বীর প্রতীক মো. আব্দুল হাই সরকার
মো. আব্দুল হাই সরকার, বীর প্রতীক (জন্ম ১৯৫৫) কোম্পানি কমান্ডার ও বীর মুক্তিযোদ্ধা। তিনি ১৯৫৫ সালের ১২ই জুলাই কুড়িগ্রাম জেলার সদর উপজেলার মোগলবাসা ইউনিয়নের মালভাঙা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম রমজান আলী সরকার এবং মাতার নাম হাফেজা খাতুন। আবদুল হাই সরকার ছিলেন একজন শ্রমিক। ১৯৭১ সালে তিনি ব্রিটিশ-আমেরিকান টোব্যাকো কোম্পানির ঢাকাস্থ মহাখালী কারখানায় দিনভিত্তিক মজুরিতে চাকরি করতেন। ২৫শে মার্চ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী গণহত্যা শুরু করলে ১লা এপ্রিল আবদুল হাই সরকার ঢাকা থেকে পালিয়ে বহু কষ্টে ৮ই এপ্রিল নিজ এলাকায় পৌঁছান। নিজ বাড়িতে কয়েকদিন অবস্থানের পর ১৫ই এপ্রিল তিনি ভুরুঙ্গামারী কলেজ মাঠে মুক্তিযুদ্ধ প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে যোগ দেন। ১৫ দিন প্রশিক্ষণ শেষে উচ্চতর প্রশিক্ষণ গ্রহণের জন্য তিনি ভারতের মুজিব ক্যাম্পে যোগ দেন। ২৮ দিন প্রশিক্ষণ শেষে সোনাহাটি বিএসএফ ক্যাম্পে অন্তর্ভুক্ত হন। এ-সময় তিনি দুধকুমার নদীর ওপর সোনাহাটি ব্রিজ ধ্বংসে ভূমিকা রাখেন। কিছুদিন পর আবার মুজিব ক্যাম্পে ১৫ দিনের সামরিক প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। এরপর ৬ নম্বর সেক্টরের সাহেবগঞ্জ সাব-সেক্টরের অধীন কুড়িগ্রাম এলাকায় যুদ্ধ করেন। তিনি মোগলবাসা, গড়াইহাট, বুড়াবুড়ি, ফুলবাড়ি, কাগলাসহ কয়েকটি জায়গায় গেরিলা ও সম্মুখ যুদ্ধে সাহসিকতাপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। তিনি ছদ্মবেশে হানাদারদের খবর সংগ্রহ করে ক্যাপ্টেন নওয়াজেশ উদ্দিনের কাছে সরবরাহ করতেন। ২০শে আগস্ট নাগেশ্বরীর নাহারগঞ্জের যুদ্ধে তিনি আহত হন। চিকিৎসা শেষে তিনি পুনরায় যুদ্ধ করেন এবং কোম্পানি কমান্ডারের দায়িত্ব পান, যা হাই কোম্পানি নামে পরিচিতি লাভ করে।
নভেম্বরের মাঝামাঝি কুড়িগ্রাম জেলার উলিপুরে পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের যুদ্ধ হয়। এ যুদ্ধে পাকিস্তানি সৈন্যদের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। এরপর তারা আশপাশের প্রায় ৭০০ নিরীহ গ্রামবাসীকে ধরে এনে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করে। এ ঘটনার প্রতিশোধ নিতে সুযোগ খুঁজছিলেন আবদুল হাই সরকার ও তাঁর কোম্পানির সহযোদ্ধারা। তাঁরা কুড়িগ্রাম-চিলমারী রেললাইনের উলিপুর অংশের হালাবটগাছে রেললাইনে অ্যান্টিট্যাংক মাইন পুঁতে পাকিস্তানি সৈন্য ও রসদবাহী ট্রেন এম্বুশ করার সিদ্ধান্ত নেন। এজন্য তাঁরা সাব-সেক্টর হেডকোয়ার্টার্স থেকে এন্টিট্যাংক মাইন সংগ্রহ করেন। আবদুল হাই জানতে পারেন, নভেম্বর মাসের শেষদিকে পাকিস্তানি সৈন্য ও রসদবাহী ট্রেন কুড়িগ্রাম থেকে উলিপুর আসবে। এ খবর পেয়ে ২৬শে নভেম্বর ভোররাতে আবদুল হাই সরকার তাঁর কোম্পানির মুক্তিযোদ্ধা ও নজরুল কোম্পানির সেকশন কমান্ডার জসিমের জসিমের অধীনস্থ মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে হালাবটগাছ নামক স্থানে অবস্থান নেন। আশপাশে তখন তেমন কোনো জনবসতি ছিল না। তাঁরা সেখানে রেললাইনের স্লিপারের নিচে এন্টিট্যাংক মাইন পুঁতে মাইনে ডেটোনেটর লাগিয়ে অপেক্ষা করতে থাকেন। সকাল নয়টার দিকে কুড়িগ্রাম থেকে পাকিস্তানি সৈনা ও রসদবাহী একটি ট্রেন উলিপুরে আসছিল। ট্রেনের একদম সামনে ছিল মাটিভর্তি ওয়াগন। সেটি চিহ্নিত স্থান অতিক্রম করামাত্র মুক্তিযোদ্ধারা ডেটোনেটরের মাধ্যমে মাইনগুলোর বিস্ফোরণ ঘটান। সঙ্গে-সঙ্গে গোটা এলাকা গগনবিদারী শব্দে প্রকম্পিত হয়ে ওঠে। একটি বগি দুমড়ে-মুচড়ে রেললাইনের পাশে পড়ে যায়। পেছনের বগিও উল্টে পড়ে। এতে ১৪-১৫ জন পাকিস্তানি সৈন্য নিহত হয়। বেঁচে যাওয়া সৈন্যরা পজিশন নিয়ে গুলি করতে থাকে। এ-সময় মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্রগুলোও একসঙ্গে গর্জে ওঠে। মুক্তিযোদ্ধাদের এ আক্রমণে পাকসেনারা দিশেহারা হয়ে পড়ে। কিছুক্ষণ প্রতিরোধ চালিয়ে তারা কুড়িগ্রামের দিকে পালিয়ে যায়। এ অপারেশনে ১৯ জন পাকিস্তানি সৈন্য নিহত হয়। অন্যদিকে মুক্তিযোদ্ধাদের পথপ্রদর্শকসহ ৮ জন সাধারণ গ্রামবাসী শহীদ হন। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে হালাবটগাছ অপারেশন ছিল গৌরবোজ্জ্বল ঘটনা। কুড়িগ্রাম শহর হানাদারমুক্তকরণে বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল হাই সরকার বিশেষ ভূমিকা পালন করেন। মহান মুক্তিযুদ্ধে সাহস ও বীরত্ব প্রদর্শনের জন্য আবদুল হাই সরকারকে বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক ল্যান্স নায়েক হিসেবে একবার এবং গণবাহিনীর সদস্য হিসেবে একবার মোট ২ বার ‘বীর প্রতীক’ খেতাবে ভূষিত করা হয়। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে তিনি এসএসসি পাস করেন। এরপর গণপূর্ত বিভাগের চাকরিতে যোগদান করেন। ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময় রাজনৈতিক কারণে তাঁকে চাকরিচ্যুত করা হয়। এরপর থেকে পরিবার-পরিজন নিয়ে তিনি কুড়িগ্রামে মানবেতর জীবন যাপন করছেন। তাঁর স্ত্রী গুলশান আরা বেগম। এ দম্পতি ৭ মেয়ে ও ৩ ছেলের জনক-জননী। [রেহানা পারভীন]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৮ম খণ্ড