বীর উত্তম মোজাহার উল্লাহ
মোজাহার উল্লাহ, বীর উত্তম (১৯৪৩-২০০৮) বীর মুক্তিযোদ্ধা। তিনি ১৯৪৩ সালের ২৪শে জুন চট্টগ্রাম জেলার মিরসরাই উপজেলার ভালুকিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম শহীদ আলী আযম এবং মাতার নাম খায়রুন নেছা। মোজাহার উল্লাহ উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হবার পর পাকিস্তান ইন্সুরেন্স কোম্পানিতে চাকরি নিয়ে করাচি অফিসে যোগদান করেন। চাকরিরত অবস্থায় তিনি স্নাতক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। তিনি চার কন্যা ও এক পুত্র সন্তানের জনক। তাঁর স্ত্রীর নাম দেলা আফরোজ। ১৯৭১ সালে মোজাহার উল্লাহ পশ্চিম পাকিস্তানের করাচিতে কর্মরত ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরুর প্রাক্কালে তিনি গ্রামের বাড়িতে ছুটি ভোগ করছিলেন। ২৫শে মার্চ রাতে পাকিস্তানি বাহিনী ঢাকাসহ সারা বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে নিরস্ত্র বাঙালিদের ওপর ব্যাপক গণহত্যা ও নির্যাতন শুরু করলে তিনি চাকরিস্থল করাচি ফিরে না গিয়ে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেয়ার জন্য ভারতের দক্ষিণ ত্রিপুরা জেলার হরিণা প্রশিক্ষণ শিবিরে যান। সামরিক প্রশিক্ষণ শেষে তিনি বাংলাদেশে এসে বীরত্বের সঙ্গে বিভিন্ন প্রতিরোধ ও গেরিলা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। উল্লেখ্য, মহান মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেয়ার কারণে মোজাহার উল্লাহর পিতাকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী আটক করে নির্মমভাবে হত্যা করে। এমনকি তাঁদের বাড়িঘরও আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেয়৷
পরবর্তীতে মোজাহার উল্লাহ মুক্তিবাহিনীর নৌ-কমান্ডো দলে অন্তর্ভুক্ত হন এবং ভারতের মুর্শিদাবাদ জেলার পলাশী নৌ- প্রশিক্ষণ ঘাঁটিতে যোগ দেন। সেখান থেকে নৌযুদ্ধে বিস্ফোরক ব্যবহারে উচ্চতর প্রশিক্ষণ সমাপ্তির পর সাবমেরিনার আব্দুল ওয়াহেদ চৌধুরী, বীর উত্তম ও বীর প্রতীকএর নেতৃত্বে অপারেশন জ্যাকপট-এ অংশগ্রহণের জন্য অন্যান্য নৌ-কমান্ডোদের নিয়ে তিনি চট্টগ্রাম আসেন। ৯ই আগস্ট মোজাহার উল্লাহ ২০ জনের একটি নৌ-কমান্ডো দলের অধিনায়ক মনোনীত হন। অপারেশন জ্যাকপটের ফলে চট্টগ্রাম বন্দর অচল করে দেয়ার পরিকল্পনায় কখনো মাছ ধরার জেলে, কখনো ফেরিওয়ালা, কখনো-বা কৃষকের ছদ্মবেশে বন্দর এলাকা রেকি করতে থাকেন। অবশেষে ১৫ই আগস্ট বর্ষণমুখর রাতে আব্দুল ওয়াহেদ চৌধুরীর নেতৃত্বে মোজাহার উল্লাহ ও অন্যান্য নৌকমান্ডোগণ অপারেশন জ্যাকপেেট অংশ নেন। নৌ-কমান্ডোগণ পানিতে নেমে সাঁতরে বন্দরে নোঙর করা অনেকগুলো নির্দিষ্ট টার্গেটে সফলতার সঙ্গে লিমপেট মাইন স্থাপন করে নিরাপদ দূরত্বে চলে আসেন। আধ ঘণ্টা পর থেকে মাইনগুলো একের পর এক বিস্ফোরিত হতে থাকে। এ অপারেশনে মুক্তিযোদ্ধারা ৯টি টার্গেট সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করে দেন। এ-সকল টার্গেটের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো বাণিজ্য জাহাজ এমভি আল আব্বাস, এমভি হরমুজ, বার্জ ওরিয়েন্ট এবং পাকিস্তান নৌবাহিনীর দুটি গানবোট ও একটি পন্টুন। এ অপারেশনের ফলে পাকসেনাদের মধ্যে ভীতিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় এবং বন্দর প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়লে তাদের মনোবলও ভেঙ্গে পড়ে।
মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে বীরত্ব ও সাহসিকতার জন্য বাংলাদেশ সরকার মোজাহার উল্লাহকে ‘বীর উত্তম’ খেতাবে ভূষিত করে (গেজেট নং ৫৭, খেতাবের সনদ নং ৫০)। ২০০৮ সালের ২৭শে অক্টোবর দেশপ্রেমিক এ বীর মুক্তিযোদ্ধা পরলোক গমন করেন। [সাজাহান মিয়া]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৮ম খণ্ড