বীর প্রতীক মো. রহমত উল্লাহ গাজী
মো. রহমত উল্লাহ গাজী, বীর প্রতীক (১৯৩৭- ২০০৮) নৌ-কমান্ডো ও অপারেশন জ্যাকপট-এর বীর মুক্তিযোদ্ধা। তিনি ১৯৩৭ সালের ১১ই নভেম্বর খুলনা জেলার পাইকগাছা উপজেলার গড়ইখালী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম শহর আলী গাজী এবং মাতার নাম অভিরুন নেছা। ১০ ভাই ও এক বোনের মধ্যে মো. রহমত উল্লাহ গাজী ছিলেন সবার বড়। তাঁর ডাক নাম ছিল দাদু। এ নামেই তিনি পরিচিত ছিলেন। মো. রহমত উল্লাহ গাজী খুলনা জেলা স্কুল থেকে ম্যাট্রিক এবং ১৯৫৬ সালে বি এল কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেন। একই বছর তিনি নৌবাহিনীতে ক্যাডেট হিসেবে যোগদান করেন। চাকরিকালীন সময়ে তিনি নৌবাহিনী থেকে স্নাতক এবং ইংল্যান্ডের ম্যানাডান (Manadon) ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ থেকে বিএসসি ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৬৮ সালে প্রশিক্ষণের জন্য তিনি তুরস্ক যান। সাবমেরিন পরিচালনার প্রশিক্ষণ নিতে তিনি ১৯৬৯ সালে সেখান থেকে ফ্রান্সের তুলোঁ বন্দরে যান এবং ১৯৭১ সালের মার্চ পর্যন্ত সেখানেই অবস্থান করেন। ২৫শে মার্চ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর গণহত্যা এবং ২৬শে মার্চ বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার পর যে ৮ জন বাঙালি সাবমেরিনার জীবনের সর্বপ্রকার ঝুঁকি নিয়ে ফ্রান্স থেকে পালিয়ে দেশে এসে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন, মো. রহমত উল্লাহ গাজী তাঁদের অন্যতম। মুক্তিযুদ্ধকালে এ ৮ জন সাবমেরিনারসহ ৫ শতাধিক যুবককে নিয়ে বাংলাদেশ সরকার- নৌ-কমান্ডো বাহিনী গঠন করে। পরবর্তীতে তাঁদের নেতৃত্বে ১৫ই আগস্ট মংলা, চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ, চাঁদপুর ও দাউদকান্দিতে প্রথম নৌ-অপারেশন পরিচালিত হয়, যা অপারেশন জ্যাকপট নামে পরিচিত। এতে হানাদার বাহিনীর অস্ত্র ও রসদ বহনকারী ২৬টি জাহাজ সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস হয়ে যায়। ফলে হানাদার বাহিনীর নৌ ও সামুদ্রিক পথে সকল কার্যক্রম মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত হয়। পরবর্তী সময়ে মো. রহমত উল্লাহ গাজী গড়ইখালী, নীল কমল, চালনা, লক্ষ্মীখোলা, পাইকগাছা, চাপড়া, আশাশুনি, শিয়ালডাঙ্গা, কপিলমুনি ও খুলনা যুদ্ধে নেতৃত্ব দেন। ৯ই ডিসেম্বর তাঁর নেতৃত্বে কপিলমুনি যুদ্ধে বিজয়ের পর গণআদালতে ১৫২ জন রাজাকারকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়। ১৭ই ডিসেম্বর সকালে তাঁর নেতৃত্বে খুলনার সার্কিট হাউজে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলিত হয়। বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবসে তাঁর নেতৃত্বে ঢাকা বিমান বন্দরে বঙ্গবন্ধুকে নৌ কন্টিনজেন্টের গার্ড অব অনার প্রদান করা হয়। মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ বাংলাদেশ সরকার মো. রহমত উল্লাহ গাজী-কে ‘বীর প্রতীক’ খেতাবে ভূষিত করে।
স্বাধীনতার পর তিনি নৌবাহিনীর চাকরিতে বহাল হন। বাংলাদেশ নৌবাহিনী গঠনে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ১৯৭৬ সালে তিনি লেফটেন্যান্ট পদে পদোন্নতি লাভ করেন এবং একই বছর চাকরি থেকে অবসর গ্রহণ করেন। এরপর তিনি বাংলাদেশ টেক্সটাইল সেক্টরে যোগদান করেন। ১৯৮৭ সালে টেক্সটাইল সেক্টরের চাকরি ছেড়ে তিনি ব্যক্তিগত ব্যবসায় নিয়োজিত হন। এ-সময় তিনি বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করেন। তিনি খুলনা বিভাগীয় সেক্টর কমান্ডার্স ফোরামের কো-অর্ডিনেটর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তাঁর স্ত্রীর নাম শাহানা রহমতউল্লাহ। ১ পুত্র ও ৩ কন্যা সন্তানের জনক মো. রহমত উল্লাহ গাজী ২০১৬ সালের ১০ই আগস্ট মৃত্যুবরণ করেন। তাঁকে পাইকগাছায় তাঁর নিজ গ্রাম গড়ইখালীর পারিবারিক কবরস্থানে সমাহিত করা হয়। [মনিরুজ্জামান শাহীন]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৮ম খণ্ড