You dont have javascript enabled! Please enable it! মুক্তিযুদ্ধে ভারতের ভূমিকা - সংগ্রামের নোটবুক

মুক্তিযুদ্ধে ভারতের ভূমিকা

মুক্তিযুদ্ধে ভারত ১৯৪৭ পরবর্তী ভারত উপমহাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়। নানা পরিপ্রেক্ষিত থেকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ বৈশ্বিক রাজনীতিতে বিভিন্নমুখী অভিঘাতের জন্ম দেয়। এ যুদ্ধকে কেন্দ্র করে দুই পরাশক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নসহ বিশ্বের রাষ্ট্রসমূহ কোনো-না-কোনোভাবে বাংলাদেশ প্রশ্নে অবস্থান নেয়। সাধারণভাবে বলা যায়, পশ্চিমা পুঁজিবাদী রাষ্ট্রসমূহ বাংলাদেশ প্রশ্নে স্থিতাবস্থা বজায় রাখার পক্ষপাতী ছিল। তবে বাংলাদেশ প্রশ্নে ভারতের খোলামেলা সমর্থন ও সোভিয়েত ইউনিয়নের ইতিবাচক অবস্থান অবধারিতভাবেই চীনকে এর বিরুদ্ধে চালিত করে। এছাড়া মুসলিম বিশ্বের সঙ্গে পাকিস্তানের একটা আবেগগত সম্পর্ক ছিল। ‘মুসলিম উম্মাহ’ নামে পরিচিত মুসলিম বিশ্বের দেশসমূহ পাকিস্তানের অন্ধ সমর্থকে পরিণত হয়। শুধু ব্যতিক্রম ছিল ইরাক। আঞ্চলিক পরিপ্রেক্ষিতের দিকে দৃষ্টি দিলে দেখা যাবে, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারত ব্যতীত দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর ভূমিকাকে ইতিবাচক বলার উপায় নেই। বার্মা (বর্তমান মিয়ানমার) ও শ্রীলঙ্কা ছিল পাকিস্তানের মিত্ৰ৷ নেপালের প্রতিক্রিয়াও মুক্তিযুদ্ধের অনুকূলে বলা যাবে না। বলা যায়, ভূ-রাজনৈতিক এবং ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কের প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের ভূমিকা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, প্রত্যক্ষ ও সুনির্দিষ্ট। মুক্তিযুদ্ধের ঘটনা প্রবাহের প্রেক্ষাপটে নিম্নবর্ণিত ইস্যুতে ভারতের ভূমিকা মূল্যায়ন করা যেতে পারে। যেমন- ক. বাংলাদেশ সরকার গঠনে সহায়তা, খ. মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ ও অস্ত্র সরবরাহ, গ. শরণার্থীদের আশ্রয়দান ও সহায়তা, ঘ. মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে আন্তর্জাতিক জনমত সৃষ্টি, ঙ. ভারতের রাজনৈতিক দল, বিভিন্ন সংগঠন ও সাধারণ জনগণের সহযোগিতা, চ. বিভিন্ন রাজ্য সরকার ও কেন্দ্রীয় সরকারের ভূমিকা।
ক. বাংলাদেশ সরকার গঠনে সহায়তা: ১৯৭০ সালে অনুষ্ঠিত পাকিস্তানের প্রথম সাধারণ নির্বাচনে ধর্মনিরপেক্ষ বাঙালি জাতীয়তাবাদের অনুসারী আওয়ামী লীগ-এর নিরঙ্কুশ বিজয় ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কের ক্ষেত্রে নতুন মাত্রা যোগ করে। এ পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৭১ সালের মার্চ মাসের শুরুতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর নির্দেশে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমদ- ঢাকাস্থ ভারতের ডেপুটি হাইকমিশনার কে সি সেনগুপ্তের সঙ্গে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বাঙালিদের ওপর সম্ভাব্য আক্রমণ এবং সে অবস্থায় ভারতের অবস্থান নিয়ে আলোচনা করেন। ঐ আলোচনায় ভারতের কাছ থেকে ‘সম্ভাব্য সকল সহযোগিতা’র আশ্বাস পেলেও, সাহায্যের প্রকৃতি বা পরিমাণ নিয়ে সুনির্দিষ্ট সিদ্ধান্ত হয়নি। তথাপি ভারতের স্থানীয় বেসামরিক প্রশাসন ও সীমান্ত রক্ষীবাহিনী (বিএসএফ) আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দকে পাকিস্তানি বাহিনীর আক্রমণের পরপর বিভিন্ন সীমান্ত এলাকায় সাদরে গ্রহণ করেছে। সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতের মাটিতে পৌঁছলে বিএসএফ-এর আঞ্চলিক প্রধান গোলক মজুমদার তাঁদের হাই কমান্ডের নির্দেশেই তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। পরবর্তীতে বিএসএফ-এর প্রধান রুস্তমজী ও গোলক মজুমদার ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী-র সঙ্গে তাজউদ্দীন আহমদের সাক্ষাতের ব্যবস্থা করেন। ২রা এপ্রিল ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে তাজউদ্দীন আহমদের বৈঠকের পূর্বেই মিসেস গান্ধী লোকসভায় বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামকে সমর্থন করে বক্তৃতা করেন। তাজউদ্দীন আহমদ বৈঠকের শুরুতে মিসেস গান্ধীকে অবহিত করেন যে, বঙ্গবন্ধু বন্দি হওয়ার পূর্বে বাংলাদেশের আনুষ্ঠানিক স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন। এপ্রিল মাসের শুরুতে তাজউদ্দীন-ইন্দিরার মধ্যে অনুষ্ঠিত দুদফা বৈঠকে মুক্তিযুদ্ধের প্রাথমিক পর্যায়ে ভারতের সাহায্য-সহযোগিতার প্রকৃতি ও ধরন সম্পর্কে কতিপয় সিদ্ধান্ত হয়। প্রথমত, ভারতের মাটিতে অবস্থান করে বাংলাদেশ সরকার মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করতে পারবে; দ্বিতীয়ত, সীমান্ত উন্মুক্ত করে দেয়া হবে যাতে শরণার্থীরা ভারতে আশ্রয় নিতে পারে; তৃতীয়ত, মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য প্রশিক্ষণ ও অস্ত্রের সংস্থান করা হবে; চতুর্থত, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত গঠনের জন্য একটি বেতার কেন্দ্র স্থাপন করা হবে। ১০ই এপ্রিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহামনকে রাষ্ট্রপতি,
সৈয়দ নজরুল ইসলাম-কে উপ-রাষ্ট্রপতি (বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি) এবং তাজউদ্দীন আহমদকে প্রধানমন্ত্রী করে ৬ সদস্যের একটি সরকার গঠন করা হয়, যা মুক্তিযুদ্ধকালে মুজিবনগর সরকার নামে পরিচিত ছিল। ১৭ই এপ্রিল বিএসএফ-এর সক্রিয় সহযোগিতায় ভারতীয় সীমান্ত থেকে বাংলাদেশের প্রায় এক মাইল অভ্যন্তরে কুষ্টিয়া জেলার মেহেরপুর মহকুমার (বর্তমান জেলা) বৈদ্যনাথতলায় ভারতীয় ও প্রচুর সংখ্যক আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের প্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে এক সমাবেশে বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রিপরিষদের আনুষ্ঠানিক শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়। ১৬ই ডিসেম্বর পর্যন্ত মুজিবনগর ছিল বাংলাদেশ সরকারের রাজধানী, যদিও পশ্চিমবঙ্গের কলকাতা থেকেই এ সরকারের কার্যক্রম পরিচালিত হয়।
ভারতে পাকিস্তান দূতাবাসে কর্মরত বাঙালি কূটনীতিকদের নবগঠিত বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে আনুগত্য ঘোষণার ক্ষেত্রে ভারতের সম্পৃক্ততা ছিল গুরুত্বপূর্ণ। কলকাতাস্থ পাকিস্তানের ডেপুটি হাইকমিশনের সকল বাঙালি কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ ডেপুটি হাইকমিশনার এম হোসেন আলী ১৮ই এপ্রিল বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামে যোগ দেন। ডেপুটি হাইকমিশন ভবনে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলনের মধ্য দিয়ে আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন হয়। এটাই ছিল প্রথম বাংলাদেশ মিশন। অবশ্য আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশ সরকার প্রতিষ্ঠার পূর্বেই ৬ই এপ্রিল নয়াদিল্লীতে পাকিস্তান হাইকমিশনের বাঙালি কূটনীতিক সেকেন্ড সেক্রেটারি কে এম শেহাবউদ্দিন ও সহকারী প্রেস এটাশি আমজাদুল হক পাকিস্তানের ফরেন সার্ভিস থেকে পদত্যাগ করে বাংলাদেশের পক্ষে তাঁদের আনুগত্য ব্যক্ত করেন। এক যৌথ বিবৃতিতে তাঁরা বলেন,
‘We have severed our connection with the fascist military dictatorship in Islamabad, From now our allegiance is to Bangladesh.’ এ পরিপ্রেক্ষিতে তাঁরা ভারতে রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা করলে ত্বরিত তা মঞ্জুর করা হয়। বাংলাদেশ সরকার প্রতিষ্ঠা থেকে শুরু করে নয় মাসব্যাপী মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনায় মুজিবনগর সরকার ভারতের সর্বাত্মক সহযোগিতা লাভ করে।
খ. মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ ও অস্ত্র সরবরাহ: বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সাফল্যের জন্য মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ ও প্রয়োজনীয় অস্ত্রের সংস্থান করা ছিল খুবই জরুরি। ২৫শে মার্চ রাতে পাকিস্তানি বাহিনীর অকস্মাৎ আক্রমণের বিরুদ্ধে সারা বাংলায় স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিরোধ গড়ে উঠেছিল। কিন্তু এপ্রিলের মাঝামাঝি বা এর কিছু পর পাকবাহিনীর পরিকল্পিত আক্রমণের মুখে প্রতিরোধ সংগ্রাম ক্রমে ভেঙ্গে পড়তে শুরু করে। যে-কোনোভাবে সশস্ত্র প্রতিরোধ অব্যাহত রাখার প্রয়োজনে শুরুতে ভারত সরকার বাংলাদেশের স্বাধীনতাকামী তরুণদের প্রাথমিক প্রশিক্ষণ ও হালকা অস্ত্র প্রদানের সিদ্ধান্ত নেয়। বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ, অস্ত্র সরবরাহ ও থাকার দায়িত্ব বিএসএফ-কে দেয়া হয়। মার্চ-এপ্রিল পর্যন্ত বিএসএফ-এর তত্ত্বাবধানে থাকলেও, ৩০শে এপ্রিল মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তার দায়িত্ব ভারতীয় সেনাবাহিনীর ওপর অর্পণ করা হয়। ভারতীয় সেনাবাহিনী ৯ই মে থেকে স্বাধীনতাকামী ছাত্র-যুবকদের সামরিক প্রশিক্ষণ শুরু করে। পশ্চিমবঙ্গে মুক্তিযোদ্ধা সংগ্রহ এবং প্রশিক্ষণের জন্য সেখানে প্রায় ১০০টি ক্যাম্প এবং বাংলাদেশে প্রায় ২০০টি ক্যাম্প প্রতিষ্ঠা করা হয়। এছাড়া ত্রিপুরা ও আসামে কিছু প্রশিক্ষণ শিবির ছিল। ভারতীয় সেনাবাহিনীর দায়িত্বে পরিচালিত সামরিক প্রশিক্ষণের মেয়াদ ছিল চার সপ্তাহ। এই স্বল্প সময়ে হাল্কা অস্ত্র ও বিস্ফোরকের ব্যবহার শেখানো হতো। প্রায় দুহাজার তরুণের সামরিক প্রশিক্ষণ মে মাসের শেষদিকে সম্পন্ন হয়। এর মধ্যে বাছাই করা যুবকদের বিশেষ প্রশিক্ষণের জন্য বিভিন্ন স্থানে প্রেরণ করা হয়, যেমন লক্ষ্ণৌতে গোলন্দাজ প্রশিক্ষণের জন্য, দেরাদুনে সিগন্যাল, আসাম ও নাগাল্যান্ডে কমান্ডো ট্রেনিং, নৌ ও বিমান সৈনিকদের জন্যও প্রশিক্ষণের পৃথক ব্যবস্থা করা হয়।
গ. শরণার্থীদের সহায়তা: বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকালে শরণার্থী সমস্যা ভারতের জন্য সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু হিসেবে দেখা দেয়। ভারত সরকার শরণার্থী সমস্যার নানা দিক তুলে ধরে জাতিসংঘসহ বৃহৎ শক্তিবর্গ এবং বিশ্বজনমতকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও ভারতের ভূমিকার অনুকূলে আনার চেষ্টা করে। বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন, পেশাজীবী সংগঠন, শ্রমিক সংগঠন, ব্যবসায়ী সংগঠন, স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক- কর্মচারী স্বেচ্ছায় বাংলাদেশের শরণার্থীদের সাহায্যে এগিয়ে আসে। ত্রাণকার্য তদারকির জন্য পুনর্বাসন মন্ত্রণালয়ের অধীনে একজন অতিরিক্ত সচিবকে দায়িত্ব প্রদান করে কলকাতায় শাখা সচিবালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়। আসাম এবং ত্রিপুরায় এর লিয়াজোঁ অফিস খোলা হয়। কেন্দ্রীয় পুনর্বাসনমন্ত্রী খাদিলকার জানান যে, সীমান্ত এলাকার রাজ্য সরকারগুলো প্রায় ৫৫টি অভ্যর্থনা কেন্দ্র খুলেছে এবং প্রয়োজন অনুসারে এরূপ কেন্দ্রের সংখ্যা বৃদ্ধি করা হবে। ত্রাণকার্যে সমন্বয় ও শরণার্থী শিবির- প্রতিষ্ঠার মূল দায়িত্বে ছিলেন কর্নেল পি এন লুথার (P N Luthar)। তিনি সাতটি রাজ্য সরকার, ২৪টি ভারতীয় স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন এবং ১২টি আন্তর্জাতিক সংস্থার সমন্বয়ের কাজ করেন। কর্নেল লুথার নয় মাসের কম সময়ের মধ্যে ৮৯৬টি শরণার্থী ক্যাম্প প্রতিষ্ঠা করেন এবং ৬.৮ মিলিয়ন শরণার্থীর থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করেন। অবশিষ্ট প্রায় তিন মিলিয়ন শরণার্থী ক্যাম্পে অবস্থান না করলেও নিয়মিত রেশন ও চিকিৎসা সহায়তা পেতেন। পশ্চিমবঙ্গ ও ত্রিপুরায় অধিকাংশ ক্যাম্প প্রতিষ্ঠা করা হয়। তবে আসাম, মেঘালয়, বিহার, উত্তর প্রদেশ এবং মধ্য প্রদেশেও ক্যাম্প প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। স্বল্প সময়ে অকস্মাৎ শরণার্থী স্রোতে আক্রান্ত ভারতের সীমান্তবর্তী রাজ্যগুলো বিশেষভাবে বাংলা ভাষাভাষী পশ্চিমবঙ্গ ও ত্রিপুরা এবং আসাম, মেঘালয় ও বিহারের বিধানসভাগুলোতে শরণার্থী সমস্যা নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের পুরো সময় আলোচনা হয়। তাছাড়া রাজনৈতিক দলগুলো শরণার্থী সমস্যার নানা দিক নিয়ে লোকসভায় বিতর্ক/আলোচনায় লিপ্ত হয়।
লোকসভায় শরণার্থী সমস্যার তীব্রতা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী একবার বলেন, “শরণার্থীর বিরামহীন প্রবাহ এবং পাকিস্তানের উদ্ভট প্রচারণা এই সত্যই প্রতিষ্ঠিত করে যে, বাংলাদেশের ঘটনাবলি আমাদের অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে নানামুখি প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করছে। যে কারণে আমি বলছি যে, this cannot be considered merely as an internal problem of Pakistan বরং এটি একটি ভারতীয় সমস্যা, আরও সঠিকভাবে বললে, এটি একটি বৈশ্বিক সমস্যা।’ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে পরিস্থিতির গভীরতা উপলব্ধির আহ্বান জানিয়ে তিনি আরো বলেন যে, দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে যেকোনো ব্যর্থতা ভয়াবহ বিপর্যয় বয়ে আনবে। তাঁর সরকারের বিরুদ্ধে আনীত নানা অভিযোগের উত্তরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘We are concerned with one thing and one thing only our own national interest and security and naturally that of the heroic people of Bangla Desh.’ শরণার্থী ইস্যুতে আন্তর্জাতিক জনমতকে প্রভাবিত করার উদ্দেশ্যে ভারত সরকার বিদেশী সাংবাদিক ও পর্যবেক্ষকদের শরণার্থী ক্যাম্পগুলো পরিদর্শনের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়। শরণার্থী সমস্যা ভয়াবহ রূপ নিলে এক পর্যায়ে তিনজন বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব, যথা মার্কিন সিনেটর ও শরণার্থী বিষয়ক সাব-কমিটির চেয়ারম্যান এডওয়ার্ড কেনেডি, বিশিষ্ট সাহিত্যিক ও ফ্রান্সের সাবেক সংস্কৃতি মন্ত্ৰী আঁদ্রে মালরো- ও জাতিসংঘের হাইকমিশনার ফর রিফিউজি প্রিন্স সদরুদ্দিন আগা খান শরণার্থী শিবির পরিদর্শনে আসেন।
শরণার্থী সমস্যা থেকে পরিত্রাণের জন্য ভারত সর্বপ্রকার প্রচেষ্টা গ্রহণ করে। কারণ ব্যাপক সংখ্যক শরণার্থীর উপস্থিতি ইতোমধ্যে জনবহুল ভারতে যে কেবল অর্থনৈতিক সমস্যা বা জাতীয় উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করেছে তাই নয়, বরং সামাজিক-রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও তা উদ্বেগজনক অবস্থার সৃষ্টি করে। সীমান্তবর্তী কোনো-কোনো রাজ্যে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার আশঙ্কা দেখা দেয়। ফলে শরণার্থী সমস্যা ভারতের জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি সৃষ্টি করে। তারপরও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় যে পরিমাণ সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, তাও পূরণ করেনি।
ঘ. মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে আন্তর্জাতিক জনমত সৃষ্টি: বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে আন্তর্জাতিক জনমত সৃষ্টির ক্ষেত্রে ভারত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও মুসলিম বিশ্বের জোরালো সমর্থন ছিল পাকিস্তানের পক্ষে। এমনকি অপর পরাশক্তি সোভিয়েত ইউনিয়নও জুন-জুলাই মাস পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে স্পষ্ট অবস্থান নেয়নি। এমনি অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে ভারত বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্রে সরকারি ও বেসরকারি প্রতিনিধি দল প্রেরণ করে। বাংলাদেশ সরকারকেও সহায়তা দেয় বিভিন্ন দেশে তাদের প্রতিনিধি পাঠানোর ক্ষেত্রে। বৈদেশিক সম্পর্ক বিষয়ক মন্ত্রী সরদার শরণ সিং-সহ অন্যান্য মন্ত্রীবর্গ এবং প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বহু রাষ্ট্র সফর করেন। উপরন্তু নয়াদিল্লীতে বাংলাদেশ বিষয়ে আন্তর্জাতিক সেমিনার আয়োজন করে দেশ-বিদেশের বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী ও মানবাধিকার কর্মীদের আমন্ত্রণ জানানো হয়। বিদেশী প্রতিনিধিদলের শরণার্থী শিবির পরিদর্শন ও বাংলাদেশ সরকারের নেতৃবৃন্দের সঙ্গে বৈঠকের ব্যবস্থা করে দেয়া হয়। পুরো ৭১ জুড়ে ভারতের কূটনৈতিক প্রচেষ্টার মূল লক্ষ্য ছিল ভারতের গৃহীত পদক্ষেপের যৌক্তিকতা বিশ্ববাসীর নিকট তুলে ধরা। অন্যদিকে পাকবাহিনীর অত্যাচার- নির্যাতনের বিবরণ প্রকাশ করে বাংলাদেশের প্রতি বিশ্ব জনমতকে সহানুভূতিশীল করা।
১লা এপ্রিল জাতিসংঘে নিযুক্ত ভারতের স্থায়ী প্রতিনিধি সমর সেন জাতিসংঘের সেক্রেটারি জেনারেল উ থান্টের নিকট প্রেরিত এক পত্রে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের নিষ্ক্রিয়তা ও নীরবতার সমালোচনা করে বলেন, ‘পশ্চিম পাকিস্তানি সৈন্যরা বাঙলাদেশের মানুষের ওপর যে-হারে নির্যাতন শুরু করেছে, তা বর্তমানে এমন এক স্তরে এসে পৌচেছে যে, তা পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার মনে করে নিষ্ক্রিয় থাকার আর সুযোগ নেই। আন্তর্জাতিক মানবগোষ্ঠী কর্তৃক একটি উপযুক্ত ব্যবস্থা অবলম্বন করা অত্যাবশ্যক হয়ে উঠেছে। মুক্তিযুদ্ধ প্রশ্নে চীনের ভূমিকার পরিপ্রেক্ষিতে মিসেস গান্ধী দ্ব্যর্থহীন ভাষায় তাঁর সরকারের নীতি ঘোষণা করে বলেন, ‘…. China’s open support to West Pakistan’s military regime against Bangladesh would not affect the country’s stand on the issue.’ ৮০টি দেশের প্রায় ৭০০ প্রতিনিধির বুলগেরিয়ার রাজধানী বুদাপেস্টে অনুষ্ঠিত বিশ্বশান্তি সম্মেলনে মিসেস গান্ধীর প্রেরিত বার্তায় পূর্ববঙ্গের জনগণের ন্যায্য দাবির প্রতি আন্তর্জাতিক সমর্থন আহ্বান করা হয়। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট দক্ষিণ এশিয়া সংকটে ভারতীয় পদক্ষেপের অনুকূলে বিশ্বনেতৃবৃন্দকে প্রভাবিত করার উদ্দেশ্যে মিসেস ইন্দিরা গান্ধী বেলজিয়াম, অস্ট্রিয়া, ফ্রান্স, সোভিয়েত ইউনিয়ন, ব্রিটেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ফেডারেল রিপাবলিক অব জার্মানি ভ্রমণ করেন।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে আন্তর্জাতিক রাজনীতির সংশ্লিষ্টতা ও ভারতীয় ভূমিকার যথার্থতা ব্যাখ্যা করার জন্য ৬৭টি রাষ্ট্রে ১৮টি সরকারি প্রতিনিধি দল প্রেরণ করে ভারত সরকার। এর মধ্যে চারটি প্রতিনিধিদলের নেতৃত্বে ছিলেন বৈদেশিক সম্পর্ক বিষয়ক মন্ত্রী সরদার শরণ সিং। এসব বিদেশ ভ্রমণে ভারত সরকারকে ৫,৪৬,০৪৪.৩৩ রূপি ব্যয় করতে হয়। ভারত সরকার নিজে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রতিনিধি প্রেরণ করা ছাড়াও বাংলাদেশ সরকারকেও বহির্বিশ্বে তার অবস্থান তুলে ধরতে নানাভাবে সহায়তা দেয়। বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে আব্দুস সামাদ আজাদ এশিয়া ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশ সফর করেন। বুদাপেস্টে ১৩-১৬ই মে অনুষ্ঠিত বিশ্বশান্তি সম্মেলনে (World Peace Assembly) তিনি পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর নজিরবিহীন অত্যাচার-নির্যাতনের বিবরণ তুলে ধরেন।
এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহ থেকেই বাংলাদেশ সরকারের স্থায়ী প্রতিনিধি হিসেবে লন্ডনে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত সংগঠনের দায়িত্ব লাভ করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী। বিশেষ করে সেপ্টেম্বর মাসে অনুষ্ঠিত জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলের নেতা হিসেবে বিশ্বের অন্যান্য রাষ্ট্রের প্রতিনিধিদের কাছে বাংলাদেশের সংগ্রামের যৌক্তিকতা তিনি তুলে ধরারা সুযোগ পান। বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্রে পাকিস্তান দূতাবাসে কর্মরত বাঙালি কূটনীতিকগণ বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য ঘোষণা করতে থাকেন। পুরো ৭১ জুড়ে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন দেশে কর্মরত তিনজন রাষ্ট্রদূতসহ ১১৫ জন বাঙালি কূটনীতিক ও কর্মকর্তা-কর্মচারী ক্রমাগত বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য ঘোষণা করেন। পাকিস্তানের পক্ষ ত্যাগকারী কূটনীতিকদের সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের যোগাযোগ প্রতিষ্ঠা, নিরাপত্তাসহ বিভিন্ন বিষয়ে ভারত প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সহায়তা প্রদান করে।
ঙ. রাজনৈতিক দল, বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ও সাধারণ জনগণের সহযোগিতা: ভারতের প্রায় সকল রাজনৈতিক দল এবং জনগণ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে তাদের জোরালো সমর্থন ও সহানুভূতি প্রকাশ করে। ভারত সরকার বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ প্রশ্নে বিভিন্ন সময়ে যেসব নীতি- নির্ধারণী সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করেছে, তাতে ভারতের রাজনৈতিক দলগুলোর প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ অংশগ্রহণ ছিল। সরকারি দল হিসেবে কংগ্রেসের ভূমিকা শুরুতে ছিল অনেকটা সতর্কতামূলক। অন্যদিকে অধিকাংশ বিরোধী রাজনৈতিক দলের প্রতিক্রিয়া ছিল স্বতঃস্ফূর্ত এবং সরাসরি বাংলাদেশের পক্ষে। বাংলাদেশের প্রতি ভারতীয় জনগণের তাৎক্ষণিক সমর্থন ও সহানুভূতি অধিকাংশ ভারতীয় রাজনৈতিক দলের নীতি ও কর্মকাণ্ডে প্রতিফলিত হয়েছে। বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো বিশেষভাবে ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টি (মাকর্সবাদী), সোস্যালিস্ট পার্টি, ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিআই) এবং জনসংঘ সরকারের নিকট বাংলাদেশকে কার্যকর সাহায্য প্রদানের জন্য জোর দাবি জানায়।
লোকসভার বিরোধীদলীয় নেতাদের সঙ্গে ৭ই মে প্রধানমন্ত্রী মিসেস গান্ধী বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদানের বিষয়ে দীর্ঘ আলোচনা করেন। বিরোধী নেতাদের স্বীকৃতিদানের দাবির জবাবে ইন্দিরা গান্ধী বলেন, স্বীকৃতি বিষয়ে ভারতের বন্ধুভাবাপন্ন দেশগুলোর সঙ্গে আলোচনা করা হয়েছে, তবে বর্তমান অবস্থায় কোনো রাষ্ট্রই বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দানের পক্ষপাতী নয়। তিনি বলেন, এখনই স্বীকৃতি না দিলেও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে সার্বিক সহায়তা দেবে ভারত। মুসলীম লীগ ও বিকানীর মহারাজা করণ সিং ছাড়া কমিউনিস্ট পার্টি, ডিএমকে, সিপিএম, পিএসসি, আরএসপি ও জনসংঘের নেতারা স্বীকৃতিদানের পক্ষে জোর বক্তব্য রাখেন। স্বীকৃতি প্রদানের দাবিতে রাজনৈতিক দলগুলো যেমন তাদের সভা-সমিতি অব্যাহত রাখে, তেমনি ভারত সরকারের ওপর জনমতের চাপও ক্রমেই বৃদ্ধি পেতে থাকে। ভারতের সব রাজনৈতিক দলই শরণার্থী ইস্যুতে সরকারের গৃহীত নীতি ও পদক্ষেপের সমালোচনা করেছে। মার্কসবাদী কমিউনিস্ট পার্টি, প্রজা সোস্যালিস্ট পার্টি, ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি – এই দলগুলো শরণার্থীদের জন্য পর্যাপ্ত ত্রাণ সামগ্রীর ব্যবস্থা এবং প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্য সেবার নিশ্চয়তা প্রদানের দাবি জানায়। এক সময় বিভিন্ন শরণার্থী শিবিরে কলেরা মহামারী আকার ধারণ করলে তারা সরকারের ব্যর্থতার তীব্র সমালোচনা করে। সীমান্ত সংলগ্ন রাজ্যগুলোতে বিশেষত পশ্চিমবঙ্গ, আসাম ও ত্রিপুরায় কিছু এলাকায় শরণার্থীদের জমি ও বাড়ি দখলে প্ররোচিত করা হয়। এর ফলে রাজনৈতিক উত্তেজনা দেখা দেয় এবং আইন-শৃঙ্খলা সমস্যার উদ্ভব ঘটে। শুরু থেকেই কেবল যুদ্ধের মাধ্যমেই শরণার্থী সমস্যার সমাধান সম্ভব বলে জনসংঘ মনে করতে থাকে। একই সুরে কথা বলতে থাকে স্বতন্ত্র সদস্যরা। বাংলাদেশের শরণার্থীরা আর কোনো দিন ফিরে যাবে না, তারা স্থায়ীভাবে ভারতে থেকে যাবে ভারত সরকারের দুর্বল নীতির কারণে এরূপ বক্তব্যও দেয়া হয় এদের পক্ষ থেকে। এমন বক্তব্য দিয়ে এ দলগুলো প্রকারান্তরে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা সৃষ্টির চেষ্টা করে।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের রাজনৈতিক দলের ভূমিকা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং সামগ্রিক বিচারে ইতিবাচক। ৪৭ সালে ভারত ও পাকিস্তান এ দুটি রাষ্ট্র সৃষ্টির পর বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ন্যায় সুদূর প্রসারী ও তাৎপর্যময় ইস্যু আর দেখা দেয়নি। বলার অপেক্ষা রাখে না, রাজনৈতিকদলগুলো স্ব-স্ব আদর্শ-কর্মসূচি ও কেউ- কেউ লাভ-ক্ষতির হিসাব কষে মুক্তিযুদ্ধ, বিষয়ে তাদের অবস্থান স্থির করে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সূচনা লগ্নেই ভারতব্যাপী এক অভূতপূর্ব আলোড়ন সৃষ্টি হয়। ভারতের সাধারণ জনগণ, সামাজিক- সাংস্কৃতিক সংগঠন ও বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনকে এ-যুদ্ধ গভীরভাবে অনুপ্রাণিত করে। ভারতের কবি, সাহিত্যিক, লেখক, শিক্ষাবিদ ও শিল্পীদের মধ্যে অধিকাংশই সম্পৃক্ত হয়ে পড়েন মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে। সারা ভারতব্যাপী গড়ে উঠতে থাকে নানা সংগঠন এবং মুক্তিযুদ্ধে তাদের ভূমিকা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, শ্রমিক সংগঠন ও কলকাতার বিশিষ্ট নাগরিকদের নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে সহায়তা দানের জন্য বিভিন্ন সংগঠন গড়ে ওঠে। এছাড়া ‘বাংলাদেশ সেবা সংঘ’ নামে আরেকটি সংগঠন কলকাতায় বাংলাদেশের পক্ষে কাজ করে। ‘স্বাধীন বাংলা সংগ্রাম সহায়ক কমিটি’ কলকাতায় মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত সংগঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রফেসর এস এন সেনকে সভাপতি করে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ সহায়ক সমিতি গঠন করা হয়। ভারত ও ভারতের বাইরে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত সৃষ্টিতে সমিতি ইংরেজিতে ছয়টি ও বাংলায় পাঁচটি মনোগ্রাফ প্রকাশ করে। সারাবিশ্বের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাবিদ, সাংবাদিক, নেতৃস্থানীয় রাজনীতিবিদ, রোটারিয়ান এমনি আরো ২,০০০ জনের ঠিকানায় ইংরেজি প্রকাশনাসমূহ প্রেরণ করে এ সমিতি। এপ্রিল মাসের প্রথম সপ্তাহে নয়াদিল্লীতে ‘বাংলাদেশ সহায়ক সমিতি’ নামে একটি কেন্দ্ৰীয় সংস্থা গঠন করা হয়। ভারতের প্রাক্তন এটর্নি জেনারেল এম সি শীতলবাদ ছিলেন সমিতির চেয়ারম্যান। ২৪শে এপ্রিল বোম্বাইয়ে বিশিষ্ট নাগরিকরা ‘বাংলাদেশ সহায়ক কমিটি’ গড়ে তোলেন। হরিশ মহীন্দ্রকে চেয়ারম্যান করে এ কমিটি গঠন করা হয়। বাংলাদেশের সহায়তার জন্য হায়দ্রাবাদে গঠন করা হয় ‘আন্দ্রা প্রদেশ বাংলা সেবা সমিতি’। হায়দ্রাবাদের এই সমিতির সভাপতি ছিলেন অবসরপ্রাপ্ত ভারতীয় কূটনীতিক বদরুদ্দিন তায়েবজী। সাবেক কেন্দ্রীয় রেলমন্ত্রী সি এল নান্দাকে প্রধান করে চণ্ডীগড়ে আরেকটি সহায়ক সমিতি গঠন করা হয়। এমনি সহায়ক সমিতি ভারতের অন্যান্য স্থানেও গড়ে ওঠে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে এই সমিতিগুলোর ভূমিকা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
চ. বিভিন্ন রাজ্য সরকার ও কেন্দ্রীয় সরকারের ভূমিকা: বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক রাজ্যসরকার ও বিধানসভা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বিহার, কেরলা, মধ্যপ্রদেশ, ত্রিপুরা, পশ্চিমবঙ্গ, উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, মেঘালয়, উড়িষ্যা, রাজস্থান ও আসামের বিধানসভাসমূহ পাকিস্তানকে নিন্দা জানিয়ে, অপরদিকে বাংলাদেশকে সম্ভাব্য সব রকমের সহায়তার প্রতিশ্রুতি জানিয়ে প্রস্তাব গ্রহণ করে। ২৮শে মার্চ উত্তর প্রদেশ বিধানসভা স্বাধীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদানের জন্য কেন্দ্রীয় সরকারকে সর্বসম্মতিক্রমে অনুরোধ জানায়। রাজস্থান বিধানসভা সর্বসম্মতিক্রমে বাংলাদেশে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হত্যাকাণ্ডের জন্য গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে। পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যসরকার ২১শে এপ্রিল ভারতের সকল রাজ্যসরকারকে পূর্ববাংলার জনগণের সাহায্যার্থে এগিয়ে আসার জন্য আহ্বান জানায়।
বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামে ভারতের ভূমিকা আলোচনা করতে গেলে ত্রিপুরার কথা আলাদা করে বলতে হয়। ৭১ সালে ত্রিপুরার মোট জনসংখ্যা ছিল ১৬ লাখ, আর ত্রিপুরায় আশ্রয় নেয়া শরণার্থীর সংখ্যা ছিল ১৭ লাখ। এমনি পরিস্থিতিতে ত্রিপুরার জনগণ এবং মুখ্যমন্ত্রী সচীন্দ্র লাল সিংহ শরণার্থীদের পাশে এসে দাঁড়ান এবং বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সর্বতোভাবে সহায়তা দেন। বিহারের মুখ্যমন্ত্রী কার্পুর ঠাকুর বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র ও গোলাবারুদসহ সম্ভাব্য সব রকমের সহায়তার প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেন। স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলোকে পৃষ্ঠপোষকতা দেয়া ছাড়াও কিছু রাজ্যসরকার প্রকাশ্যে বাংলাদেশ ফান্ডে অনুদান দেয়। উড়িষ্যা সরকার ৫০,০০০ রুপির অনুদান প্রদান করে। বিহার সরকার দেয় ২৫০০০ রুপি। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রতি রাজ্যসরকারসমূহের সক্রিয় সমর্থন ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারকে আরো বলিষ্ঠ ভূমিকা গ্রহণে প্রণোদনা যুগিয়েছে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের ভূমিকা কী হবে এ নিয়ে সরকারি মহলে ভিন্নমতও ছিল। ক্ষমতাসীন কংগ্রেসের প্রভাবশালী অংশের অভিমত ছিল ‘শরণার্থী সমস্যা থেকে উদ্ধারের চেষ্টার অতিরিক্ত কোন আকাঙ্ক্ষা তথা বাংলাদেশের স্বাধীনতা ভারতের জন্য অহেতুক ঝুঁকি, সমস্যা ও বিড়ম্বনা সৃষ্টি করবে।’ এ অংশের সুপারিশ ছিল, মার্কিন মধ্যস্থতায় পাকিস্তানের ওপর প্রভাব খাটিয়ে বাংলাদেশ সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানে উপনীত হওয়া। অন্যদিকে কংগ্রেসের বাম অংশের কাছে শরণার্থী সমস্যার সমাধানে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিষয়টিই প্রাধান্য পায়। তবে মুক্তিযুদ্ধে ভারতের প্রত্যক্ষ সহায়তা ছিল অপরিহার্য। এ পরিপ্রেক্ষিতে ভারতের বিপক্ষে পাকিস্তান-চীন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান নেয়ার আশঙ্কা ভারতের নিরাপত্তাকে ভীষণ ঝুঁকিপূর্ণ করে তোলে। এমনি পরিস্থিতিতে তাদের যুক্তি, সোভিয়েট ইউনিয়নের সঙ্গে সমঝোতা প্রতিষ্ঠা ব্যতীত ভারতের অন্য কোনো উপায় নেই। ভারত নিজের যুদ্ধ প্রস্তুতি, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক জনমত, পরাশক্তির প্রতিক্রিয়া, এমনি নানাদিক বিবেচনার পর পাকিস্তানের সঙ্গে প্রত্যক্ষ যুদ্ধে লিপ্ত হয়। এ পরিপ্রেক্ষিতে ভারত সরকার গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে ৬ই ডিসেম্বর মিসেস গান্ধী লোকসভায় বলেন, ‘পাকিস্তান ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে, শান্তিপূর্ণ সমাধানের আকাঙ্ক্ষার কোনো গুরুত্ব নেই। বাংলাদেশের জনগণ তাদের অস্তিত্বের সংগ্রামে লিপ্ত আর ভারতের জনগণ যুদ্ধ করছে আগ্রাসনের বিরুদ্ধে। তাঁরা বর্তমানে একই শত্রুর বিরুদ্ধে সহযাত্রী।’ ৬ ই ডিসেম্বর প্রথমে ভুটান, এরপর ভারত স্বাধীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদানের কথা ঘোষণা করে। বাংলাদেশ ও ভারতের সেনাবাহিনীর সমন্বয়ে গঠন করা হয় যৌথ কমান্ড। পূর্ব রণাঙ্গনে যৌথ কমান্ডের অধীনে পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় সেনাবাহিনী সর্বাত্মক যুদ্ধে লিপ্ত হয়। তিন ডিভিশন পাকিস্তানি সেনার বিরুদ্ধে মিত্রবাহিনী-তে ভারতের নিয়মিত সেনা সদস্য ছিল ৭ ডিভিশন। অধিকন্তু বাংলাদেশের তিন ব্রিগেড নিয়মিত সৈন্যের পাশাপাশি ১০টি সেক্টরে বিশ হাজার সৈন্যের অতিরিক্ত আরো এক লাখের অধিক গেরিলা সদস্য ছিল। ভারতের ইস্টার্ন ফ্রন্টের চিফ অব স্টাফ লে জে জ্যাকব লিখেছেন যে, মাত্র ১৩ দিনের সংক্ষিপ্ত যুদ্ধে ভারতীয় ও বাংলাদেশী বাহিনী আনুমানিক ১,৫০,০০০ বর্গকিলোমিটার এলাকা মুক্ত করেছে। আক্রমণ প্রতিরোধের জন্য সুবিধাজনক দুর্গম একটি ভূখণ্ডে অত্যন্ত শক্তিশালী, সুশিক্ষিত একটি সেনাবাহিনীকে পরাভূত করাই ছিল এক সম্পূর্ণ বিজয়। ১৬ই ডিসেম্বর বিকেল চারটায় ভারতের ইস্টার্ন কমান্ডের প্রধান ও বাংলাদেশ-ভারত যৌথ কমান্ডের অধিনায়ক লে. জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা, বাংলাদেশের ডেপুটি চিফ অব স্টাফ গ্রুপ ক্যাপ্টেন এ কে খোন্দকার এবং ভারতের অপরাপর সশস্ত্র বাহিনীর প্রতিনিধিগণ ঢাকায় অবতরণ করেন। এর আধ ঘণ্টা পর ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে বাংলাদেশ- ভারত যৌথ বাহিনীর কাছে পাকিস্তানি পূর্বাঞ্চলীয় সমরাধিনায়ক লে. জেনারেল এ এ কে নিয়াজী পূর্ব রণাঙ্গনে সকল পাকিস্তানি বাহিনীর পক্ষে আত্মসমর্পণ দলিলে স্বাক্ষর করেন। ভারতের প্রধানমন্ত্রী পূর্ব ও পশ্চিম উভয় রণাঙ্গনে ভারতের পক্ষ থেকে একক যুদ্ধ বিরতির ঘোষণা দেন। তিনি আরো বলেন, “ঢাকা এখন একটি স্বাধীন দেশের মুক্ত রাজধানী। বাংলাদেশের জনগণকে তাদের বিজয়ের মুহূর্তে আমরা অভিনন্দন জানাই। মানবিক চেতনার মূল্যবোধে বিশ্বাসী সব জাতি এটাকে মানুষের স্বাধিকার অর্জনের একটি মাইল ফলক হিসেবে স্বীকৃতি দেবে।’
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের ভূমিকার নানা ভাষ্য রয়েছে। অধিকাংশ গবেষক/পণ্ডিত জাতীয় স্বার্থের আলোকে ব্যাখ্যা করে থাকেন। কারণ চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী পাকিস্তানের ন্যায় যুদ্ধবাজ প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতের দুপ্রান্তে না থাকলে নিরাপত্তা ঝুঁকি ও ব্যয়, দুটোই হ্রাস পাবে। আঞ্চলিক শক্তিসাম্যও ভারতের অনুকূলে চলে আসবে। ভারতীয় নিরাপত্তা বিশ্লেষকগণ মনে করেন, বাংলাদেশের অভ্যুদয় ভারতের নিরাপত্তার ক্ষেত্রে ভিন্ন পরিস্থিতি তৈরি করেছে। উপমহাদেশে পাকিস্তান আর পূর্বের ন্যায় কার্যকর ভারসাম্য স্থাপনকারী শক্তি থাকল না। উত্তর সীমান্তের আক্রমণ মোকাবিলা করা ভারতের জন্য এখন অনেক সহজ হবে। বৈরী নাগা ও মিজোরাম এখন আর পূর্ববঙ্গে প্রশিক্ষণ ও অস্ত্রের জন্য সহায়তা পাবে না। চীন ও পূর্বাঞ্চলকে নিয়ে ভারতকে আর তেমন উদ্বিগ্ন থাকতে হবে না।
পূর্ব পাকিস্তান সঙ্কটের মূলে রয়েছে আওয়ামী লীগ ও ভারত সরকারের যড়যন্ত্র – পাকিস্তান সরকারের প্রকাশিত শ্বেতপত্রে এরূপ দাবি করা হলেও, পাকিস্তান পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যকার বৈষম্য, বিরোধ বা বঞ্চনার বিষয়টিকে সম্পূর্ণ এড়িয়ে যায়। ফলে পাকিস্তানের এ মূল্যায়ন অতি পরিচিত সেই ‘ব্লেইম গেম’ ভিন্ন কিছু নয়। এটা অস্বীকারের উপায় নেই যে, মুক্তিযুদ্ধে ভারতের অনুসৃত নীতি ও কর্মপদ্ধতির বিষয়টি নির্ধারিত হয়েছে ভারত-পাকিস্তান এবং পাকিস্তানের দু-অংশের সম্পর্কের পটভূমিতে। পশ্চিমা গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের সহায়তাকে বিচার করা হয়েছে পাক-ভারত দ্বন্দ্বের প্রেক্ষাপটে। ভারতীয় মনোভাব সম্পর্কে লন্ডনের ডেইলি টেলিগ্রাফ পত্রিকা প্রতিনিধি ডেভিড লোশাক ১০ই মার্চ ১৯৭১ লিখেছেন, ‘ভারত শুধু চায় তার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বীকে টুকরো টুকরো করতে অথবা তাকে চিরদিনের জন্য হীনবল করতে। ভারতের কাছে এর চেয়ে ভালো আর কিছুই নয়।’
ভারতের রাজনৈতিক দল ও গণমাধ্যমে জনমতের প্রতিফলন ঘটেছে পূর্ণমাত্রায়। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের অনুকূলে ভারতীয় জনমত কেন এত প্রভাবিত হলো? এর প্রাথমিক কারণ, আবেগজাত মানবিকতাবোধ। দ্বিতীয়ত, মুক্তিযুদ্ধের আদর্শিক আবেদন। মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাস পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর নির্বিচারে নির্যাতন, গণহত্যা, ধর্ষণ যে-কোনো হৃদয়বান মানুষকে বাঙালিদের পাশে দাঁড়াতে উদ্বুদ্ধ করবে, এটাই স্বাভাবিক। যে-কারণে পশ্চিমা দেশগুলোর অনেক সরকার মুক্তিযুদ্ধ প্রশ্নে অনেক সময় পর্যন্ত নির্বিকার থাকলেও, সেসব দেশের সাধারণ জনগণ ও সংবাদপত্র শুরু থেকেই তীব্র ভাষায় পাকবাহিনীর মানবতাবিরোধী কর্মকাণ্ডের ধিক্কার জানায়। সুতরাং প্রতিবেশী ভারতীয় জনগণের মধ্যে সহানুভূতি ও আবেগ আরো তীব্র হওয়া অপ্রত্যাশিত ছিল না। এক্ষেত্রে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শিক চেতনাও কম গুরুত্বপূর্ণ ছিল না। বিশেষত দ্বিজাতিতত্ত্বের বিপরীতে ভাষা ও কৃষ্টি নির্ভর অসাম্প্রদায়িক জাতীয়তাবাদ ছিল বাংলাদেশের মূল ভিত্তি। মুক্তিযুদ্ধের এই অসাম্প্রদায়িক চেতনার সঙ্গে যুক্ত হয় গণতন্ত্র এবং সমাজতন্ত্রের আদর্শ। যে-কারণে ভারতের বাম ও উদারপন্থী রাজনৈতিকদলগুলো মুক্তিযুদ্ধকে সক্রিয়ভাবে সমর্থন করে এবং সোভিয়েত ইউনিয়নসহ পূর্ব ইউরোপের সমাজতান্ত্রিক দেশগুলো বাংলাদেশের পক্ষে অবস্থান নেয়। এর উল্টো প্রতিক্রিয়ায় মুসলিম দেশসমূহ এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানের পক্ষে অবস্থান নেয়। চীনও পাকিস্তানের পক্ষে ছিল, কারণ চীনের সমাজতান্ত্রিক ধারণার সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী বাংলাদেশ সরকারের সমাজতান্ত্রিক ধারণার পার্থক্য ছিল। উপরন্তু চীন-ভারত দ্বন্দ্ব ও সোভিয়েত-চীন দ্বন্দ্বও এ ক্ষেত্রে কাজ করেছে। ৭১-এর আগস্ট মাসের ‘ভারত-সোভিয়েত মৈত্রী চুক্তি’ মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে চীনের অবস্থানকে আরো দৃঢ় করে। বিভিন্ন রাষ্ট্রের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে স্ব-স্ব জাতীয় স্বার্থ প্রাধান্য পায়, যা অস্বীকার করার উপায় নেই। কিন্তু বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ক্ষেত্রে ভারতের ভূমিকাকে কেবলমাত্র জাতীয় স্বার্থের নিরিখে বিচার করা ঠিক হবে না। কারণ ভারতের গণমানুষের কাছে মুক্তিযুদ্ধের ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতার পেছনে আদর্শিক আবেদনই ছিল বড় কথা। মুক্তিযুদ্ধের ইস্যুতে সারা ভারতব্যাপী সেদেশের জনমত ছিল বাংলাদেশের পক্ষে অত্যন্ত দৃঢ় ও ঐক্যবদ্ধ। সে কারণে ভারত সরকারের পক্ষে যুদ্ধের ঝুঁকিসহ সাহসী ও চূড়ান্ত পদক্ষেপ নেয়া সম্ভব হয়েছিল। [মোহাম্মদ সেলিম]
তথ্যসূত্র: মোহাম্মদ সেলিম, বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক, বাংলা একাডেমি ২০০৯

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৮ম খণ্ড