You dont have javascript enabled! Please enable it! মুক্তিযুদ্ধে সোভিয়েত ইউনিয়নের ভূমিকা - সংগ্রামের নোটবুক

মুক্তিযুদ্ধে সোভিয়েত ইউনিয়নের ভূমিকা

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকালে বিশ্বজুড়ে চলছিল দুই পরাশক্তির মধ্যে স্নায়ুযুদ্ধ। একদিকে সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতৃত্বাধীন সমাজতান্ত্রিক দেশ, অপরদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন বিশ্বের পুঁজিবাদী দেশসমূহ। উভয় দেশের নেতৃত্বে পূর্ব থেকেই গড়ে উঠেছিল পরস্পরবিরোধী সামরিক জোট। সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রথম থেকেই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রতি তাদের সমর্থন ও সহযোগিতা ব্যক্ত করে। অন্যদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিক্সন প্রশাসন পাকিস্তানের পক্ষে এবং বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার বিরুদ্ধে দৃঢ় অবস্থান গ্রহণ করে। সমাজতান্ত্রিক দেশ হওয়া সত্ত্বেও সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে মতাদর্শিক বৈরিতা ও ভারতের বিপরীতে পাকিস্তানের সঙ্গে দীর্ঘ সুসম্পর্কের কারণে চীনও পাকিস্তানের পক্ষে অবস্থান নেয়। সৌদি আরব, মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ এবং বিশ্বের অন্যান্য মুসলিম প্রধান রাষ্ট্রগুলোর সিংহভাগ পাকিস্তানের পক্ষ অবলম্বন করে। ফলে কার্যত বাংলাদেশ প্রশ্নে বিশ্বে দুটি ধারার সৃষ্টি হয়।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বিশ্বের সমর্থন আদায়ের ব্যাপারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ব থেকেই অত্যন্ত সচেতন ছিলেন। এ লক্ষ্যে তিনি প্রয়োজনীয় কৌশলও গ্রহণ করেছিলেন। বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রাম যে ন্যায়সঙ্গত এবং একটি জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকারের স্বীকৃত নীতির সঙ্গে সম্পূর্ণ সঙ্গতিপূর্ণ, তা তিনি বিশ্বেবাসীকে বুঝাতে সক্ষম হয়েছিলেন। ৭০-এর নির্বাচন ও নির্বাচনে তাঁর নেতৃত্বাধীনে আওয়ামী লীগ-এর বিপুল বিজয়ের মাধ্যমে তা বিশ্ববাসীর কাছে আরো স্পষ্ট হয়।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ফ্যাসিবাদের পরাজয় এবং মিত্রশক্তিসমূহের মধ্যে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিশিষ্ট ভূমিকা পালন ও যুদ্ধে বিজয়, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সমাজতন্ত্রের অভ্যুদয়, পরাধীন বিভিন্ন দেশ ও জাতিসমূহের স্বাধীনতার মন্ত্রে জেগে ওঠা ইত্যাদির ফলে সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতৃত্বে একটি বিশেষ শক্তিকেন্দ্রের সৃষ্টি হয়। সোভিয়েত ইউনিয়ন আদর্শগতভাবে দরিদ্র, পরাধীন ও উন্নয়নশীল দেশ-জাতির পক্ষে অবস্থান নেয়। আমাদের স্বাধীনতা বা জাতীয় মুক্তির সংগ্রামে সোভিয়েত ইউনিয়ন ছিল বাংলাদেশের স্বাভাবিক মিত্র। তাই মুক্তিযুদ্ধের প্রথম থেকেই সোভিয়েত ইউনিয়ন বাংলাদেশের পক্ষে প্রকাশ্য অবস্থান গ্রহণ করে। অন্যদিকে বাংলাদেশের প্রধান মিত্র ও সাহায্যকারী দেশ ভারতের পক্ষে সোভিয়েত ইউনিয়নের দৃঢ় সমর্থন ও ভূমিকা মুক্তিযুদ্ধে অধিক শক্তি যুগিয়েছিল।
ষাটের দশক থেকে বাংলাদেশে ছাত্র আন্দোলন ও সংগঠন ছিল খুবই শক্তিশালী, যা বিশ্বের সাম্রাজ্যবাদবিরোধী ও প্রগতিশীল ছাত্র আন্দোলনের বিশেষ দৃষ্টি আকর্ষণ করে। কিন্তু তখনকার দিনে ঐসব ছাত্র আন্দোলনের আন্তর্জাতিক সম্মেলনে পাকিস্তান থেকে কোনো প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠনের যোগদান করা ছিল অচিন্তনীয়। কেননা সরকারি কর্তৃপক্ষের অনুমতি বা পাসপোর্ট পাওয়ার কোনো সুযোগই তখন ছিল না। কিন্তু ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান-এর পরিণতিতে জেনারেল আইয়ুব খানের পতন এবং জেনারেল ইয়াহিয়া খানের সময় বাঙালির জাতীয় মুক্তির তীব্র আন্দোলন, ৭০- এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগের অভূতপূর্ব বিজয়, বঙ্গবন্ধুর একক নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা, স্বাধীনতার মন্ত্রে উজ্জীবিত বাঙালির জাতিসত্তার উত্থান ইত্যাদি ঘটনা শাসকগোষ্ঠীকে অনেক দুর্বল ও ভীত করে তোলে। ঠিক একই সময়ে চেকোশ্লোভাকিয়ার ব্রাতিস্লাভা শহরের আন্তর্জাতিক ছাত্র ইউনিয়ন (International Union of Students- IUS)-এর দশম সম্মেলনে বাংলাদেশের সে সময়কার অন্যতম বৃহৎ ছাত্র সংগঠন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি (বর্তমান নিবন্ধের লেখক)-কে আমন্ত্রণ জানানো হয়। তখনকার উদ্ভূত পরিস্থিতিতে উক্ত সম্মেলনে তাঁকে যোগদানের অনুমতি দিতে পাকিস্তানের সামরিক সরকার বাধ্য হয়। মাত্র এক মাসের জন্য পাসপোর্ট দেয়া হয় এবং কেবল মাত্র চেকোশ্লোভাকিয়া ভ্রমণের কথা পাসপোর্টে স্পষ্ট উল্লেখ করা হয়।
শুরু থেকেই বিষয়টি সম্বন্ধে বঙ্গবন্ধু অবহিত ছিলেন। সম্মেলনে যোগদান উপলক্ষে সোভিয়েত ইউনিয়নের ছাত্র ও যুব সংগঠন এবং সরকারের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতৃবৃন্দের নিকট বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের বিষয়টি সুযোগমতো তুলে ধরার ব্যাপারে বঙ্গবন্ধুর একধরনের নির্দেশনা ছিল। উদ্দেশ্য, বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামে তাদের সমর্থন আদায়। সে কারণে উল্লিখিত সম্মেলনে যাওয়া-আসার পথে ৮-৯ দিন মস্কোতে যাতে যাত্রাবিরতি করা যায়, সে বন্দবস্তও করে রাখা হয়েছিল।
IUS-এর সম্মেলনে সোভিয়েত ছাত্র সংগঠনের নেতৃবৃন্দ ও ভারতের All India Student Federation (AISF)-এর প্রতিনিধি দলের সার্বিক সমর্থন ও সহযোগিতায় বাংলাদেশের জনগণের মুক্তিসংগ্রামের পক্ষে সমর্থন জ্ঞাপন করে প্রস্তাব গৃহীত হয়। এ সকল তৎপরতার ফলে পরবর্তীকালে মুক্তিযুদ্ধের সময় অনেক দেশের প্রগতিশীল সাম্রাজ্যবাদবিরোধী ছাত্র-যুব সংগঠনের বাংলাদেশের পক্ষে সমর্থন লাভ সহজ হয়েছিল।
IUS সম্মেলন থেকে ফেরার পথে ৮-৯ দিন মস্কোতে অবস্থানকালে বর্তমান নিবন্ধের লেখক সেদেশের
ছাত্র-যুব সংগঠনের নেতা এবং পার্টি ও সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গের সঙ্গে বিভিন্ন সময়ের বৈঠকে
বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের বিভিন্ন দিক এবং সর্বদিক বিবেচনায় এটি যে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীর ন্যায়সঙ্গত আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম, তা তুলে ধরতে সচেষ্ট হন। ঐ সময় মস্কোতে তিনি এ ব্যাপারে যাঁদের সাহায্য-সহযোগিতা লাভ করেন, তাঁদের মধ্যে বরিস লেপসভ, শ্লাভা, ভালুজা, তানিয়া ও কাতিয়ার নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
২৫শে মার্চ কালরাতে বাংলাদেশের নিরস্ত্র ও ঘুমন্ত মানুষের ওপর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী কামান ও ট্যাঙ্ক নিয়ে অতর্কিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে নির্বিচারে গণহত্যা শুরু করলে, এ নারকীয় হত্যাযজ্ঞের বিরুদ্ধে যে কয়টি দেশ রাষ্ট্রীয়ভাবে তাৎক্ষণিক সোচ্চার প্রতিবাদ জানায়, সোভিয়েত ইউনিয়ন তার মধ্যে অন্যতম। মার্চের শেষদিকে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আলোচনা ভেঙ্গে দিয়ে ইয়াহিয়া খান ঢাকা ছেড়ে ইসলামাবাদে চলে যাওয়ার পর প্রথম সুযোগে এবং বাংলাদেশে গণহত্যা শুরু হওয়ার ৫৬ ঘণ্টার মধ্যেই সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রধানমন্ত্রী আলেক্সি কোসিগিনের একটি নিন্দা-বার্তা নিয়ে ২৮শে মার্চ ইসলামাবাদে সোভিয়েত রাষ্ট্রদূত জেনারেল ইয়াহিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। গণহত্যার সরাসরি নিন্দা এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নিরাপত্তা বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে সোভিয়েত ইউনিয়ন নিজেদের অবস্থান ব্যক্ত করে। ২রা এপ্রিল সোভিয়েত প্রেসিডেন্ট নিকোলাই পদগোর্নি পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানকে কড়া ভাষায় একটি চিঠি লেখেন। তাতে তিনি পূর্ব বাংলার জনগণের বিরুদ্ধে পাকিস্তান সরকারের সামরিক বল প্রয়োগ, মানুষের প্রাণহানি, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও অন্যান্য রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে বন্দি এবং তাঁদের ওপর নির্যাতন ইত্যাদি বিষয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, ‘[শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর দল] সাম্প্রতিক সাধারণ নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের সন্দেহাতীত সমর্থন লাভ করেছিলেন।… পাকিস্তানে বর্তমানে যে জটিল সমস্যার উদ্ভব হয়েছে, বলপ্রয়োগ না করে রাজনৈতিকভাবে তার সমাধান করা যায় এবং করতে হবে। পূর্ব পাকিস্তানে দমননীতি ও রক্তপাত যদি চলতে থাকে, তাহলে নিঃসন্দেহে সমস্যার সমাধান আরও কঠিন হয়ে উঠবে।’ চিঠিতে ….সোভিয়েত প্রেসিডেন্ট মানুষের ওপর নিপীড়নের অবসান ঘটিয়ে সমস্যা সমাধানের একটি শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক উপায় উদ্ভাবনের জন্য অত্যন্ত জরুরি ব্যবস্থা গ্রহণ করতে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার প্রতি আহ্বান জানান। চিঠিটি ৪ঠা এপ্রিল ১৯৭১ প্রাভদায় প্রকাশিত হয়।
জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে সোভিয়েত ইউনিয়ন পূর্ব বাংলায় পাকিস্তানের অব্যাহত গণহত্যার বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানাতে থাকে। এর ফলে বাংলাদেশের জনগণের মনোবল আরো বৃদ্ধি পায়। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সোভিয়েত ইউনিয়ন ক্রমাগত শক্ত অবস্থান গ্রহণ করতে থাকে।
মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিভিন্ন গণসংগঠন প্রচারাভিযান পরিচালনা করে। তার মধ্যে সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টি, শান্তি কমিটি, বিভিন্ন ট্রেড ইউনিয়ন, সোভিয়েত- আফ্রো গণসংহতি কমিটি, সাংবাদিক ইউনিয়ন, নারী কমিটি, রেডক্রস, শিশুদের সংগঠন পাইওনিয়ার, ছাত্র-যুব সংগঠন কমসোমল প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। বিশেষ করে জাতিসংঘে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সোভিয়েত প্রতিনিধিদের দৃঢ় অবস্থান গ্রহণ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও পাকিস্তানের সমর্থক সকল দেশ ও শক্তির সকল ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করে দেয়। সর্বোপরি বাংলাদেশ প্রশ্নে ভারতের পক্ষে সোভিয়েত ইউনিয়নের দৃঢ় অবস্থান, ভারতের সঙ্গে মৈত্রী চুক্তি স্বাক্ষর (৯ই আগস্ট ১৯৭১) এবং প্রকাশ্যে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভারতকে সমর্থনদান, বাংলাদেশের শরণার্থীদের সাহায্য-সহযোগিতা প্রদান ইত্যাদির মাধ্যমে সোভিয়েত ইউনিয়ন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে অপ্রতিরোধ্য বিজয়ের দিকে নিয়ে যেতে শক্তি যোগায়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জাতিসংঘে একাধিকবার পাকিস্তানের পক্ষে প্রস্তাব উত্থাপন করলে সোভিয়েত ইউনিয়ন বারবার ভেটো প্রদান করে তা আটকে দেয় (দেখুন মুক্তিযুদ্ধে জাতিসংঘের ভূমিকা)।
যুদ্ধের একেবারে শেষদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বঙ্গোপসাগরে পাকিস্তানের পক্ষে এবং মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে সপ্তম নৌবহর প্রেরণ করলে এর বিরুদ্ধে দ্রুত পাল্টা ব্যবস্থা গ্রহণ করে সোভিয়েত ইউনিয়ন ষষ্ঠ নৌবহর সেখানে পাঠায় এমতাবস্থায় জাতিসংঘকে ব্যবহার করে যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানের পক্ষে প্রচেষ্টা নেয়ার কৌশল অবলম্বন করে, কিন্তু প্রধানত সোভিয়েত ইউনিয়নের কারণে তাদের সকল প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়ে যায়।
পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নিষ্ঠুরতম ও পরিকল্পিত আক্রমণে ভীত-সন্ত্রস্ত বাংলাদেশের প্রায় ১ কোটি মানুষ ভিটে-মাটি ছেড়ে প্রাণ রক্ষার্থে ভারতের বিভিন্ন শরণার্থী শিবির-এ আশ্রয় নেয়। ভারতের সরকার ও জনগণ সাধ্যমতো তাদের আশ্রয় ও সাহায্য প্রদান করে। শরণার্থীদের জন্য সোভিয়েত ইউনিয়ন খাদ্য, পোশাক, ঔষধসহ জরুরি জিনিসপত্র নিয়ে এগিয়ে আসে। নিজেদের সাহায্যের পাশাপাশি বিপুলসংখ্যক শরণার্থীর ত্রাণকার্যে সক্রিয়ভাবে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়ার জন্য সোভিয়েত ইউনিয়ন বিশ্বব্যাপী ব্যাপক প্রচারাভিযান পরিচালনা করে।
জুনের মধ্যবর্তী সময় থেকে সোভিয়েত ইউনিয়ন বিমানযোগে পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন উদ্বাস্তু শিবির থেকে শরণার্থীদের মধ্যপ্রদেশের মানায় স্থাপিত অস্থায়ী আশ্রয়কেন্দ্রে সরিয়ে নিতে সাহায্য করে। সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে শরণার্থীদের জন্য ঔষধসহ নানা জরুরি সামগ্রী পাঠানো হয়। সোভিয়েত ইউনিয়নের বিভিন্ন গণসংগঠন পরিকল্পিতভাবে বাংলাদেশের জন্য সহায়তা কার্যক্রমকে সে দেশের ব্যাপক মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দেয়। সোভিয়েত ইউনিয়নের সাধারণ মানুষও সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়।
সোভিয়েত ইউনিয়নে নিযুক্ত পাকিস্তানি রাষ্ট্রদূত জামশেদ মার্কার ২২শে জুন ক্রেমলিনে প্রধানমন্ত্রী কোসিগিনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। কোসিগিন মার্কারকে যেসব কথা বলেন, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে- জীবনের হুমকির কারণেই বাংলাদেশের শরণার্থীরা পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হচ্ছে; এ-সময় অনেকে গুলিতে নিহত হচ্ছে; একে কিছুতেই স্বাভাবিক অবস্থা বলা যায় না। তিনি, ‘আমাদের দেশের [সোভিয়েত ইউনিয়ন] মানুষ ব্যাপারটা কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না’ উল্লেখ করে পাকিস্তানি রাষ্ট্রদূতকে প্রশ্ন ছুড়ে বলেন, ‘আপনারা কীভাবে বিশ্বের মানুষের কাছে সহানুভূতি আশা করেন?’
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে ‘ভারতের চক্রান্তে পাকিস্তান ভাঙ্গার ষড়যন্ত্র’ বলে পাকিস্তান একদিকে সর্বাত্মক প্রচারণা চালায়, অন্যদিকে সর্বাধুনিক সমরাস্ত্রে নিজেদের সজ্জিত করতে থাকে। সাম্রাজ্যবাদের প্রত্যক্ষ মদদে পাকিস্তান ভারতকে ‘আগ্রাসী শক্তি’ বলেও বিশ্বব্যাপী প্রচার চালায়। ঠিক এমনই এক পরিস্থিতিতে ৯ই আগস্ট ১৯৭১ স্বাক্ষরিত হয় ২০ বছর মেয়াদি ঐতিহাসিক ‘ভারত-সোভিয়েত সহযোগিতা চুক্তি’। এ চুক্তির নবম ধারাটি ছিল খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। ঐ ধারায় বলা হয়, ‘ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়ন কখনো কারও দ্বারা আক্রান্ত হলে, তারা তা নিজেদের ওপর আক্রমণ বলে গণ্য করবে এবং পরস্পরের সহযোগিতায় এগিয়ে যাবে।’
মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের এক নোট থেকে জানা যায়, বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি সোভিয়েত ইউনিয়ন যে প্রয়োজনীয় সর্বপ্রকার সাহায্য-সহযোগিতা যোগাবে, সে কথা জুন মাসের শেষে ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী শরণ সিং-এর কাছে সোভিয়েত প্রধানমন্ত্রী কোসিগিন উল্লেখ করেন।
‘ভারত-সোভিয়েত সহযোগিতা চুক্তি’র ফলে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সোভিয়েত ইউনিয়নের সমর্থন-সংশ্লিষ্টতা আরো প্রশস্ত হয়, যা ভারতকে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব কাটিয়ে নতুন শক্তিতে উজ্জীবিত করে। বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের ক্ষেত্রে ভারতীয় সহযোগিতার এক পর্যায়ে পাকিস্তানের সঙ্গে সরাসরি যুদ্ধ অনিবার্য হয়ে উঠলে, উল্লিখিত চুক্তির ফলে সোভিয়েতের কাছ থেকে ভারতের অস্ত্রসহযোগিতা পাওয়ার সুযোগ তৈরি হয়। একই চুক্তির ফলে ভারতের পাশে সোভিয়েত ইউনিয়নের দৃঢ়ভাবে দাঁড়ানোর নিশ্চয়তাও পাওয়া যায়। তাই চুক্তি স্বাক্ষরের পরপর ভারত নিঃশঙ্ক চিত্তে মুক্তিযুদ্ধে দ্রুত অধিকতর সহযোগিতার হাত সম্প্রসারিত করে। ভারতের কাছে এ চুক্তি ছিল এক ধরনের নিরাপত্তা রক্ষাকবচ। বলার অপেক্ষা রাখে না, এ চুক্তির ফলে যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভারত দৃঢ় অবস্থান গ্রহণে সক্ষম হয়। আগস্টের মাঝামাঝি পর্যন্ত ভারতে ট্রেনিংপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের সংখ্যা ছিল ১০ হাজারের কাছাকাছি। অস্ত্রের স্বল্পতার জন্য প্রতীক্ষারত অসংখ্য তরুণকে ব্যাপকহারে ট্রেনিং দেয়া তখন পর্যন্ত সম্ভব হয়নি। ট্রেনিংপ্রাপ্তদের মধ্যে অনেকে আবার অস্ত্রের অভাবে একশনে যেতে পারছিলেন না। ভারত- সোভিয়েত চুক্তির ফলে এ সমস্যা কেটে যায়। শুধু এফএফ বাহিনীতে প্রতিমাসে ২০ হাজার করে নতুন মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেনিং-এর সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
উল্লিখিত চুক্তি যুক্তরাষ্ট্র ও পাকিস্তানে গভীর উদ্বেগের সৃষ্টি করে। হেনরি কিসিঞ্জার ‘ভারত-সোভিয়েত সহযোগিতা চুক্তি’কে ‘bombshell’ বলে অভিহিত করেন। চুক্তিকে ঘিরে উদ্বেগের কথা সোভিয়েত কর্তৃপক্ষকে জানাতে ইয়াহিয়া খান পাকিস্তানের পররাষ্ট্র সচিব সুলতান খানকে মস্কোতে পাঠান ৬ই সেপ্টেম্বর সোভিয়েত পররাষ্ট্রমন্ত্রী আন্দ্রেই গ্রোমিকোর সঙ্গে সুলতান খানের সাক্ষাৎকালে ‘ভারত-সোভিয়েত সহযোগিতা চুক্তি’র কথা উল্লেখ করে সোভিয়েত পররাষ্ট্রমন্ত্রী তাকে স্পষ্ট জানিয়ে দেন, ‘বাংলাদেশের ব্যাপারে পাকিস্তান যদি ভারতের বিরুদ্ধে সামরিক পদক্ষেপ নেয়, তাহলে সোভিয়েত ইউনিয়ন নীরব থাকবে না।’
১৮ই অক্টোবর মার্কিন রাষ্ট্রদূত বীম্ মস্কোয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী গ্রোমিকোর নিকট পাক-ভারত সীমান্ত থেকে উভয় পক্ষের সৈন্য প্রত্যাহারের জন্য মার্কিন-সোভিয়েত যৌথ উদ্যোগ গ্রহণের প্রস্তাব করেন। দিল্লি সফরকালে সোভিয়েত সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিকোলাই ফিরুবিন মার্কিন ঐ প্রস্তাব প্রত্যাখান করে ২৩শে অক্টোবর স্পষ্ট জানিয়ে দেন, “শেখ মুজিবের মুক্তি এবং ‘পূর্ব পাকিস্তানে দ্রুত রাজনৈতিক নিষ্পত্তি সাধন’ ছাড়া কেবল সীমান্ত অঞ্চল থেকে ভারত ও পাকিস্তানের সৈন্য প্রত্যাহারের মাধ্যমে যুদ্ধের আশঙ্কা রোধ করা সম্ভব নয়।” পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা বা রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ এনে বন্দি অবস্থায় সেখানকার সামরিক আদালতে আগস্ট মাস থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রহসনমূলক বিচার শুরু হয় এবং অক্টোবর মাসে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দিয়ে ঐ বিচারের রায় ঘোষণা করা হয়। বিচাকার্য চলাকালীন ও পরবর্তী সময়ে রায় ঘোষণার পর বিশ্বের যে-সকল দেশ এ ব্যাপারে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে বঙ্গবন্ধুর মুক্তি ও সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানের আহ্বান জানিয়ে পাকিস্তান সরকারের নিকট বার্তা পাঠায়, সোভিয়েত ইউনিয়ন ছিল তার মধ্যে অন্যতম।
২৭শে অক্টোবর ফিরুবিনের ভারত সফর শেষে দুদেশের পক্ষ থেকে এক যুক্ত ঘোষণা দেয়া হয়। তাতে বলা হয়, ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়ন সম্পূর্ণভাবে একমত যে, পাকিস্তান খুব শীঘ্র আক্রমণাত্মক যুদ্ধ শুরু করতে পারে। বিদ্যমান উত্তেজনাকর পরিস্থিতিতে আঞ্চলিক শান্তি বিপন্ন হয়ে পড়ার আশঙ্কা দেখা দেয়ায় উভয় পক্ষের মধ্যে ভারত-সোভিয়েত মৈত্রী চুক্তির নবম ধারার আলোকে সামগ্রিক বিষয় নিয়ে আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়।
ফিরুবিনের ভারত ত্যাগ করার ৩ দিনের মধ্যে সোভিয়েত বিমান বাহিনীর প্রধান এয়ার মার্শাল কুটাকভের নেতৃত্বে এক উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন সোভিয়েত সামরিক মিশন দিল্লি রওনা হয়। ১লা নভেম্বর থেকে আকাশ পথে ভারতের জন্য সোভিয়েত সামরিক সরবরাহ শুরু হয়।
এর পূর্বে ২৯শে সেপ্টেম্বর ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী-র সোভিয়েত ইউনিয়ন সফর শেষে প্রচারিত এক যৌথ বিবৃতিতে বলা হয়, ‘উভয় পক্ষই মনে করছেন, শান্তি বজায় রাখার স্বার্থেই পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের ইচ্ছা, অলংঘনীয় অধিকার ও আইনসঙ্গত স্বার্থের প্রতি মর্যাদা দিয়ে সেখানে উদ্ভূত সমস্যাবলির এক রাজনৈতিক মীমাংসায় উপনীত হওয়ার জন্য এবং শরণার্থীদের সম্মান ও মর্যাদা সুরক্ষিত থাকার মতো অবস্থায় তাদের দ্রুত ও নিরাপদে নিজেদের দেশে প্রত্যাবর্তনের জরুরি ব্যবস্থাদি গ্রহণ করা প্রয়োজন।’ উভয় পক্ষই পরবর্তী সময়েও ভারতীয় উপমহাদেশে উদ্ভূত রাজনৈতিক পরিস্থিতির ব্যাপারে পারস্পরিক যোগাযোগ অব্যাহত রাখার অঙ্গীকার ব্যক্ত করে।
৯ই ডিসেম্বর ভারত সফরকালে সোভিয়েত সংসদীয় প্রতিনিধিদলের নেতা ও সুপ্রিম সোভিয়েতের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ক সংসদীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক ভি কুদরিয়াভেৎসেভ বাংলাদেশ প্রশ্নে সোভিয়েত ইউনিয়নের অবস্থান পুনর্ব্যক্ত করে বলেন, ‘বাংলাদেশে যে সংগ্রাম চলছে, তা জাতীয় মুক্তি আন্দোলন যে সমাধানই নির্ণয় করা হোক না কেন, তা করতে হবে জনগণের ইচ্ছা, তাদের আইনসংগত অধিকার ও জাতীয় আশা-আকাঙ্ক্ষার ভিত্তিতে।’
জাতিসংঘে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সোভিয়েত ইউনিয়ন জোরালো ভূমিকা রাখে। বাংলাদেশবিরোধী চক্রান্ত রুখতে সোভিয়েত ইউনিয়ন জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে কার্যত একাই লড়ে যায়। সেপ্টেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের সভায় সোভিয়েত ইউনিয়ন বাংলাদেশের মানুষের রাজনৈতিক অধিকারের প্রতি সমর্থন জানায়। কিন্তু জাতিসংঘের অধিকাংশ সদস্য দেশ ব্যাপারটিকে পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয় বলে বিষয়টি এড়িয়ে যায়। তারা শুধু শরণার্থী সমস্যা সমাধানে আন্তর্জাতিক সাহায্য-সহযোগিতার কথা বলে।
অন্যদিকে মুক্তিযুদ্ধ যখন চূড়ান্ত বিজয়ের একেবারে দ্বারপ্রান্তে, তখন জাতিসংঘে পাকিস্তান, যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা শর্তহীন যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব উত্থাপন করতে প্রচেষ্টা চালায়। এসব প্রস্তাবে সংকটের মূল উৎস তথা বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে স্বীকার করে নেয়ার বিষয়ে কোনো কথাই ছিল না। বরং তাতে বাংলাদেশে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর দখলদারিত্ব বজায় রেখেই ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব করা হয়। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর অবস্থান টিকিয়ে রাখার দূরভিসন্ধিমূলক প্রস্তাবের বিরুদ্ধে সোভিয়েত ইউনিয়ন বারবার ভেটো দিতে থাকে। বারবার ভেটো প্রয়োগের বিষয়টি দৃষ্টিকটু প্রতীয়মান হতে পারে বিধায় সোভিয়েত ইউনিয়ন ও পোল্যান্ড পূর্ব বাংলার নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিকট ক্ষমতা হস্তান্তরের বিকল্প প্রস্তাব উত্থাপন করে। ফলে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে বিষয়টি অমীমাংসিতভাবে ঝুলে থাকে। জাতিসংঘে প্রস্তাব গ্রহণের মাধ্যমে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পাকিস্তানের মিত্রদের মুক্তিযুদ্ধের বিজয় রোধ করার ষড়যন্ত্র এভাবে সোভিয়েত ইউনিয়ন ব্যর্থ করে দেয়।
৩রা ডিসেম্বর বাংলাদেশ প্রশ্নে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সরাসরি যুদ্ধ শুরু হলে, পরদিন নিরাপত্তা পরিষদের জরুরি বৈঠক আহ্বান করা হয়। নিরাপত্তা পরিষদের ঐ বৈঠকে সোভিয়েত ইউনিয়নের স্থায়ী প্রতিনিধি জ্যাকব মালিক বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধিকে বক্তব্য প্রদানের সুযোগ দানের দাবি জানান। অনেক দেশের আপত্তির মুখেও মালিক তাঁর প্রস্তাবের পক্ষে দৃঢ়তার সঙ্গে যুক্তি উত্থাপন করেন। তিনি তাঁর বক্তব্যে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধকে জাতীয় মুক্তির আন্দোলন হিসেবে চিহ্নিত করে বলেন, ‘আমরা যদি উটপাখির মতো বালিতে মাথা গুঁজে থাকতে চাই, তাহলে এ নিয়ে ভাবার কিছু নেই। কিন্তু বাস্তব সত্য যদি আমরা জানতে চাই – কেন এই দুই দেশের মধ্যে সামরিক সংঘর্ষ দেখা দিয়েছে, তাহলে এই সংকটের মূল কারণটা জানতে হবে; এই ঘটনা ও তার কারণ নিরূপণ করতে হবে।’ একই বক্তব্যে তিনি বাংলাদেশ সংকটকে জাতীয় মুক্তি আন্দোলন (ন্যাশনাল লিবারেশন মুভমেন্ট) হিসেবে অভিহিত করেন। যদিও শেষ পর্যন্ত জাতিসংঘে বাংলাদেশের প্রতিনিধির বক্তব্য দেয়ার সুযোগ হয়নি, কিন্তু মালিকের প্রস্তাবের সূত্র ধরে অন্যরা প্রকাশ্যে স্বীকার করুক আর না করুক সকলের সামনে একথা স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল যে, বাংলাদেশের প্রশ্নটি শুধু উদ্বাস্তুবিষয়ক একটি সমস্যা নয়, বরং বাঙালিদের জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের অংশবিশেষ।
৫ই ডিসেম্বর জাতিসংঘে জ্যাকব মালিক ভারত উপমহাদেশের সংকট সম্বন্ধে তার অপর এক বক্তব্যে বলেন, ‘ভারতীয় উপমহাদেশের বিপজ্জনক পরিস্থিতি অতি দ্রুত পূর্ব পাকিস্তানের একটি রাজনৈতিক সমাধানের দাবি তুলে ধরছে। এই সমাধান করতে হবে সেখানকার জনগণের প্রকৃত আকাঙ্ক্ষা, যা ১৯৭০ সালের ডিসেম্বরের নির্বাচনে ব্যক্ত হয়েছে, তার সঙ্গে সামঞ্জস্য রক্ষা করে। এ কথার অর্থ হল পূর্ব পাকিস্তানের জনগণকে তথা তাদের নির্বাচিত গণপ্রতিনিধিদেরকেই তাদের ভবিষ্যৎ নির্ধারণের পূর্ণ এক্তিয়ার দিতে হবে। ১৩ই ডিসেম্বর নিরাপত্তা পরিষদের সভায় জ্যাকব মালিক যুক্তি দেখিয়ে বলেন, ‘সাম্প্রতিক ঘটনাবলির কারণে এই সংকটে শুধু পাকিস্তান ও ভারত নয়, বাংলাদেশও একটি পক্ষ। দেড় লাখ গেরিলা যোদ্ধা স্বাধীনতার জন্য লড়ছেন, তাদের প্রতিনিধির বক্তব্যও শোনা উচিত।’
পাকিস্তানের সমর্থনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সামরিক হস্তক্ষেপের প্রস্তুতি নিতে শুরু করে। পাকিস্তানি বাহিনীর নিশ্চিত পরাজয় ঠেকাতে ৯ই ডিসেম্বর মার্কিন প্রেসিডেন্ট নিক্সন মার্কিন সপ্তম নৌবহরকে বঙ্গোপসাগরের দিকে অগ্রসর হওয়ার নির্দেশ দেন। সপ্তম নৌবহর ছিল সর্বাধুনিক পারমাণবিক অস্ত্রে সজ্জিত পাঁচ হাজার নাবিক, ৭৫টি যুদ্ধবিমান, ৫টি হেলিকপ্টার, ৩টি স্বচালিত মিসাইলবিধ্বংসী ডেস্ট্রয়ার, ৪টি কামান বিধ্বংসী ডেস্ট্রয়ার, ১টি হেলিকপ্টার বাহক ছাড়াও অন্যান্য মরণাস্ত্র দ্বারা সজ্জিত। এ নৌবহর সমুদ্রের বহু দূর থেকে নির্ভুলভাবে গোলা নিক্ষেপ করে কোনো দেশের ব্যাপক সম্পদ ও মানুষকে নিশ্চিহ্ন করতে সক্ষম ছিল।
সপ্তম নৌবহরের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল, মুক্তপ্রায় বাংলাদেশে পাকিস্তানি বাহিনীর চূড়ান্ত পরাজয় ঠেকানোর জন্য নৌ, বিমান ও স্থল তৎপরতা চালানো; বঙ্গোপসাগরে ভারতের নৌ-অবরোধ ব্যর্থ করা; পাকিস্তানি স্থলবাহিনীর তৎপরতায় সাহায্য দান; ভারতীয় বিমান তৎপরতা প্রতিহত করা এবং মার্কিন নৌ-সেনা অবতরণে সাহায্য করা ইত্যাদি। কিন্তু সপ্তম নৌবহরের উদ্দেশ্য ব্যর্থ করে দেয় সোভিয়েত ইউনিয়ন। সপ্তম নৌবহরের গতিরোধ করতে পাল্টা পদক্ষেপ গ্রহণে সোভিয়েত ইউনিয়ন এক মুহূর্তও দেরি করেনি। সোভিয়েত নৌবাহিনীর এডমিরাল সের্গেই গরশকফ ঘোষণা দেন যে, মার্কিন নৌবহরকে বঙ্গোপসাগরে আসতে দেয়া হবে না।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্র করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ‘শক্ত ব্যবস্থা’ গ্রহণ করতে পারে এ উপলব্ধি সোভিয়েত ইউনিয়নের আগে থেকেই ছিল। মার্কিন সপ্তম নৌবহর আসার আগেই ভারত মহাসাগরে সোভিয়েত নৌবহরের সমাবেশ সম্পূর্ণ হয়। ভারত মহাসাগর এলাকায় আগে থেকেই তিনটি সোভিয়েত যুদ্ধজাহাজ টহলরত অবস্থায় ছিল। ডিসেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহে প্রথম নৌবহরটি তাদের দায়িত্ব শেষে পূর্বনির্ধারিত বিশ্রামের উদ্দেশ্যে তাদের ঘাঁটি ভ্লাদিভস্তকে ফিরে যাচ্ছিল। কিন্তু মার্কিন পরিকল্পনা আঁচ করতে পেরে সোভিয়েত নৌ-কমান্ড তাদের টহল অব্যাহত রাখার নির্দেশ দেয়। এসব যুদ্ধজাহাজের সঙ্গে নতুন নৌবহর এসে যোগ দেয়। প্রয়োজনে আরো অতিরিক্ত নৌযান প্রেরণের সিদ্ধান্ত হয়। ফলে ডিসেম্বরের মাঝামাঝি ভারত মহাসাগর এলাকায় মোট সোভিয়েত নৌযানের সংখ্যা দাঁড়ায় ১৬। মার্কিন সপ্তম নৌবহরের গতিবিধি জানার জন্য সোভিয়েত ইউনিয়ন কসমস ৪৬৪ পর্যবেক্ষণ উপগ্রহ উৎক্ষেপণ করে।
সোভিয়েত ইউনিয়ন সময়মতো কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ না করলে, সপ্তম নৌবহর বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের জন্য এক ভয়াবহ পরিণতি বয়ে নিয়ে আসতে পারত। সোভিয়েতের সময়োচিত পদক্ষেপের কারণে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর পরাজয় নিশ্চিত হয়ে যায়।
বাংলাদেশর মহান মুক্তিযুদ্ধে সোভিয়েত ইউনিয়ন এক ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করে। শুধু মুক্তিযুদ্ধকালে নয়, যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশের পুনর্গঠনেও সোভিয়েত ইউনিয়ন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনে এগিয়ে আসে। ২৪শে জানুয়ারি ১৯৭২ সোভিয়েত ইউনিয়ন বাংলাদেশকে কূটনৈতিক স্বীকৃতি প্রদান করে। উল্লেখ্য, বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদানকারী প্রথম দেশগুলোর মধ্যে সোভিয়েত ইউনিয়ন ছিল অন্যতম। জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক নানা ফোরামে বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্তির প্রশ্নেও সোভিয়েত ইউনিয়ন অত্যন্ত দৃঢ় ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। [নুরুল ইসলাম নাহিদ]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৮ম খণ্ড