রংপুর সেনানিবাস আক্রমণ (রংপুর সদর)
রংপুর সেনানিবাস আক্রমণ (রংপুর সদর) ছিল মুক্তিযুদ্ধের এক দুঃসাহসিক অভিযান। ২৮শে মার্চ পরিচালিত এ অভিযানের নায়করা ছিলেন স্থানীয় বাঙালি ও আদিবাসী সম্প্রদায়ের দেশপ্রেমিক সন্তানেরা। সেই অজানা- অচেনা দুঃসাহসী মানুষগুলো ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের অদম্য দিশারি, প্রতিরোধ আন্দোলনের অগ্রসৈনিক। সেদিন তাঁরা এক ভয়ঙ্কর প্রতিকূল অবস্থার মোকাবেলা করেছিলেন। তাঁরা জানতেন যে, এ অভিযানে তাঁদের মৃত্যু অনিবার্য। তারপরও তাঁরা পিছপা হননি। বাংলাদেশের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের সময় সংঘটিত হাজারো যুদ্ধের মধ্যে রংপুর সেনানিবাস আক্রমণ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য, যার পরিণতি আনুমানিক ছয় শতাধিক বীর সন্তানের সগৌরব আত্মাহুতি। এ আক্রমণের পটভূমি মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
১৯৭০ সালের নির্বাচনের পূর্বে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান- রংপুর কালেক্টরেট ময়দানে এক বিশাল জনসভায় ভাষণ দেন। তাঁর আগমন উপলক্ষে রংপুরবাসীদের মধ্যে ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনার সৃষ্টি হয় এবং আপামর জনসাধারণ সেই জনসভায় অংশগ্রহণ করে। উপস্থিত জনগণের মধ্যে অধিক সংখ্যক ছিল আদিবাসী। সেখানে বুদু ওঁরাও, মাইকেল, ফ্রান্সিস, উদয়, অরুণ, বরুণ, বাদল পাহানসহ রংপুর ও এর আশপাশের এলাকার সাঁওতাল, ওঁরাও ও মুণ্ডা সম্প্রদায়ের শতশত নরনারী বাদ্যযন্ত্রের তালে- তালে দলে-দলে এসে জনসভায় যোগ দেয়। মনে হচ্ছিল এটি যেন তাদের একটি বিশাল উৎসব। তারা বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শুনে ভীষণভাবে অনুপ্রাণিত হয়। সেদিনের সেই সমাবেশে ওঁরাও সম্প্রদায়ের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি বুদু ওঁরাওয়ের দায়িত্ব ছিল মানুষকে শৃঙ্খলাবদ্ধভাবে বসিয়ে ভাষণ শুনতে সাহায্য করা। পাকিস্তানিদের অন্যায়, শোষণ ও অবিচার থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য বঙ্গবন্ধু সেদিন তাঁর ভাষণে বাংলার মানুষকে নৌকা মার্কায় ভোট দেয়ার আহ্বান জানান। আদিবাসী সম্প্রদায় সেদিনই সিদ্ধান্ত নেয় যে, তারা সবাই নৌকায় ভোট দেবে। সে অনুযায়ী ভোটের দিন তারা সবাই নৌকা মার্কায় ভোট দেয়। ভোট গণনার পর আওয়ামী লীগ-এর বিজয়ে এলাকায় বিশাল মিছিল বের হয় এবং সবাই এক সমাবেশে মিলিত হয় এদিন রাতে দরিদ্র আদিবাসীরা নিজেরা চাঁদা সংগ্রহ করে খাওয়া-দাওয়া ও আনন্দ-উৎসবের আয়োজন করে।
১৯৬৯ সালে পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক পরিস্থিতি যখন অত্যন্ত নাজুক, তখন ঐ বছরেরই নভেম্বর মাসে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সদর দপ্তরের নির্দেশে ২৯ ক্যাভালরি রেজিমেন্টের ৭০টি ট্যাংক চট্টগ্রাম বন্দরে এসে পৌঁছায়। লে. কর্নেল সৈয়দ সাগীর হোসেন ২৯ ক্যাভালরির অধিনায়ক ছিলেন। ৭০টি ট্যাংকের মধ্যে ১৪টি ৫৭ পদাতিক ব্রিগেডের অধিনায়ক ব্রিগেডিয়ার জাহানজেব আরবাবের তত্ত্বাবধানে ঢাকা সেনানিবাসে ও ৬টি ২০ বালুচ রেজিমেন্টের অধিনায়ক লে. কর্নেল এ এইচ ফাতেমীর তত্ত্বাবধানে চট্টগ্রামে রাখা হয় এবং বাকি ৫০টি ১৯৭০ সালের জানুয়ারি মাসে রংপুর সেনানিবাসে পাঠানো হয়। নিঃসন্দেহে এ ট্যাংক মোতায়েন ছিল একটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত।
ট্যাংক রেজিমেন্টের ফায়ারিং পাওয়ার বৃদ্ধির জন্য এর সঙ্গে পর্যাপ্ত পরিমাণে জিপ মাউন্টেড মেশিনগান সংযুক্ত করা হয়। রংপুরে রেজিমেন্টের অবস্থান ছিল শহরের এক প্রান্তে, অবাঙালি অধ্যুষিত উপশহর এলাকায়। অবাঙালিরা বরাবরই বাঙালিবিদ্বেষী ছিল এবং রংপুরে ২৯ ক্যাভালরি রেজিমেন্ট আসার পর এই রেজিমেন্টের সৈন্যদের সঙ্গে তাদের নিবিড় সম্পর্ক গড়ে ওঠে। উল্লেখ্য যে, মুক্তিযুদ্ধকালে নিরীহ বাঙালি নিধনে এই ট্যাংকগুলো বেশি ব্যবহৃত হয়।
এদিকে ইয়াহিয়া খান ১৯৭১ সালের ৩রা মার্চের জাতীয় সংসদের অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করলে তার কূটকৌশল উপলব্ধি করে বঙ্গবন্ধু সংসদীয় দলের বৈঠক ডেকে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিতের সিদ্ধান্ত প্রত্যাখান করেন। তিনি ২রা মার্চ ঢাকায় ও ৩রা মার্চ সারাদেশে হরতাল কর্মসূচি ঘোষণা করেন এবং ৭ই মার্চ রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যান) ভাষণ দেয়ার কথা বলেন।
দেশের অন্যান্য অঞ্চলের মতো রংপুরেও ৩রা মার্চ স্বতঃস্ফূর্ত হরতাল পালিত হয়। সেদিন সর্বস্তরের মানুষের অংশগ্রহণে একটি মিছিল বের হয়। মিছিলটি তেঁতুলতলা থেকে আলমনগর স্টেশনের কাছে পৌঁছলে অবাঙালি সরফরাজ খানের বাড়ি থেকে মিছিলের ওপর গুলিবর্ষণ করা হয়। গুলিতে গুপ্তপাড়ার ১২ বছরের কিশোর শঙ্কু সমজদার নিহত হয়। ফলে, উত্তেজিত জনতা শহরের অবাঙালিদের দোকানপাট ভাঙচুর করে। পরদিন অবাঙালিদের আক্রমণে বাটার গলির মুখে দুজন বাঙালি প্রাণ হারায়। ৩রা মার্চ রংপুরে মিছিলে গুলিবর্ষণ ও হতাহতের খবর নীলফামারী, গাইবান্ধা, কুড়িগ্রাম ও লালমনিরহাটে পৌছার পর সাধারণ মানুষ বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। সেদিন শ্যামপুর উচ্চবিদ্যালয় প্রাঙ্গণে আয়োজিত জনসমাবেশে শ্যামপুর চিনিকলের ব্যবস্থাপক মোসলেহ উদ্দিন আহমেদ স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন। এরই জের হিসেবে পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষ ৩-৫ই মার্চ পর্যন্ত রংপুরে কারফিউ জারি করে। সাধারণ জনগণ এতে আতঙ্কিত হলেও তারা অসহযোগ আন্দোলন থেকে পিছপা হয়নি। ৩রা মার্চের পর থেকে রংপুর সেনানিবাস আক্রমণের পূর্বদিন (২৭শে মার্চ) পর্যন্ত রংপুরের বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও ছাত্র সংগঠনের নেতা- কর্মীরা গ্রামে-গঞ্জে সভা-সমিতি করে জনগণকে বোঝানোর চেষ্টা করেন যে, সশস্ত্র সংগ্রাম ছাড়া বাঙালিদের মুক্তির আর কোনো পথ নেই।
৭ই মার্চ রংপুর সেনানিবাস একটি দুর্ভেদ্য দুর্গে পরিণত হয়। সেনানিবাসের প্রতিটি প্রবেশপথে ভারী অস্ত্র বসিয়ে সৈন্যরা অবস্থান নেয়। সৈন্যদের বেশ কয়েকটি দল সেনানিবাস ও এর আশপাশের এলাকায় টহল দিতে থাকে। ট্যাংকগুলোকে সেনানিবাসের রাস্তার পাশে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়। পাশাপাশি সৈন্যরা বুলডোজারের সাহায্যে হালকা বিমান অথবা হেলিকপটার অবতরণক্ষেত্র নির্মাণের কাজ শুরু করে। বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষণ- শোনার জন্য রংপুরবাসী এক বিশাল মিছিল নিয়ে শহর প্রদক্ষিণ করে টাউন হল প্রাঙ্গণে রেডিও-টেলিভিশনের সামনে সমবেত হয়। কিন্তু পাকিস্তানের সামরিক সরকারের নির্দেশে রেডিও-টেলিভিশন ভাষণ প্রচার না করায় দেশের অন্যান্য অঞ্চলের মতো রংপুরেও প্রচণ্ড অসন্তোষ ও উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে।
মার্চ মাসের শুরুতে রংপুর অঞ্চলে যে সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়েছিল, সে পরিষদ জনগণের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। ৪ঠা/৫ই মার্চ থেকে সংগ্রাম পরিষদের নেতৃবৃন্দ ও স্থানীয় বাঙালিরা রংপুর সেনানিবাসে খাদ্যসামগ্রী এবং পানি সরবরাহ বন্ধ করে দেয়ার ঘোষণা দেন। সে অনুযায়ী সেনানিবাসের বাঙালি ঠিকাদারদের সহযোগিতায় সেনানিবাসে খাদ্যসামগ্রী সরবরাহ পুরোপুরি বন্ধ করে দেয়া হয়। ফলে, সেনানিবাসের অভ্যন্তরে খাদ্যঘাটতি দেখা দেয়। সৈনিক লঙ্গর ও অফিসার্স মেসে শুধু ডাল ও রুটি পরিবেশন করা হলে পশ্চিম পাকিস্তানি অফিসার ও সৈন্যদের মধ্যে অসন্তোষ দেখা দেয়।
১৭ই মার্চ রংপুর ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক রফিকুল ইসলাম গোলাপ কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ প্রেরিত স্বাধীন বাংলার পতাকার নমুনাসহ স্বাধীনতার ইশতেহার গ্রহণ করেন। ২৩শে মার্চ তিনি ডিসির বাসভবনে এবং ইলিয়াস আহমেদ ডিসি অফিসে স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করেন। এদিনই ন্যাপ (ভাসানী) নেতা মাহফুজ আলি নবাবগঞ্জ বাজারে স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করেন। এসব ঘটনা চারদিকে প্রচারিত হতে থাকে এবং স্বাধীনতাকামী মানুষ অবধারিত সংগ্রামের জন্য মানসিক প্রস্তুতি নেয়।
রংপুরের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ও ছাত্রনেতারা ঢাকার পরিস্থিতি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করতে থাকেন। বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণে ‘যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে’ মর্মে যে নির্দেশ দেয়া হয় তা মানুষকে গভীরভাবে নাড়া দেয়। রংপুরের স্থানীয় নেতারা ইপিআর সদস্যদের সঙ্গে গোপনে আলোচনা চালিয়ে যেতে থাকেন। ইপিআর বাহিনী আধাসামরিক বাহিনী হওয়ায় একে কখনোই আধুনিক সমরাস্ত্রে সজ্জিত করা হয়নি। এ বাহিনীতে সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালি ছিলেন বলে তাঁদের কাছে দেশবাসীর প্রত্যাশাও ছিল অনেক। রংপুরস্থ ইপিআর-এর ১০ নম্বর উইং সদর দপ্তরের উইং অধিনায়ক ছিল অবাঙালি মেজর মো. কাজমী। তার দুজন সহকারী উইং অধিনায়কের মধ্যে একজন ছিলেন বাঙালি ক্যাপ্টেন নওয়াজেশ উদ্দিন, অপরজন ছিল অবাঙালি – ক্যাপ্টেন মো. আলি ভুট্টো। এ উইংয়ের অধীনে ছিল পাঁচটি কোম্পানি ও একটি সাপোর্ট প্লাটুন। এসব কোম্পানির মধ্যে চারটি কোম্পানি ও সাপোর্ট প্লাটুনের অধিনায়ক ছিলেন বাঙালি এবং একটি কোম্পানির অধিনায়ক ছিল অবাঙালি।
রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ও ছাত্রনেতাদের একটি দল ইপিআর- এর ১০ নম্বর উইংয়ের সহকারী অধিনায়ক ক্যাপ্টেন নওয়াজেশ উদ্দিনের সঙ্গে গোপনে মিলিত হন। তিনি রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে সর্বপ্রকার সহযোগিতার আশ্বাস দেন। কিন্তু উইং অধিনায়ক মেজর মো. কাজমী ও উপ-অধিনায়ক ক্যাপ্টেন মো. আলি ভুট্টো সবসময় ক্যাপ্টেন নওয়াজেশ উদ্দিনের গতিবিধির ওপর নজর রাখত। তাছাড়া সিগন্যাল ডিটাচমেন্টের দিকেও তারা কড়া নজর রাখত এবং গোপনীয় বিষয়গুলো নিজেরাই ওয়্যারলেসের মাধ্যমে প্রেরণ করত। ক্যাপ্টেন নওয়াজেশ উদ্দিন স্থানীয় রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে এও জানান যে, রংপুর ও আশপাশের জনগণকে দ্রুত প্রস্তুত করতে হবে। যদি পাকিস্তানি সামরিক সরকার বঙ্গন্ধুর নিকট ক্ষমতা হস্তান্তর না করে এবং বাঙালিদের ওপর নির্যাতন চালিয়ে যেতে থাকে, তাহলে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ অনুযায়ী যার যা আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে। এ লক্ষ্যে নেতৃবৃন্দের নির্দেশমতো রংপুরের সাধারণ মানুষ ও আদিবাসীরা প্রস্তুতি গ্রহণ করতে থাকে।
রংপুরের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ও ছাত্রনেতৃবৃন্দ গোপনে তাঁদের আলোচনা চালিয়ে যেতে থাকেন। সে আলোচনায় অংশ নেন ইপিআর-এর নুরুজ্জামান ও নুরুদ্দিন। তাঁরা নেতৃবৃন্দকে জানান যে, প্রয়োজন হলে তাঁরা তাঁদের অস্ত্রাগার থেকে মেশিনগান, মর্টার ইত্যাদি নিয়ে জনগণের সঙ্গে মিলিত হবেন। যদি সেনানিবাস আক্রমণ করতে হয় তাহলেও তাঁরা তা করবেন এবং জনগণের সঙ্গে এগিয়ে যাবেন। তাঁরা আরো জানান যে, এক্ষেত্রে ভেতরে অবস্থানরত বাঙালি সৈনিকরা নিশ্চয়ই অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে তাঁদের সঙ্গে যোগ দেবেন এবং পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে রংপুর থেকে উৎখাত করতে সার্বিকভাবে সহযোগিতা করবেন।
এসব আলোচনার পর আওয়ামী লীগ নেতা এডভোকেট গনি মিয়া তাঁর বন্ধু বুদু ওঁরাওয়ের সঙ্গে আলোচনায় বসেন। তাঁরা বিভিন্ন গ্রামে জনসংযোগ চালান এবং ওঁরাও সম্প্রদায়কে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে উদ্বুদ্ধ করেন। একইভাবে সাঁওতালদেরও সঙ্ঘবদ্ধ করার দায়িত্ব নেন আওয়ামী লীগ নেতা মজিবর রহমান মাস্টার। তাঁর সঙ্গে সাঁওতাল নেতাদের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিল। লোহানীপাড়ার সাঁওতাল সম্প্রদায়ের সঙ্গে তিনি নিয়মিত যোগাযোগ রাখছিলেন। তিনি সাঁওতাল নেতা জয়রাম সরেন, সর্দার মারটি, সাগরাম টুডু, ভোলানাথ, কারমা কেরকেটা, কারসুম কেরকেটা, গোয়েন্দা কেরকেটা, দিবেন্দ্রনাথ সিংহ প্রমুখের সঙ্গে যোগাযোগ করেন এবং তাঁদের এ আন্দোলনে যোগ দেয়ার জন্য উদ্বুদ্ধ করেন। জয়রাম সরেনের পিতা লালরাম সরেন এবং বড়ভাই সুবিরাম সরেন তাঁদেরকে সবরকম সহযোগিতা করেন। এর ফলে আদিবাসী সম্প্রদায়ের মধ্যে এক জাগরণের সৃষ্টি হয়। তাঁদের প্রতিনিধিরা সাইকেলযোগে জনসংযোগ অব্যাহত রাখেন।
মার্চ মাসের প্রথম থেকে যখন দেশব্যাপী অসহযোগ আন্দোলন চলছিল এবং সেনানিবাসের ঠিকাদারদের সহযোগিতায় রংপুর সেনানিবাসে খাদ্যসামগ্রী সরবরাহ বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল, তখন থেকেই পাকিস্তানি সৈন্যরা সেনানিবাসের আশপাশের গ্রামগুলোতে গিয়ে জোরপূর্বক গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগি ও ক্ষেতের শাক-সবজি ছিনিয়ে আনা শুরু করে। গ্রামবাসীরা পাকিস্তানি সৈন্যদের এ দুষ্কর্মে বাধা দিলে তাঁদের ওপর চালানো হতো অমানুষিক অত্যাচার। এ অত্যাচারের মাত্রা বাড়তে শুরু করলে গ্রামবাসীরা নিজেদের মধ্যে সংগঠিত হতে এবং পাকিস্তানি সৈন্যদের দুষ্কর্মের দাঁতভাঙা জবাব দেয়ার জন্য প্রস্তুত হতে থাকে।
২৩শে মার্চ বেলা ১০টার দিকে রংপুর সেনানিবাস থেকে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ২৯ ক্যাভালরি রেজিমেন্টের একজন অফিসার লেফটেন্যান্ট আব্বাস কয়েকজন সশস্ত্র সৈন্য নিয়ে প্রতিদিনের মতো খাদ্যসামগ্রী সংগ্রহে বের হয়। লে. আব্বাস একটি জিপে করে সেনানিবাসের পশ্চিম গেট দিয়ে সম্মানীপুর ও দমোদরপুর গ্রামের দিকে রওনা দেয়। তার সঙ্গে ছিল একজন ড্রাইভার ও চারজন সৈন্য। লে. আব্বাস ইতঃপূর্বেও সেনানিবাসের আশপাশের গ্রাম থেকে বলপূর্বক খাদ্যশস্য ছিনিয়ে নিয়েছে। গ্রামের দিকে তার এগিয়ে যাওয়ার খবরটি সম্মানীপুর, দমোদরপুর, বড়বাড়ি ও মনোহরপুর গ্রামে ছড়িয়ে পড়ে।
সম্মানীপুর গ্রামের একজন সাহসী ও শক্তিশালী যুবক ছিলেন শাহেদ আলি কসাই। তিনি মার্চ মাসের প্রথম থেকেই পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে তাঁর গ্রামের লোকজনকে সংগঠিত করার কাজ শুরু করেন। দরিদ্র কৃষক পরিবারের সন্তান শাহেদ আলি স্থানীয় বড়বাড়ি স্কুল থেকে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্ত করে রংপুর শহরের মুনশিপাড়াস্থ কেরামতীয়া উচ্চ বিদ্যালয়ে পড়াশুনা শুরু করেছিলেন। কিন্তু অর্থনৈতিক অসচ্ছলতার কারণে পড়াশুনা চালিয়ে যেতে পারেননি। অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ার পর পেটের দায়ে তিনি কসাইয়ের কাজ বেছে নেন এবং লালবাগহাটের একটি মাংসের দোকানে কাজ শুরু করেন। ৮ই মার্চ সকালে গ্রামের বাজারে গিয়ে তিনি বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ শোনেন। সেদিন থেকেই তিনি গ্রামের মানুষকে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অত্যাচার ও বলপূর্বক খাদ্যসংগ্রহের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে বলেন এবং এর বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেয়ার জন্য প্রস্তুত হতে উদ্বুদ্ধ করেন। তিনি তাদের আরো বলেন, বঙ্গবন্ধু নির্দেশ দিয়েছেন ‘যার যা আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত হওয়ার জন্য’। তিনি তাঁর গরুকাটার বড় ছোরাটি দেখিয়ে বলতেন, ‘আমার এই ছরি নিয়ে আমি প্রস্তুত, আপনারাও যার যা আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকবেন’। তাঁর সঙ্গে একমত হয়ে গ্রামবাসী সিদ্ধান্ত নেয় যে, তারা পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে কোনোপ্রকার খাদ্যসামগ্রী সরবরাহ করবে না এবং পূর্বের মতো বলপূর্বক খাদ্যসামগ্রী ছিনিয়ে নেয়ার চেষ্টা করলে তা প্রতিহত করবে।
সম্মানীপুর-দমোদরপুর গ্রামের দিকে খাদ্যসামগ্রী সংগ্রহে পাকিস্তানি সেনাদের একটি দল ক্যান্টনমেন্ট থেকে এগিয়ে আসছে – স্থানীয় জসিম উদ্দিনের কাছ থেকে এ খবর পেয়ে শাহেদ আলি তাঁর বিশাল ছুরিটি নিয়ে দৌড়ে গ্রামবাসীদের একত্রিত করতে থাকেন। খুব কম সময়ের মধ্যে সম্মানীপুর ও দমোদরপুর গ্রামের শতশত মানুষ দা, খুন্তি, বল্লম, কোদাল, কুড়াল, লাঠি ইত্যাদি নিয়ে পাকিস্তানি সৈন্যদের প্রতিহত করার জন্য প্রস্তুত হয়। শাহেদ আলির সঙ্গে গ্রামের কয়েকজন তরুণ এসব অস্ত্র নিয়ে দৌড়ে গ্রামের শেষ প্রান্তের দিকে যেতে থাকে।
লে. আব্বাসের জিপটি দমোদরপুর গ্রামের দিকে ধীরগতিতে এগিয়ে আসছিল, কারণ রাস্তাটি ছিল কাঁচা এবং খানাখন্দে ভরা। দমোদরপুর গ্রামে ঢোকার পথেই ছিল একটি বাড়ি ও একটি ছোটক্ষেত এবং রাস্তার পাশে ছিল একটি উঁচু ঢিবি, গাছ ও বাঁশঝাড়। এর পেছনে শাহেদ আলিসহ আরো ১০ জন যুবক হাতে ছুরি, বর্শা, কুড়াল ইত্যাদি নিয়ে সৈন্যদের অপেক্ষা করতে থাকে। শাহেদ আলি নিজেদের মধ্যে আক্রমণের বিষয়ে আলাপ করেন। আক্রমণ অতি দ্রুত করতে হবে, যেন সৈন্যরা রাইফেল দিয়ে গুলি করার সুযোগ না পায়। গাড়িটি ঢিবির কাছে পৌছাতেই শাহেদ আলি আড়াল থেকে বেরিয়ে দ্রুত জিপের বনেটের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েন এবং মুহূর্তেই লে. আব্বাসকে ছুরিকাঘাত করেন। সঙ্গে-সঙ্গে অন্যরাও গাড়ির পেছনদিকে বসা সৈন্যদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। ঘটনার আকস্মিকতায় পাকসেনারা হতভম্ব হয়ে পড়ে। তারা কিছু বুঝে ওঠার আগেই শাহেদ আলি ও তাঁর সঙ্গীরা সৈন্যদের হাত থেকে অস্ত্র ছিনিয়ে নিয়ে তাদের আঘাত করতে থাকে। ততক্ষণে সম্মানীপুর ও দমোদরপুর গ্রামের শতশত মানুষ সেখানে উপস্থিত হয়। তাদের মিলিত আক্রমণে লে. আব্বাস ও সৈন্যরা মৃতপ্রায় হয়ে পড়ে। ইতোমধ্যে পার্শ্ববর্তী মনোহরপুর গ্রামের সৈনিক নুরুল ইসলাম (যিনি ছুটিতে বাড়িতে এসেছিলেন) সেখানে উপস্থিত হন। তিনি শাহেদ আলি ও গ্রামবাসীদের বলেন, পাকসেনারা যদি তাদের সৈন্যদের এ অবস্থায় দেখে তাহলে তারা এ এলাকায় ধ্বংসযজ্ঞ চালাবে, গ্রামগুলোকে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেবে। তিনি তাদের বলেন জিপ ও আহত সৈন্যদের দূরে কোনো ফাঁকা জায়গায় ফেলে আসতে। তখন গ্রামবাসীদের অনুরোধে নুরুল ইসলাম আহতদেরসহ জিপটি চালিয়ে দমোদরপুর থেকে ছয় কিলোমিটার দূরে ডাঙিরপাড় নামক স্থানের পরিত্যক্ত জায়গায় ফেলে আসেন। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর উদ্ধারকারী একটি দল চারদিকে খোঁজাখুঁজির পর গুরুতর আহত অবস্থায় লে. আব্বাস ও অন্য সেনাদের সেনানিবাসে নিয়ে যায় এ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে পাকিস্তান সেনাবাহিনী গণেশপুর এলাকাকে ঘটনাস্থল মনে করে প্রতিশোধ নেয়ার উদ্দেশ্যে পরদিন গ্রামটি সম্পূর্ণরূপে জ্বালিয়ে দেয়। তারা সেনানিবাসের পশ্চিম পাশের আদর্শ গ্রামটিও জ্বালিয়ে দেয়। নির্বিচারে গ্রামগুলোতে অগ্নিসংযোগ করায় সেনানিবাসের আশপাশের মানুষের ক্ষোভ আরো বৃদ্ধি পায়। সৈন্যদের ওপর গ্রামবাসীদের আক্রমণের পর রংপুর সেনানিবাসের পাকিস্তানি অফিসার ও সৈন্যদের মধ্যে উত্তেজনা বৃদ্ধি পায়। ২৪শে মার্চ রাতে সামরিক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় লে. আব্বাসের মৃত্যু হয়। এ খবরে সেনানিবাসে আরো উত্তেজনার সৃষ্টি হয় এবং থমথমে ভাব বিরাজ করতে থাকে। ব্রিগেড সদর দপ্তরে দমোদরপুর ও আশপাশের গ্রামগুলো আক্রমণের পরিকল্পনা করা হয়। লে. আব্বাসকে আক্রমণকারী শাহেদ আলি এ ঘটনার পর তাঁর গ্রাম ছেড়ে কর্মস্থল লালবাগহাটে চলে যান। ২৫শে মার্চের পর পাকিস্তান সেনাবাহিনী লে. আব্বাসের মৃত্যুর জন্য দায়ী ব্যক্তিদের খোঁজ করতে শুরু করে এবং তাদের এদেশীয় সহযোগী গাঁটিয়া আমজাদের মাধ্যমে খবর পেয়ে তারা লালবাগহাটে গিয়ে শাহেদ আলিকে হত্যা করে। পরদিন লালবাগহাট থেকে প্রায় ১৫ কিলোমিটার দূরে লাহিড়ীরহাটের কাছে একটি কর্দমাক্ত স্থানে তাঁর ক্ষতবিক্ষত মৃতদেহ পাওয়া যায়। তাঁর শরীরে ছিল বেশ কয়েকটি গুলি ও নির্যাতনের চিহ্ন। তাঁর চোখ উপড়ে ফেলা হয়েছিল এবং মাথায় আঘাতের ফলে মগজ বেরিয়ে গিয়েছিল। পরে শাহেদ আলির আত্মীয়-স্বজনরা মৃতদেহ এনে সম্মানীপুর গ্রামে তাঁর বাড়ির পেছনে কবর দেয়।
২৫শে মার্চ রংপুর সেনানিবাসে অবস্থানরত পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ব্রিগেড সদর দপ্তরসহ ২৯ ক্যাভালরি রেজিমেন্ট এবং সৈয়দপুর সেনানিবাসে অবস্থানরত ২৬ ফ্রন্টিয়ার ফোর্স রেজিমেন্ট নিজেদের সম্পূর্ণরূপে প্রস্তুত করে রেখেছিল। সেদিন বেলা ১টায় ব্রিগেড সদর দপ্তরে একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এ বৈঠকে ইপিআর-এর ১০ নম্বর উইংয়ের সহকারী অধিনায়ক ক্যাপ্টেন নওয়াজেশ উদ্দিনকে প্রথমে উপস্থিত থাকার নির্দেশ দেয়া হলেও সভা শুরুর কিছু পূর্বে ব্রিগেডিয়ার মালিক তাঁকে রংপুর শহরের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার কাজ দেখার জন্য পাঠিয়ে দেয়। ক্যাপ্টেন নওয়াজেশ বাঙালি বলে তাঁর উপস্থিতিতে আলোচনা করা ঠিক হবে না মনে করেই তাঁকে ঐ অজুহাতে বাইরে পাঠিয়ে দেয়া হয়। রাত ১২টার পর পাকিস্তান সেনাবাহিনী রংপুর শহরে নিরস্ত্র বাঙালিদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। সেই সঙ্গে ইপিআর-এর ১০ নম্বর উইং সদর দপ্তরে অবস্থানরত বাঙালি সদস্যদেরও আক্রমণ করা হয়। সমগ্র রংপুর শহরে এলোপাতাড়ি গুলিবর্ষণ শুরু হয় এবং অনেক মানুষ হতাহত হয়।
২৬শে মার্চ থেকে রংপুর শহরবাসীরা নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে দলে-দলে গ্রামে যেতে থাকে। অনেকে সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে চলে যায়। এদিন রংপুর শহরে পাকিস্তান সেনাবাহিনী কর্তৃক সংঘটিত গণহত্যার প্রতিবাদে হাজার-হাজার ক্ষুব্ধ জনতা পাকিস্তান-বিরোধী স্লোগান দিতে- দিতে টোগরাইহাট রেল স্টেশনে সমবেত হয়। রংপুর শহরের সঙ্গে অন্যান্য স্থানের রেল যোগাযোগ ব্যাহত করার জন্য তারা তিন মাইল পর্যন্ত রেললাইন উপড়ে ফেলে।
২৬শে মার্চ সারাদিন পাকিস্তানি সৈন্যরা রংপুর শহর ও এর আশপাশে টহল দেয়। ২৭শে মার্চ এসব এলাকায় রটে যায় যে, সেনানিবাসে অবস্থানরত বাঙালি সৈনিকরা অস্ত্রসহ বিদ্রোহ করে জনতার কাতারে সামিল হয়ে স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহণ করবেন। লোকমুখে এ-কথাও ছড়িয়ে পড়ে যে, সেনানিবাসে বহু বাঙালি সৈনিককে হত্যা করা হয়েছে, অনেককে বন্দি করা হয়েছে এবং বাকিদের নিরস্ত্র করা হয়েছে। পাকিস্তানি সৈন্যরা সেনানিবাসে তাদের অবস্থান আরো শক্তিশালী করে। এ সংবাদ বাইরে ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে-সঙ্গে স্বাধীনতাকামী জনগণ আরো উত্তেজিত হয়ে ওঠে। রংপুর শহর ও এর আশপাশের এলাকায় সেনানিবাস আক্রমণের বিষয় নিয়ে সারাদিন আলোচনা চলতে থাকে। রংপুরের রাজনৈতিক ও গণ্যমান্য ব্যক্তিরা মনে করেছিলেন, পূর্বের আলোচনা অনুযায়ী সাফল্যের সঙ্গে সেনানিবাস ঘেরাও করতে পারলে ইপিআর-এর বাঙালি সদস্যরা তাঁদের ভারী অস্ত্রশস্ত্র ও মর্টার নিয়ে সেনানিবাসে আক্রমণ চালাবেন।
তাঁরা আরো মনে করেছিলেন যে, এ আক্রমণের ফলে সেনানিবাসে অবস্থানরত বাঙালি সৈনিক ও কর্মকর্তারা অস্ত্রশস্ত্রসহ বের হয়ে তাঁদের সঙ্গে যোগ দিতে সক্ষম হবেন। কিন্তু ২৭শে মার্চ পর্যন্ত তেমন কোনো অবস্থা সৃষ্টি করা যায়নি। এদিন বিকেল ৪টার দিকে ২৯ ক্যাভালরি রেজিমেন্টের সৈন্যরা রাতে শহরে টহল দেয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিল। তখন সেনানিবাসের চারদিকে অস্থিরতা পরিলক্ষিত হয়। চতুর্দিকে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। এর মধ্যে রটে যায় যে, রংপুর সেনানিবাস আক্রমণ করা হবে। কিন্তু কারা আক্রমণ করবে তা কেউ বুঝতে পারছিল না। সেদিন বিকেলে রংপুরের কবি শেখ আমজাদ হোসেন, মজিবর রহমান মাস্টার, এডভোকেট গনি মিয়াসহ অন্য নেতারা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর গণহত্যা ও নির্যাতনের বিষয় নিয়ে সাধারণ গ্রামবাসী, সাঁওতাল ও ওঁরাও নেতৃবৃন্দ এবং ঘাঘট নদীর মাঝিদের সঙ্গে আলোচনায় বসেন। আলোচনার পর সিদ্ধান্ত হয় যে, পরদিন ২৮শে মার্চ সেনানিবাসের আশপাশের সব গ্রামের মানুষ, ঘাঘট নদীর মাঝিরা, রংপুর শহরের ছাত্র- জনতা, ওঁরাও ও সাঁওতাল আদিবাসীরা একত্রে চারদিক থেকে সেনানিবাস ঘেরাও করবে এবং পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে রংপুর থেকে উৎখাত করবে। তারা তীর- ধনুক, বল্লম, দা, কুড়াল আর বাঁশের লাঠি নিয়ে সেনানিবাসের দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে নিসতেবগঞ্জ হাট এলাকাসহ ঘাঘট নদীর তীরঘেঁষে জমায়েত হবে এবং এদিক থেকে বড় আক্রমণ পরিচালনা করা হবে। অন্যান্য এলাকা যেমন মিঠাপুকুর, বলদিপুকুর, মানজাই, রানিরহাট, রূপসি, তামকাট, জয়রাম আনোয়ার, পালিচড়া, বুড়িরহাট, গঙ্গাচড়া, শ্যামপুর, দমদমা, লালবাগ, দমোদরপুর, পাগলাপির, সাহেবগঞ্জ ও বাহার কাছনার জনগণ ঘাঘট নদীর পাড়ে জড়ো হয়ে সেখান থেকে এগিয়ে যাবে। তাদের লক্ষ্য হবে একটাই – সেনানিবাস দখল করা।
সেনানিবাস ঘেরাও অপারেশনের সাফল্যের জন্য আদিবাসী সম্প্রদায়ের জনগণের সহযোগিতা ও অংশগ্রহণ প্রয়োজন ছিল। ইতঃপূর্বে তাদের সঙ্গে এ ব্যাপারে আলোচনাও হয়েছে এবং তারা অপারেশনে অংশগ্রহণের জন্য প্রস্তুত। এডভোকেট গনি মিয়া বলদিপুকুরে গিয়ে বুদু ওঁরাওয়ের সঙ্গে এবং মজিবর রহমান মাস্টার লোহানীপাড়ায় গিয়ে জয়রাম সরেনের সঙ্গে আলাপ করেন যাতে তাঁরা ২৮শে মার্চ দুপুরের মধ্যে সশস্ত্র অবস্থায় সেনানিবাসের কাছে পৌঁছে যান। তাঁদের আলোচনায় অন্যান্য সাঁওতাল নেতারাও অংশ নেন। সাঁওতাল নেতারা ঠিক করেন, ২৮শে মার্চ সকালে সাঁওতাল যোদ্ধারা তাঁদের আদিদেবতা ‘সিং বোঙ্গা’ (সূর্যের দেবতা)-র পূজা করে যুদ্ধে রওনা দেবেন। তাঁরা নিয়মিত এ দেবতার পূজা করেন। সূর্য পূর্ব দিকে ওঠার সময় এ পূজা করা হয় এবং পূজায় পাঁঠা বা সাদা মোরগ বলি দেয়া হয়। তাঁরা আরো সিদ্ধান্ত নেন যে, পূজা করে পূর্বমুখী হয়ে শপথ নিয়ে তাঁরা যুদ্ধের জন্য রওনা হবেন।
পূর্ব থেকেই পাকিস্তানিদের ওপর রংপুরের আদিবাসীদের ক্ষোভ ছিল। কারণ, পাকিস্তানি সৈন্য ও তাদের এদেশীয় সহযোগীরা আদিবাসী ও খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীদের ওপর প্রায়ই অত্যাচার করত। মাঝে-মধ্যে তারা তাঁদের বাড়িঘরে হানা দিত। ইতঃপূর্বে খ্রিস্টান মিশনের বেশ কয়েকজন ধর্মযাজক ও আদিবাসী নেতাকে সেনানিবাসে ধরে নিয়ে অত্যাচার করা হয়। তাঁরা সেই অত্যাচারের প্রতিশোধ নেয়ার জন্য পাড়ায়- পাড়ায় সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে প্রচারণা চালাতে এবং সংঘবদ্ধ হতে থাকেন।
জনসংযোগের শেষ পর্যায়ে কয়েকজন বর্ষীয়ান নেতা সকলকে বোঝাতে চেয়েছিলেন যে, আধুনিক মারণাস্ত্রের বিরুদ্ধে আদিম যুগের তীর-ধনুক ও বল্লম দিয়ে আক্রমণ করলে বহু নিরীহ মানুষ হতাহত হবে এবং এর পরিণতি হবে ভয়াবহ। কিন্তু তারুণ্যে ভরা যুবকরা সেদিন নেতাদের কথায় কর্ণপাত করেনি। তারা জনস্রোত তৈরি করে প্রাণশক্তিতে উজ্জীবিত হয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়।
২৮শে মার্চ বিকেলে চারদিক থেকে হাজার-হাজার মানুষ সেনানিবাসের দিকে ছুটে আসতে থাকে; কোথাও এক সারিতে, কোথাও বা দলে-দলে। তাদের প্রত্যেকের হাতে ছিল সাধারণ অস্ত্র ও দৈনন্দিন ব্যবহার্য জিনিসপত্র, যেমন তীর-ধনুক, বল্লম, লাঠি, দা, কুড়াল ইত্যাদি। চারদিকে স্লোগান আর চিৎকার। বিক্ষুব্ধ জনতার আগমন ও আক্রমণের সংবাদ পেয়ে সেনানিবাসের গেটে-গেটে এমপি চেকপোস্ট বসানো হয়। সেনাবাহিনী আতঙ্কিত হয়ে অস্ত্র ও গোলাবারুদ নিয়ে প্রস্তুত হয়। সেনানিবাসের চতুর্দিকে মেশিনগানসজ্জিত জিপগুলো অবস্থান নেয়। পাকিস্তানি অফিসাররা দ্রুত সেনানিবাসের প্রান্তে এসে অবস্থা পর্যবেক্ষণ করার চেষ্টা করে। অনেকে দূরবীক্ষণ দিয়েও দেখার চেষ্টা করে। কেউ-কেউ ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করার জন্য জিপের ওপর উঠে দাঁড়ায়। তাদের বিশ্বাস হচ্ছিল না যে তারা কী দেখছে! সাধারণ কিছু অস্ত্র নিয়ে কীভাবে এই মানুষগুলো আধুনিক স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত ট্যাংক রেজিমেন্টের ঘাঁটিতে আক্রমণ চালাবে তা তারা ভেবে পাচ্ছিল না।
অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে তারা এই অগ্রসরমান জনগোষ্ঠীর দিকে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। দেশপ্রেমে বলীয়ান এই মানুষগুলো ক্রমাগত এগিয়ে আসছিল। আদিবাসী নেতা ও নেতৃস্থানীয় গ্রামবাসীরা এ আক্রমণের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন।
কিছুক্ষণের মধ্যেই এমপি চেকপোস্টগুলোর দিকে শতশত তীর ছুটে আসে। হাজার-হাজার কালো মাথার মানুষগুলো পিঁপড়ার মতো সারিবদ্ধভাবে এগিয়ে আসতে থাকে। তারা চিন্তাও করেনি তাদের পরিণতি কতটা ভয়ঙ্কর হবে। ইতোমধ্যে পাকিস্তানি সৈন্যরা সম্পূর্ণরূপে প্রস্তুত হয়ে যায়। এক-এক করে মেশিনগানসজ্জিত ১০টি জিপ সেনানিবাসের প্রান্তে এসে অবস্থান নেয়। মেশিনগানের সঙ্গে অ্যামুনিশন চেইন স্থাপন করা হয়। কয়েকটি ট্যাংকও দ্রুতগতিতে এসে অবস্থান নেয়। সৈন্যরা রাইফেলে বেয়নেট স্থাপন করে নির্দেশের অপেক্ষায় থাকে। গ্রামবাসীরা আরো কিছুটা অগ্রসর হওয়ার সঙ্গে-সঙ্গে সেনানিবাস থেকে মেশিনগানসহ জিপ নিয়ে পাকিস্তানি সৈন্যরা রাস্তায় এসে নিরীহ জনতার ওপর গুলিবর্ষণ শুরু করে। মেশিনগানের অবিশ্রান্ত গুলিতে ঝাঁকে-ঝাঁকে মানুষ মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। অনেকে মুমূর্ষু অবস্থায় পড়ে থাকে মাঠের মধ্যে। তাদের রক্তে লাল হয়ে যায় পুরো এলাকা। মধ্যযুগীয় বর্বরতার শিকার হয় শতশত মানুষ। কিছুক্ষণ পর মেশিনগান থেকে গুলিবর্ষণের সাময়িক বিরতি ঘটে। তখন চারদিক থেকে কেবল আর্তচিৎকার ভেসে আসে। তখন পর্যন্ত ওঁরাও এবং সাঁওতাল তীরন্দাজ বাহিনী সেনানিবাসের দিকে তীর ছুড়তে-ছুড়তে অগ্রসর হতে থাকে। তারপর মেশিনগানগুলো আবার গর্জে ওঠে, আর ঝাঁঝরা হতে থাকেন সম্মুখ সমরের যোদ্ধারা। অনেকে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন, গুলির শব্দে অনেকে ছত্রভঙ্গ হয়ে যান। কিন্তু ওঁরাওরা পিছু হটতে চাননা। এডভোকেট গনি মিয়া ও অন্য নেতৃবৃন্দের অনুরোধে বুদু ওঁরাও পশ্চাদপসরণ করেন। তীরন্দাজ ওঁরাওরা দ্রুত পিছিয়ে ক্ষেত-খামার-বিল- জলাশয়-জঙ্গলের আড়ালে লুকিয়ে পড়েন। কিন্তু মাহাদেও ওঁরাও পশ্চাদপসরণ না করে সেনানিবাসের দিকে এগিয়ে যান। ঝাঁকে-ঝাঁকে গুলি এসে তাঁর দেহ ভেদ করে এবং সঙ্গে-সঙ্গে তিনি মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন।
সেদিন বর্বর পাকিস্তানি সৈন্যরা আনুমানিক ছয় শতাধিক মানুষকে হত্যা করে এবং সেনানিবাসের আশপাশের সমস্ত গ্রামে অগ্নিসংযোগ করে। তারপরের দৃশ্য ছিল আরো করুণ ও বর্বরোচিত। জিপ থেকে নেমে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে লে. কর্নেল সাগীর হোসেন তার অফিসারদের উদ্দেশ্যে কিছু নির্দেশ দেয়। মুহূর্তের মধ্যে সৈন্যরা বেয়নেট লাগানো রাইফেল নিয়ে ছুটে যায় মাঠের দিকে। যাঁরা আহত হয়েছিলেন তাঁদেরকে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে মৃত্যু নিশ্চিত করে। বেশ কিছুক্ষণ পর লে. কর্নেল সাগীর বাইনোকুলার দিয়ে পুরো এলাকা পর্যবেক্ষণ করে আরো কিছু নির্দেশ দেয়। নির্দেশ মোতাবেক সৈন্যরা মাঠে পড়ে থাকা লাশগুলো সেনানিবাসের কাছে নিয়ে আসতে থাকে। অবাঙালি ক্যাপ্টেন সাজেদ মাহমুদ লে. কর্নেল সাগীরকে জানায় যে, মাঠের মধ্যে ট্রাক যেতে সমস্যা হচ্ছে বলে সব লাশ তুলে আনা সম্ভব হচ্ছে না। ক্যাপ্টেন সাজেদ মাহমুদ পরামর্শ দেয় লাশগুলো যেখানে আছে সেখানেই পুঁতে রাখতে। পরক্ষণে আবার নির্দেশ দেয় সবগুলো লাশ একত্র করে সন্ধ্যার পর পুড়িয়ে ফেলতে, যাতে এ হত্যাকাণ্ডের কোনো চিহ্ন না থাকে। পাকিস্তানি সৈন্যরা তখন রক্তাক্ত নিথর দেহগুলো এক জায়গায় জড়ো করে।
মেশিনগানের গুলিতে যাঁরা আহত হয়েছিলেন, তাঁদেরও পুড়িয়ে ফেলার জন্য এক জায়গায় এনে জড়ো করা হয়। তখনো তাঁরা করুণ আর্তনাদ করছিলেন। এতে বিরক্ত হয়ে পাকসেন্যরা বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে-খুঁচিয়ে তাঁদের আর্তনাদ চিরতরে স্তব্ধ করে দেয়। তারপর মৃতদেহগুলো একত্র করে ট্যাংক থেকে পেট্রোল ঢেলে জ্বালিয়ে দেয়। অনেকগুলো মৃতদেহ মাটিতে পুঁতে রাখা হয়। ঘটনার পর হত্যাকাণ্ড তদারক করতে আসা পাকিস্তানি অফিসাররা বলতে থাকে, “ঠিক হ্যায়, বাঙালি সাব খতম হো গিয়া।’
২৮শে মার্চ রংপুর সেনানিবাস আক্রমণের ঘটনায় যেসব নিরীহ গ্রামবাসী, ঘাঘট নদীর মাঝি ও আদিবাসী সম্প্রদায়ের মানুষ শহীদ হয়েছিল, তাদের সম্পূর্ণ তালিকা হয়ত কোনোদিনও প্রস্তুত করা সম্ভব হবে না। কারণ, পাকসেনারা অর্ধদগ্ধ মৃতদেহগুলোর ওপর দিয়ে এমনভাবে ট্যাংক চালিয়ে দেয় যে হাড়গোড়গুলো পর্যন্ত সম্পূর্ণরূপে গুঁড়ো-গুঁড়ো হয়ে যায়। এ আক্রমণের পর জীবিত গ্রামবাসীরা পালিয়ে যায় এবং অনেকে ভারতে চলে যায়। আদিবাসী সম্প্রদায়ের মানুষরাও এ ঘটনার পর ভারতে পালিয়ে যায়। পরবর্তীকালে তাদের অনেকেই সেখান থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বহুসংখ্যক আদিবাসী ভারতে তাদের সম্প্রদায়ের মানুষদের সঙ্গে থেকে যায়।
১৯৭১ সালের ২৮শে মার্চ রংপুর সেনানিবাস আক্রমণের জন্য রংপুর শহর ও আশপাশের গ্রামগুলো থেকে যে হাজার- হাজার মানুষ বঙ্গবন্ধুর নির্দেশমতো ‘যার যা ছিল তাই নিয়ে’ সেনানিবাসে হামলে পড়েছিলেন, তাঁদের একমাত্র লক্ষ্য ছিল দেশমাতৃকাকে শত্রুমুক্ত করে স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনা। এ ঘটনার স্মরণে সেনানিবাসের প্রবেশদ্বারে তীরধনুকসহ জয়রাম সরেনের প্রতিকৃতিসম্বলিত একটি স্মারক ভাস্কর্য নির্মিত হয়েছে, যা জয়রাম সরেন স্মৃতিস্মারক স্থাপত্য- নামে পরিচিত। [কাজী সাজ্জাদ আলী জহির]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৯ম খণ্ড