বীর প্রতীক মো. সোলায়মান
মো. সোলায়মান, বীর প্রতীক (জন্ম ১৯৫৪) যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা, পুলিশে চাকরিরত অবস্থায় মুক্তিযুদ্ধে যোগদান, সৈয়দপুর, নীলফামারী ও ঠাকুরগাঁও-এর বিভিন্ন এলাকায় প্রতিরোধযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী, মুক্তিযুদ্ধে অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক “বীর প্রতীক’ খেতাবে ভূষিত।
মো. সোলায়মান ১৯৫৪ সালে নাটোর শহরের কাপুড়িয়াপট্টিতে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম মো. আব্দুল হাই মিয়া ও মাতা রহিমা বেগম। আট ভাই-বোনের মধ্যে সোলায়মান সর্বকনিষ্ঠ। শৈশবে লালবাজার প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্ত করে দিনাজপুরের মহারাজা জি এন স্কুল থেকে ১৯৬৯ সালে এসএসসি পাস করেন। এর পরপরই ১৯৬৯ সালে পূর্ব পাকিস্তান পুলিশে কনস্টেবল হিসেবে যোগদান করে রংপুরে ট্রেনিং শেষে নীলফামারীতে যোগ দেন। ৭১-এর মার্চে সোলায়মান নীলফামারীর তৎকালীন এসডিও শফিউজ্জামানের আহবানে ৩ সহকর্মীসহ সৈয়দপুরে প্রতিরোধযুদ্ধে অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। সৈয়দপুরে পরিস্থিতি প্রতিকূলে চলে গেলে নীলফামারীতে ফেরার পথে গোলাহাট নামক স্থানে বোমা হামলার হাত থেকে অল্পের জন্য প্রাণে রক্ষা পান সোলায়মান। নীলফামারী ফিরে প্রতিরোধযুদ্ধে অংশ নেয়ার উদ্দেশ্যে তাঁরা জেলখানা থেকে প্রায় পাঁচশ কয়েদিকে ছেড়ে দেন। এরপর ৫০ পুলিশ, ৫০ ইপিআর, সেনাবাহিনী ও আনসারের কয়েকজন সদস্য মিলে সংগঠিত হয়ে শুরু করেন প্রতিরোধযুদ্ধ। সাব- সেক্টর কমান্ডার ক্যাপ্টেন শাহরিয়ারের নেতৃত্বে তাঁদের দল সৈয়দপুর অভিমুখে রওনা হলে পথিমধ্যে পাকসেনাদের সঙ্গে সম্মুখ যুদ্ধে অবতীর্ণ হন। প্রায় দুঘণ্টা যুদ্ধের পর তাঁরা পেছন ফিরে ঠাকুরগাঁও-এ চলে যান। সেখানে ইপিআর ক্যাম্প থেকে অবরুদ্ধ কর্নেল নজরুল ইসলামকে উদ্ধার করেন। এরপর ক্যাপ্টেন শাহরিয়ারের নেতৃত্বে ভজনপুরকে কেন্দ্র করে খানসামা, মীরগড়, জগদল, হরিভাসাসহ বিভিন্ন এলাকায় বীরদর্পে প্রতিরোধযুদ্ধ চালিয়ে যেতে থাকে তাঁদের বাহিনী। এক পর্যায়ে জগদলে বাংকারে অবস্থানরত অবস্থায় গুলিবিদ্ধ হন সোলায়মান। আহত অবস্থায় প্রথমে তেঁতুলিয়ায় ও পরবর্তীতে ভারতের শিলিগুড়ি বাগডোগরায় আর্মি হাসপাতালে এক মাস চিকিৎসা শেষে দেশে ফিরে আবার তিনি সহযোদ্ধাদের সঙ্গে যুদ্ধের ময়দানে মিলিত হন। যুদ্ধের শেষদিকে তাঁদের দল খানসামাসহ সৈয়দপুরের দশমাইল পর্যন্ত অগ্রসর হয়। সেখানেই তাঁরা শুনতে পান বিজয়ের সুখবর। তারপরও বাড়ি না ফিরে তাঁরা নিজেদের নিয়োজিত করেন দেশ গড়ার কাজে। বিভিন্ন স্থান থেকে তাঁরা পরিত্যক্ত মাইন, বোমা ও অন্যান্য বিস্ফোরক দ্রব্য উদ্ধার করে মহারাজা জি এন স্কুলের একটি রুমে জমা করছিলেন। ১৯৭২ সালের ৪ঠা জানুয়ারি সেখানে ঘটে যায় এক হৃদয়বিদারক ঘটনা। ঘটনার দিন গাড়ি থেকে বিস্ফোরক নামানোর সময় পড়ে গিয়ে তা বিস্ফোরিত হওয়ার সঙ্গে-সঙ্গে স্কুল রুমে জমা করা সমস্ত বিস্ফোরক বিস্ফোরিত হয়। উক্ত দুর্ঘটনায় মহারাজা স্কুলটি সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যায় এবং ঘটনা স্থলেই ক্যাম্পের ৫ শত মুক্তিযোদ্ধা প্রাণ হারান। মো. সোলায়মান এ দুর্ঘটনায় আহত হন।
বাড়ি ফিরে মো. সোলায়মান হাসপাতালে ভর্তি হন। অপারেশন করে তাঁর শরীর থেকে ৮টি স্প্লিন্টার বের করা হয়। এরপরও তাঁর শরীরে রয়ে যায় আরো বেশ কয়েকটি স্প্রিন্টার। দীর্ঘ চিকিৎসার পর বীর প্রতীক মো. সোলায়মান ৭৫-এ পুনরায় পুলিশের চাকরিতে যোগ দিতে গেলে তাঁকে আর স্বপদে ফিরিয়ে নেয়া হয়নি। এরপর তিনি নাটোরের ট্রাক শ্রমিক ইউনিয়নের সঙ্গে যুক্ত হন এবং বিভিন্নভাবে জীবিকা নির্বাহ করেন। তাঁর ৫ কন্যা ও ১ পুত্রসহ মোট ছয়টি সন্তান রয়েছে। বর্তমানে শারীরিকভাবে অসুস্থ এই বীর প্রতীক নাটোর শহরে পরিবার নিয়ে বসবাস করছেন। [আবিদা সুলতানা]
তথ্যসূত্রঃ মো. সোলায়মান বীর প্রতীকএর সঙ্গে লেখকের বিভিন্ন সময়ে সাক্ষাৎকার; বাংলাদেশ গেজেট, ১১ই মার্চ ২০০৪, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৮ম খণ্ড