You dont have javascript enabled! Please enable it! মুক্তিযুদ্ধে মুন্সীগঞ্জ সদর উপজেলা - সংগ্রামের নোটবুক

মুক্তিযুদ্ধে মুন্সীগঞ্জ সদর উপজেলা

মুন্সীগঞ্জ সদর উপজেলা ১৯৭০ সালের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত জাতীয় ও প্রাদেশিক উভয় পরিষদের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করলেও তাদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ষড়যন্ত্র শুরু করেন। এর অংশ হিসেবে ১৯৭১ সালের ৩রা মার্চ ঢাকায় অনুষ্ঠেয় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন ১লা মার্চ স্থগিত ঘোষণা করেন। ফলে, ২রা মার্চ থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর আহ্বানে সারা দেশে অসহযোগ আন্দোলন শুরু হয়। মুন্সীগঞ্জ সদর উপজেলায়ও সে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। এমন একটি পরিস্থিতিতে বঙ্গবন্ধু সাতই মার্চের ভাষণ দেন। তাঁর ভাষণ শুনে সকলের মধ্যে স্বাধীনতার চেতনা জাগ্রত হয় এবং মুন্সীগঞ্জের জনতা একটি সম্ভাব্য মুক্তিযুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হতে থাকে।
মুক্তিযুদ্ধকে সামনে রেখে মুন্সীগঞ্জ সদর উপজেলায় আওয়ামী লীগ ও যুব সম্প্রদায়ের নেতৃত্বে সর্বস্তরের জনতা ঐক্যবদ্ধ হয়। ১০ই মার্চ ডা. আবদুল কাদিরকে আহ্বায়ক করে গঠিত হয় মহকুমা সংগ্রাম কমিটি। কমিটির অন্য সদস্যরা ছিলেন হারুন-অর-রশিদ, আবুল কাশেম তারা মিয়া, মকবুল হোসেন মিজি, সুলতান মিয়া, কফিলউদ্দিন আহমেদ, আনোয়ার হোসেন অনু, আনিস- উজ-জামান, খালেকুজ্জামান খোকা, শহিদুল আলম সাঈদ, মোহাম্মদ হোসেন বাবুল (ছাত্রলীগ নেতা) প্ৰমুখ।
মহকুমার প্রতিটি ইউনিয়নেও এর শাখা কমিটি গঠিত হয়। ২৬শে মার্চ প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। ২৭শে মার্চ সকাল ৮টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত তাঁর সেই ঘোষণা আবুল কাশেম তারা মিয়া মাইকে প্রচার করেন এবং মুক্তিযুদ্ধের জন্য তৈরি হতে জনগণের প্রতি আহ্বান জানান। একই সঙ্গে তিনি হানাদার বাহিনী যাতে মুন্সীগঞ্জে প্রবেশ করতে না পারে সেজন্য দা, বটি, টেটা, জুইত্যা, সড়কি ইত্যাদি দেশীয় অস্ত্র নিয়ে রাস্তার-রাস্তায় ব্যারিকেড সৃষ্টির জন্য জনগণকে উদ্বুদ্ধ করেন এবং ছাত্র-যুবকদের যুদ্ধের কলাকৌশল শেখানোর জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেন। পরবর্তীতে উপর্যুক্ত ব্যক্তিবর্গ মুন্সীগঞ্জ সদর উপজেলায় মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকের দায়িত্ব পালন করেন।
মুক্তিযুদ্ধকালে মুন্সীগঞ্জ মহকুমা কমান্ডার ছিলেন আনিস-উজ- জামান। মুন্সীগঞ্জ সদর থানার কমান্ডার ছিলেন মোহাম্মদ হোসেন বাবুল। মুজিব বাহিনী (বিএলএফ)-র মুন্সীগঞ্জ মহকুমার কমান্ডার ছিলেন প্রথমে কাজী আনোয়ার হোসেন (এসপি আনোয়ার) এবং পরে আনোয়ার হোসেন অনু।
পাকবাহিনীর হাতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বন্দি হওয়ার পর থেকেই মুন্সীগঞ্জ সদরের নেতৃবৃন্দ আশঙ্কা করছিলেন যে, তাঁরা যে-কোনো সময় পাকসেনাদের দ্বারা আক্রান্ত হতে পারেন। তাই তাঁদের প্রধান লক্ষ্য ছিল মুন্সীগঞ্জের প্রবেশদ্বার লঞ্চঘাট দখলে রাখা। এজন্য মুক্তিযোদ্ধা ও সাধারণ জনগণ লঞ্চঘাট ও ধলেশ্বরী নদীর তীরবর্তী বিভিন্ন স্থানে বাংকার খনন করে অবস্থান নেয় এবং সার্বক্ষণিক পাহারার ব্যবস্থা করে। কিন্তু ১০ই মে একজন মেজরের নেতৃত্বে প্রায় দুশ পাকসেনা অতর্কিতে লঞ্চঘাট দখল করে নেয়। তাদের ভারী অস্ত্রের সামনে টিকতে না পেরে মুক্তিযোদ্ধা ও সাধারণ জনগণ পশ্চাদপসরণ করে এবং পাকসেনারা শহরে প্রবেশ করে হরগঙ্গা কলেজে ক্যাম্প স্থাপন করে।
মুন্সীগঞ্জ সদর উপজেলায় পাকবাহিনীকে সহযোগিতা করার জন্য আবদুল হাকিম বিক্রমপুরী (কোর্টগাঁও, সাবেক এমএলএ)-কে আহ্বায়ক করে ১৬ সদস্যবিশিষ্ট একটি শান্তি কমিটি গঠন করা হয়। এর সদস্য ছিল এডভোকেট মো. ইদ্রিস আলী (দেওভোগ), আবুল হোসেন (নয়াগাঁও), আবদুল আজিজ মিয়া (পঞ্চসার), সফিকুল হক ভূঞা (রামপাল), এম এ আউয়াল (সমরচারিকান্দি) প্রমুখ। এছাড়া ৮৪ সদস্যের একটি রাজাকার বাহিনী—ও গঠন করা হয়। এর সদস্য ছিল জয়নুল আবেদীন (রাঞ্চা), কাজিম উদ্দিন (রাঞ্চা), লতিফ আলী (দেওভোগ), জালালুদ্দিন (বাইকার), আবদুল খালেক (আধারা), আরশাদ আলী (দেওভোগ) প্রমুখ। এই দুই বাহিনীর সদস্যদের সহযোগিতায় পাকবাহিনী হত্যা, অগ্নিসংযোগ, নারীধর্ষণ ইত্যাদি অমানবিক কর্মকাণ্ড পরিচালিত করে।
পাকবাহিনী মুন্সীগঞ্জ শহরে প্রবেশ করেই বঙ্গবন্ধুর প্রধান দেহরক্ষী মহিউদ্দিন আহমদের বাড়িসহ বেশ কয়েকটি বাড়িতে আগুন দেয়। ১৪ই মে ভোরে শহরের অদূরে কেওয়া গ্রামের কেদারেশ্বর চৌধুরীর বাড়ি ঘেরাও করে সেখান থেকে শিক্ষক, চিকিৎসক, ব্যবসায়ী, সরকারি কর্মকর্তাসহ ২২ জন ব্যক্তিকে ধরে আনে। তাদের মধ্য থেকে ১৬ জনকে সাতানিখিল খালের পারে দাঁড় করিয়ে ব্রাশ ফায়ারে হত্যা করে। এতে ১৪ জন শহীদ হন। এ ঘটনা সাতানিখিল গণহত্যা নামে পরিচিত|
১৯শে সেপ্টেম্বর পাকসেনারা মুন্সীগঞ্জ শহরের মালপাড়ার বাসিন্দা বিশিষ্ট আইনজীবী ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব মন্মথ মুখার্জীকে ধরে নিয়ে নির্মম নির্যাতনের পর মুন্সীগঞ্জ লঞ্চঘাটে হত্যা করে। মুন্সীগঞ্জ থানার ওসি একজন রাজাকারের সহায়তায় মো. কাওসার আলম তালুকদার, মো. মজিবর রহমান রাজা ও মো. রুহুল আমিন নামক তিনজন যুবককে হরগঙ্গা কলেজ ক্যাম্পে ধরে নিয়ে দীর্ঘদিন নির্যাতন করে। পরে তারা কৌশলে পালিয়ে যায়। শান্তি কমিটি ও রাজাকার বাহিনীর লোকেরা শহর ও আশপাশের এলাকা থেকে অনেক নারীকে ধরে এনে হানাদার বাহিনীর হাতে তুলে দেয়। পাশাপাশি শান্তি কমিটির সদস্যরা এলাকায় মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তোলার চেষ্টা করে এবং হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর নানারকম অত্যাচার চালায়। তবে শান্তি কমিটির সদস্যসংখ্যা কম থাকায় তারা বেশিদিন এলাকায় টিকতে পারেনি। মুক্তিযোদ্ধারা সংগঠিত হওয়ার পরপরই তাদের কার্যক্রম স্তিমিত হয়ে পড়ে।
উপজেলায় পাকবাহিনীর প্রধান নির্যাতনকেন্দ্র ছিল হরগঙ্গা কলেজ ক্যাম্প। এছাড়া শহরের পুরাতন কাছারি এলাকার ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তান (বর্তমান সোনালী ব্যাংক) কার্যালয়েও একটি নির্যাতনকেন্দ্র ও বন্দিশিবির ছিল। এ-দুটি স্থানে বহু নিরীহ মানুষকে ধরে এনে নির্মম নির্যাতন ও অধিকাংশকে হত্যা করা হয়।
মুন্সীগঞ্জ সদর উপজেলায় দুটি বধ্যভূমির সন্ধান পাওয়া গেছে- মুন্সীগঞ্জ হাইস্কুল ছাত্রাবাস সংলগ্ন বধ্যভূমি এবং হরগঙ্গা কলেজ সংলগ্ন বধ্যভূমি। স্বাধীনতার পরে এ-দুটি স্থানে পাকবাহিনীর নির্মম নির্যাতন ও হত্যাযজ্ঞের চিহ্ন পাওয়া গেছে। জানা-অজানা অসংখ্য মানুষের মৃতদেহ ও কঙ্কাল এখান থেকে উদ্ধার করা হয়েছে।
মুন্সীগঞ্জ উপজেলায় পাকবাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের দুটি যুদ্ধ হয় মুন্সীগঞ্জ থানাযুদ্ধ এবং রতনপুর যুদ্ধ। মুন্সীগঞ্জ থানা যুদ্ধ হয় ১৩ই নভেম্বর রাতে। এদিন মুক্তিযোদ্ধারা সাতভাগে বিভক্ত হয়ে মেশিনগান, মর্টার ও গ্রেনেড হামলা চালিয়ে থানা ও শহর দখল করেন। এ-সময় পাকবাহিনীর সহযোগী মুন্সীগঞ্জ থানার ওসি নিহত হয়। এ যুদ্ধে নেতৃত্ব দেন আনিস-উজ-জামান, মোহাম্মদ হোসেন বাবুল, আনোয়ার হোসেন অনু, খালেকুজ্জামান খোকা প্রমুখ। রতনপুর যুদ্ধ হয় ৪ঠা ডিসেম্বর। শহিদুল আলম সাঈদের নেতৃত্বে সংঘটিত এ যুদ্ধে ৮ জন পাকসেনা ও ৪ জন রাজাকার নিহত হয়। যুদ্ধের সময় একটি যুদ্ধবিমান আকাশে মহড়া দিচ্ছিল। মুক্তিযোদ্ধারা এটিকে শত্রুবিমান ভেবে আত্মরক্ষার জন্য নিরাপদ স্থানে চলে যান। এ সুযোগে হানাদার বাহিনীর জীবিত সদস্যরা পালিয়ে যায়। পরে জানা যায় যে বিমানটি ছিল মিত্রবাহিনীর। ১১ই ডিসেম্বর ভোরে হানাদার বাহিনী গোপনে হরগঙ্গা কলেজ ক্যাম্প ছেড়ে নৌপথে নারায়ণগঞ্জের দিকে পালিয়ে যায়। ফলে এদিনই মুন্সীগঞ্জ সদর উপজেলা হানাদারমুক্ত হয় এবং মুক্তিযোদ্ধাসহ সর্বস্তরের জনতা বিজয়োল্লাসে মেতে ওঠে।
মুন্সীগঞ্জ সদর উপজেলার শহীদ মুক্তিযোদ্ধারা হলেন- মুজিবুর রহমান (পিতা জাহেদ আলী, কোর্টগাঁও), নূর হোসেন দেওয়ান (পিতা হাফেজ মজিদ, ছোট মাকুহাটি), সুলতান আহম্মদ (পিতা হাজী সোনা মিয়া, চন্দনতলা), আমিন জিন্নাহ (পিতা মোতাহার উদ্দিন, রামগোপালপুর), ফয়জুর রহমান (পিতা ওসমান মুন্সী, রনছ মুন্সীগঞ্জ), নূর মোহাম্মদ (পিতা খলিল বেপারী, মহেশপুর), আব্দুস সালাম (পিতা আকরাম বেপারী, উত্তর চরমশুরা), প্রেমানন্দ দাস (পিতা হরি আনন্দ দাস, শ্রীপল্লী), মীর ইমাম হোসেন (পিতা আব্বাস আলী, উত্তর কাজীকসবা), হরকুমার চক্রবর্তী (পিতা রাজমোহন চক্রবর্তী, বাগমামুদালী পাড়া), শচীন্দ্রনাথ মুখার্জী (পিতা শৈলেশ মুখার্জী, বাগমামুদালী পাড়া), আব্দুল বারেক (রামেরগাঁও), আব্দুর রউফ (কোর্টগাঁও), মো. খোকন (পিতা মীর আলী পেশকার, কোর্টগাঁও), ডা. সুরেন্দ্র চন্দ্র সাহা (বাগমামুদালী পাড়া), অধ্যাপক সুরেশ চন্দ্র ভট্টাচার্য (বাগমামুদালী পাড়া), বাদল চন্দ্র ভট্টাচার্য (পিতা অধ্যাপক সুরেশ চন্দ্র ভট্টাচার্য, বাগমামুদালী পাড়া), অজয় কুমার সাহা (পিতা ডা. সুরেন্দ্র চন্দ্র সাহা, বাগমামুদালী পাড়া), শম্ভু নাথ (নগর কসবা, মিরকাদিম), মন্মথ মুখার্জী (পিতা ঈশান মুখার্জী, কালীবাড়ি রোড), বীরেন বিশ্বাস (যোগিনীঘাট), মনু মিয়া (যোগিনীঘাট), গোপাল কবিরাজ (যোগিনীঘাট), শম্ভুনাথ কবিরাজ (যোগিনীঘাট), আনিসুজ্জামান (পিতা হযরত আলী মিজি, যোগিনীঘাট), সাহা মিস্ত্রী (পিতা কালাচান, কোর্টগাঁও), মজিবুর রহমান (যোগিনীঘাট) এবং সুনীল কুমার সাহা (বাগমামুদালী পাড়া)।
মুন্সীগঞ্জ সদর উপজেলায় মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। ১৯৮০র দশকে হরগঙ্গা কলেজের পূর্বপাশে মুন্সীগঞ্জ হাইস্কুল ছাত্রাবাস সংলগ্ন বধ্যভূমিতে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মিত হয়েছে। ১৯৯১ সালে কেওয়ার চৌধুরী বাড়ির শহীদদের স্মরণে মুক্তিযোদ্ধা সংসদের পক্ষ থেকে একটি শহীদ মিনার নির্মিত হয়েছিল, কিন্তু কতিপয় দুবৃত্ত এক সময় তা ভেঙ্গে ফেলে। হরগঙ্গা কলেজ সংলগ্ন বধ্যভূমিতে ‘স্বাধীনতা” নামে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মিত হয়েছে। মুন্সীগঞ্জ হাইস্কুলের পাশে সরকারের গণপূর্ত বিভাগ ২০০০ সালে একটি স্মৃতিস্তম্ভের নির্মাণ কাজ শুরু করে যা ২০১১ সালে সমাপ্ত হয়। ২০১২ সালে শহরের সুপার মার্কেট চত্বরে (থানার পুল) ‘অঙ্কুরিত মুক্তিযুদ্ধ’ নামে একটি ভাস্কর্য নির্মিত হয়েছে। এছাড়া শহরের পুরনো হাসপাতাল পাড়ায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের দক্ষিণ পাশে শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের নামখচিত স্মৃতিস্মম্ভ এবং শহরের লিচুতলায় মুক্তিযুদ্ধের স্মরণে ‘পতাকা একাত্তর’ নামে ভাস্কর্য নির্মিত হয়েছে। [মীর নাসিরউদ্দিন উজ্জ্বল]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৮ম খণ্ড