মুহাড়াপাড়া যুদ্ধ (হাকিমপুর, দিনাজপুর)
মুহাড়াপাড়া যুদ্ধ (হাকিমপুর, দিনাজপুর) সংঘটিত হয় দু-দফায় নভেম্বরের শেষদিকে এবং ডিসেম্বরের প্রথম দিকে। এতে মিত্রবাহিনী ও মুক্তিবাহনীর ব্যাপক সংখ্যক সৈন্য শহীদ হন।
হাকিমপুর উপজেলার হিলি সীমান্ত বাংলাদেশের হিলি ও ভারতের পশ্চিম দিনাজপুরের প্রধান যোগাযোগ কেন্দ্র হওয়ায় রণকৌশলগত কারণে এ স্থানটি দখলে রাখা পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নিকট খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। তাই মুক্তিযুদ্ধের শুরু থেকেই তারা হিলি সীমান্ত দখল করার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে
যুদ্ধের প্রথম পর্যায়ে ১৪ই এপ্রিল পাকিস্তানি সেনারা হিলি দখলের চেষ্টা চালালে ক্যাপ্টেন আনোয়ার হোসেনের নেতৃত্বে তৃতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের আলফা বাহিনীসহ সাধারণ ছাত্র-জনতা প্রতিরোধ গড়ে তোলে। ১৮ই এপ্রিল পর্যন্ত প্রতিরোধযোদ্ধারা হানাদারদের ঠেকিয়ে রাখতে সমর্থ হন। কিন্তু ১৯শে এপ্রিল পাঁচবিবি, ঘোড়াঘাট ও বিরামপুরের দিক থেকে পাকিস্তানি সেনাদের ত্রিমুখী আক্রমণ শুরু হলে মুক্তিযোদ্ধারা ছত্রভঙ্গ হয়ে যান। আলফা বাহিনীসহ প্রতিরোধযোদ্ধারা ভারতের ভেতরে পালিয়ে গিয়ে বকশীগঞ্জ আমবাগানে অবস্থান নেন। এ যুদ্ধের পর হিলি সীমান্তসহ হাকিমপুর উপজেলা পুরোপুরি পাকিস্তানি সেনাদের দখলে চলে যায়। দখল স্থায়ী করার জন্য হানাদারদের ৪ ফ্রন্টিয়ার ফোর্স ছাতনী, মুহাড়াপাড়া ও বাসুদেবপুরে তিনটি শক্তিশালী ক্যাম্প স্থাপন করে। এ ক্যাম্পগুলোর পরস্পরের মধ্যে দূরত্ব ছিল দেড় থেকে দুই কিলোমিটার। পাশাপাশি মুহাড়াপাড়া, হিলি বাজার, পালপাড়া, নওপাড়া, চণ্ডীপুর; ফকিরপাড়াসহ বিভিন্ন স্থানে হানাদার বাহিনী কংক্রিটের বাংকার নির্মাণ করে। এক বাংকার থেকে আরেক বাংকার, এক ক্যাম্প থেকে আরেক ক্যাম্পে যাতায়াতের জন্য ট্রেঞ্চ নির্মাণ করে। ট্রেঞ্চের মাধ্যমে এক বাংকার থেকে আরেক বাংকারে যাতায়াতের ব্যবস্থা থাকায় পাকিস্তানি সেনারা ঠিক কোন জায়গায় অবস্থান করছে তা দিনের বেলায়ও বোঝা যেত না। মুহাড়াপাড়ার বাংকারটি এত গভীর ও বিশাল ছিল যে, সেখানে বেশ কয়েকটি ট্যাংক এবং বহু সংখ্যক পাকিস্তানি সৈন্য ছিল। এভাবে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী হিলি সীমান্তকে তাদের নিজেদের জন্য একটি দুর্ভেদ্য দুর্গে পরিণত করে। তারা সীমান্তের বিভিন্ন এলাকায় যখন-তখন হামলা, লুটপাট, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ ও নির্যাতনের ঘটনা ঘটাতে থাকে। প্রায় প্রতিদিনই তারা দেড়-দুশ গজ দূরে সীমান্তের দিকে গোলাগুলি নিক্ষেপের মাধ্যমে ভারতীয় বাহিনীকেও অস্থির করে তুলত। তাদের গুলিতে সীমান্তের অনেক ভারতীয় নাগরিক মারা যায়। এমতাবস্থায় মুক্তিবাহিনী পাকিস্তানি ঘাঁটিতে কয়েক দফা হামলা চালিয়ে ব্যর্থ হয়। অব্যাহত হামলায় অস্থির হয়ে ভারতীয় সেনারা ২১ থেকে ২৩শে নভেম্বর পর্যন্ত পাকিস্তানি হানাদারদের ঘাঁটি লক্ষ করে আর্টিলারি ও বিমান হামলা চালায়। কিন্তু হানাদারদের ঘাঁটি এতই দুর্ভেদ্য ছিল যে, এসব হামলায় তাদের কোনভাবেই কাবু করা যাচ্ছিল না, বরং তিনদিনের ঐ যুদ্ধে বেশ কয়েকজন ভারতীয় সেনা প্রাণ হারান।
অতঃপর ভারতীয় সেনা ও মুক্তিযোদ্ধারা দীর্ঘ প্রস্তুতি নেন। ডিসেম্বরের শুরুতে ভারত সরকার পাকিস্তানের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক যুদ্ধ ঘোষণা করলে মিত্রবাহিনী ও মুক্তিবাহিনীর কয়েক হাজার সদস্য সর্বাত্মক প্রস্তুতি নিয়ে ৯, ১০ ও ১১ই ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাংকারগুলোতে ব্যাপক বিমান, আর্টিলারি ও ট্যাংক হামলা চালান। পাকিস্তানি সেনারা ট্যাংকসহ ভারী অস্ত্র দ্বারা হামলা প্রতিরোধ করে। তারা অন্যান্য ঘাঁটি থেকে সরে এসে মুহাড়াপাড়ার বাংকারে শক্ত ডিফেন্স তৈরি করে। মিত্রবাহিনী গুলি, শেল ও বোমাবর্ষণের পাশাপাশি বাংকারের ভেতর গরম পানি নিক্ষেপ করতে থাকে। বাধ্য হয়ে এক পর্যায়ে পাকিস্তানি সেনারা বাংকার ছেড়ে বাইরে আসতে থাকলে স্থল বাহিনীর হামলার মুখে পড়ে এবং সম্মুখ যুদ্ধ হয়। অবশেষে উভয় পক্ষে ব্যাপক হতাহতের মধ্য দিয়ে ১১ই ডিসেম্বর হিলি-হাকিমপুর হানাদারমুক্ত হয়। এ ভয়াবহ যুদ্ধে তিনশতাধিক ভারতীয় সেনা ও দেড়শতাধিক মুক্তিযোদ্ধা প্রাণ হারান। তবে এ যুদ্ধে খুব কম সংখ্যক পাকসেনা প্রাণ হারায় এবং বাকিরা পালিয়ে যায়। তারা পালিয়ে যাওয়ার সময় নবাবগঞ্জ উপজেলার চড়ারহাটে ব্যাপক গণহত্যা সংঘটিত করে। ভাদুরিয়া এলাকায় তাদের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের ব্যাপক যুদ্ধ সংঘটিত হয় এবং ৩০ জন পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়। [আজহারুল আজাদ জুয়েল]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৮ম খণ্ড