মোগলহাট অপারেশন (লালমনিরহাট সদর)
মোগলহাট অপারেশন (লালমনিরহাট সদর) পরিচালিত হয় ১৫ই সেপ্টেম্বর। এতে ২৭ জন পাকসেনা নিহত, বহু সংখ্যক আহত ও রেল লাইনের ব্যাপক ক্ষতি হয়। অপরদিকে ২ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ ও ৫ জন আহত হন।
লালমনিরহাট সদর উপজেলার তিস্তা নদীর তীরবর্তী ভারতীয় সীমান্ত সংলগ্ন একটি ইউনিয়নের নাম মোগলহাট। এখানে একটি রেল স্টেশন ছিল, যা বর্তমানে পরিত্যক্ত। মুক্তিযুদ্ধের সময় লালমনিরহাট থেকে মোগলহাট রেল স্টেশন পর্যন্ত ট্রেন চলাচল করত। এ স্টেশনে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ক্যাম্প ছিল। স্টেশন থেকে ১৫০ গজের মতো দূরে তিস্তা নদী এবং নদীর অপর পাড়ে ভারত। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ট্রেনযোগে শহর থেকে মোগলহাট যাতায়াত করত। মোগলহাট রেল স্টেশন ক্যাম্প ও সীমান্ত এলাকায় প্রহরারত সেনাদের প্রয়োজনীয় অস্ত্র ও খাদ্যসহ যাবতীয় রসদসামগ্রী ট্রেনযোগে মোগলহাটে আনা-নেয়া করা হতো। এ-সময় তারা এখানকার লোকজনের ওপর অত্যাচার-নির্যাতন ও গণহত্যা চালাত। দুরাকুটি রেলগেট, কর্ণপুর, চওড়াতাড়ি, রত্নাই ব্রিজ, মোগলহাট তামাক গুদাম ও মোগলহাট টেম্পো স্ট্যান্ড এলাকাসহ একাধিক স্থানে গণহত্যা চালিয়ে তারা বহু লোককে হত্যা করে।
মোগলহাটে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর অপতৎপরতা বন্ধের লক্ষ্যে যুদ্ধের মাঝামাঝি সময় থেকে মুক্তিযোদ্ধারা তৎপরতা শুরু করেন। একাধিক স্থানে গেরিলা অপারেশন চালান। ৬নং সেক্টরের আওতায় মোগলহাটে মুক্তিবাহিনী-র একটি সাব-সেক্টর ছিল। এর অধিনায়ক ছিলেন ক্যাপ্টেন দেলোয়ার হোসেন। তিনি মোগলহাটে পাকিস্তানি সেনা ক্যাম্পে অস্ত্র ও রসদ সরবরাহ বন্ধ করা এবং পাকিস্তানি সেনাদের মধ্যে ভীতি সঞ্চারের লক্ষ্যে মোঘলহাট রেল লাইন উড়িয়ে দেয়ার উদ্যোগ গ্রহণ করেন। তাঁর নেতৃত্বে ৩০ সদস্যের মুক্তিযোদ্ধার একটি দল ১৫ই সেপ্টেম্বর অপারেশনে বের হয়। ঐদিন মোগলহাটে অবস্থানরত পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর জন্য রসদ ও অতিরিক্ত সেনাসদস্য ট্রেনে করে আনা হচ্ছিল। মুক্তিযোদ্ধারা ট্রেনটি উড়িয়ে দেয়ার পরিকল্পনা নিয়ে মোগলহাট ইউনিয়নের দুরাকুটি নামক এলাকায় রেল লাইনের ওপর গ্যালাটিন ও পিইকে লাগিয়ে কিছুটা দূরে ট্রেন আসার অপেক্ষায় থাকেন। এক পর্যায়ে ট্রেন আসে এবং এর সামনের অংশ বিস্ফোরিত হয়ে উড়ে যায়। এ ধরনের ঘটনা ঘটতে পারে এমন আশঙ্কায় পাকিস্তানি সেনারাও কৌশল গ্রহণ করত। তারা মুক্তিবাহিনীর হামলা প্রতিহত করার জন্য ট্রেনের সামনের বগিগুলোতে বালুর বস্তা ভরে রাখত। তারপরের বগিতে রাখত প্রয়োজনীয় রসদ। সেনারা থাকত শেষের দিকের বগিগুলোতে। এন্টিট্যাংক মাইনের আঘাতে ট্রেনের সামনের অংশের বালুর বস্তা ভর্তি বগিগুলো বিস্ফোরিত হওয়ার সঙ্গে-সঙ্গে পেছনের বগিতে থাকা সেনারা পজিশন নিয়ে গুলি বর্ষণ শুরু করে এবং মুক্তিবাহিনীকে তিন দিক থেকে ঘিরে ফেলে। মুক্তিযোদ্ধারা একটি মেশিনগানসহ কয়েকটি হালকা অস্ত্র দ্বারা এর জবাব দিতে থাকেন এবং ঘেরাওয়ের কবল থেকে নিরাপদ দূরত্বে সরে যান। এ অপারেশনে ২ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ এবং ক্যাপ্টেন দেলোয়ার হোসেনসহ ৫ জন আহত হন। অপরদিকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ২৭ জন সদস্য নিহত ও বহু সংখ্যক আহত হয়। এ ঘটনায় ট্রেনটির পাশাপাশি রেল লাইনেরও ব্যাপক ক্ষতি হয়। এ অপারেশনের পর মোগলহাটে অবস্থানরত পাকিস্তানি সেনাদের জন্য খাদ্য ও অস্ত্র সরবরাহ বেশ কিছু দিনের জন্য ব্যাহত হয়। মোগলহাট রেলওয়ে ওভারব্রিজ সংলগ্ন বধ্যভূমিটি বর্তমানে সংরক্ষিত অবস্থায় আছে। [আজহারুল আজাদ জুয়েল]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৮ম খণ্ড