You dont have javascript enabled! Please enable it! মুক্তিযুদ্ধে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকা - সংগ্রামের নোটবুক

মুক্তিযুদ্ধে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকা

মুক্তিযুদ্ধে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাঙালির জাতিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকা অপরিসীম ও ঐতিহাসিকভাবে খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। শিল্পী সৈয়দ আবদুল্লাহ খালিদ নির্মিত অপরাজেয় বাংলা – ৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনন্যসাধারণ ভূমিকার ‘আইকন’ হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে। ১৯২১ সালে প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে শুরু করে অবিভক্ত ভারতের একটি পশ্চাৎপদ অঞ্চল পূর্ববঙ্গের মানুষের আর্থ-সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক চেতনার উন্মেষ ও তার বিস্তারে এ বিশ্ববিদ্যালয় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। প্রতিষ্ঠার পর এ বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন্দ্র করে পূর্ব বাংলার বিশেষ করে স্বচ্ছল মুসলিম পরিবারের সন্তানরা আধুনিক ও উচ্চশিক্ষার সুযোগ লাভ করে। ক্রমান্বয়ে তৈরি হয় একটি শিক্ষিত তরুণ সম্প্রদায়ের। তারা ১৯৪৭-এ ভারত বিভাগপূর্ব পাকিস্তান আন্দোলন এবং ৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর নবতর পর্যায়ে বাঙালির জাতীয় মুক্তি বা স্বাধীনতা সংগ্রামে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে।
১৯৪৪ সালে বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগ-এর সাধারণ সম্পাদক আবুল হাশিমের উদ্যোগে পুরান ঢাকার ১৫০ মোগলটুলিতে পার্টির প্রগতিশীল কর্মীদের একটি অফিস প্রতিষ্ঠা করা হয়। এর প্রধান সংগঠক ছিলেন ১৯৪৭-পরবর্তী আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক শামছুল হক, যিনি টাঙ্গাইলের শামছুল হক নামে খ্যাত ছিলেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৪৩ সালে ইতিহাসে বিএ (অনার্স) ডিগ্রি লাভ করার পর এলএলবি-তে ভর্তি হন। তাঁর নেতৃত্বে ১৫০ মোগলটুলি পার্টি হাউসকে কেন্দ্র করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের একটি অংশ পাকিস্তান আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা রাখে। তবে, সোহরাওয়ার্দী-আবুল হাশিম সমর্থক ছাত্রদের প্রগতিশীল এ অংশের রাষ্ট্রভাবনা ১৯৪৭ সালে প্রতিষ্ঠিত পাকিস্তান ছিল না। তাদের রাষ্টভাবনায় ছিল শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক উত্থাপিত ১৯৪০ সালের ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাবের বহুমাত্রিক রাষ্ট্রধারণার আলোকে ভারতের উত্তর-পূর্ব অঞ্চল (বর্তমান বাংলাদেশ)-এ একটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা। পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের কনভেনর নঈমউদ্দিন আহমদ, কমরেড তোয়াহা, সৈয়দ নজরুল ইসলাম- প্রমুখ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র নেতৃবৃন্দ ঐ অফিসকে ঘিরে পাকিস্তান আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে গঠিত মুজিবনগর সরকার নামে সুপরিচিত স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার-এর প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ ভারত বিভাগের পূর্বে ঢাকা কলেজের ছাত্র থাকা অবস্থায় তিনিও ১৫০ মোগলটুলি পার্টি হাউসের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা করতেন। উল্লেখ্য, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সে-সময় ইসলামিয়া কলেজ (বর্তমান মওলানা আবুল কালাম আজাদ কলেজ)-এর ছাত্রনেতা হিসেবে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সান্নিধ্যে থেকে রাজনীতিতে প্রধানত কলকাতায় সার্বক্ষণিকভাবে নিজেকে নিয়োজিত রাখেন।
পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, ১৯৪৭ সালে প্রতিষ্ঠিত পাকিস্তান ভারত বিভাগপূর্ব সোহরাওয়ার্দী-আবুল হাশিম সমর্থক মুসলিম লীগের প্রগতিশীল অংশের রাষ্ট্রভাবনা ছিল না। বিশেষ করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ভারতের দুই অংশ নিয়ে এক পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় বিশ্বাসী ছিলেন না বলেই ভারত বিভাগের প্রাক্কালে বঙ্গীয় কংগ্রেসের কতিপয় নেতাকে সঙ্গে নিয়ে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর ভারতের উত্তর-পূর্ব অঞ্চলে স্বাধীন অখণ্ড বাংলা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার উদ্যোগের সঙ্গে তিনি (বঙ্গবন্ধু) নিজেকে সক্রিয়ভাবে যুক্ত করেছিলেন এবং তা বাস্তবায়নে সচেষ্ট হন। নতুন রাষ্ট্র পাকিস্তানে বাঙালির সামাজিক-অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক মুক্তির কোনো আকাঙ্ক্ষাই পূরণের সম্ভাবনা তো দেখা গেলই না, বরং শুরু থেকেই বাঙালিদের ওপর চেপে বসে পশ্চিম পাকিস্তানি এক ধরনের ঔপনিবেশিক শাসন- শোষণ-নিয়ন্ত্রণ ও জাতি-নিপীড়ন। এর বিরুদ্ধে নতুন করে বাঙালি জাতির মুক্তি সংগ্রামে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নেতৃত্বদানে এগিয়ে আসেন।
পাকিস্তান রাষ্ট্রে বাঙালিদের প্রথম বিদ্রোহ দেখা দেয় রাষ্ট্রভাষার প্রশ্নকে কেন্দ্র করে। বস্তুত ভাষাবিতর্ক নিয়েই পাকিস্তান রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা। আর ঐ ভাষাবিতর্কের মধ্যে নিহিত ছিল বাঙালির স্বতন্ত্র সত্তা বা আত্মপরিচয়ের স্বীকৃতির আকাঙ্ক্ষা। কার্যত পাকিস্তান রাষ্ট্রে রাষ্ট্রভাষার প্রশ্নকে কেন্দ্ৰ করে নতুন আঙ্গিকে বাঙালি জাতিসত্তার উত্থান ঘটে, যা বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অভ্যুদয়ের মধ্য দিয়ে চূড়ান্ত পরিণতি লাভ করে। ঐ ভাষা-আন্দোলন- থেকে স্বাধীনতা অর্জন পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছিল, অর্থে, সকল আন্দোলন-সংগ্রামের কেন্দ্রবিন্দু। আনুষ্ঠানিকভাবে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার একমাস পূর্বে আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. জিয়াউদ্দিন আহমেদ নতুন রাষ্ট্রের রাষ্ট্রভাষা উর্দুর পক্ষে মত প্রকাশ করলে এর বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষক ও বিশিষ্ট ভাষাবিদ ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ‘আমাদের ভাষা সমস্যা’ শীর্ষক এক নিবন্ধে বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে গ্রহণ করার পক্ষে জোরালো যুক্তি তুলে ধরেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষক ও ছাত্রদের নিয়ে ১৯৪৭ সালের ২রা সেপ্টেম্বর বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক আবুল কাশেমের নেতৃত্বে গঠিত হয়েছিল ‘পাকিস্তান তমদ্দুন মজলিস’ নামে একটি সংগঠন। ভাষা- আন্দোলনের প্রাথমিক পর্যায়ে এ সংগঠন বাংলা ভাষার দাবির পক্ষে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ১৯৪৮ সালের ৪ঠা জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের উদ্যোগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক মুসলিম হলের অডিটোরিয়ামে ছাত্রদের এক সভায় প্রতিষ্ঠিত হয় পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ। ৪৮ ও ৫২-র ভাষা-আন্দোলনে এ ছাত্র সংগঠনের নেতা-কর্মীরা নেতৃস্থানীয় ভূমিকা পালন করেন। স্মর্তব্য, ভাষা-আন্দোলনের প্রথম পর্যায়ে ১৯৪৮ সালের ১১ই মার্চ ‘বাংলা ভাষা দাবি দিবস’ পালন উপলক্ষে পূর্ব পাকিস্তান সেক্রেটারিয়েট (ইডেন বিল্ডিং)-এর সম্মুখে পিকেটিং করা অবস্থায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান গ্রেপ্তার বরণ করেন। তিনি ছিলেন ভাষা-আন্দোলনের প্রথম কারাবন্দিদের মধ্যে অন্যতম। সেদিন বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আরো অনেক ছাত্র ও নেতা- কর্মী গ্রেপ্তার হন। সে-সময় বঙ্গবন্ধু ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের ছাত্র।
১৯৪৮ সালের ২১শে মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দান (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান)-এর জনসভা ও ২৪শে মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলে ছাত্রদের সমাবর্তন অনুষ্ঠান উভয় স্থানে পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর ‘উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা’ ঘোষণার তাৎক্ষণিক প্রতিবাদ সে-সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররাই জানিয়েছিল।
ভাষা-আন্দোলনের দ্বিতীয় পর্ব অর্থাৎ ১৯৫২ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র না থাকলেও (১৯৪৯ সালে চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের আন্দোলনে নেতৃত্বদানের কারণে তাঁকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করা হয়), তিনি ২১শে ফেব্রুয়ারি সরকার কর্তৃক জারিকৃত ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে রাজপথে নেমে আসতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র নেতৃবৃন্দের প্রতি নির্দেশনা দেয়া ছাড়াও নিজে বন্দি অবস্থায় ফরিদপুর কারাগারে এক নাগাড়ে ১১ দিন আমরণ অনশন পালন করেন। সরকারি নির্দেশ উপেক্ষা করে ২১শে ফেব্রুয়ারির কর্মসূচি পালনকালে পুলিশ ও আধাসামরিক বাহিনীর সদস্যদের গুলিতে সেদিন কয়েকজন ছাত্র ও তরুণ শহীদ এবং অনেকে আহত হন। শহীদদের মধ্যে ছিলেন- আবুল বরকত, আব্দুল জব্বার, রফিক উদ্দীন আহমদ, আব্দুস সালাম, শফিউর রহমান প্রমুখ। এঁদের মধ্যে আবুল বরকত ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের এমএ শেষ বর্ষের ছাত্র এবং শফিউর রহমান (২২শে ফেব্রুয়ারি শহীদ) ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের (প্রাইভেট) ছাত্র। এ-সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ওপরও সরকারি দমন-পীড়ন চলে। ড. মুনির চৌধুরী, ড. মোজাফফর আহমেদ চৌধুরী (তখন তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর) প্রমুখ পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হন। ভাষা-শহীদদের স্মরণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ মিনার পাড়া সংলগ্ন রাস্তার অপর পাশে নির্মিত হয় বাঙালির জাতীয় জাগরণের প্রেরণার উৎস কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার।
১৯৪৯ সালের ২৩শে জুন পুরান ঢাকার কে এম দাস লেনের ‘রোজগার্ডেন’-এ প্রতিষ্ঠা লাভ করে বাঙালির জাতীয় মুক্তির আন্দোলনের সংগঠন আওয়ামী মুসলিম লীগ (১৯৫৫ সালে আওয়ামী লীগ নামকরণ)। এর প্রতিষ্ঠাতাদের মধ্যে অনেকেই ছিলেন (যেমন আতাউর রহমান খান, আব্দুস সালাম খান, শামছুল হক, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, মোল্লা জালাল উদ্দিন আহমদ প্রমুখ) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্র। ১৯৫৪ সালে পূর্ব বাংলার প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ও অপর ৩টি দল নিয়ে গঠিত যুক্তফ্রন্টের কাছে ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগের শোচনীয় পরাজয় ঘটে (২৩৭টি মুসলিম আসনের মধ্যে মুসলিম লীগ পায় মাত্র ৯টি আসন)। এ নির্বাচনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রসমাজ যুক্তফ্রন্টের প্রার্থীদের পক্ষে সারাদেশে প্রচার অভিযানে নিজেদের নিয়োজিত করে। নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের পক্ষে আওয়ামী লীগের প্রার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্র এবং পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক খালেক নেওয়াজ খানের নিকট মুসলিম লীগ সরকারের মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমিনের বিপুল ভোটের ব্যবধানে পরাজয়বরণ ছিল সে-সময়ে এক চাঞ্চল্য সৃষ্টিকারী ঘটনা। নির্বাচনের পর শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হকের নেতৃত্বে যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভা গঠিত হলেও, তা মাত্র দুমাসেরও কম সময় সরকার পরিচালনার সুযোগ পায়। এরপর পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনের ৯২(ক) ধারার আওতায় যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভা বাতিল ঘোষণা করে। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার দীর্ঘ প্রায় নয় বছর পর ১৯৫৬ সালে প্রথম শাসনতন্ত্র রচিত হয়েছিল বটে, কিন্তু তা মাত্র ২ বছর ৬ মাসের মতো বহাল ছিল। মূলত বাঙালিদের ওপর পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর শাসন-শোষণ ও নিয়ন্ত্রণ স্থায়ী ও নিরঙ্কুশ করার হীন স্বার্থে ১৯৫৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসে প্রথমে জেনারেল এস্কান্দার মীর্জা এবং ৩ সপ্তাহের ব্যবধানে তাকে সড়িয়ে জেনারেল আইয়ুব খান রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে। শুরু হয় পশ্চিম পাকিস্তানভিত্তিক সেনা-আমলা নিয়ন্ত্রিত আইয়ুবের এক দশকের স্বৈরশাসন। এর বিরুদ্ধে ক্রমান্বয়ে পূর্ব বাংলায় গড়ে উঠতে থাকে দুর্বার গণআন্দোলন। ঐ আন্দোলনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রসমাজ পালন করে গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা।
আইয়ুব সরকারের সময়ে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির বিরুদ্ধে নতুন করে ষড়যন্ত্র শুরু হয়। রাষ্ট্রীয় প্রচার মাধ্যমে অঘোষিতভাবে রবীন্দ্র সঙ্গীত ও কবিতা নিষিদ্ধ করা হয়। এর বিরুদ্ধে বাঙালিরা প্রতিবাদমুখর হয়ে ওঠে। তারই অংশ হিসেবে তারা ১৯৬২ সালে বিপুল আয়োজনের মাধ্যমে ঢাকাসহ পূর্ব বাংলার বিভিন্ন স্থানে রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকী পালনের সিদ্ধান্ত নেয়। সে-লক্ষ্যে ঢাকা হাইকোর্টের বিচারপতি এস এম মোরশেদকে সভাপতি ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষক খান সারওয়ার মুর্শিদকে সম্পাদক করে কেন্দ্রীয় রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন কমিটি গঠিত হয়। কবি বেগম সুফিয়া কামালের সভাপতিত্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলে রবীন্দ্রজয়ন্তীর এক বিশাল অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়। একই বছর প্রতিষ্ঠা লাভ করে বাঙালি সংস্কৃতির নন্দিত প্রতিষ্ঠান ‘ছায়নট’। ১৯৬৩ সালের ২২-২৮শে সেপ্টেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের উদ্যোগে ‘বাংলা ভাষা ও সাহিত্য সপ্তাহ’ পালিত হয়। ১৯৬৬ সালের ১৪-২০শে ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের উদ্যোগে ‘বাংলা প্রচলন সপ্তাহ’ পালন করা হয়। এ-সময় দোকানপাটের নামফলক, গাড়ির নম্বর ইত্যাদি বাংলায় লেখার অভিযান চলে।
এদিকে ১৯৬২ সালের ৩০শে জানুয়ারি আইয়ুব সরকার কর্তৃক আকস্মিকভাবে করাচিতে বর্ষিয়ান রাজনীতিবিদ ও বাঙালিদের অত্যন্ত জনপ্রিয় নেতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে গ্রেপ্তার করা হলে, পূর্ব বাংলার ছাত্র সমাজ বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। ১লা ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বতঃস্ফূর্ত ছাত্র ধর্মঘট পালিত হয়। শুরু হয় আইয়ুব শাসনবিরোধী আন্দোলন। আইয়ুবের পররাষ্ট্র মন্ত্রী মঞ্জুর কাদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে পূর্বনির্ধারিত একটি অনুষ্ঠানে বক্তৃতা দিতে এলে ছাত্রদের হাতে নিগৃহীত হয়। ৬ই ফেব্রুয়ারি থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়। বহু ছাত্রনেতা ও কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়। একই দিন আওয়ামী লীগ সমর্থক হিসেবে পরিচিত বহুল প্রচারিত বাঙালি দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকার সম্পাদক তফাজ্জল হোসেন মানিক মিঞাকে এবং পরের দিন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে কারারুদ্ধ করা হয়। এতদ্সত্ত্বেও ৭ই ফেব্রুয়ারি প্রেসিডেন্ট আইয়ুবকে ঢাকা সফরকালে প্রচণ্ড ছাত্র বিক্ষোভের সম্মুখীন হতে হয়। তার সফর উপলক্ষে নির্মিত তোরণ ছাত্ররা জ্বালিয়ে দেয়। ১৯৬২ সালে আইয়ুব সরকার কর্তৃক নিযুক্ত ‘শরিফ শিক্ষা কমিশন’-এর উর্দু ভাষার প্রতি আনুকূল্য, ব্যয়বহুল ও শিক্ষা সংকোচনমূলক প্রতিক্রিয়াশীল রিপোর্টের বিরুদ্ধে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র সমাজ দুর্বার আন্দোলন গড়ে তোলে। একই আন্দোলনকালে ১৭ই সেপ্টেম্বর পুলিশের গুলিতে ছাত্রসহ কয়েক জন তরুণ নিহত হন। ছাত্র আন্দোলন ও ধর্মঘটের কারণে ঐ বছর মাত্র ২৭ দিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় খোলা থাকে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে আইয়ুব সরকার শরিফ শিক্ষা কমিশন রিপোর্ট স্থগিত ঘোষণা করতে বাধ্য হয়। ১৯৬৪ সালে হামুদুর রহমান শিক্ষা কমিশন রিপোর্টের বিরুদ্ধেও অনুরূপ ছাত্র আন্দোলন গড়ে ওঠে এবং সরকার এবারও পিছিয়ে যায়।
পাকিস্তানি শাসনের একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল পূর্ব বাংলার ক্ষেত্রে আঞ্চলিক বৈষম্য। পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় প্রশাসন ও সামরিক বাহিনীতে বাঙালিদের প্রতিনিধিত্ব ছিল যৎসামান্য। রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানসমূহ, রাজধানী, বিদেশী মিশন সবকিছু ছিল পশ্চিম পাকিস্তানে অবস্থিত। সেখানে তিনবার কেন্দ্রীয় সরকারের রাজধানী স্থানান্তরিত হয়। কিন্তু ঢাকা কখনো সেকেন্ড ক্যাপিটালেরও মর্যাদা পায়নি। স্থল ও বিমান বাহিনী তো বটেই, এমনকি নৌবাহিনীর হেডকোয়ার্টার্স পর্যন্ত ছিল সেখানে। স্বাভাবিকভাবেই একটি দেশের রাজধানী পরিণত হয় অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের প্রাণকেন্দ্রে। পূর্ব পাকিস্তানে উৎপাদিত সোনালি আঁশ পাট রপ্তানি করে অর্জিত বিপুল বৈদেশিক মুদ্রা এখানের পরিবর্তে পশ্চিম পাকিস্তানের উন্নয়নে ব্যয় করা হয়। এক হাজার মাইলেরও অধিক ভারতীয় ভূখণ্ড দ্বারা পাকিস্তানের দুঅংশ বিভক্ত থাকায়, অর্থনীতির ‘ট্রিকেল ডাউন’ তত্ত্ব এক্ষেত্রে ছিল অকার্যকর। এক কথায়, শুরু থেকেই পূর্ব পাকিস্তান পরিণত হয় পশ্চিম পাকিস্তানি শাসক ও শিল্পপতি-ব্যবসায়ীদের এক ধরনের কলোনি বা বাজারে। আসলে পাকিস্তান ছিল ‘আইনি এক রাষ্ট্র, কিন্তু দুদেশ’। এরূপ অবস্থায় পাকিস্তানের দুঅংশের মধ্যে দিন-দিন আঞ্চলিক বৈষম্য বৃদ্ধি পাওয়া ছিল নিতান্তই স্বাভাবিক। এমনি পটভূমিতে ৫০-এর দশকের শেষ ও ৬০- এর দশকের শুরুতে প্রধানত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির কয়েকজন শিক্ষক যেমন ড. নুরুল ইসলাম, ড. রেহমান সোবহান, ড. মোশাররফ হোসেন, ড. আনিসুর রহমান প্রমুখ পাকিস্তানের দুঅংশের মধ্যে আঞ্চলিক বৈষম্যের এক ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরে এর প্রতিকারে বহুল আলোচিত ‘দুই অর্থনীতি তত্ত্ব’ (Two Economy Theory) উপস্থাপন করেন। পরবর্তীতে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৬-দফা কর্মসূচি প্রণয়নে এ তত্ত্ব প্রভাব ফেলে বলে মনে করা হয়।
কাশ্মীর ইস্যুতে ১৯৬৫ সালে ১৭ দিনের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময় পূর্ব পাকিস্তান সমগ্র বিশ্ব থেকে সম্পূর্ণ বিছিন্ন ও চরম নিরাপত্তাহীন অবস্থায় থাকে। এ পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৬৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ‘বাঙালির মুক্তিসনদ’ হিসেবে খ্যাত ঐতিহাসিক ছয়দফা কর্মসূচি পেশ করেন। ৬-দফার মূল লক্ষ্য ছিল বাঙালির জাতীয় মুক্তি বা স্বাধীনতা অর্জন। বঙ্গবন্ধু মাত্র ৩ মাস এ কর্মসূচি প্রচারের সুযোগ পান। ৬-দফাকে বিছিন্নতাবাদের কর্মসূচি হিসেবে আখ্যায়িত করে এর সমর্থকদের বিরুদ্ধে আইয়ুব খান ‘অস্ত্রের ভাষা’ প্রয়োগের হুমকি দেয়। ৮ই মে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করা হয়। ১৯৬৯ সালের ২২শে ফেব্রুয়ারি মুক্তিলাভ না করা পর্যন্ত তাঁকে এক নাগাড়ে প্রায় ৩ বছর কারাগারে বন্দিজীবন কাটাতে হয়। বন্দি অবস্থায় ১৯৬৮ সালে তাঁকে ১ নম্বর আসামি করে আগরতলা মামলা- (তখন ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা’ নামে পরিচিত) দায়ের করে ঢাকার কুর্মিটোলা ক্যান্টনমেন্টে সামরিক আদালতে তাঁর ও মামলার অন্য ৩৪ জন আসামির বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে বিচার অনুষ্ঠিত হয়।
৬-দফা কর্মসূচি পেশের পর আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতৃবৃন্দের অনেকে হয় দোদুল্যমান থাকেন, না হয় গ্রেপ্তার বরণ করেন। বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তারের একই রাতে (৮ই মে) আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমদ, কোষাধ্যক্ষ নুরুল ইসলাম চৌধুরী, শ্রম সম্পাদক জহুর আহমদ চৌধুরী, অন্যতম সহ-সভাপতি মজিবর রহমান (রাজশাহী) প্রমুখকে গ্রেপ্তার করা হয়। ২২শে জুন ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক মিজানুর রহমান চৌধুরী (যিনি দলের সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন) গ্রেপ্তার হন। আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটির ৩৯ সদস্যের অধিকাংশই জেলে নিক্ষিপ্ত হন। ১৯৬৬ সালে শুধু সেপ্টেম্বর মাসেই সারাদেশে ৯৩৩০ জন আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়। এমনি জেল-জুলুম, সরকারি নির্যাতন সারাটা সময় ধরে চলতে থাকে।
তখন ছিল এক কঠিন সময়। এর মধ্যেই ১৯৬৬ সালের ৭ই জুন আওয়ামী লীগের আহ্বানে বঙ্গবন্ধুসহ সকল রাজবন্দিদের মুক্তি ও ৬-দফা দাবি আদায়ে সমগ্র প্রদেশব্যাপী সর্বাত্মক হরতাল পালিত হয়। এ হরতাল সফল করতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র এবং ঢাকা, টঙ্গী ও নারায়ণগঞ্জের শ্রমিকরা বিশেষ ভূমিকা পালন করে। আগরতলা মামলার বিচার চলাকালে (১৯৬৮-৬৯) গণবিদ্রোহ দেখা দেয়। পূর্ব বাংলার সর্বস্তরের মানুষের মনে দ্রুত ধারণা জন্মায় যে, এটি ছিল ৬-দফাভিত্তিক বাঙালির ন্যায্য দাবি আদায়ের সংগ্রাম চিরতরে নস্যাৎ করতে বাঙালিদের বিরুদ্ধে আইয়ুব সরকারের ষড়যন্ত্রমূলক মামলা ও বিচারের নামে প্রহসন (যদিও বঙ্গবন্ধু ও অন্যদের বিরুদ্ধে পূর্ব বাংলাকে ‘স্বাধীন করার’ আইয়ুব সরকারের অভিযোগ অসত্য ছিল না, যা পরবর্তীতে নানা তথ্য-প্রমাণে প্রতিষ্ঠিত হয়)।
বাঙালির জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের এ ক্রান্তিকালে ছাত্রসমাজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু)-র নেতৃত্বে ঐতিহাসিক ভূমিকা পালনে এগিয়ে আসে (দেখুন ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান)। ১৯৬৯ সালের জানুয়ারি মাসের প্রথমদিকে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ, পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন (মেনন ও মতিয়া উভয় গ্রুপ), সরকারি ছাত্র সংগঠন জাতীয় ছাত্র সমাজ (এনএসএফ)-এর বিদ্রোহী দোলন গ্রুপ নিয়ে ডাকসু-র নেতৃত্বে ১১ দফা কর্মসূচিভিত্তিক আইয়ুববিরোধী মঞ্চ কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। বর্তমান আওয়ামী লীগ নেতা তোফায়েল আহমেদ ছিলেন তখন ডাকসু-র সহ-সভাপতি (ভিপি)। ৬৯-এর ১৭ই জানুয়ারি ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় ছাত্র-জমায়েতের কর্মসূচি ঘোষণা করে। সরকার ১৪৪ ধারা জারি করে সকল সভা-সমাবেশ-মিছিল নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। ঐদিন ও পরের দিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং ঢাকা শহরে ছাত্রদের সঙ্গে পুলিশের দিনভর সংঘর্ষ হয়। পুলিশ-ইপিআর বাহিনীর সদস্যরা লাঠি চার্জ ও কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে তাণ্ডবলীলা চালায়। হলে-হলে ছাত্রদের বেধড়ক প্রহার ও অনেককে গ্রেপ্তার করা হয়। পুলিশ-ইপিআর বাহিনীর হাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরাও লাঞ্চিত হন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতি এ ঘটনার তীব্র নিন্দা জানায়। ডাকসু-র নেতৃত্বাধীনে ও ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ব্যানারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা ১৪৪ ধারা লঙ্ঘন, কার্ফু ভঙ্গ এবং পুলিশ-ইপিআর-সেনাবাহিনীকে উপেক্ষা করে রাজপথে বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। সারাদেশের ছাত্রসমাজ এর সঙ্গে যোগ দেয়। চতুর্দিক প্রকম্পিত করে গগনবিদারী স্লোগান তোলে; ‘জেলের তালা ভাঙ্গবো, শেখ মুজিবকে আনবো’, ‘তোমার নেতা আমার নেতা, শেখ মুজিব শেখ মুজিব’, ‘তোমার আমার ঠিকানা, পদ্ম-মেঘনা-যমুনা’ ইত্যাদি। ২০শে জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলা থেকে ছাত্রদের একটি জঙ্গি লাঠি মিছিল বের হলে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সম্মুখে পুলিশের গুলিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের ছাত্র ও পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন (মেনন)-এর নেতা আসাদুজ্জামান শহীদ হন। এ সংবাদ দ্রুত ছড়িয়ে পড়লে সারাবাংলার ছাত্রসমাজ বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। ২৪শে জানুয়ারি ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আহ্বানে ঢাকা শহরে হরতালের কর্মসূচি পালনকালে ইপিআর বাহিনীর গুলিতে নিহত হয় ঢাকা নবকুমার ইনস্টিটিউটের নবম শ্রেণির ছাত্র মতিয়ুর। ছাত্রদের আন্দোলনের সঙ্গে সর্বস্তরের জনগণ একাত্মতা ঘোষণা করে তাতে যোগ দিতে থাকে। দ্রুত দেশ একটি বিপ্লবী অভ্যুত্থানের দিকে ধাবিত হয়। ৬ই ফেব্রুারি প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান ঢাকা সফরে এলে ছাত্রদের প্রচণ্ড বিক্ষোভের সম্মুখীন হয়। ৯ই ফেব্রুয়ারি সংগ্রামী ছাত্রসমাজ পল্টনে অনুষ্ঠিত ছাত্র-জনতার এক মহাসমাবেশ থেকে আইয়ুবনগরের নাম ‘শেরে বাংলা নগর’, আইয়ুব গেট (মোহাম্মদপুর)-এর নাম ‘শহীদ আসাদ গেট’ এবং আইয়ুব চিল্ড্রেন পার্কের না ‘শহীদ মতিয়ুর পার্ক’ রাখার ঘোষণা দেয়। ১৫ই ফেব্রুয়ারি ঢাকা সেনানিবাসে বন্দি অবস্থায় পাকিস্তানি নিরাপত্তা বাহিনী কর্তৃক আগরতলা মামলার অন্যতম আসামী সার্জেন্ট জহুরুল হককে গুলি করে হত্যা করা হয়। তাঁর হত্যার তিনদিন পর ১৮ই ফেব্রুয়ারি সেনাবাহিনীর সদস্যদের হাতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ও রসায়ন বিভাগের শিক্ষক ড. শামসুজ্জোহা মর্মান্তিকভাবে নিহত হন। এসব হত্যাকাণ্ড আইয়ুববিরোধী আন্দোলনে স্ফুলিঙ্গ ছড়িয়ে দেয়, সংঘটিত হয় ৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান। ২২শে ফেব্রুয়ারি আইয়ুব সরকার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও আগরতলা মামলার অন্যান্য আসামিদের নিঃশর্ত মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। পরের দিন ঢাকা রেসকোর্স ময়দান (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান)-এ আয়োজিত ছাত্র-জনতার এক বিশাল গণসম্বর্ধনা অনুষ্ঠানে ডাকসু-র ভিপি তোফায়েল আহমেদ কর্তৃক বাঙালির প্রিয় নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করা হয়।
এদিকে আইয়ুব সরকার কর্তৃক রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সঙ্গে সমঝোতার উদ্যোগ ব্যর্থ হলে ২৫শে মার্চ আইয়ুব খান ক্ষমতা থেকে বিদায় নেয় এবং সেনা প্রধান জেনারেল ইয়াহিয়া খান তার স্থলে ক্ষমতাসীন হয়। পরিবর্তিত রাজনৈতিক অবস্থায় ১৯৭০ সালের ৭ ও ১৭ই ডিসেম্বর (১২ই নভেম্বর ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় ও সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাসে ব্যাপক প্রাণহানি ঘটায় উপকূলীয় কতিপয় আসনে ১৭ই জানুয়ারি ১৯৭১) সর্বজনীন ভোটাধিকার ও জনসংখ্যা অনুপাতে আসন বণ্টন নীতি (যা ছিল বাঙালির দীর্ঘ দিনের দাবি)-র আওতায় জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর ২৪ বছরে এটিই ছিল প্রথম সাধারণ নির্বাচন। নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ৬-দফা কর্মসূচির ভিত্তিতে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদ ও পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদ উভয়ে বিপুল বিজয় অর্জন করে (দেখুন সত্তরের নির্বাচন )। এ নির্বাচনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ সারাদেশের ছাত্রসমাজ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। নির্বাচনে বিজয়ী আওয়ামী লীগ প্রধান ও মেজরিটি পার্টির নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নিকট ক্ষমতা হস্তান্তরের পরিবর্তে ইয়াহিয়ার সামরিক জান্তা ষড়যন্ত্রের আশ্রয় গ্রহণ করলে পরিস্থিতি দ্রুত চূড়ান্ত পরিণতির দিকে এগিয়ে যেতে থাকে। ৩রা মার্চ ১৯৭১ অনুষ্ঠেয় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন ২ দিন পূর্বে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান স্থগিত ঘোষণা করে। প্রতিবাদে ঢাকার জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে রাস্তায় নেমে আসে। সারাদেশের মানুষ বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। এমনি অবস্থায় ২রা মার্চ থেকে বঙ্গবন্ধু অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেন, যা ২৫শে মার্চ পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর গণহত্যা শুরুর পূর্ব পর্যন্ত চলে।
৭ই মার্চ রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণে বাঙালি জাতির প্রতি আহ্বান জানিয়ে এক দিকনির্দেশনামূলক ভাষণদান করে একই সঙ্গে অসহযোগ আন্দোলনের সর্বাত্মক কর্মসূচি ঘোষণা করেন। অসহযোগ আন্দোলনকে সার্বিকভাবে সফল করতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ সারাদেশের ছাত্রসমাজ বিশেষ ভূমিকা পালন করে। ২রা মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কলা ভবন চত্বরে ছাত্র- জনতার এক বিশাল সমাবেশে প্রথম স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা প্রকাশ্যে প্রদর্শিত হয়। ডাকসু-র তখনকার সহ- সভাপতি আ স ম আব্দুর রব, সাধারণ সম্পাদক আবদুল কুদ্দুস মাখন এবং ছাত্রলীগ-এর কেন্দ্রীয় ছাত্র নেতৃবৃন্দ এ ঐতিহাসিক ঘটনা সংঘটিত করেন। একই সমাবেশ থেকে জিন্নাহ হলের নাম পরিবর্তন করে ‘সূর্যসেন হল’ নামকরণের ঘোষণা দেয়া হয়। একই দিন বিকেলে ছাত্রলীগ নেতৃবৃন্দ কর্তৃক স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠনে সিদ্ধান্ত হয়। ডাকসু ও ছাত্রলীগ নেতৃত্বের যৌথ উদ্যোগে ৩রা ডিসেম্বর পল্টনে বঙ্গবন্ধুর উপস্থিতিতে এক বিশাল ছাত্র-জনতার সভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে সভাপতিত্ব করেন ছাত্রলীগ সভাপতি নূরে আলম সিদ্দিকী। সভায় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শাজাহান সিরাজ ‘স্বাধীনতার ইশতেহার’ পাঠ করেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি’ এটিকে স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘জাতির পিতা’ এবং সংগ্রামের সর্বাধিনায়ক ঘোষণা করা হয়। একই সমাবেশে ‘স্বাধীন বাংলাদেশ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ’ গঠনের ঘোষণা দেয়া হয়। তবে ৮ই মার্চ ছাত্রলীগের কার্যনিবাহী কমিটির সভায় সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ‘স্বাধীন বাংলাদেশ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ’ গঠনের আনুষ্ঠানিক সিদ্ধান্ত গৃহীত ও এ মর্মে নির্দেশনা দেয়া হয়। পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের নাম পরিবর্তন করে শুধু ‘ছাত্রলীগ’ রাখা হয়। ডাকসু ও ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দকে নিয়ে ‘স্বাধীন বাংলাদেশ কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ’ গঠিত হয়। ২৩শে মার্চ ‘পাকিস্তান দিবস’-এ এ পরিষদের আহ্বানে সারা বাংলা জুড়ে ‘প্রতিরোধ দিবস’ পালিত হয়। ঐদিন সকল বাড়িঘর, দোকানপাট, যানবাহন, অফিস-আদালত, কল-কারখানা সর্বত্র পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় পতাকার স্থলে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলিত হয়। এসব ঘটনার মধ্য দিয়ে কার্যত স্বাধীন বাঙালি জাতির বিপ্লবী অভ্যুত্থান ঘটে। শুধু অবশিষ্ট ছিল পাকিস্তানি দখলদারিত্ব থেকে দেশকে সম্পূর্ণভাবে মুক্ত করে স্বাধীনতাকে আনুষ্ঠানিক রূপদান করা। ২৫শে মার্চ কালরাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী বাঙালিদের ওপর নির্বিচার হত্যায় ঝাঁপিয়ে পড়ে। ২৬শে মার্চ প্রথম প্রহরে পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে বন্দি হওয়ার পূর্ব মুহূর্তে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। সঙ্গে- সঙ্গে সারাদেশে শুরু হয় পাকিস্তানি হানাদারদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ও মুক্তিযুদ্ধ। ১০ই এপ্রিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি, সৈয়দ নজরুল ইসলামকে উপ-রাষ্ট্রপতি, তাজউদ্দীন আহমদকে প্রধানমন্ত্রী করে গঠিত ৬ সদস্যবিশিষ্ট বাংলাদেশ সরকারের নেতৃত্বে পরিচালিত হয় এ মুক্তিযুদ্ধ। ৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মধ্যে সরাসরি রণাঙ্গনে অংশগ্রহণ করেছেন এমন সংখ্যা হাতে গোনা দু-একজন হলেও (অধ্যাপক নূর মোহাম্মদ মিয়া, অধ্যাপক আব্দুল মান্নান চৌধুরী), শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ ছিল ব্যাপক। বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষণ এর পরপর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীরা ডামি রাইফেল দিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের খেলার মাঠে যুদ্ধের প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। যুদ্ধকালে বিশেষ করে ছাত্ররা ভারতে অধিকতর প্রশিক্ষণ নিয়ে বিভিন্ন সেক্টরের রণাঙ্গনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। কেউ-কেউ ঢাকায় ক্র্যাক প্লাটুন নামে পরিচিত দুর্ধর্ষ গেরিলা দলের সদস্য হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ অপারেশন পরিচালনা করে শত্রুবাহিনীর একাধিক সদস্যকে হতাহত ও বহু টার্গেট ধ্বংস করেন। যুদ্ধক্ষেত্রে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক ছাত্রযোদ্ধা শাহাদাত বরণ করেন। ছাত্রীরাও নানাভাবে যুদ্ধ প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করে। এছাড়া মুক্তিযুদ্ধকালে মুজিব বাহিনী বা বিএলএফ নামে যে বিশেষ বাহিনী গঠিত হয়েছিল, তার শীর্ষ ৪ কমান্ডার শেখ ফজলুল হক মনি, আব্দুর রাজ্জাক, সিরাজুল আলম খান ও তোফায়েল আহমেদ সকলেই ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্র ও ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতা। মুজিব বাহিনীর সদস্যদের প্রায় সকলেই ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ সারাদেশের স্কুল- কলেজের শিক্ষার্থী ও ছাত্রলীগের নেতা-কর্মী।
রণাঙ্গনের বাইরে বিভিন্ন ফ্রন্টে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের কারো কারো ভূমিকা ছিল উল্লেখযোগ্য। তাঁদের মধ্যে যাঁর নাম সর্বাগ্রে শ্রদ্ধাভরে সর্বদা উচ্চারিত তিনি হলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী। তিনি ১৯৬৯-১৯৭১ সময়ে ঐ পদে আসীন ছিলেন। ৭১-এর মধ্য মার্চে অসহযোগ আন্দোলন চলাকালে পাকিস্তানি বাহিনীর গুলিতে ২ জন নিরপরাধ ছাত্র নিহত হলে, এর প্রতিবাদে দেশের বাইরে জেনেভা থেকে তিনি উপাচার্য হিসেবে পদত্যাগ করেন। ২৫শে মার্চ অপারেশন সার্চলাইট নাম দিয়ে পাকিস্তানি বাহিনী অন্যান্য স্থানের সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ও শিক্ষকদের ওপর পৈশাচিক হত্যাকাণ্ড চালালে তিনি খুবই ক্ষুব্ধ ও ব্যথিত হন। তিনি জেনেভা থেকে লন্ডন চলে আসেন এবং বিবিসি-সহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে পাকিস্তানি বাহিনীর এ হত্যাকাণ্ডের তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানান। এরপর ১০ই এপ্রিল বাংলাদেশ সরকার গঠিত হলে জাতিসংঘসহ বহির্বিশ্বে তাঁকে সরকারের স্থায়ী প্রতিনিধি নিযুক্ত করা হয়। লন্ডনভিত্তিক কার্যালয় খুলে সেখান থেকে মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাস তিনি ইউরোপের বিভিন্ন দেশ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও জাতিসংঘে বাংলাদেশের পক্ষে জনমত গঠন, কূটনৈতিক তৎপরতা পরিচালনা এবং মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে প্রবাসী বাঙালিদের বিভিন্ন তৎপরতায় সমন্বয় সাধনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন (দেখুন আবু সাঈদ চৌধুরী )।
মুক্তিযুদ্ধকালে গঠিত বাংলাদেশ সরকারের প্লানিং সেলের সদস্য হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. মুজাফফর আহমেদ চৌধুরী (রাষ্ট্রবিজ্ঞান) ও খান সরওয়ার মুরশিদ (ইংরেজি) গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. মুশাররফ হোসেন (অর্থনীতি; স্বাধীনতা-পরবর্তী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান) এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. আনিসুজ্জামান (বাংলা; বর্তমানে জাতীয় অধ্যাপক)ও এ সেলের সদস্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত ছিলেন।
মুক্তিযুদ্ধকে সর্বজনীন রূপ দেয়ার লক্ষ্যে মুজিবনগর সরকার কর্তৃক সেপ্টেম্বর মাসে ৯ সদস্যবিশিষ্ট যে উপদেষ্টা পরিষদ গঠন করা হয়, তাঁদের মধ্যে ন্যাপ সভাপতি অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক শিক্ষক। সেপ্টেম্বর মাসে বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর নেতৃত্বে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশন উপলক্ষে বিদেশী প্রতিনিধি ও কূটনীতিকদের মধ্যে তৎপরতা পরিচালনার উদ্দেশ্যে বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক যে ১৭ সদস্যবিশিষ্ট দলকে প্রেরণ করা হয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. রেহমান সোবহান তার অন্যতম সদস্য ছিলেন( দেখুন কূটনীতিকদের ভূমিকা)।
বাঙালির জাতীয় মুক্তির সংগ্রামে অনন্য ভূমিকা পালনের কারণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পরিণত হয়েছিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর অপারেশন সার্চলাইট নামক বর্বর আক্রমণের অন্যতম প্রধান টার্গেট। ২৫শে মার্চ রাতে ট্যাংক, মেশিনগানসহ ভারী অস্ত্র নিয়ে হানাদারদের বিশেষ বাহিনী জগন্নাথ হল, জহুরুল হক হল (সাবেক ইকবাল হল), সলিমুল্লাহ মুসলিম হল, রোকেয়া হল, ফজলুল হক মুসলিম হল, চারুকলা ইনস্টিটিউট (বর্তমান অনুষদ)-এর শিক্ষার্থীদের নিউ মার্কেট সংলগ্ন বর্তমান শাহনেওয়াজ ভবন ও শিক্ষকদের আবাসিক কোয়ার্টার্সে আক্রোশে ঝাঁপিয়ে পড়ে। ঐ এক রাতেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৯ জন শিক্ষক (ল্যাবরেটরি স্কুলের প্রধান শিক্ষক মোহাম্মদ সাদেকসহ) ও কয়েকশ ছাত্র-কর্মচারীকে তারা নির্মমভাবে হত্যা করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিনের স্বত্বাধিকারী মধুসূদন দে- (মধু দা), তাঁর স্ত্রী, পুত্র ও পুত্রবধূকে হত্যা করা হয়। মুক্তিযুদ্ধের সময় বিশেষ করে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর পরাজয়ের পূর্বক্ষণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিথযশা অধ্যাপকদের তাঁদের আবাসিক কোয়ার্টার্স থেকে চোখ বেঁধে ধরে নিয়ে নির্মম নির্যাতন শেষে ঢাকার মিরপুর ও রায়ের বাজার বধ্যভূমিতে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয় (দেখুন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গণহত্যা ও -ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বুদ্ধিজীবী হত্যা-)। এভাবে মুক্তিযুদ্ধকালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মোট ১৮ জন শিক্ষক নির্মম হত্যার শিকার হন। তাঁরা হলেন- অনুদ্বৈপায়ন ভট্টাচার্য (ফলিত পদার্থ বিজ্ঞান), আবদুল মুকতাদির (ভূতত্ত্ব), আতাউর রহমান খান খাদিম (পদার্থ বিজ্ঞান), অধ্যাপক এ এন এম মুনীরুজ্জামান (পরিসংখ্যান), অধ্যাপক গোবিন্দ চন্দ্র দেব (দর্শন), অধ্যাপক ড. জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা (ইংরেজি), ড. ফজলুর রহমান খান (মৃত্তিকা বিজ্ঞান), শরাফত আলী (গণিত), ড. মুহম্মদ সাদত আলী (শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট), অধ্যাপক ড. আবুল খায়ের (ইতিহাস), আনোয়ার পাশা (বাংলা), অধ্যাপক গিয়াসউদ্দিন আহমদ (ইতিহাস), ড. ন আ ম ফয়জুল মহী (শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট), অধ্যাপক ড. মুনীর চৌধুরী (বাংলা), অধ্যাপক ড. মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী (বাংলা), রাশীদুল হাসান (ইংরেজি), অধ্যাপক ড. সন্তোষচন্দ্র ভট্টাচার্য (ইতিহাস), অধ্যাপক ড. সিরাজুল হক খান (শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট)। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মেডিকেল সেন্টারের প্রধান চিকিৎসক ডা. মোহাম্মদ মোর্তজাও অনুরূপ হত্যাকাণ্ডের শিকার হন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শনের স্নাতকোত্তর শ্রেণির ছাত্র ও দৈনিক আজাদ পত্রিকার বিশ্ববিদ্যালয়ের রিপোর্টার চিশতী শাহ হেলালুর রহমানকে ২৫শে মার্চ জহুরুল হলের জানালার কার্নিসে সারারাত কাটানোর পর পরের দিন পাকিস্তানি সেনাদের নজরে পড়লে তাঁকে সেখান থেকে নামিয়ে নির্মম-নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হল গণকবর পাকিস্তানি হায়েনাদের বর্বরতার নিদর্শন হয়ে আছে। উপাচার্যের বাসভবন সংলগ্ন স্মৃতি চিরন্তন-এ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারের ১৯৪ জন শহীদের নাম উৎকলিত রয়েছে।
৭১-এ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষককে গ্রেপ্তার করে দুমাসের মতো ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে বন্দি করে রাখে। তাঁরা হলেন— শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আহসানুল হক (ইংরেজি), কে এ এম সা’দউদ্দীন (সমাজবিজ্ঞান), রফিকুল ইসলাম (বাংলা), আ ন ম শহীদুল্লাহ (গণিত) ও আবুল খায়ের (শহীদ বুদ্ধিজীবী, ইতিহাস; বন্দি অবস্থা থেকে মুক্তি লাভের পর ১৪ই ডিসেম্বর আলবদর বাহিনী বাসা থকে ধরে নিয়ে মিরপুর বধ্যভূমিতে হত্যা করে)।
মহান মুক্তিযুদ্ধে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা পালন করা সত্ত্বেও পাকিস্তানি সেনা কর্তৃপক্ষ কর্তৃক নিযুক্ত (জুলাই ৭১; পূর্বে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য) উপাচার্য সৈয়দ সাজ্জাদ হোসেনের নেতৃত্বে একদল শিক্ষক মুক্তিযুদ্ধবিরোধী ভূমিকা পালন ও হানাদার বাহিনীর সঙ্গে নানাভাবে সহযোগিতা করে। তাদের কেউ-কেউ বুদ্ধিজীবী হত্যার সঙ্গেও যুক্ত ছিল। স্বাধীনতার পর দালালির অভিযোগে তাদের বাধ্যতামূলক ছুটি দেয়া হয়। তারা হলো- ড. কাজী দীন মোহাম্মদ (বাংলা), মো. মোস্তাফিজুর রহমান (আরবি), ড. ফাতিমা সাদিক (আরবি), ড. জি ডব্লিও চৌধুরী (রাষ্ট্রবিজ্ঞান; আইয়ুবের মন্ত্রিসভায় যোগাযোগ মন্ত্রী ও ইয়াহিয়া খানের উপদেষ্টা), ড. রাশিদুজ্জামান (রাষ্ট্রবিজ্ঞান), এ কে এম শহীদুল্লাহ (রাষ্ট্রবিজ্ঞান), এ কে এম জামাল উদ্দিন মোস্তফা (রাষ্ট্রবিজ্ঞান), মো. আফসার উদ্দিন (সমাজবিজ্ঞান), মীর ফখরুজ্জামান (মনোবিজ্ঞান), ড. মো. শামসুল ইমাম (পদার্থবিদ্যা), ড. আবদুল জব্বার (ফার্মেসি), ড. মাহবুবউদ্দিন আহমদ (পরিসংখ্যান), মো. ওবায়দুল্লাহ ওরফে আশকার ইবনে শাইখ (পরিসংখ্যান), মো. হাবিবুল্লাহ (শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট), মো. আবদুল কাদের মিয়া (শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট), শাফিয়া খাতুন (শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট), লে. ক. (অব.) মতিউর রহমান (স্বাস্থ্য প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট), আতিকুজ্জামান খান (সাংবাদিকতা), ড. আফতাব আহমেদ সিদ্দিকী (উর্দু ও পার্সি), ফজলুল কাদের (উর্দু ও পার্সি), নূরুল মোমেন (আইন), এস এম ইমামুদ্দিন (ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি), মাহবুবুল আলম (উদ্ভিদবিদ্যা) ও ফাইজুল জালাল (উদ্ভিদবিদ্যা)। পরে সাধারণ ক্ষমার আওতায় তাদের অনেকে চাকরিতে পুনর্বহাল হয়। ড. মোহর আলী (ইতিহাস)-কে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী কর্মকাণ্ড ও দালালির অভিযোগে ১৯৭২ সালে গ্রেপ্তার করা হয়। ভূগোল বিভাগের শিক্ষক নাকভী ও ইতিহাসের শিক্ষক আসগর (উভয়ই অবাঙালি) মুক্তিযুদ্ধকালে পাকবাহিনীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত থেকে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সরবরাহসহ স্বাধীনতার বিরোধী তৎপরতায় লিপ্ত ছিল। পাকহানাদার বাহিনীর আত্মসমপর্ণের পূর্বেই তাঁরা দেশ ত্যাগ করে।
বাঙালির জাতীয় মুক্তির সংগ্রামে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবদান অতুলনীয়। এর স্বীকৃতিস্বরূপ ২০১১ সালে প্রতিষ্ঠানগতভাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মাননা ‘স্বাধীনতা পুরস্কার’-এ ভূষিত করা হয়। [হারুন-অর- র-রশিদ]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৮ম খণ্ড