You dont have javascript enabled! Please enable it! বীরশ্রেষ্ঠ মোহাম্মদ মোস্তফা কামাল - সংগ্রামের নোটবুক

বীরশ্রেষ্ঠ মোহাম্মদ মোস্তফা কামাল

মোহাম্মদ মোস্তফা কামাল, বীরশ্রেষ্ঠ (১৯৪৭-১৯৭১) সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় খেতাবপ্রাপ্ত শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধা। তিনি ২৮শে এপ্রিল আখাউড়ার গঙ্গাসাগরের পার্শ্ববর্তী দরুইন গ্রামে পাকবাহিনীর সঙ্গে সম্মুখ যুদ্ধে শহীদ হন। ১৯৪৭ সালের ১৬ই ডিসেম্বর ভোলা জেলার দৌলতখান থানার পশ্চিম হাজিপুর গ্রামে (জন্মস্থানটি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেলে পরবর্তীতে সরকার কর্তৃক ভোলা সদরের আলীনগর ইউনিয়নের মৌটুসী গ্রামে নতুন একটি বাড়ি তৈরি করে দেয়া হয়) তাঁর জন্ম। পিতার নাম মো. হাবিবুর রহমান এবং মাতা মোছা. মালেকা বেগম। পিতা সেনাবাহিনীর হাবিলদার ছিলেন। এজন্য হাবিব মিলিটারি নামে সর্বমহলে তিনি পরিচিত ছিলেন।
ছেলেবেলা থেকেই মোস্তফা কামালের প্রবল ইচ্ছা ছিল সৈনিক হওয়ার। তাই লেখাপড়া বেশিদূর অগ্রসর হয়নি। স্কুলে ছাত্র থাকা অবস্থায় ১৯৬৭ সালের শেষের দিকে বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়ে তিনি ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে যোগ দেন। ট্রেনিং শেষে ১৯৬৮ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ৪র্থ ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টে তাঁর পোস্টিং হয়। এরপর তাঁর পিতা-মাতা পুত্রের সন্ধান পান।
মুক্তিযুদ্ধের সময় ব্রাহ্মণবাড়িয়া ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধক্ষেত্র। ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি ৪র্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের এক কোম্পানি সৈন্যসহ মেজর সাফায়াত জামিল, বীর বিক্রমকে কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট থেকে এখানে পাঠানো হয়। উদ্দেশ্য, বাঙালি সৈন্যরা যাতে পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে কোনোপ্রকার প্রতিরোধ গড়ে তুলতে না পারে। একইভাবে ২৫শে মার্চের অপারেশন সার্চলাইট শুরুর একদিন পূর্বে বেঙ্গল রেজিমেন্টের কিছুসংখ্যক সৈন্যসহ মেজর খালেদ মোশাররফ, বীর উত্তমকে পাঠানো হয় সিলেটের শমসেরনগরে। পাকিস্তানিদের দুরভিসন্ধি বুঝতে তাঁদের সময় লাগেনি। ২৫শে মার্চের ক্রাকডাউনের সঙ্গে-সঙ্গে খালেদ মোশাররফ পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ও বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য ঘোষণা করে তাঁর বাহিনী নিয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার দিকে অগ্রসর হন। এখানে পৌছে সাফায়াত জামিলের সঙ্গে যৌথভাবে হানাদারদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট থেকে আগত লে. কর্নেল খিজির হায়াত খান ও অন্যান্য পাকিস্তানি অফিসার ও জওয়ানদের বন্দি করা হয়। এপ্রিলের মাঝামাঝি পর্যন্ত এ অঞ্চলকে তাঁরা মুক্ত রাখতে সক্ষম হন। মোস্তাফা কামাল ছিলেন মেজর সাফায়েত জামিলের কোম্পানিতে তিনি তাঁর নেতৃত্বে অসীম সাহসিকতার সঙ্গে এখানকার প্রতিরোধ যুদ্ধে অংশ নেন। ১৪ই এপ্রিল পাকিস্তানি হানাদাররা হেলিকপ্টার গানশিপ, নেভাল গানবোট, বম্বার্ড বিমান নিয়ে একযোগে ব্রাহ্মণবাড়িয়া-আশুগঞ্জ অঞ্চলে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরোধ ঘাঁটিতে তীব্র আক্রমণ করে। হেলিকপ্টার দিয়ে অসংখ্য সৈন্য নামানো হয়। বেশ কয়েক ঘণ্টা ধরে হানাদারদের সঙ্গে প্রতিরোধযোদ্ধাদের যুদ্ধ চলে। তাদের ভারী অস্ত্রশস্ত্রের সম্মুখে মুক্তিযোদ্ধাদের টিকে থাকা সম্ভব ছিল না৷ তাই কৌশলগত কারণে তাঁরা আখাউড়ায় পশ্চাদপসরণ করে তিতাস নদীর ব্রিজ, গঙ্গাসাগর ও তার উত্তরে দরুইন গ্রামে নতুন প্রতিরক্ষা ঘঁটি গড়ে তোলেন। মোস্তফা কামালের সাহস, বুদ্ধিমত্তা ও কর্মতৎপরতায় মুগ্ধ হয়ে মেজর সাফায়াত জামিল তাঁকে সেকশন কমান্ডার করে দরুইন গ্রামের প্রতিরক্ষা ঘাঁটির দায়িত্ব দেন। তাঁর সঙ্গে ছিল মাত্র ১০ জন সৈন্য। ১৭ই এপ্রিল শত্রুসেনারা দরুইন ঘাঁটিতে আক্রমণ চালায়। দিনভর যুদ্ধ চলে। এক পর্যায়ে মোস্তফা কামালের সাহায্যার্থে আরো কিছু মুক্তিসেনা যোগ দেন। ১৮ই এপ্রিল ছিল যুদ্ধের চূড়ান্ত দিন। শত্রুরা ক্ষীপ্র গতিতে স্থানীয় মোগরা বাজার ও গঙ্গাসাগর এলাকায় অবস্থান নেয়। একটি উঁচু দালানের ছাদে মেশিনগান বসিয়ে সেখান থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের দরুইন ঘাঁটির দিকে অবিরাম গোলাবর্ষণ করতে থাকে। সৈন্যসংখ্যা ও অস্ত্র বিচারে এটি ছিল একেবারেই অসম যুদ্ধ। শত্রুরা তিনদিক থেকে গ্রামটি ঘিরে ফেলে। মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য হয় শত্রুর হাতে নিশ্চিত মৃত্যু, না হয় পশ্চাদপসরণ এ ভিন্ন অন্য কোনো পথ ছিল না। মোস্তফা কামাল সবাইকে পিছু হটার নির্দেশ দিয়ে নিজে ট্রেঞ্চের মধ্য থেকে এলএনজি দিয়ে কভারিং ফায়ার করতে থাকেন। এভাবে সহযোদ্ধারা সবাই নিরাপদ স্থানে চলে যেতে সক্ষম হন বটে, কিন্তু শত্রুর ব্রাশ ফায়ারের আঘাতে মোস্তফা কামালের সমগ্র শরীর ঝাঁঝরা হয়ে যায়। এরপর হানাদাররা বেয়নেট চার্জ করে। পরিখার মধ্যেই পড়ে থাকে তাঁর ক্ষত- বিক্ষত দেহ। যুদ্ধ শেষে পাকসেনারা ঐ স্থান থেকে চলে গেলে স্থানীয় লোকজন তাঁর দেহ উদ্ধার করে দরুইনের মাটিতে এ বীর সন্তানকে সমাহিত করে।
মহান মুক্তিযুদ্ধে অসীম সাহসিকতা প্রদর্শন ও নিজের জীবন উৎসর্গ করার জন্য সরকার শহীদ মোস্তফা কামাল-কে সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মাননা ‘বীরশ্রেষ্ঠ’ উপাধিতে ভূষিত করে। এছাড়া আখাউড়ায় স্থাপন করা হয় বীরশ্রেষ্ঠ মোস্তফা কামাল স্মৃতি কমপ্লেক্স। ভোলা সদরের আলীনগর ইউনিয়ন অন্তর্ভুক্ত মৌটুসী গ্রামের নামকরণ করা হয় কামালনগর। ভোলা সদরে তাঁর নামে একটি কলেজ এবং কলেজ প্রাঙ্গণে বীরশ্রেষ্ঠ মোস্তফা কামাল লাইব্রেরি ও জাদুঘর প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। [হারুন-অর-রশিদ]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৮ম খণ্ড