, for rendering a service to the state, which “the state itself has not undertaken.’ রণদা প্রসাদ কলকাতায়ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান স্থাপনের মাধ্যমে সমাজসেবার দ্বার উন্মুক্ত করেন। সমাজের মঙ্গল কামনায় তাঁর এই উদার দানশীলতায় মুগ্ধ হয়ে তৎকালীন ইংরেজ সরকার তাঁকে ‘রায়বাহাদুর’ উপাধিতে ভূষিত করে। সর্বসাধারণের কাছে তিনি ‘দানবীর’ নামে খ্যাত।
রণদা প্রসাদ ১৯৪৭ সালে তাঁর মায়ের নামে ‘কুমুদিনী কল্যাণ ট্রাস্ট’ প্রতিষ্ঠা করেন এবং শিক্ষা ও সমাজসেবার জন্য তাঁর সমস্ত সম্পত্তি এই ট্রাস্টকে দান করে যান। এবছরই ভারত বিভাগের পর তিনি পূর্ব পাকিস্তান (বর্তমান বাংলাদেশ)-এ চলে আসেন। কুমুদিনী কল্যাণ ট্রাস্টও দুভাগে ভাগ হয়ে যায়। রণদা প্রসাদ ও তাঁর একমাত্র পুত্র ভবানী প্রসাদ (রবি) নারায়ণগঞ্জে তাঁদের ব্যবসার মূল কেন্দ্র গড়ে তোলেন এবং বেশির ভাগ সময় এখানেই থাকতেন।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় রণদা প্রসাদ বিভিন্নভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করতেন। মির্জাপুর কুমুদিনী হাসপাতালে আহত মুক্তিযোদ্ধাদের গোপনে চিকিৎসা দেয়া হতো। এসব খবর পাকসেনা ও রাজাকাররা জানতে পেরে তাঁর ওপর ক্ষিপ্ত হয়। তারা ২৮শে এপ্রিল রণদা প্রসাদ ও ভবানী প্রসাদকে নারায়ণগঞ্জের বাসা থেকে ধরে নিয়ে মোহাম্মদপুর শরীর চর্চা কেন্দ্রে আটকে রাখে। ৫ই মে তাঁরা ছাড়া পান। ৭ই মে আবার তারা পিতা-পুত্রকে ধরে নিয়ে যায়। তারপর থেকে তাঁদের আর কোনো সন্ধান পাওয়া যায়নি। এই শোকে রণদা প্রসাদের স্ত্রী কিরণবালা দেবী অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং দীর্ঘ রোগভোগের পর ১৯৮৯ সালে মৃত্যুবরণ করেন।
রণদা প্রসাদের মৃত্যুর পরও চিকিৎসা ও শিক্ষার ক্ষেত্রে কুমুদিনী কল্যাণ ট্রাস্টের জনহিতকর কর্মকাণ্ড থেমে নেই। এ ট্রাস্টের অর্থায়নে মির্জাপুরে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে কুমুদিনী নার্সিং স্কুল এন্ড কলেজ (১৯৭৩), কুমুদিনী উইমেন্স মেডিকেল কলেজ (২০০১) এবং নারায়ণগঞ্জে রণদা প্রসাদ সাহা বিশ্ববিদ্যালয় (২০১৩)। [দুলাল ভৌমিক]
তথ্যসূত্র: সিরাজুল ইসলাম সম্পাদিত, বাংলাপিডিয়া (খণ্ড ৮), প্রথম সংস্করণ, বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি, ঢাকা ২০০৩; রশীদ হায়দার সম্পাদিত, স্মৃতি : ১৯৭১, বাংলা একাডেমি ১৯৯৫, পৃ. ৯১-৯৬; দৈনিক ইত্তেফাক, ১৫ই নভেম্বর ২০১৮, পৃ. ৮; The Daily Star, 24th November 2018, p. 7

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৯ম খণ্ড