বীর প্রতীক মোহাম্মদ আব্দুর রশীদ
মোহাম্মদ আব্দুর রশীদ, বীর প্রতীক (১৯৪৪-১৯৮১) বীর মুক্তিযোদ্ধা। তিনি ১৯৪৪ সালের ২২শে জুলাই পিতার কর্মস্থল রাজশাহী শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম আব্দুল খালেক এবং মাতার নাম আনোয়ারা খাতুন। তিনি ১৯৬১ সালে ঢাকার রায়ের বাজার হাইস্কুল থেকে এসএসসি এবং ১৯৬৩ সালে ঢাকা কলেজ থেকে এইচএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ১৯৬৫ সালে তিনি পাকিস্তান সামরিক বাহিনীতে ক্যাডেট হিসেবে যোগদান করেন। ১৯৬৬ সালের আগস্ট মাসে তিনি পাকিস্তান মিলিটারি একাডেমি (কাকুল) থেকে সফলতার সঙ্গে প্রশিক্ষণ শেষ করে কমিশন প্রাপ্ত হন। তারপর তাঁকে পোস্টিং দেয়া হয় ১৭ ফ্রন্টিয়ার ফোর্স পাঞ্জাবে।
১৯৭১ সালে আব্দুর রশীদ ক্যাপ্টেন পদে প্রেষণে রাজশাহী ক্যাডেট কলেজ এডজুট্যান্ট হিসেবে কর্মরত ছিলেন। ২৫শে মার্চ রাতে পাকিস্তানি সেনারা অপারেশন সার্চলাইট নামে ঢাকাসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে নিরস্ত্র বাঙালিদের ওপর নির্মম গণহত্যা ও নির্যাতন শুরু করলে তিনি বিদ্রোহ করে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। তিনি রাজশাহী সারদা পুলিশ একাডেমির পুলিশ বাহিনী ও রাজশাহীতে কর্মরত ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস (ইপিআর)-এর বাঙালি সদস্যদের সংগঠিত করে একটি মুক্তিযোদ্ধা দল গঠন করেন এবং রাজশাহীতে অবস্থিত পাকিস্তানি সৈন্যদের আক্রমণ করে ৩০শে মার্চ পর্যন্ত অবরুদ্ধ করে রাখেন। অবরুদ্ধ পাকিস্তানি সৈন্যদের উদ্ধাদের জন্য ২৫ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের এক কোম্পানি সৈন্য গোপালপুর পৌঁছানোর পর আব্দুর রশীদের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা তাদের ওপর প্রচণ্ড আক্রমণ চালান। এতে মেজর আসলাম ও ক্যাপ্টেন ইসহাকসহ ৪০জন পাকসেনা নিহত হয় এবং অন্যরা পালিয়ে যায়। পলায়নরত পাকসেনাদের একটি অংশ ৩০শে মার্চ আড়ানি রেল স্টেশনে পৌঁছলে আব্দুর রশীদের দল সকলকে হত্যা করে। এছাড়াও তাঁর নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা ৬ই এপ্রিল রাজশাহী শহরে পাকসেনাদের অবস্থানের ওপর আক্রমণ করলে তাদের অনেক ক্ষয়ক্ষতি হয় এবং মুক্তিযোদ্ধারা শত্রুসেনাদের প্রচুর গোলাবারুদ ও অস্ত্রশস্ত্র দখলে নেন।
পরবর্তীতে সেক্টরভিত্তিক মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে আব্দুর রশীদ ৭নং সেক্টরের শেখপাড়া সাব-সেক্টরের অধিনায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এই সাব-সেক্টরের অধীনে ছিল রাজশাহী জেলার দুর্গাপুর, পুঠিয়া, চারঘাট ও বাঘা উপজেলা। এসব এলাকার পাকসেনাদের অবস্থান অত্যন্ত সুরক্ষিত হলেও আব্দুর রশীদের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা পাকসেনাদের ব্যাপক ক্ষতি সাধন করেন। তাঁর নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা বাঘা, বাজুবাঘা, বেস পুকুরিয়া, চারঘাট ও দুর্গাপুর এলাকায় পাকিস্তানি সেনাদের বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি সফল অপারেশন পরিচালনা করেন।
স্বাধীনতা যুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ অবদানের জন্য বাংলাদেশ সরকার মোহাম্মদ আব্দুর রশীদকে ‘বীর প্রতীক’ উপাধিতে ভূষিত করে। এই বীর মুক্তিযোদ্ধার স্মরণে ঢাকার পান্থপথে ‘কর্নেল আব্দুর রশীদ স্কোয়ার’ এবং ‘কর্নেল আব্দুর রশীদ প্লাজা’-র নামকরণ করা হয়।
মুক্তিযুদ্ধ শেষে আব্দুর রশীদ তাঁর কর্মস্থল বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে যোগদান করেন এবং পদোন্নতি পেয়ে ১৯৭৯ সালে কর্নেল পদে উন্নীত হন। ১৯৮১ সালে জিয়াউর রহমান, বীর উত্তম-এর হত্যা মামলায় তাঁকে দোষী সাবস্ত্য করে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেয়া হয় এবং ২৩শে সেপ্টেম্বর তাঁর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। ব্যক্তিজীবনে তিনি ছিলেন এক কন্যা ও দুই পুত্র সন্তানের জনক। তাঁর স্ত্রীর নাম আনোয়ারা রশীদ। [সাজাহান মিয়া]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৮ম খণ্ড