বীর বিক্রম মোহর আলী
মোহর আলী, বীর বিক্রম (১৯৪৭-১৯৭১) নায়েক ও শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধা। তিনি ১৯৪৭ সালে চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার নামুশংকরবাটি ইউনিয়নের নয়নসুখা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম সোলেমান মণ্ডল এবং মাতার নাম সায়মা খাতুন।
নায়েক মোহর আলী পাকিস্তান সেনাবাহিনীত চাকরিরত ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের প্রাক্কালে তাঁর পোস্টিং ছিল চট্টগ্রামের ৮ম বেঙ্গল রেজিমেন্টে। ২৫শে মার্চ রাতে পাকিস্তানি সৈন্যরা নিরস্ত্র বাঙালিদের হত্যায় ঝাঁপিয়ে পড়ে। একই সময়ে চট্টগ্রামের হালিশহরে ইবিআরসি-তে পাকবাহিনী বেলুচ রেজিমেন্ট ৮ম বেঙ্গলের ঘুমন্ত বাঙালি সেনাদের ওপর সশস্ত্র আক্রমণে ঝাঁপিয়ে পড়ে। তাতে বহু বাঙালি সেনাসদস্য নিহত হন। অন্যরা পালিয়ে আত্মরক্ষা করেন। তাঁদের মধ্যে নায়েক মোহর আলীও ছিলেন। চট্টগ্রামের বিভিন্ন স্থানে প্রতিরোধ সংগ্রামে তিনি যোগ দেন। এরপর অনেকে সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে যান। তিনি তাঁদের সঙ্গে ভারতে না গিয়ে নিজ এলাকা চাঁপাইনবাবগঞ্জে চলে যান। তিনি কাজী নুরুজ্জামানের নেতৃত্বে ৭নং সেক্টরে যুদ্ধে যোগ দিয়ে সাহসিকতার সঙ্গে বিভিন্ন স্থানে পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করেন। ক্যাপ্টেন গিয়াস উদ্দিনের নেতৃত্বে ৭নং সেক্টরের লালগোলায় তিনি যুদ্ধ করেন। ক্যাপ্টেন গিয়াস ছিলেন পাকবাহিনীর কাছে এক মূর্তিমান আতঙ্ক। তাঁর নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল নবাবগঞ্জ থানার অন্তর্গত পাকিস্তানি হানাদারদের রাধাকান্তপুরহাট ঘাঁটি আক্রমণ করে। নায়েক মোহর আলী এ আক্রমণে সক্রিয় ভূমিকা রাখেন। এ যুদ্ধে রাধাকান্তপুরহাট ঘাঁটি শত্রুমুক্ত হয়। এতে ৭ জন পাকসেনা ও ১১ জন রাজাকার নিহত হয়৷ অপরদিকে, মুক্তিবাহিনীর নায়েক আরশাদ আলী শহীদ এবং কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা আহত হন। ক্যাপ্টেন গিয়াসের তত্ত্বাবধানে মুক্তিযোদ্ধাদের অপর একটি দল ইসলামপুর পাকিস্তানি ঘাঁটিতে আক্রমণ চালায়। এটি ছিল পাকসেনাদের সুরক্ষিত ও শক্ত একটি ঘাঁটি। ডিসেম্বরের প্রথমদিকে এ আক্রমণ চলে। মুক্তিযোদ্ধারা তিন ভাগে ভাগ হয়ে তিন দিক থেকে আক্রমণ চালান। তাঁদের সপোর্টে ভারতের এবং মিত্রবাহিনী মর্টারের গোলাবর্ষণ করতে থাকে। তুমুল যুদ্ধে পাকসেনাদের পর্যুদস্ত করা যাচ্ছিল না। মুক্তিসেনারা যুদ্ধের কৌশল পাল্টান। মোহর আলীসহ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা ক্রলিং করে গ্রেনেড নিয়ে শত্রুর বাঙ্কারের একেবারে নিকটে পৌছে যান। মোহর আলীর ছোড়া প্রথম গ্রেনেডে পাকসেনাদের একটি বাঙ্কার ধ্বংস হয়ে যায়, সেখান থেকে গুলিবর্ষণথেমে যায়। মোহর আলী লক্ষ করেন তাঁর সহযোদ্ধারা পাশে নেই। তিনি তখন একা। চরম সাহসিকতার সঙ্গে তিনি পরবর্তী বাঙ্কারে গ্রেনেড ছোড়ার সময় তাঁকে লক্ষ করে শত্রুপক্ষের নিক্ষিপ্ত গুলিতে তাঁর দেহ ক্ষতবিক্ষত হয়ে যায়। শহীদ হন বীর মুক্তিযোদ্ধা মোহর আলী। তবে এ ঘাঁটি দখলের যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধারা সফল হন। শতাধিক পাকসেনা হতাহত হয়। ৩০ জন রাজাকার বন্দি হয় এবং পরে আরো ৫০ জন আত্মসমর্পণ করে। মোহর আলীসহ ১০ জন মুক্তিযোদ্ধা এখানে শহীদ হন এবং কয়েকজন আহত হন। পাকসেনারা চরম মার খেয়ে ইসলামপুর ছেড়ে চাঁপাইনবাবগঞ্জের মূল ঘাঁটিতে একত্রিত হয়। ইসলামপুরের যুদ্ধ শেষে মুক্তিযোদ্ধা ও গ্রামবাসী মিলে শহীদ মোহর আলী ও অন্য শহীদদের মৃতদেহ ইসলামপুরের কাছে সীমান্ত সংলগ্ন গ্রামে সমাহিত করেন।
মহান মুক্তিযুদ্ধে আত্মোৎসর্গ করায় বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক মোহর আলী-কে ‘বীর বিক্রম’ (মরণোত্তর) উপাধিতে ভূষিত করা হয়। তিনি ছিলেন অবিবাহিত। [শেখ সাইয়েদুল ইসলাম]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৮ম খণ্ড