You dont have javascript enabled! Please enable it! বীর প্রতীক মো. নূর হামিম - সংগ্রামের নোটবুক

বীর প্রতীক মো. নূর হামিম

মো. নূর হামিম, বীর প্রতীক (১৯৫৪-২০১৬) বীর মুক্তিযোদ্ধা। তিনি ১৯৫৪ সালের ১০ই নভেম্বর পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলার ভগবানগোলা থানার হাবাসপুর গ্রামে নানা বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পৈতৃক বাড়ি রাজশাহী জেলার গোদাগাড়ি উপজেলার পিরিজপুর গ্রামে। তাঁর পিতার নাম ডা. মো. আবদুল আলিম, মাতার নাম নূর মহল। ৩ ভাই ও ১ বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন সবার বড়। ছোটবেলায় তিনি পিতৃহীন হন। তাঁর প্রকৃত নাম আবু মো. নূর হামিম রিজভী|
১৯৭১ সালে উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণির ছাত্র ছিলেন। ছাত্রাবস্থায়ই তিনি রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ বিজয় অর্জন করলেও পাকিস্তানি সামরিক জান্তা ক্ষমতা হস্তান্তরের পরিবর্তে ষড়যন্ত্রের আশ্রয় গ্রহণ করে। এতে একজন সচেতন বাঙালি হিসেবে অন্যদের মতো তিনিও ক্ষুব্ধ হন। বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষণ- তাঁকে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণে অনুপ্রাণিত করে।
মুক্তিযুদ্ধ শুরুর বছর খানেক পূর্বে মো. নূর হামিম রিজভী ভারতে নানাবাড়িতে চলে যান। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে মায়ের কথায় অনুপ্রাণিত হয়ে মাতৃভূমিকে বাঁচাতে তিনি মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। এপ্রিল মাসে ভারতের বিহার রাজ্যের চাকুলিয়ায় ২৯ দিনের সশস্ত্র প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। প্রশিক্ষণ শেষে ভারতীয় নাইনটিন মারাঠা সেনাবাহিনীর একজন ক্যাপ্টেনের অধীনে পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলার লালগোলা থানার ধুল্লাউড়ি ক্যাম্পে যোগ দেন। প্রশিক্ষণে পারদর্শিতার জন্য তাঁকে গ্রুপ কমান্ডারের দায়িত্ব প্রদান করা হয়। এখানে অবস্থানকালে তিনি বাংলাদেশে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে একাধিক সফল অপারেশন পরিচালনা করেন। পরবর্তীতে তিনি ৭নং সেক্টরের কমান্ডার কর্নেল কাজী নূরুজ্জামানের অধীনে ৪নং সাব-সেক্টর কমান্ডার ক্যাপ্টেন গিয়াসউদ্দিন আহমেদ চৌধুরী, বীর বিক্রমএর নেতৃত্বে ‘হিট এন্ড রান’ গ্রুপের গেরিলা যোদ্ধা হিসেবে বিভিন্ন যুদ্ধ ও অপারেশনে অংশগ্রহণ করেন।
মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে মো. নূর হামিম হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসরদের আহুত কাকনহাটে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী একটি জনসভা পণ্ড করে দেন। রাজশাহী-চাঁপাইনবাবগঞ্জ মহাসড়কের প্রেমতলীর পার্শ্ববর্তী ফরদপুর গ্রামের ফরদপুর ব্রিজ তিনি তাঁর গ্রুপ নিয়ে ধ্বংস করেন। ২১শে আগস্ট ক্যাপ্টেন গিয়াস উদ্দিন আহমেদ চৌধুরীর নেতৃত্বে অভয়া ব্রিজ অপারেশনে এলএমজি-ম্যান হিসেবে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন এবং হানাদার বাহিনীর ব্যাপক ক্ষতিসাধন করেন। ৭ই নভেম্বর মো. নূর হামিম রাজশাহী-চাঁপাইনবাবগঞ্জ মহাসড়কের পবা উপজেলার কসবায় পাকিস্তানি সৈন্যদের একটি টহল জিপ এম্বুশ করেন। এতে পাঞ্জাব রেজিমেন্টের একজন ক্যাপ্টেন, ৯ জন সৈন্য ও একজন পুলিশ অফিসার নিহত এবং জিপটি সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়।
মহান মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ বাংলাদেশ সরকার মো. নূর হামিমকে ‘বীর প্রতীক’ খেতাবে ভূষিত করে। মো. নূর হামিম কৈশোরে ফুটবল এবং ক্রিকেট খেলায় পারদর্শী ছিলেন। স্বাধীনতাপরবর্তী সময়ে তিনি রাজশাহী শহরের বোয়ালিয়ায় বসবাস শুরু করেন। এ-সময় তিনি নিজেকে বিভিন্ন সামজিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে জড়িত রাখেন। তিনি রাজশাহীতে অনেকগুলো ক্রীড়া ক্লাব ও নিজ গ্রাম পিরিজপুরে ‘সুরসপ্তক সাংস্কৃতিক পরিষদ’-এর প্রতিষ্ঠাতা। সঙ্গীত অঙ্গনে তাঁর ঈর্ষণীয় দক্ষতা ছিল। এছাড়া তিনি রাজশাহী শহরে প্রতিষ্ঠিত সূর্যশিখা, নোসিন আর্ট ও শিল্পাশ্রম-এর সংগীতের ওস্তাদ এবং রেডিও বাংলাদেশের অনিয়মিত কণ্ঠশিল্পী ছিলেন। তিনি ২০১৬ সালের ২২শে ফেব্রুয়ারি ৬৫ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুকালে তিনি স্ত্রী ফজিলাতুননেছা এবং ২ পুত্র সন্তান রেখে যান। তাঁকে নিজ বাড়ি রাজশাহী জেলার গোদাগাড়ি উপজেলার পিরিজপুর গ্রামে সমাহিত করা হয়। [মনিরুজ্জামান শাহীন]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৮ম খণ্ড