বীর উত্তম মো. বদিউল আলম
মো. বদিউল আলম, বীর উত্তম (জন্ম ১৯৪৬) বীর মুক্তিযোদ্ধা। তিনি ১৯৪৬ সালের ৩০শে অক্টোবর গাইবান্ধা জেলার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার রামপুরা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম
মোজাম্মেল হক সরকার এবং মাতার নাম রাবেয়া খাতুন।
১৯৬৩ সালে বরফখালী হাইস্কুল থেকে মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হবার পর ১৯৬৪ সালে বদিউল আলম পাকিস্তান নৌ-বাহিনীতে নাবিক পদে যোগদান করেন। করাচি নৌ-ঘাঁটিতে প্রশিক্ষণরত অবস্থায় ১৯৬৮ সালে তিনি করাচি ইসলামিয়া কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরুর প্রাক্কালে বদিউল আলম ফ্রান্সের তুলো নৌঘাঁটিতে পিএনএস ম্যানগ্রো সাবমেরিনে প্রশিক্ষণ নিচ্ছিলেন। পাকিস্তান নৌবাহিনীর জন্য ক্রয় করা- এ সাবমেরিনে প্রশিক্ষণে অংশ নেয়ার জন্য পাকিস্তান থেকে ৫৭ জন সাবমেরিনার সেনা ফ্রান্সে যায়। তাদের মধ্যে ১৩ জন ছিলেন বাঙালি। এই ১৩ জনের মধ্যে বদিউল আলমসহ ৮ জন সাবমেরিনার কৌশলে পালিয়ে ভারতীয় দূতাবাসের সহায়তায় ভারতে চলে আসেন এবং মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। বদিউল আলম মুক্তিযুদ্ধে নৌ-কমান্ডো গঠনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। তিনি কিছুকাল নৌ-কমান্ডো প্রশিক্ষণ ক্যাম্পের একজন প্রশিক্ষক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। আগস্ট মাসের মাঝামাঝি সময়ে বদিউল আলমের নেতৃত্বে ২০ জনের একটি নৌ-কমান্ডো দলকে অপারেশনের জন্য বাংলাদেশের অভ্যন্তরে পাঠানো হয়। ১৫ই আগস্ট চাঁদপুর বন্দরে মেঘনা-ডাকাতিয়া নদীর মোহনায় নোঙর করা পাকিস্তানি ছয়টি জাহাজ ধ্বংস করা ছিল তাঁদের টার্গেট। বদিউল আলম তাঁর দলকে ছয়টি ভাগে ভাগ করে সবার দায়িত্ব বুঝিয়ে দেন। কমান্ডোরা যথাসময়ে বন্দর সংলগ্ন নদীতে নেমে পড়েন। একেতো বর্ষাকাল, তদুপরি প্রবল ঢেউ আর স্রোত। এরই মধ্যে দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিটি দল সফলতার সঙ্গে নির্দিষ্ট টার্গেটে লিমপেট মাইন লাগিয়ে নিরাপদ স্থানে চলে আসে। ৪৫ মিনিটের মধ্যেই মাইনগুলো একে-একে বিস্ফোরিত হতে থাকে। মুহূর্তের মধ্যে ছয়টি জাহাজই ডুবে যায়। উল্লেখ্য, এ অভিযানে বদিউল আলমের সঙ্গে উপদলনেতা হিসেবে ছিলেন সালাহউদ্দিন আহমেদ, বীর উত্তম মোহাম্মদ মমিন উল্লাহ পাটোয়ারী, বীর প্রতীক ও শাহজাহান কবির, বীর প্রতীক। চাঁদপুরের এই সফল অভিযানের পর তিনি মুর্শিদাবাদের পলাশী নৌঘাঁটিতে চলে যান।
পরবর্তীতে অক্টোবর মাসে বদিউল আলম ৪০ জন নৌ- কমান্ডো দলের দলনেতা মনোনীত হয়ে মংলা সমুদ্র বন্দর অভিযানে আসেন। অক্টোবর থেকে নভেম্বর মাস পর্যন্ত তিনি অসীম সাহস ও বীরত্বের সঙ্গে মংলা ও চালনা বন্দরসহ খুলনার দক্ষিণাঞ্চল, দাকোপ, পাইকগাছা ও আশাশুনির বিভিন্ন জলপথে বহু জাহাজ, বার্জ, গানবোট, লঞ্চ ইত্যাদি ধ্বংস করতে সমর্থ হন। নৌকমান্ডো অভিযান ছাড়াও তিনি এ অঞ্চলে বেশ কয়েকটি পাকসেনা ঘাঁটি দখল যুদ্ধে বীরত্বের সঙ্গে অংশগ্রহণ করেন।
মুক্তিযুদ্ধ শেষে বদিউল আলম বাংলাদেশ নৌবাহিনীতে যোগদান করেন এবং ১৯৭৭ সালে স্বেচ্ছায় অবসর গ্রহণ করেন। এরপর ১৯৮৪ সালে তিনি ঢাকাস্থ ব্রিটিশ হাই কমিশন অফিসে যোগদান করেন। ১৯৮৫ সালে তিনি এখান থেকে রিলিজ নিয়ে জনতা ব্যাংকে নিরাপত্তা অফিসার হিসেবে যোগদান করেন এবং ২০০৪ সালে অবসর গ্রহণ করেন। স্বাধীনতা যুদ্ধে বীরত্ব ও সাহসিকতার জন্য বাংলাদেশ সরকার মো. বদিউল আলমকে ‘বীর উত্তম’ খেতাবে ভূষিত করে (গেজেট নং ৬০, খেতাবের সনদ নং ৫৩)। তিনি তিন কন্যা ও এক পুত্র সন্তানের জনক। [সাজাহান মিয়া]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৮ম খণ্ড