বীর প্রতীক মোজাম্মেল হক
মোজাম্মেল হক, বীর প্রতীক (জন্ম ১৯৫৬) কুখ্যাত মোনায়েম খান হত্যা অপারেশন দলের সদস্য ও বীর মুক্তিযোদ্ধা। তিনি ১৯৫৬ সালে ঢাকা জেলার ভাটারা ইউনিয়ন (বর্তমানে ভাটারা ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের অন্তর্ভুক্ত)-এর সোলমাইদ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম হাসেন উদ্দিন এবং মাতার নাম তারা বানু।
মোজাম্মেল হক ঢাকার স্টাফ ওয়েলফেয়ার হাইস্কুলের দশম শ্রেণির ছাত্র থাকাকালে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। তেজগাঁও পলিটেকনিক স্কুলে তিনি ষষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত অধ্যয়ন করেন। এরপর সপ্তম থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত স্টাফ ওয়েলফেয়ার হাইস্কুলে পড়াশুনা করেন।
১৯৭২ সালে তিনি উপর্যুক্ত স্কুল থেকে এসএসসি পাস করেন। উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে অধ্যয়নের জন্য তিনি ঢাকার তিতুমীর কলেজে ভর্তি হন। ১৯৭৩-৭৪ সালে তিনি এ কলেজের ছাত্র সংসদের নির্বাচিত সাধারণ সম্পাদক (জিএস) ছিলেন। ঢাকার প্রাত্যহিক জীবনে অবাঙালিরা সাধারণ বাঙালিদের প্রতি যে অপমানজনক আচরণ করত তা মোজাম্মেল হককে সাংঘাতিকভাবে বিক্ষুব্ধ করে। তাঁর গ্রামের বাড়ি তখন শহরের বাইরে থাকলেও ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট, গুলশান, বনানী ইত্যাদি স্থান থেকে খুব বেশি দূরে ছিল না। তিনি বাসে করে স্কুলে যাওয়ার সময় বাসের মধ্যে বাঙালিদের প্রতি অবাঙালি বাস ড্রাইভার, হেল্পার বা প্যাসাঞ্জারদের অমর্যাদাকর আচরণ লক্ষ করতেন। তাঁদের গ্রামের লোকদের মধ্যে যারা বিভিন্ন কাজে গুলশান বনানী বা ক্যান্টনমেন্টে যেতেন তাদের প্রতি অবাঙালি সামরিক ও বেসামরিক ব্যক্তিরা যে বৈষম্যমূলক ও মর্যাদাহানিকর ব্যবহার করত, তা-ও তাঁকে ব্যথিত ও ক্ষুব্ধ করত।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানার-এর ডাকে ১৯৭১ সালের মার্চে চলা অসহযোগ আন্দোলন – ও ২৬শে মার্চ স্বাধীনতা ঘোষণার পর তরুণ মোজাম্মেল হক মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেয়ার সিদ্ধান্ত নেন। তিনি মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিতে এপ্রিল মাসে ভারতের মেঘালয়ে যান। কুমিল্লার কাছে গোমতী নদীর গলা পরিমাণ পানিতে হেঁটে তিনি সীমান্ত অতিক্রম করেন। মেলাঘর প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে তিনি মেজর হায়দারের অধীনে মুক্তিযুদ্ধের গেরিলা প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। প্রশিক্ষণ নিলেও দীর্ঘদিন কোনো অপারেশনে যাওয়ার সুযোগ না পাওয়ায় মোজাম্মেল হকের মনে কষ্ট দানা বাঁধতে থাকে। তিনি কোনো গেরিলা অপারেশনে তাঁকে পাঠানোর জন্য মেজর হায়দারকে অনুরোধ করতে থাকেন। তরুণ মুক্তিযোদ্ধাদের নৈতিক সাহস পর্যাপ্ত নয় বিবেচনা করে মেজর হায়দার অনেককে অপারেশনে পাঠানো থেকে বিরত থাকেন। কিন্তু অদম্য মোজাম্মেল অপারেশনে যাওয়ার জন্য নানাভাবে মেজর হায়দারের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে থাকেন। একদিন মোজাম্মেলকে পেয়ে রাগান্বিত হায়দার জানতে চান, কেন বারবার তিনি তাঁর নজরে পড়ার চেষ্টা করছেন। মোজাম্মেল তাঁকে জানান, মুক্তিযোদ্ধাদের নৈতিক সাহসের ঘাটতি নেই, সুযোগ দিলে প্রমাণ করব আমরা সবচেয়ে কঠিন অপারেশন করতেও সক্ষম। মেজর হায়দার এক পর্যায়ে জানতে চান, মোজাম্মেল গভর্নর মোনায়েম খানের বিরুদ্ধে অপারেশন করতে পারবেন কি না। উৎফুল্ল মোজাম্মেল তৎক্ষণাৎ রাজি হন এবং এ অপারেশন করতে পারলে কী পুরস্কার দেয়া হবে তা জানতে চান। মেজর হায়দার পাল্টা প্রশ্ন করেন, তাঁর কী পুরস্কার চাই। মোজাম্মেল তখন মেজর হায়দারের কোমরে থাকা পিস্তলটি চান বলে জানান। মেজর হায়দার বলেন, কেবল পিস্তল নয়, জাতি তাঁকে এর চেয়েও অনেক বড় সম্মান উপহার দিবে।
মেজর হায়দারের নির্দেশ অনুযায়ী মোজাম্মেল হক গভর্নর মোনায়েম খানের বিরুদ্ধে অপারেশনের প্রস্তুতি নেন। তাঁর প্রথম ও দ্বিতীয় প্রয়াস ব্যর্থ হয়। তৃতীয়বার তিনি সফল হন। তিনি মোনায়েম খানের বনানীর বাসায় কর্মরত কাজের লোকদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। এদের মধ্যে যারা মুক্তিযুদ্ধের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিলেন তাদের সহায়তা নেন। ফুফাত ভাই আনোয়ার হোসেন, বীর প্রতীক কে নিয়ে মোজাম্মেল ১৩ই অক্টোবর মোনায়েম খানের বাড়িতে অপারেশন পরিচালনা করেন। বাড়ির নিচ তলার ড্রয়িং রুমে থাকা মোনায়েম খান মোজাম্মেল হকের ছোড়া গুলিতে মারাত্মকভাবে আহত হয় এবং হাসপাতালে তার মৃত্যু ঘটে। টাকায় গভর্নর মোনায়েম খানের বিরুদ্ধে পরিচালিত এ অপারেশনের খবর দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। এ খবর আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমেও প্রচারিত হয়। এ অপারেশনের সাফল্য মুক্তিযোদ্ধাদের ব্যাপকভাবে অনুপ্রাণিত করে।
মহান মুক্তিযুদ্ধে সাহসিকতাপূর্ণ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ বাংলাদেশ সরকার মোজাম্মেল হককে ‘বীর প্রতীক’ খেতাবে ভূষিত করে। স্বাধীনতার পর তিনি ব্যবসাকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করেন। দীর্ঘদিন থেকে তিনি রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। তিনি বৃহত্তর সাতারকুল ইউনিয়ন পরিষদ ভাটারা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। ঢাকা থেকে দুবার তিনি জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। তিনি ১ কন্যা সন্তানের জনক। তাঁর স্ত্রীর নাম নূরজাহান হক। [জালাল আহমেদ]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৮ম খণ্ড