মুক্তিযুদ্ধ ও মুসলিম রাষ্ট্রসমূহ
সাধারণভাবে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে মুসলিম রাষ্ট্রসমূহের প্রাথমিক ও ধারাবাহিক প্রতিক্রিয়া ছিল বিরোধিতা করা এবং পাকিস্তানের প্রতি অন্ধ সমর্থন প্রদান। এতদ্সত্ত্বেও অনেক মুসলিম রাষ্ট্রই পাকিস্তানকে সমর্থনও জোগায়নি বা বাংলাদেশের বিরুদ্ধাচরণও করেনি; তারা সংঘাতে জড়িত দুপক্ষ থেকেই সমদূরত্ব ও নীরবতা বজায় রেখেছিল। মোটা দাগে বলতে গেলে, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে প্রতিক্রিয়া ও অবস্থানের ভিত্তিতে মুসলিম দেশগুলোকে অন্তত চারটি দলে বিভক্ত করা যায়। প্রথম দলটি পাকিস্তানের সামরিক পদক্ষেপের প্রতি সমর্থন জানিয়েছিল এবং দেশটিকে সামরিক সহায়তাও দিয়েছিল। এ দলে ছিল সৌদি আরব, ইরান, লিবিয়া, জর্ডান এবং তুরস্ক। বিশেষত ইরান ‘কঠিন পরীক্ষার মুহুর্তে’ পাকিস্তানের পাশে দাঁড়িয়ে এক সঙ্গে যুদ্ধ করার আগ্রহ প্রকাশ করেছিল। দেশটি পাকিস্তানকে ৫২টি যুদ্ধবিমান, হেলিকপ্টার ও ট্যাঙ্ক দিয়েছিল। সৌদি আরব ৭৫টি বিমান পাঠিয়েছিল; আর জর্ডান দিয়েছিল ১০টি এফ-১০৪ বিমান। এখানে উল্লেখ্য যে, এসব যুদ্ধ সামগ্রীর উৎস ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। পাকিস্তানে সরাসরি অস্ত্র প্রেরণের ওপর মার্কিন কংগ্রেসের নিষেধাজ্ঞা থাকায় এগুলো বিকল্প পন্থায় পাকিস্তানে প্রেরণ করা হয়েছিল। অধিকন্তু, ওয়াশিংটনের অনুরোধেই এ বিকল্প পন্থার আশ্রয় নেয়া হয়েছিল।
বিশেষত সৌদি মনোভাব ছিল বেশ বিদ্বেষপূর্ণ। ৭১-এর ৮ই এপ্রিল আল-মদিনা নামক একটি সৌদি পত্রিকায় তার নির্বাহী সম্পাদক মুহাম্মদ সালেহ উদ্দিন ‘এ স্যাল্যুটেশান টু পাকিস্তান’ (পাকিস্তানকে সালাম) শীর্ষক একটি নিবন্ধ লেখেন। নিবন্ধে বঙ্গবন্ধুর নিন্দা করা হয় এ বলে, ‘মুজিব ক্ষমতার জন্য লালায়িত একজন অবিবেচক জুয়াড়ির মতো আচরণ করেছেন, এমনকি তা তার জাতি ও জনগণের বিনিময়ে হওয়া সত্ত্বেও।’ লেখক এ সত্যটি ভুলে গিয়েছিলেন যে, রাজনৈতিক সংঘাতের সূত্রপাত ঘটে বৈধ সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের ব্যাপারে পাকিস্তানিদের অনমনীয়তার কারণে।
মুসলিম রাষ্ট্রসমূহের দ্বিতীয় দলটি পাকিস্তানকে নৈতিক সমর্থন ও পরোক্ষ সহায়তা প্রদান করে। এ দলে ছিল কুয়েত, সংযুক্ত আরব আমিরাত (ইউএই) এবং মরক্কো। তৃতীয় দলে ছিল ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, মিসর, সুদান, আলজেরিয়া, আফগানিস্তান ও ইরাক। এ দেশগুলো সামগ্রিকভাবে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে নিরপেক্ষ ছিল।
চতুর্থ দলটি নীরবতা বজায় রেখেছিল। এ দলে ছিল সোমালিয়া, উত্তর ইয়েমেন, লেবানন, দক্ষিণ ইয়েমেন, চাদ, তিউনিসিয়া, নাইজেরিয়া, গায়ানা, মৌরিতানিয়া, সেনেগাল এবং মালির মতো দেশ। আপাতদৃষ্টিতে এ দলটিতে মুসলিম দেশগুলোর একটি বড় অংশ ছিল, যদিও প্রভাবের দিক থেকে প্রায় গুরুত্বহীন।
লক্ষণীয় যে, মুক্তিযুদ্ধের সূচনালগ্নেই কিছু মুসলিম রাষ্ট্র পাকিস্তানের পক্ষে বিবৃতি দিয়েছিল— ইন্দোনেশিয়া ২৭শে মার্চ (পরবর্তীতে তারা নিরপেক্ষ থাকে); ইরান ২৮শে মার্চ; ইউএআর ৩০শে মার্চ; তুরস্ক ও মালয়েশিয়া ৩রা এপ্রিল (পরে নিরপেক্ষতা অবলম্বন করে); লিবিয়া ৭ই এপ্রিল; সিরিয়া ১৫ই এপ্রিল এবং সৌদি আরব ২৮শে এপ্রিল।
মুসলিম বিশ্বের এ ধরনের নীতিগত অবস্থানের (যদিও সবাই সমগোত্রের ছিল না) কিছুটা ব্যাখ্যা আছে। প্রথমত, এটি সুস্পষ্টভাবে প্রতীয়মান ছিল যে, জাতি-ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদ হতেই বাঙালির আত্ম-নিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠার প্রয়াসের সূত্রপাত ঘটে এবং এতে ঐক্য সৃষ্টিকারী অথবা পরিচিতিমূলক উপাদান হিসেবে ইসলামের কোনো স্থান ছিল না। ফলে মুসলিম বিশ্ব মুক্তিযুদ্ধকে দেখেছে ইসলামি আদর্শের প্রতিপক্ষ এবং ‘ইসলামি’ পাকিস্তানকে বিভক্তকারী হিসেবে। দ্বিতীয়ত, তদানীন্তন সোভিয়েত ইউনিয়নের সমর্থন ও অতি উৎসাহী ইসরাইলের স্বীকৃতি ও সহায়তা এসব দেশে ব্যাপক ভুল ধারণার সৃষ্টি করে। তদুপরি, ভারতের ভূমিকা এবং শেষ পর্যন্ত তার যুদ্ধে জড়িয়ে পড়া ভবিষ্যতের বাংলাদেশের পরিচিতি সম্পর্কে এসব দেশকে সন্দিহান করে তোলে। তাছাড়া পাকিস্তানিদের জোরদার প্রচারণা ছিল যে, বাঙালিরা ‘হিন্দু’ ভারত দ্বারা প্ররোচিত হচ্ছিল। সর্বোপরি, পাকিস্তান আপাতদৃষ্টিতে মুসলিম বিশ্বকে বোঝাতে সক্ষম হয়েছিল যে, ইসলাম বিপদাপন্ন হয়ে পড়েছে।
এ প্রেক্ষাপটে মুক্তিযুদ্ধ প্রসঙ্গে অর্গানাইজেশন অফ ইসলামিক কনফারেন্স (ওআইসি, বর্তমানে অর্গানাইজেশন অফ ইসলামিক কোঅপারেশন)-এর ভূমিকার কথা বিবেচনা করা প্রয়োজন। মুসলিম উম্মাহর ২২ সদস্যবিশিষ্ট এ সংস্থাটি সে- সময় বাংলাদেশ সংকটকে ‘পাকিস্তানের দুই অংশের অভ্যন্তরীণ বিষয়’ বলে চিত্রায়িত করতে চেয়েছিল। তারা যুদ্ধকে একটি ষড়যন্ত্র হিসেবে তুলে ধরেছিল এবং পাকিস্তানের অত্যাচারী সেনাশাসকদের প্রতি সমর্থন যুগিয়েছিল। ওআইসি-র মহাসচিব টুঙ্কু আব্দুর রহমান ২৯শে মার্চে এক বিবৃতিতে বলেন, ‘পূর্ব পাকিস্তানের সংকট পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয় এবং পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে বাইরের কোনো দেশের হস্তক্ষেপ কাম্য নয়।
কোনো পক্ষের যুক্তি-পরামর্শই ওআইসি-র ঐ অবস্থান পরিবর্তন করতে পারেনি। ২০শে এপ্রিলে লেখা একটি পত্রে জাতিসংঘের মহাসচিব উ থান্ট টুঙ্কু আব্দুর রহমানকে মধ্যস্থতা করার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। কিন্তু এতে কোনো ফল হয়নি। ২৫শে জুন জেদ্দায় অনুষ্ঠিত সম্মেলনে ওআইসি ‘পাকিস্তানের ঐক্য ও আঞ্চলিক অখণ্ডতা রক্ষায়’ পাকিস্তানের প্রচেষ্টার প্রতি সমর্থন জানায়। একই সময়ে জারি করা একটি বিবৃতিতে ওআইসি সভা যে-কোনো ‘বিদেশী হস্তক্ষেপ’-এর নিন্দা জানায়। ২৬শে জুন নয়া দিল্লিভিত্তিক বাংলাদেশী কূটনীতিক কে এম শেহাবুদ্দিন (পাকিস্তানের পক্ষ ত্যাগকারী) একটি পত্রে বাংলাদেশের বাস্তবতা মেনে নিতে ওআইসি-র প্রতি আহ্বান জানান। তিনি জোর দিয়ে বলেন, ‘পাকিস্তান এখন মৃত এবং শহীদদের লাশের নিচে তা চাপা পড়ে গেছে। জুলাই ও আগস্ট মাসে মুজিবনগর সরকার-এর অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও প্রধানমন্ত্রী -তাজউদ্দীন আহমদ- আবেগময়ী ভাষায় লেখা একটি পত্রে যুক্তিবাদী অবস্থান গ্রহণের জন্য ওআইসি-র প্রতি আহ্বান জানান। কিন্তু তাতে কোনো ফল হয়নি। বিশেষত তাজউদ্দীন আহমদ অত্যন্ত জোরালোভাবে পাকিস্তানপন্থী মুসলিম দেশগুলোর যুক্তি খণ্ডনের চেষ্টা করেন এভাবে, “ইয়াহিয়ার বাহিনী বাংলাদেশে ইসলামি ন্যায়নিষ্ঠা প্রতিষ্ঠার যুদ্ধে লিপ্ত আছে এমন ধারণা একটি দুঃখজনক ভ্রম। তাদের নীরবতা তাই উপনিবেশবাদ ও বর্বরতার প্রতি সমর্থন জোগায়। ইসলামাবাদের প্রতি বৈষয়িক সমর্থন তাদেরকে স্বৈরতন্ত্রের পক্ষভুক্ত করে।’
ইসরাইলি ভূমিকা, যার কথা আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, তাৎক্ষণিক ও দীর্ঘমেয়াদী তাৎপর্যের প্রেক্ষাপটে ব্যাখ্যা করা প্রয়োজন। ২রা জুলাই ইসরাইলি সংসদ নেসেট-এ ‘পশ্চিম পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হত্যাযজ্ঞ, ধ্বংসলীলা ও সর্বব্যাপী নির্যাতনের’ নিন্দা জানানো হয়। ইসরাইল এমনকি ম্যাগেন ডেভিড অ্যাডম (ইসরাইলি রেডক্রস)-এর মাধ্যমে বাঙালি শরণার্থীদের জন্য ভারতে ঔষধ, যন্ত্রপাতি ও খাদ্যসামগ্রী প্রেরণ করে। দৃশ্যত, ইসরাইলের এ ভূমিকার উদ্দেশ্য ছিল মুসলিম দেশগুলোর বিপরীতে সুবিধা আদায় করা তথা বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম রাষ্ট্র (জনসংখ্যা বিচারে বাংলাদেশ)-এর সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের মাধ্যমে ইসরাইলের কূটনৈতিক অগ্রগতি অর্জন। কিন্তু বাংলাদেশ সরকার- ইসরাইলি পদক্ষেপ প্রত্যাখ্যান করে এবং এর মাধ্যমে কূটনৈতিক প্রজ্ঞা ও দূরদৃষ্টি উভয়রই পরিচয় দেয়।
বাস্তবতার বিপরীতে মুসলিম দেশগুলোর অর্থহীন ও যুক্তিহীন অবস্থান মোহাম্মদ হেইকাল নামক বিশিষ্ট মিশরীয় সাংবাদিকের বিবৃতিতে উঠে আসে। ১৯৭৩ সালের জানুয়ারি মাসে ঢাকা সফরের সময় (মিশরীয় সাংবাদিক প্রতিনিধিদলের নেতা হিসেবে) তিনি স্বীকার করেন ‘পুরো জিনিসটি আমাদের কাছে স্পষ্ট ছিল না। এখন আমরা অনুভব করি যে, আমরা যা ভেবেছিলাম ঘটনা তার চেয়ে বেশি কিছু ছিল।’ [সৈয়দ আনোয়ার হোসেন]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৮ম খণ্ড