You dont have javascript enabled! Please enable it! বীর প্রতীক মোহাম্মদ আব্দুল মতিন - সংগ্রামের নোটবুক

বীর প্রতীক মোহাম্মদ আব্দুল মতিন

মোহাম্মদ আব্দুল মতিন, বীর প্রতীক (জন্ম ১৯৪৪) বীর মুক্তিযোদ্ধা। তিনি ১৯৪৪ সালের ৬ই ফেব্রুয়ারি কিশোরগঞ্জ জেলার তাড়াইল উপজেলার কাজলা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম মুন্সি আব্দুল গনি এবং মাতার নাম রওশন আরা বেগম৷ তিনি ১৯৫৯ সালে নিয়ামতপুর হাইস্কুল থেকে এসএসসি, ১৯৬১ সালে সরকারি গুরুদয়াল কলেজ থেকে এইচএসসি এবং ১৯৬৩ সালে একই কলেজ থেকে স্নাতক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ১৯৬৪ সালে তিনি পাকিস্তান মিলিটারি একাডেমিতে ক্যাডেট হিসেবে যোগ দেন। পশ্চিম পাকিস্তানের এবোটাবাদের কাকুল মিলিটারি একাডেমি থেকে সফলতার সঙ্গে কোর্স সমাপ্তির পর ১৯৬৫ সালে তিনি কমিশন প্রাপ্ত হন এবং পশ্চিম পাকিস্তানের মুলতান সেনানিবাসের আরমার ডিভিশনে সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট হিসেবে যোগদান করেন।
১৯৭১ সালে আব্দুল মতিন পশ্চিম পাকিস্তানের কেম্বলপুর সেনানিবাসে ক্যাপ্টেন পদে কর্মরত ছিলেন। এ বছর ফেব্রুয়ারি মাসে তিনি ছুটি কাটাতে কিশোরগঞ্জের নিজ গ্রামে আসেন। ২৫শে মার্চ পাকিস্তানি বাহিনী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে নিরস্ত্র বাঙালিদের ওপর ব্যাপক গণহত্যা ও নির্যাতন শুরু করলে কে এম সফিউল্লাহ, বীর উত্তম-এর নেতৃত্বে ২য় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট পাকিস্তানি সেনাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে প্রতিরোধযুদ্ধ শুরু করে। ২৯শে মার্চ এই রেজিমেন্ট কিশোরগঞ্জ পৌঁছলে আব্দুল মতিন এতে যোগ দিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন।
২রা এপ্রিল থেকে আব্দুল মতিন ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের কোম্পানি কমান্ডার হিসেবে ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও সিলেট জেলার আশুগঞ্জ সংলগ্ন লালপুর, শাহবাজপুর, মাধবপুর এবং তেলিয়াপাড়া চা-বাগান এলাকায় প্রতিরোধযুদ্ধ পরিচালনা করেন। এসব যুদ্ধের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হবিগঞ্জ জেলার মাধবপুরের যুদ্ধ, যা ২৮শে এপ্রিল সংঘটিত হয়। এদিন সকালে পাকিস্তানি বাহিনীর একটি ব্যাটালিয়ন আব্দুল মতিনের প্রতিরক্ষা অবস্থানে তিনদিক থেকে ব্যাপক গোলাবর্ষণ শুরু করে। বিকেলে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর আরেকটি ব্যাটালিয়ন তাদের সঙ্গে যোগ দিলে পরিস্থিতি ভয়াবহ হয়ে ওঠে। তবে আব্দুল মতিন বিচলিত না হয়ে সহযোদ্ধাদের নিয়ে শত্রুসেনাদের আক্রমণ দৃঢ়তার সঙ্গে প্রতিহত করেন।
সেক্টরভিত্তিক মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে আব্দুল মতিন ৩ নম্বর সেক্টরের সিমলা সাব-সেক্টরের অধিনায়কের দায়িত্ব পালন করেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে হবিগঞ্জ জেলার তেলিয়াপাড়া চা-বাগান মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান ছিল। এপ্রিল মাসের ৪ তারিখ -এম এ জি ওসমানী, কে এম সফিউল্লাহ, লে. কর্নেল আব্দুর রব, বীর উত্তম, মেজর কাজী নূরুজ্জামান, বীর উত্তম, মেজর খালেদ মোশাররফ, বীর উত্তম, মেজর শাফায়াত জামিল, বীর বিক্রম, মেজর মইনুল হোসেন চৌধুরী, বীর বিক্রম, ক্যাপ্টেন আব্দুল মতিন এবং আরো অনেক বাঙালি সামরিক অফিসার উপস্থিত হয়ে কেন্দ্রীয়ভাবে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। তাই এ স্থানটি কৌশলগত কারণে দখলে রাখা মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ ছিল। পাকিস্তানি সেনাদের আক্রমণে ৩ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধারা ক্রমেই তেলিয়াপাড়া থেকে সীমান্তবর্তী এলাকায় চলে যেতে বাধ্য হলেও আব্দুল মতিনের নেতৃত্বে তেলিয়াপাড়া চা-বাগান তাঁদের দখলে রাখতে সক্ষম হন। যুদ্ধের এক পর্যায়ে পাকিস্তানি বাহিনীর ৩৩ বেলুচ রেজিমেন্টের দু-কোম্পানি সৈন্য অতর্কিতে আক্রমণ করে তেলিয়াপাড়া চা-বাগান দখল করে নেয়। তবে পাকবাহিনী তাদের এই দখলকে সুসংহত করার পূর্বেই আব্দুল মতিনের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা পাল্টা আক্রমণ করে পাকসেনাদের হটিয়ে পুনরায় তেলিয়াপাড়া চা-বাগান তাঁদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসেন৷
মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত পর্যায়ে ব্রিগেড আকারে ‘এস’ ফোর্স গঠন করা হলে আব্দুল মতিন ১১তম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ব্রাভো কোম্পানির অধিনায়ক হিসেবে মাধবপুর, শাহবাজপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও আশুগঞ্জে সংঘটিত সম্মুখ যুদ্ধে বীরত্বের সঙ্গে অংশগ্রহণ করেন।
মহান মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ বাংলাদেশ সরকার আব্দুল মতিনকে ‘বীর প্রতীক’ খেতাবে ভূষিত করে (গেজেট নং ২৫৩, খেতাবের সনদ নং ০৩)। মুক্তিযুদ্ধ শেষে তিনি তাঁর কর্মস্থল বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে যোগদান করেন এবং ১৯৮৬ সালে মেজর জেনারেল পদে উন্নীত হন। ১৯৯৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে সেনাবাহিনী থেকে অবসর গ্রহণ করার পর তিনি চট্টগ্রামে নিজস্ব উদ্যোগে একটি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। ২০০৩ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত তিনি ব্যুরো অব এন্টি করাপশন (বর্তমান দুর্নীতি দমন কমিশন)-এ যোগ দেন। ২০০৭-২০০৮ সালে তিনি নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হিসেবে স্বরাষ্ট্র, নৌ- পরিবহণ ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করেন। ব্যক্তিজীবনে তিনি এক কন্যা সন্তানের জনক। তাঁর স্ত্রীর নাম শওকত আরা মতিন। [সাজাহান মিয়া]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৮ম খণ্ড