You dont have javascript enabled! Please enable it! বীর বিক্রম মো. মহিবুল্লাহ - সংগ্রামের নোটবুক

বীর বিক্রম মো. মহিবুল্লাহ

মো. মহিবুল্লাহ, বীর বিক্রম (১৯৩৮-১৯৭১) শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধা। তিনি ১৯৩৮ সালের ১৪ই সেপ্টেম্বর চাঁদপুর জেলার কচুয়া উপজেলার শাহেদাপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম মওলানা সুজাত আলী এবং মাতার নাম রফিকাতুন্নেছা। তিনি রহিমানগর (কচুয়া) প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেন এবং শাহাপুর (চট্টগ্রাম) হাইস্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাশ করেন। এরপর কচুয়া কলেজে প্রথম বর্ষে ভর্তি হলেও তিনি পড়া শেষ করতে পারেননি।
মো. মহিবুল্লাহ অসীম সাহসী ও সুঠাম দেহের অধিকারী ছিলেন। তাই পাকিস্তান নৌবাহিনীতে তিনি অতি সহজেই চাকরি পেয়ে যান এবং ১৯৬২ সালে নৌবাহিনীতে যোগ দেন। তিনি চট্টগ্রাম ও করাচিতে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। প্রশিক্ষণ শেষে তাঁর কর্মক্ষেত্র হয় করাচি।
১৯৭১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে মহিবুল্লাহ ৩ মাসের ছুটিতে জন্মস্থান চাঁদপুরে আসেন। ছাত্রজীবন থেকে মহিবুল্লাহ রাজনীতি-সচেতন ছিলেন। দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি দেখে তিনি মনে-মনে দেশের জন্য কিছু করার সিদ্ধান্ত নেন। ২৫শে মার্চ পাকিস্তানি বাহিনী বাঙালিদের ওপর নির্বিচার হত্যাযজ্ঞ শুরু করলে মহিবুল্লাহ প্রতিরোধ যুদ্ধে যোগ দেন। তিনি চট্টগ্রামের ঝাওতলা রেলওয়ে স্টেশনের কাছে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী বিহারিদের প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। এখানে অনেক বিহারি হতাহত হয়। চট্টগ্রাম থেকে আখাউড়ায় এসে তিনি কয়েকটি প্রতিরোধযুদ্ধে অংশ নেন। এরপর তিনি নিজ এলাকায় স্থানীয়ভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করেন। অনেককে প্রশিক্ষণ প্রদান করেন। এপ্রিল মাসে তিনি তাঁর ছোটভাই হাফিজুল্লাহ ও কয়েকজন ছাত্র- তরুণকে নিয়ে কাঠালিয়া সীমান্ত দিয়ে ভারতের আগরতলায় যান। সেখানে গিয়ে তিনি মেজর খালেদ মোশাররফ, বীর উত্তম-এর অধীনে ২ নম্বর সেক্টরে যোগ দেন। মো. মহিবুল্লাহ যখন মুক্তিযুদ্ধে বিভিন্ন স্থানে জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করছিলেন, তখন পাকবাহিনী ও তাদের দোসররা তাঁর পরিবার-পরিজনের ওপর আক্রমণ ও নির্যাতন চালায়। হানাদাররা দুবার তাঁর বাড়ি পুড়িয়ে দেয়।
মুক্তিবাহিনীর নৌ-উইং গঠিত হলে মহিবুল্লাহ অক্টোবর মাসে নৌবাহিনীতে যোগ দেন। তিনি নাবিক হিসেবে নৌবাহিনীর গানবোট পলাশ-এ পদায়িত হন। তিনি কয়েকটি অপারেশনে অংশ নেন। ৩০শে নভেম্বর ‘অপারেশন হট প্যান্টস’-এর অধীনে তাঁরা ভারতের হলদিয়া বন্দর থেকে বাংলাদেশের চালনা বন্দরে এসে ব্রিটিশ পতাকাবাহী জাহাজ ‘সিটি অব সেন্ট আল ভেনাস’-কে ধাওয়া করে কোলকাতা বন্দরে নিয়ে যান। মো. মহিবুল্লাহ ১লা থেকে ৩রা ডিসেম্বরের মধ্যে মাইন পুঁতে ৫টি বিদেশী জাহাজ ধ্বংস করায় অবদান রাখেন। এসব অপারেশনের ফলে মংলা বন্দর অচল হয়ে পড়ে।
৬ই ডিসেম্বর চালনা বন্দর ও খুলনা নৌঘাঁটি দখলের লক্ষ্যে ভারতের হলদিয়া নৌঘাঁটি থেকে গানবোট ‘পদ্মা’র সঙ্গে ‘পলাশ’ খুলনার দিকে যাত্রা করে। এদের সঙ্গে ভারতীয় গানবোট পানভেল ও চিত্রাঙ্গদা-ও ছিল। এ অভিযানের কমান্ডার ছিলেন ভারতীয় নৌবাহিনীর এম এন সামন্ত। ৯ই ডিসেম্বর গানবোটগুলো মংলা বন্দরে পৌঁছে। চিত্রাঙ্গদা-কে মংলায় রেখে পানভেল, পদ্মা ও পলাশ ১০ই ডিসেম্বর লক্ষ্যের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। সামনে পানভেল এবং পেছনে পদ্মা ও পলাশ। গানবোট পলাশ-এ অন্য মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে মহিবুল্লাহও ছিলেন। বেলা সাড়ে ১১টার দিকে গানবোটগুলো খুলনা শিপিয়ার্ডের কাছাকাছি এলে ২টি জঙ্গি বিমান নাবিকদের নজরে আসে। তাঁরা শত্রুপক্ষের বিমান ভেবে এগুলোর ওপর গুলি করার জন্য কমান্ডারের অনুমতি চান। কিন্তু কমান্ডার এম এন সামন্ত এগুলোকে ভারতীয় বিমান বলে গুলি না করার নির্দেশ দেন। একটু পর এ বিমান দুটি ফিরে এসে প্রথমে পদ্মায় এবং পরে পলাশ-এর ওপর গোলাবর্ষণ করে। এটি ছিল একটি দুর্ঘটনা। গোলায় ২টি গানবোটেই আগুন ধরে যায়। গোলাবর্ষণ ও আগুনে ভারতীয় ও বাংলাদেশের নাবিক ও যোদ্ধাদের কয়েকজন শহীদ ও অনেকে আহত হন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৮ই ডিসেম্বর নৌবাহিনীর সদস্যরা ধ্বংসপ্রাপ্ত পলাশ-এর ছাদ থেকে দুটি লাশ উদ্ধার করেন। এর একটি ছিল মো. মহিবুল্লাহর। পরে তাঁর লাশ রূপসা নদীর পূর্বতীরে রুহুল আমিন, বীরশ্রেষ্ঠ-এর কবরের পাশে দাফন করা হয়৷
বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে বীরত্ব প্রদর্শন এবং জীবনদানের স্বীকৃতিস্বরূপ বাংলাদেশ সরকার মো. হবিবুল্লাহকে ‘বীর বিক্রম’ খেতাবে ভূষিত করা হয় (গেজেট নম্বর ২০৪, খেতাবের সনদ নম্বর ১২৯)। ব্যক্তিজীবনে তিনি উদার ও পরোপকারী ছিলেন। সধারণ মানুষের সহায়তায় তিনি সব সময় সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতেন। তিনি ২ পুত্র সন্তানের জনক। তাঁর স্ত্রীর নাম মমতাজ বেগম (প্রয়াত)। [জালাল আহমেদ]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৮ম খণ্ড