বীর বিক্রম মুহাম্মদ মুস্তাফিজুর রহমান
মুহাম্মদ মুস্তাফিজুর রহমান, বীর বিক্রম (১৯৪১- ২০০৮) বীর মুক্তিযোদ্ধা, সাব-সেক্টর কমান্ডার, স্বাধীন বাংলাদেশে সেনাবাহিনী প্রধান। তিনি ১৯৪১ সালের ২০শে জানুয়ারি রংপুর সদর উপজেলার রিন্নাটারী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম আব্দুস সাত্তার এবং মাতার নাম জরিমন নেছা৷ মেধাবী ছাত্র মুস্তাফিজুর রহমান রংপুরের ধাপ প্রাইমারি স্কুল ও রংপুর মাইনর স্কুল (বর্তমান রংপুর হাইস্কুল) থেকে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বৃত্তি লাভ করেন। ১৯৫৬ সালে তিনি রংপুর জেলা স্কুল থেকে মেট্রিকুলেশন পরীক্ষায় বিজ্ঞান শাখায় প্রথম বিভাগে ১১তম স্থান ও ১৯৫৮ সালে রংপুর কারমাইকেল কলেজ থেকে এইচএসসি পরীক্ষায় বিজ্ঞান শাখায় প্রথম বিভাগে চতুর্থ স্থান অধিকার করেন। ১৯৬০ সালে একই কলেজ থেকে তিনি কৃতিত্বের সঙ্গে বিএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ১৯৬৫ সালে তিনি ঢাকা প্রোকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) থেকে বিএসসি ইঞ্জিনিয়ারিং (সিভিল) ডিগ্রি লাভ করেন। এ বছরই তিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ইঞ্জিনিয়ারিং কোরে মনোনীত হন এবং ১৯৬৬ সালে কাকুল মিলিটারি একাডেমিতে সফলতার সঙ্গে প্রশিক্ষণ শেষে কমিশন লাভ করেন।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরুর আগে মুহাম্মদ মুস্তাফিজুর রহমান ক্যাপ্টেন পদে এসিস্ট্যান্ট গ্যারিসন ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে পাকিস্তান এয়ারফোর্স কুর্মিটোলা, ঢাকা সেনানিবাসে কর্মরত ছিলেন। ২৫শে মার্চ রাতে অপারেশন সার্চলাইট-এর নামে পাক হানাদার বাহিনী ঢাকা শহরসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে নির্বিচারে গণহত্যা শুরু করলে তার প্রতিবাদে শুরু হয় বাঙালির প্রতিরোধ যুদ্ধ। মুস্তাফিজুর রহমান ২৮শে মার্চ ঢাকা সেনানিবাস ত্যাগ করে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন।
সেক্টরভিত্তিক মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে মুস্তাফিজুর রহমান ৮ নং সেক্টরের বানপুর সাব-সেক্টরের কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এই সাব-সেক্টরের বিভিন্ন স্থানে তিনি পাকিস্তানি সৈন্য এবং তাদের এ দেশীয় দোসরদের বিরুদ্ধে বীরত্বের সঙ্গে যুদ্ধ পরিচালনা করেন। তাঁর নেতৃত্বে পরিচালিত যুদ্ধের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য চুয়াডাঙ্গা জেলার জীবননগর থানার ধোপাখালীর যুদ্ধ। ধোপাখালী স্থানটি ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী হওয়ায় এর গুরুত্ব বিবেচনা করে পাকিস্তানি বাহিনী এখানে একটি শক্ত ঘাঁটি স্থাপন করে। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে এখানে অনেকগুলো খণ্ড ও গেরিলাযুদ্ধ সংঘটিত হয়। নভেম্বর মাসের প্রথমদিকে মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় মিত্রবাহিনী যৌথভাবে এ ঘাঁটি আক্রমণের সিদ্ধান্ত নেয়। পরিকল্পনা অনুযায়ী ১১ই নভেম্বর রাতে যৌথবাহিনী ধোপাখালী আক্রমণ করে। প্রতিআক্রমণে পাকিস্তানি সেনারা মেশিনগান ও আর্টিলারি মর্টার ফায়ার শুরু করে। মুস্তাফিজুর রহমান প্রচণ্ড মনোবল ও সাহসের সঙ্গে শত্রুর মোকাবেলা করেন। যুদ্ধের এক পর্যায়ে তিনি পেটে গুলিবিদ্ধ হন এবং ভারতীয় সেনাবাহিনীর ফিল্ড হাসপাতালে তাঁর চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়। এ যুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখার জন্য তাৎক্ষণিকভাবে তাঁকে মেজর পদে পদোন্নতি দেয়া হয়।
মহান মুক্তিযুদ্ধে বীরত্ব ও অসামান্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ বাংলাদেশ সরকার মুহাম্মদ মুস্তাফিজুর রহমানকে ‘বীর বিক্রম’ উপাধিতে ভূষিত করে (গেজেট নং ৮৪, খেতাবের সনদ নং ৯)। মুক্তিযুদ্ধ শেষে তিনি তাঁর কর্মক্ষেত্র বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে যোগদান করেন এবং ২০০০ সালে জেনারেল পদে উন্নীত হন। মুস্তাফিজুর রহমান তাঁর সুদীর্ঘ কর্মজীবনে সেনাবাহিনীর বহু গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯৮ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত তিনি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রধান (চিফ অব স্টাফ) হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। মুক্তিযুদ্ধের গৌরবময় অধ্যায় চিরস্মরণীয় করে রাখার জন্য তাঁর উদ্যোগে ঢাকা সেনানিবাসে বঙ্গবন্ধু জাদুঘর (১৯৯৮) এবং মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক জাদুঘর ‘বিজয় কেতন’ প্রতিষ্ঠা করা হয়। এছাড়াও তিনি ১৯৯৪ সালে যশোরে বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের জাদুঘর ‘গৌরবাঙ্গন’ ও স্মৃতিসৌধ ‘রক্তঋণ’ প্রতিষ্ঠা করেন। ২০০০ সালে তিনি সেনাবাহিনী থেকে অবসর গ্রহণ করেন। ব্যক্তিজীবনে মুস্তাফিজুর রহমান তিন কন্যা সন্তানের জনক। তাঁর স্ত্রীর নাম রাশিদা মুস্তাফিজ। ২০০৮ সালের ৩রা আগস্ট এই বীর মুক্তিযোদ্ধা পরলোক গমন করেন। [সাজাহান মিয়া]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৮ম খণ্ড