বীর বিক্রম মো. দৌলত হোসেন মোল্লা
মো. দৌলত হোসেন মোল্লা, বীর বিক্রম (১৯৪৭- ১৯৭১) শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধা। তিনি ১৯৪৭ সালের ১২ই ডিসেম্বর গাজীপুর জেলার কাপাসিয়া থানার চর খামের গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম আয়েত আলী মোল্লা এবং মাতার নাম তাহেরা খাতুন। তিনি কাপাসিয়া পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিক এবং নরসিংদী কলেজ থেকে এইচএসসি পাশ করেন।
দৌলত হোসেন মোল্লা ১৯৬৬ সালে পাকিস্তান নৌবাহিনীতে যোগ দিয়ে কর্মজীবন শুরু করেন। তিনি প্রথমে করাচিতে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। পরে প্রশিক্ষণের অংশ হিসেবে বিভিন্ন জাহাজে কাজ করেন। প্রশিক্ষণ পর্বের পর তিনি করাচিতে নিযুক্ত হন। ১৯৭০ সালে তিনি পাকিস্তান নৌবাহিনীর সদস্য হিসেবে শ্রীলংকার কলম্বো যান। ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে তিনি ছুটিতে গাজীপুরে আসেন। এরপর তিনি আর চাকরিতে ফিরে যাননি। বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের ওপর পাকিস্তানি বাহিনীর নির্মম হত্যাযজ্ঞের পর দৌলত হোসেন পাকিস্তান রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে দেশকে শত্রুমুক্ত করার জন্য মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন।
দৌলত হোসেন ৯ই এপ্রিল মুক্তিবাহিনীতে যোগ দেন। প্রথমে তিনি কয়েকটি স্থল ও প্রতিরোধ যুদ্ধে বীরত্বের সঙ্গে লড়াই করেন। পরে মুক্তিবাহিনীর নৌ-উইং গঠিত হলে তিনি তাতে যোগ দেন। তিনি অপারেশন জ্যাকপট-এর আওতায় কয়েকটি যুদ্ধ ও অপারশেনে অংশ নেন। এসব ক্ষেত্রে তিনি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। মুক্তিযুদ্ধের শেষের দিকে দৌলত হোসেন বাংলাদেশ নৌবাহিনীর গানবোট ‘পলাশ’-এ যোগ দেন। তিনি পলাশ-এর ক্রুম্যান নিযুক্ত হন। ‘পদ্মা’ নামে নৌবাহিনীর আর একটি গানবোট ছিল। ৬ই ডিসেম্বর চালনা বন্দর ও খুলনা নৌঘাঁটি দখলের লক্ষ্যে ভারতের হলদিয়া নৌঘাঁটি থেকে ‘পদ্মা’র সঙ্গে ‘পলাশ’ খুলনার দিকে যাত্রা করে। তাদের সঙ্গে ভারতীয় গানবোট পানভেল ও চিত্রাঙ্গদা-ও ছিল। এ অভিযানের কমান্ডার ছিলেন ভারতীয় নৌবাহিনীর এম এন সামন্ত। ৯ই ডিসেম্বর গানবোটগুলো মংলা বন্দরে পৌঁছে। চিত্রাঙ্গদা-কে মংলায় রেখে পানভেল, পদ্মা ও পলাশ ১০ই ডিসেম্বর লক্ষ্যের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। সামনে পানভেল এবং পেছনে পদ্মা ও পলাশ। পলাশ-এ অন্য মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে দৌলত হোসেনও ছিলেন। বেলা সাড়ে ১১টার দিকে গানবোটগুলো খুলনা শিপিয়ার্ডের কাছাকাছি এলে ২টি জঙ্গি বিমান নাবিকদের গোচরীভূত হয়। তাঁরা শত্রুপক্ষের বিমান ভেবে এগুলোর ওপর গুলি করার অনুমতি চান। কিন্তু কমান্ডার এম এন সামন্ত এগুলোকে ভারতীয় বিমান বলে গুলি না করার নির্দেশ দেন। একটু পর এ বিমানগুলো ফিরে এসে প্রথমে পদ্মায় এবং পরে পলাশ-এর ওপর গোলাবর্ষণ করে। ভুলবশত এ দুর্ঘটনা ঘটে। দুটি গানবোটেই আগুন ধরে যায়। গোলাবর্ষণ ও আগুনে ভারতীয় ও বাংলাদেশের নাবিক ও যোদ্ধাদের কয়েকজন শহীদ ও অনেকে আহত হন। দৌলত হোসেনও মারাত্মকভাবে আহত হন। কিন্তু জীবন রক্ষার শেষ উপায় হিসেবে তিনি জ্বলন্ত জাহাজ থেকে নদীতে লাফিয়ে পড়েন এবং অনেক কষ্টে নদীর তীরে পৌঁছতে সক্ষম হন। কিন্তু তীরে থাকা রাজাকাররা তাঁকে ধরে ফেলে। তারা বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে-খুঁচিয়ে নিষ্ঠুরভাবে তাঁকে হত্যা করে। বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে বীরত্ব ও সাহসিকতা প্রদর্শন এবং জীবনদানের স্বীকৃতিস্বরূপ বাংলাদেশ সরকার মো. দৌলত হোসেন মোল্লাকে ‘বীর বিক্রম’ খেতাবে ভূষিত করে (গেজেট নম্বর ২০৩, খেতাবের সনদ নম্বর ১২৮)। ব্যক্তিজীবনে তিনি এক কন্যা সন্তানের জনক। তাঁর স্ত্রীর নাম আমেনা বেগম। [জালাল আহমেদ]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৮ম খণ্ড