You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.04.12 | মুড়াপাড়া গণহত্যা ও গণকবর (রূপগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ) - সংগ্রামের নোটবুক

মুড়াপাড়া গণহত্যা ও গণকবর (রূপগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ)

মুড়াপাড়া গণহত্যা ও গণকবর (রূপগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ) নারায়ণগঞ্জ জেলার রূপগঞ্জ উপজেলার একটি ইউনিয়ন মুড়াপাড়া। ১২ই এপ্রিল এখানে একটি গণহত্যা সংঘটিত হয়। এদিন মুড়াপাড়া ইউনিয়নের হোমিওপ্যাথিক ডাক্তার আব্দুর রহিম, মুড়াপাড়া জুট মিলস-এর মালিক গুল বখস ভূঁইয়া, লতিফ ও লাল মিয়ার সহায়তায় পাকসেনারা ডেমরা থেকে গানবোটে করে মুড়াপাড়া বাজারে আসে। আব্দুর রহিম পূর্বেই পাকসেনাদের রূপগঞ্জ থানার ম্যাপ ও তথ্য সরবরাহ করেছিল। ঘটনার দিন সকাল ১০টার দিকে পাকসেনারা স্থানীয় রাজাকারদের সঙ্গে নিয়ে হিন্দু-অধ্যুষিত মুড়াপাড়ার দিকে অগ্রসর হয়। পাকসেনাদের আসার খবর শুনে লোকজন প্রাণভয়ে ছোটাছুটি শুরু করে। মুড়াপাড়া পাইলট স্কুলের সংস্কৃত শিক্ষক পণ্ডিত রাধাবল্লভ দাস স্ত্রী অমত্য দাসী ও তিন বছরের নাতনী মহামায়াকে নিয়ে মেয়ের বাড়ি জাঙ্গীরে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। মুড়াপাড়া ইউনিয়ন অফিসের সামনে পৌঁছতেই তারা পাকসেনাদের সামনে পড়ে যান। পাকসেনারা তার নাতনী মহামায়াকে জিজ্ঞেস করে, “তুমি হিন্দু না মুসলমান?’ শিশুটি হিন্দু বললে একজন পাকসেনা তাকে কাঁধে তুলে নেয়। পণ্ডিত রাধাবল্লভ দাসকে পিছমোড়া করে সুপারিগাছের সঙ্গে বেঁধে উলঙ্গ করে তাঁর ওপর নির্যাতন চালায়। নির্যাতনের পর গুলি করার প্রস্তুতি নিলে তার স্ত্রী বাধা দেন। তখন পাকসেনারা দুজনকেই গুলি করে লাশ খাদে ফেলে দেয়। এরপর শিশুটিকে কাঁধে নিয়ে তারা গ্রামের প্রতিটি বাড়িতে আক্রমণ চালায়। নিরপরাধ ৫- ৬ জন হিন্দুকে ধরে এনে মায়া সিনেমা হলের সামনে জড়ো করে। তারপর তাদের একই রশিতে বেঁধে গুলি করে হত্যা করে এবং লাশগুলো মুড়াপাড়া নগরের প্রফুল্ল মাস্টারের বাড়ির বাঁশঝাড়ের সামনে মাটিতে পুঁতে রাখে। পাকসেনারা গ্রামে তাণ্ডবলীলা শেষ করতে-করতে বিকেল হয়ে যায়। এরপর তারা শিশুটিকে তার দাদু রাধাবল্লভের লাশের কাছে এনে কাঁধ থেকে নামিয়ে এবং তার মুখ হাঁ করিয়ে মুখের ভেতর গুলি করে আছাড় দিয়ে মাটিতে ফেলে দেয়।
মুড়াপাড়া গণহত্যার কয়েকদিন পর পাকসেনারা এক বিকেলে গাড়ি নিয়ে মুড়াপাড়া বাজারের কাছে শীল বাড়ির সামনে আসে এবং ১৫-২০ জন পাকসেনা উমেশ শীলের বাড়িতে ঢোকে। তখন কৃষ্ণ দাসী নামে এক মহিলা নিকটস্থ চালকলে কাজ করছিলেন। পাকসেনারা গ্রামে ঢুকেছে এ খবর শুনেই তিনি এক দৌড়ে বাড়িতে গিয়ে স্বামী ক্ষেত্রমোহন দাসকে পালিয়ে যেতে বলেন। তিনি নিজে ছেলেমেয়েদের নিয়ে ব্রাহ্মণগাঁও পালিয়ে যান। ক্ষেত্রমোহন বাড়ির পাশের পাটক্ষেতে লুকিয়েছিলেন। কিন্তু মুড়াপাড়ার একজন মুসলমান ভাড়াটিয়া পাকসেনাদের তা দেখিয়ে দেয়। পাকসেনারা ক্ষেত্রমোহনকে ধরে নিকটস্থ পুকুরপাড়ে নিয়ে যায়। পার্শ্ববর্তী ঋষিপাড়ার কয়েকজন বৃদ্ধ-বৃদ্ধা (বয়স ৬০- ৭০ বছর) বার্ধক্যের কারণে পালিয়ে যেতে পারেননি, ঘরেই ছিলেন। তাদের মধ্যে কয়েকজন হলেন সূর্যমণি দাসী, অমত্য রাণী, সরলা দাসী, সুমিত্রা দাসী ও সুনিল। পাকসেনারা তাদের টেনেহিঁচড়ে ঘর থেকে বের করে এনে ক্ষেত্রমোহনসহ একই দড়িতে বেঁধে পুকুরপাড়ে গাবগাছ ও বাঁশঝোপের তলায় দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করে। এছাড়া সেদিন তাজউদ্দিন, অমেশ চন্দ্র শীল, আ. হামিদ, কুলসুম বিবি, কৃষ্ণ দাসী, হরমোহন, শশীমোহন, খুশী রাণী, হরিনাথ, সুচারু রাণী, ভবেশ চন্দ্র শীলও পাকসেনাদের গুলিতে শহীদ হন। [রীতা ভৌমিক]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৮ম খণ্ড