বীর প্রতীক মো. সেলিম
মো. সেলিম, বীর প্রতীক (১৯৫২-১৯৭১) শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধা ও গ্রুপ কমান্ডার। তিনি ১৯৫২ সালে কিশোরগঞ্জ জেলার কুলিয়ারচর উপজেলার কাশিমনগর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম মো. আলী আকবর এবং মাতার নাম নূর বানু। এ দম্পতির ৪ পুত্র ও ৪ কন্যার মধ্যে মো. সেলিম ছিলেন সর্বজ্যেষ্ঠI তিনি অল্প বয়স থেকে খুব মেধাবী ও সাহসী ছিলেন। মো. সেলিম ১৯৬৮ সালে বাজিতপুর সরকারি বয়েজ হাইস্কুল থেকে বিজ্ঞান বিভাগে কৃতিত্বের সঙ্গে এসএসসি পাস করেন। ১৯৭০ সালে তিনি ভৈরবের হাজী আসমত আলী কলেজ থেকে আইএসসি পাস করেন। মো. সেলিম পরিবারের বড় সন্তান হিসেবে চাকরি জীবনে প্রবেশের চেষ্টা করেন। তিনি পাকিস্তান বিমান বাহিনীতে চাকরির জন্য পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে জিডি (জেনারেল ডিউটি) পাইলট হিসেবে মনোনীত হন। বিমান বাহিনীতে যোগ দেয়ার জন্য তাঁর কাছে ১৯৭১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে চিঠি আসে। কিন্তু স্বাধীনচেতা মো. সেলিম ততদিনে দেশকে পাকিস্তানিদের কবল থেকে মুক্ত করার জন্য মুক্তিযুদ্ধে যোগদানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। মো. সেলিম একজন ক্রীড়াবিদ ও দক্ষ ফুটবলার হিসেবে পরিচিত ছিলেন।
মো. সেলিম ছাত্রজীবন থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর অনুসারী ছিলেন। ছাত্রলীগ-এর একজন সংগ্রামী কর্মী হিসেবে তাঁর খ্যাতি ছিল। হাজী আসমত আলী কলেজ ছাত্র সংসদের তিনি নির্বাচিত সদস্য ছিলেন। ছাত্রলীগের কর্মী হিসেবে তিনি ৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থান ও ৭০- এর নির্বাচনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। ৭১-এর মার্চে বঙ্গবন্ধু অসহযোগ আন্দোলন-এর ডাক দিলে মো. সেলিম কুলিয়ারচরে আয়োজিত বিভিন্ন কর্মসূচিতে অংশ নেন। ২৬শে মার্চ বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা ঘোষণা করলে তিনি মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। প্রথমে ভৈরব ও কিশোরগঞ্জ এলাকার কিছু প্রতিরোধ যুদ্ধে তিনি অংশ নেন। পরে ভারতের আগরতলায় গিয়ে ২ নম্বর সেক্টরে যোগ দেন। এ সেক্টরের অধীনে মেজর এ টি এম হায়দারের তত্ত্বাবধানে তিনি মেলাঘরে মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। এ প্রশিক্ষণের সময় মো. সেলিমের সঙ্গে খায়রুল জাহান, বীর প্রতীকএর পরিচয় হয়। প্রশিক্ষণ শেষে খায়রুল জাহানকে একটি মুক্তিযোদ্ধা দলের প্রথম গ্রুপ কমান্ডার ও মো. সেলিমকে দ্বিতীয় গ্রুপ কমান্ডার নিযুক্ত করা হয়। এ দল দেশের ভেতরে বিভিন্ন গেরিলা অপারেশন পরিচালনা করে। নভেম্বর মাসে তাঁরা কিশোরগঞ্জ এলাকায় যুদ্ধ করার জন্য কিশোরগঞ্জ-হোসেনপুর সড়কের পার্শ্ববর্তী প্যাড়াডাঙ্গায় অবস্থান নেন। এখান থেকে তাঁরা রাজাকার বাহিনী ও পাকসেনাদের বিরুদ্ধে অপারেশনের পরিকল্পনা করেন। ২৬শে নভেম্বর পাকসেনা ও রাজাকারদের একটি বড় দল প্যাড়াডাঙ্গায় তাঁদের অবস্থানের ওপর আক্রমণ করে। মুক্তিযোদ্ধারা সংখ্যায় ছিলেন অনেক কম। হঠাৎ আক্রান্ত হওয়ার পরও অল্পসংখ্যক মুক্তিযোদ্ধা তাদের বিরুদ্ধে প্রবল প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। দলনেতা খায়রুল জাহান ও মো. সেলিম সামনে অগ্রসর হয়ে শত্রুদের বিরুদ্ধে বীরত্বের সঙ্গে লড়াই করতে থাকেন। এক সময় পাকসেনাদের গুলিতে ঘটনাস্থলে মো. সেলিম শহীদ হন। এ যুদ্ধে খায়রুল জাহানও শহীদ হন। রাজাকাররা এ দুই বীর শহীদের মৃত্যুতে উল্লাস প্রকাশ করে। তারা তাঁদের মরদেহ নিয়ে কিশোরগঞ্জ শহর প্রদক্ষিণ করে।
মহান মুক্তিযুদ্ধে সাহসিকতাপূর্ণ অবদান ও আত্মোৎসর্গের স্বীকৃতিস্বরূপ বাংলাদেশ সরকার মো. সেলিমকে ‘বীর প্রতীক’ (মরণোত্তর) খেতাবে ভূষিত করে। শহীদ সেলিমের স্মৃতি রক্ষার্থে কুলিয়ারচর শহরে শহীদ সেলিম স্মৃতি সংসদ গঠিত হয়েছে। স্মৃতি সংসদের উদ্যোগে স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস ও শহীদ সেলিমের শাহাদাত দিবসে অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। কুলিয়ারচরের ক্রীড়ামোদী মানুষের উদ্যোগে শহীদ সেলিম স্মৃতি ফুটবল প্রতিযোগিতাও আয়োজিত হয়। [জালাল আহমেদ]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৮ম খণ্ড