You dont have javascript enabled! Please enable it! মুক্তিযুদ্ধে মোহনগঞ্জ উপজেলা (নেত্রকোনা) - সংগ্রামের নোটবুক

মুক্তিযুদ্ধে মোহনগঞ্জ উপজেলা (নেত্রকোনা)

মোহনগঞ্জ উপজেলা (নেত্রকোনা) বাঙালির জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা মুক্তিযুদ্ধ। আর এ মুক্তিযুদ্ধে নেত্রকোনা জেলার মোহনগঞ্জ উপজেলার মানুষ উল্লেখযোগ্য অবদান রাখে। ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর ঐতিহাসিক ভাষণের পর থেকে সারাদেশের মতো মোহনগঞ্জেও মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি শুরু হয়। বিভিন্ন গ্রাম থেকে প্রতিদিন ছাত্র-যুবক, কৃষক-শ্রমিক ও সাধারণ জনতা লাঙ্গল, জোয়াল, কোদাল, লাঠি, বল্লম প্রভৃতি নিয়ে মিছিল করে মোহনগঞ্জ শহরে আসতে শুরু করে। ভাটি বাংলার রাজধানীখ্যাত মোহনগঞ্জ মিছিলের শহরে পরিণত হয়। আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, ন্যাপ- প্রভৃতি প্রগতিশীল রাজনৈতিক ও ছাত্র সংগঠনের কর্মীরা সংগঠিত হতে থাকে। ডা. আখলাকুল হোসাইনকে আহ্বায়ক এবং আব্দুল কদ্দুছ আজাদকে সদস্যসচিব করে মোহনগঞ্জ থানা সংগ্রাম কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির সদস্যরা ছাত্র-যুবক-জনতাকে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে উদ্বুদ্ধ করেন। মোহনগঞ্জের ৩৩৯ জন মুক্তিযোদ্ধা সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন।
২৫শে মার্চ ঢাকায় পাকবাহিনীর নির্মম গণহত্যার পর মোহনগঞ্জ গার্লস স্কুল প্রাঙ্গণে ছাত্র-যুবকদের গেরিলা প্রশিক্ষণ শুরু হয়। আওয়ামী লীগ ও ন্যাপ-এর নেতারা বাঙালি পুলিশ সদস্যদের সহায়তায় থানার আগ্নেয়াস্ত্র গেরিলা প্রশিক্ষণের জন্য ছাত্র-যুবকদের হাতে তুলে দেন। পানুর গ্রামের মোবারক আলী খান ও আনসার কমান্ডার আব্দুল হামিদ গেরিলা প্রশিক্ষণ পরিচালনা করেন। মোহনগঞ্জে পাকবাহিনী আসার পূর্ব পর্যন্ত আওয়ামী লীগ ও ন্যাপ এ দুই দলের এবং ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়ন-এর নেতা-কর্মীদের গেরিলা প্রশিক্ষণ চলে। পরে মোহনগঞ্জের মুক্তিযোদ্ধারা মহেশখলা ইয়ুথ ক্যাম্প থেকে নিয়োগ নিয়ে ভারতের তুরা, দেরাদুন ও হাফলংয়ে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন।
মোহনগঞ্জে আওয়ামী লীগের যে-সকল নেতা মুক্তিযুদ্ধের শীর্ষস্থানীয় সংগঠক হিসেবে ভূমিকা রাখেন, তাঁরা হলেন- আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতা ও জাতীয় পরিষদ সদস্য আব্দুল মমিন, ডা. আখলাকুল হোসাইন (গণপরিষদ সদস্য), থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি মোফাজ্জল হোসেন খান চৌধুরী ছদ্দু মিয়া, থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল কদ্দুছ আজাদ, আব্দুল ওয়াহেদ, আমীর উদ্দিন আহমেদ, আবুল হাসেম, আব্দুল মজিদ, ছাত্রলীগ নেতা গোলাম এরশাদুর রহমান প্ৰমুখ। ন্যাপের পক্ষে মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক হিসেবে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখেন সৈয়দ গেদু মিয়া, জালাল উদ্দিন আহমেদ, ইউনিয়নের মুহাম্মদ আব্দুল বারী প্ৰমুখ। ন্যাপ, কমিউনিস্ট পার্টি এবং ছাত্র ইউনিয়নের গেরিলা বাহিনীতে আরো ছিলেন ইমদাদুর রহমান, মোহাম্মদ শাহজাহান, আব্দুল হেকিম, দ্বিজেশ চক্রবর্তী বাচ্চু প্রমুখ। ৩০শে এপ্রিল পাকবাহিনী অতর্কিতে মোহনগঞ্জে অনুপ্রবেশ করে থানায় ক্যাম্প স্থাপন করে।
পাকবাহিনীকে সহায়তাদানের জন্য মোহনগঞ্জের কয়েকজন মুসলিম লীগ নেতা শান্তি কমিটি গঠন করে। তাদের নেতৃত্বে রাজাকার ও আলবদর- বাহিনী গড়ে ওঠে। মোহনগঞ্জে শান্তি কমিটি বেশ সক্রিয় ছিল। এ কমিটির প্রধান ছিল আবুল হোসেন শেখ। অন্য সদস্যদের মধ্যে ছিল- আ. খালেক, লাল হোসেন, সোনামদী খাঁ, আ. আজিজ নায়েব, আব্দুল হাই ক্বারী মিয়া, মাহতাব উদ্দিন, ইব্রাহিম, হাবিবুর রহমান সম্রাট, আব্দুল খালেক, চান মিয়া, করিম নেওয়াজ খাঁ, চুন্নু মিয়া, নজরুল শেখ, রবিউল্লাহ, আব্দুস সাত্তার, আশরাফ আলী চৌধুরী, আব্দুর রেজ্জাক, গিয়াস উদ্দিন, আমজাদ মিয়া, ছোয়াব উদ্দিন প্রমুখ। এছাড়া হাদী বাবু-সহ স্থানীয় বিহারিদের অনেকে শান্তি কমিটির সদস্য ও পাকবাহিনীর সহযোগী হিসেবে কাজ করে।
পাকবাহিনী রাজাকারদের সহায়তায় কাজিহাটি গ্রামে অবস্থিত আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতা আব্দুল মমিন এমএনএ-এর বাড়িসহ গ্রামের অন্য কয়েকটি বাড়িতে হানা দেয়। মুক্তিযুদ্ধের মাঝামাঝি সময়ে পাকবাহিনী বাহাম গ্রামের সৈয়দ আলীর বাড়িতে হানা দিয়ে তার কয়েকজন আত্মীয়কে ধরে স্থানীয় কংস নদীর পাড়ে অবস্থিত শ্মশানঘাটে নিয়ে তাদের ওপর গুলি চালায়। এতে আব্দুন নূর ও শওকত আলী নামে দুজন ঘটনাস্থলে শহীদ হন। এছাড়া নূরুল আমিন, আব্দুস সাত্তার ও শুক্কুর আলী এ ৩ জন মারাত্মকভাবে আহত হন। এরা ছিলেন পার্শ্ববর্তী ধর্মপাশা থানার বাখরপুর গ্রামের অধিবাসী। পাকহানাদাররা টেঙ্গাপাড়ার হাজী বাড়ি থেকে ধর্মপাশা থানার মধিপুর গ্রামের রহমত আলী ও শামছু মিয়াকে ধরে নিয়ে গুলি করে হত্যা করে। মুক্তিযোদ্ধাদের সন্ধানে তারা মাঘান গ্রামে প্রবেশ করে সমস্ত গ্রাম পুড়িয়ে দেয়। একইভাবে বড়তলি গ্রামটিও হানাদারদের দেয়া আগুনে ভস্মীভূত হয়। পাকহানাদার বাহিনী ও তাদের দোসররা বড়কাশিয়া গ্রামের রমজান আলী, সুরুজ মিয়া, মাইলোড়া গ্রামের আব্দুল মালেক, আব্দুল ওয়াহিদ ও আব্দুল মোমিনের বাড়ি এবং বিরামপুর গ্রামের চিত্তরঞ্জন সরকারের বাড়ি ও একটি মন্দির পুড়িয়ে দেয়। তারা মোহনগঞ্জ বাজার, মাইলোড়া, কাজীরোড, খুরশিমূল প্রভৃতি গ্রামে ব্যাপক লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটায়। মাইলোড়া গ্রামের একজন হিন্দু নারী পাকবাহিনী ও রাজাকারদের দ্বারা গণধর্ষণের শিকার হন। মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাস জুড়ে মোহনগঞ্জ থানার বিভিন্ন গ্রামের অনেক মানুষ পাকবাহিনী ও তাদের দোসরদের হাতে এভাবে নিহত হন। নিহতদের মধ্যে আরো যাঁদের পরিচয় জানা গেছে, তাঁরা হলেন— মাইলোড়া গ্রামের সতীশ চন্দ্র রায়, গিয়াস উদ্দিন, নজির হোসেন, তোতা মিয়া, জানু মিয়া, দৌলতপুর গ্রামের সন্তোষ চন্দ্র রায়, ছানা দত্ত, বড়তলি গ্রামের হেমেন্দ্র চন্দ্র সরকার, মোহনগঞ্জ সদরের ডা. আব্দুছ ছোবান এবং মাঘান গ্রামের মো. ইসকান্দর।
মোহনগঞ্জ থানা ভবনটিকে পাকবাহিনী তাদের নির্যাতনকেন্দ্র ও বন্দিশিবির হিসেবে ব্যবহার করে। পাকবাহিনী ও তাদের দোসররা মোহনগঞ্জের কংস নদের তীরে অবস্থিত শ্মশানঘাটটিকে বধ্যভূমি হিসেবে ব্যবহার করে। এটি মোহনগঞ্জ শ্মশানঘাট বধ্যভূমি হিসেবে পরিচিত। এখানে নিরীহ বাঙালিদের এনে হত্যা করা হতো।
মুক্তিযুদ্ধকালে ইপিআর-এর সুবেদার ফজলুর রহমানের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি গ্রুপ গাগলাজুরের কাছে ধনু নদীতে পাকবাহিনীর রসদ বোঝাই একটি লঞ্চ বিধ্বস্ত করে। জুন মাসের শেষদিকে মুক্তিযোদ্ধাদের কয়েকটি দল প্রশিক্ষণ শেষে মোহনগঞ্জের বিভিন্ন গ্রামে আশ্রয় নেয়। মুক্তিযোদ্ধারা পাকবাহিনী যেখানে হানা দেয় সেখানেই পাল্টা প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। এভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরোধের মুখে পাকবাহিনীর গতিবিধি এক পর্যায়ে সীমিত হয়ে পড়ে।
ডিসেম্বর মাসের প্রথমদিকে মোহনগঞ্জ থানাকে শত্রুমুক্ত করার লক্ষ্যে চূড়ান্ত প্রস্তুতি গ্রহণকালে পাকসেনারা কোম্পানি কমান্ডার গোলাম মৌলাকে বন্দি করে তাঁর ওপর অমানবিক নির্যাতন চালায়। তাঁকে উদ্ধারের জন্য মুক্তিযোদ্ধাদের কয়েকটি দল একত্রিত হয়ে থানা ক্যাম্প আক্রমণের প্রস্তুতি নেয়। এ প্রস্তুতিতে অংশ নেন গোলাম মৌলা কোম্পানির প্লাটুন কমান্ডার মহব্বত আলী, মাহবুব আলম কোম্পানির প্লাটুন কমান্ডার মোহন খান, কোম্পানি কমান্ডার আহাম্মদ আলী চৌধুরী হীরা এবং কোম্পানি কমান্ডার আজিজুল হক চৌধুরী (ইসহাক মিয়া) ও তাঁদের দল। মুক্তিযোদ্ধাদের এ প্রস্তুতির খবর পেয়ে পাকবাহিনী ৭ই ডিসেম্বর রাতে গোলাম মৌলাকে আহত অবস্থায় রেখে ক্যাম্প ছেড়ে পালিয়ে যায়।
ডিসেম্বরের প্রথম থেকে মুক্তিবাহিনী পাক হানাদারদের চারদিক থেকে ঘিরে ফেলে এবং থানা ক্যাম্প আক্রমণের প্রস্তুতি নেয়। এছাড়া নেত্রকোনা-মোহনগঞ্জ সড়কে অবস্থিত ঠাকুরাকোনা রেলওয়ে সেতু-সহ নেত্রকোনা মহকুমা সদরে যাতায়াতের সব রাস্তা বন্ধ করে দেয়া হয়। ফলে হানাদার ক্যাম্পে খাবার ও রসদ সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়। একদিকে মুক্তিবাহিনীর চাপ, অন্যদিকে খাদ্য সঙ্কট ও সামগ্রিক যুদ্ধ পরিস্থিতিতে ৭ই ডিসেম্বর রাতে পাক হানাদাররা মোহনগঞ্জ ছেড়ে নেত্রকোনায় চলে যায়। ৮ই ডিসেম্বর মোহনগঞ্জ হানাদারমুক্ত হয়। এদিন রাজাকারদের অনেকে জনতার হাতে ধরা পড়ে। কয়েকজন গণপিটুনিতে নিহত হয়। ২২শে ডিসেম্বর মোহনগঞ্জ সদরের লোহিয়ার মাঠে দালাল- রাজাকারদের বিরুদ্ধে গণআদালত বসে।
মুক্তিযুদ্ধে মোহনগঞ্জের ৬ জন বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। তাঁরা হলেন— একদিল হোসেন (পিতা আব্দুল খালেক, বরান্তর; ইসলাম উদ্দিন খান কালা মিয়া কোম্পানির মুক্তিযোদ্ধা; দুর্গাপুরের বিজয়পুর সীমান্ত ক্যাম্পের যুদ্ধে শহীদ), আলী উসমান (পিতা আব্দুল জব্বার, পানুর; মোবারক আলী কোম্পানির মুক্তিযোদ্ধা; কলমাকান্দা যুদ্ধে শহীদ), নূর হোসেন (পিতা আব্দুল হেকিম, পালগাঁও; গোলাম মৌলা কোম্পানির মুক্তিযোদ্ধা; শিববাড়ি ক্যাম্প যুদ্ধে শহীদ), আনোয়ার আলম খান চৌধুরী কামাল (পিতা মোফাজ্জল হোসেন খান চৌধুরী, টেঙ্গাপাড়া; গোলাম এরশাদুর রহমান খানের নেতৃত্বাধীন বিএলএফ – কোম্পানির মুক্তিযোদ্ধা; ফাংগা ক্যাম্পে শহীদ), সিপাহি নূরুল হুদা সিদ্দিক (পিতা খালেক নেওয়াজ, নলজুরি; কুমিল্লায় শহীদ) এবং ক্রিড়াবিদ দবির উদ্দিন (পিতা ডা. মোশারফ হোসেন, টেঙ্গাপাড়া; বিএলএফ কোম্পানির মুক্তিযোদ্ধা, নেত্রকোনা সদরে শহীদ)।
১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ কালরাতে ঢাকায় পাকবাহিনীর নির্মম হত্যাযজ্ঞে শহীদ হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. ফজলুর রহমান। তাঁর গ্রামের বাড়ি মোহনগঞ্জের টেঙ্গাপাড়া গ্রামে। ১৯৭৫ সালে মোহনগঞ্জ পৌরসভার প্রধান সড়কটির নামকরণ করা হয় শহীদ এফ রহমান রোড। স্বাধীনতার পর মোহনগঞ্জের ছেছড়াখালি বাজারে শহীদ স্মৃতি উচ্চ বিদ্যালয় এবং করাচাপুর গ্রামে মুক্তিযোদ্ধা স্মৃতি নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয় নামে দুটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠিত হয়। শহীদ মুক্তিযোদ্ধা আলী উসমানের নামে লোহিয়ার মাঠে পৌরসভার উদ্যোগে একটি শিশু পার্কের নামকরণ করা হয়েছে। এ পার্কের অভ্যন্তরে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের উদ্যোগে মুক্তিযোদ্ধা মুক্তমঞ্চ নির্মাণ করা হয়েছে। [সঞ্জয় সরকার]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৮ম খণ্ড