বীর প্রতীক মো. আব্দুস সালাম
মো. আব্দুস সালাম, বীর প্রতীক (জন্ম ১৯৫২) ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের অন্যতম নেতা, বীর মুক্তিযোদ্ধা ও অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল। তিনি ১৯৫২ সালে সিলেট জেলার গোলাপগঞ্জ উপজেলাধীন বরায়া উত্তরভাগে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম হাফিজ মোজাম্মেল আলী ও মাতার নাম মুমেনা খানম। মুক্তিযুদ্ধের প্রাক্কালে তিনি ঢাকার জিন্নাহ কলেজ (বর্তমানে তিতুমীর কলেজ)-এর ছাত্র ছিলেন। স্নাতক প্রথম বর্ষের ছাত্র হিসেবে অধ্যয়নকালে তিনি উক্ত কলেজে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের অন্যতম নেতা নির্বাচিত হন। কলেজের প্রতিনিধি হিসেবে তিনি কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সদস্য হন। মার্চ মাসে কেন্দ্র থেকে ছাত্রনেতাদের নিজ নিজ জেলায় গিয়ে কাজ করার নির্দেশ দিলে তিনি সিলেটে চলে যান।
২৫শে মার্চ রাতে সংঘটিত ভয়াবহ গণহত্যার পর তিনি কয়েকদিন তাঁর সহযোগী করিমগঞ্জে চলে যান।
কয়েকজনের সঙ্গে শহরের সার্বিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করেন। এরপর মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য একটি গাড়ি নিয়ে তেলিয়াপাড়ার উদ্দেশে জকিগঞ্জ সীমান্ত দিয়ে ভারতের সেখান থেকে আগরতলা হয়ে তেলিয়াপাড়া চা বাগানে এসে ২য় ইস্ট বেঙ্গলের অধীনে প্রশিক্ষণ নিয়ে ৩নং সেক্টরে যোগদান করেন। আব্দুস সালাম উক্ত সেক্টরের সাব-সেক্টর কমান্ডার ক্যাপ্টেন হেলাল মুর্শেদের অধীনে বহু যুদ্ধে বীরত্বের পরিচয় দেন। দারাগাও রেলব্রিজ ধ্বংসে তিনি বিশেষ দক্ষতা ও বীরত্ব প্রদর্শন করেন। আগস্টের তৃতীয় সপ্তাহে ৩নং সেক্টরের অধিনায়ক মেজর কে এম সফিউল্লাহ, বীর উত্তম শায়েস্তাগঞ্জের (হবিগঞ্জ) পূর্বদিকে করাঙ্গী নদীর ওপর দারাগাও রেলওয়ে ব্রিজ ধ্বংস করার জন্য সালামকে দায়িত্ব প্রদান করেন। ব্রিজটি সম্পূর্ণ ধ্বংস করার জন্য ৪০০ পাউন্ড এক্সপ্লোসিভসহ ৪০ জন মুক্তিযোদ্ধার একটি দল নিয়ে তিনি আশ্রমবাড়ি ক্যাম্প থেকে সকালে রওনা দিয়ে রাত ৩.৩০টায় প্রায় ২৫ মাইল দূরবর্তী ব্রিজের কাছাকাছি পৌছেন। তখন ব্রিজের পশ্চিম পাশে অবস্থিত একটি ঘরে ঘুমন্ত ৭ জন এবং বাইরে প্রহরারত আরো ২ জন রাজাকার ছিল। সালাম তাঁর দলকে দুভাগে ভাগ করে একদলকে ব্রিজের নিচে এক্সক্লোসিভ লাগানোর জন্য প্রেরণ করেন। বাকিদের নিয়ে সতর্কতার সঙ্গে ক্রলিং করে ব্রিজের কাছে গিয়ে প্রথমেই ২ জন প্রহরীকে বুকে অস্ত্র ”ধরে তাদের হাত-মুখ বেঁধে ফেলেন। তারপর দ্রুত প্রহরা ঘরে প্রবেশ করে অস্ত্রের মুখে ৭ জন রাজাকারকে বেঁধে ৭টি রাইফেল হস্তগত করেন। ততক্ষণে ব্রিজের নিচে এক্সক্লোসিভ লাগানোর পর বন্দিদের ব্রিজের মাঝখানে বেঁধে বিস্ফোরণ ঘটানোর উদ্যোগ নিতে গিয়ে দেখেন আরো ২ জন রাজাকার এগিয়ে আসছে। সময়ের স্বল্পতার কারণে তাদের গুলি করে হত্যার পর বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। ফজরের আজানের সময় প্রচণ্ড শব্দে ব্রিজটি ধ্বংস এবং রাজাকারদের মৃত্যু নিশ্চিত হলে ক্যাম্পের পথে ফিরে যায় আব্দুস সালামের দল।
মহান মুক্তিযুদ্ধে সাহসিকতা ও বীরত্বপূর্ণ অবদানের জন্য বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক মো. আব্দুস সালামকে “বীর প্রতীক’ খেতাবে ভূষিত করা হয়। দেশ স্বাধীন হলে আব্দুস সালাম ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশ মিলিটারি একাডেমির প্রথম কমিশন অফিসার ব্যাচ এসএসসি-১ এ যোগদান করেন। ১৯৭৫ সালে কমিশন লাভ করে সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট হিসেবে ১৪ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে যোগদান করেন। সফল সৈনিক জীবন শেষে ১৯৯৮ সালে তিনি কর্নেল হিসেবে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী থেকে অবসর গ্রহণ করেন। মো. আব্দুস সালাম ১ পুত্র সন্তানের জনক। তাঁর স্ত্রীর নাম নূরুন নাহার সালাম। [মুহম্মদ সায়েদুর রহমান তালুকদার]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৮ম খণ্ড