You dont have javascript enabled! Please enable it! মুক্তিযুদ্ধে বীরাঙ্গনা - সংগ্রামের নোটবুক

মুক্তিযুদ্ধে বীরাঙ্গনা

মুক্তিযুদ্ধে বীরাঙ্গনা ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে পাকহানাদার বাহিনী ও তাদের এ দেশীয় দোসরদের দ্বারা অবর্ণনীয়, অমানবিক, নিষ্ঠুর, নির্মম ও পাশবিক নির্যাতনের শিকার বাঙালি নারীদের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান- বীরাঙ্গনা নামে আখ্যায়িত করেন। যে-কোনো যুদ্ধই মানবতার বিরুদ্ধে। আর সে-যুদ্ধে সবচেয়ে বেশি অত্যাচারিত, নির্যাতিত, নিপীড়িত ও লাঞ্ছিত হয় নারী ও শিশুরা। ১৯৭১-এ বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতাযুদ্ধের সময়ও এর ব্যতিক্রম ঘটেনি। এদের বড় একটি অংশ জুড়ে রয়েছেন তাঁরা, যারা বীরাঙ্গনা নামে পরিচিত। বয়স, জাতি, শ্রেণি, পেশা, বিত্ত, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সকলেই হানাদার বাহিনীর পাশবিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী, কামার, কুমার, মুচি কেউ-ই এদের হাত থেকে রক্ষা পায়নি। ৬ বছরের শিশু থেকে ৭০ বছরের বৃদ্ধাও এদের হাত থেকে রক্ষা পায়নি। রক্ষা পায়নি নববধূ, যুবতি, শ্রমিক, ধনী, গরিব, পাহাড়ি, উপজাতীয়, চা বাগানের শ্রমিকরাও। তাঁদেরকে কেউ-কেউ অপবিত্র নারী, কলঙ্কিত নারী, দুর্দশাগ্রস্ত নারী, ক্ষতিগ্রস্ত নারী, দুর্ভাগা নারী, ধর্ষণ এবং পাকহানাদার বাহিনীর আগ্রাসনের শিকার হিসেবে আখ্যায়িত করে। হাল্কা অস্ত্র ও সামান্য প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মুক্তিকামী-স্বাধীনতাকামী নিরীহ বাঙালিদের অসহায়ত্বের সুযোগে পাকহানাদার বাহিনী ও তাদের এ দেশীয় সহযোগীদের নির্যাতনে যেসব মহিয়সী রমণী নিজের সম্ভ্রম বিলিয়ে দিয়েছেন, নিজেদের জীবন উৎসর্গ করেছেন, তাঁদের জীবনের সেই ত্যাগ এবং বিভীষিকাময় জীবনের ইতিকথা ইতিহাসে এক অজানা অধ্যায়। কতটা কষ্ট, অপমান, অপবাদের বোঝা বয়ে যে একটি নারী বেঁচে থাকতে পারেন, তা বুঝতে পারা যায় তাঁদের জীবন প্রবাহ সম্পর্কে জানতে গিয়ে এবং তাদের সঙ্গে কথা বলে।
মুক্তিযুদ্ধে পাকহানাদার বাহিনী ও তাদের এ দেশীয় দোসররা যে কত ধরনের কত অশ্লীল উপায়ে পাশবিক নির্যাতন করেছে, তা ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না। নারীর ওপর তাদের আচরণ মধ্যযুগীয় বর্বরতাকেও হার মানায় (দেখুন নারী নির্যাতন)। ১৩-১৪ বছরের এক কিশোরীর কথা বলা যাক। পাকিস্তানি পশুরা দিন-রাত ক্যাম্পে তার ওপর পাশবিক নির্যাতন চালায়। শুধু ধর্ষণ-ই করেনি, সারা শরীর কামড়ে ক্ষত-বিক্ষত করে দেয়। হাত-পা বেঁধে পুকুরে ফেলে রাখে। বেয়নেট দিয়ে সারা শরীরে খোঁচায় আর মুক্তিযোদ্ধাদের খোঁজ জানতে চায়।
এমনও হয়েছে যে, পাকহানাদার বাহিনী এসেছে, যখন মহিলারা ঘরের বাইরে। তাদের ভাষায় ‘কুত্তাগুলো’ এসেই ঘরে ঢুকে পড়ে এবং তাদেরকে ভয় দেখিয়ে জোর করে ঘরের ভেতর নিয়ে যায়। কোলের বাচ্চা থাকলে তাকে এক টানে মেঝেতে ফেলে দেয়া হয়। অন্যরা কাপড়-চোপড় টানাটানি শুরু করে। চিৎকার দিতে চাইলে মুখ চেপে ধরে কাপড়-চোপড় খুলে ফেলে শুরু করে ধর্ষণ। একজনের পর একজন পালাক্রমে এভাবে নির্যাতনে অনেক গর্ভবতী নারীর গর্ভপাত ঘটে বা পেটের বাচ্চা মারা যায়।
বিভিন্ন জায়গা থেকে নারীদের ধরে এনে বিভিন্ন ক্যাম্পে রাখা হতো। আবার কখনো একই কক্ষে একাধিক নারীকে উলঙ্গ/অর্ধ-উলঙ্গ অবস্থায় রাখা হতো। কেউ কাউকে চিনত না বা একই এলাকার হলে হয়তো চিনত। দিন নেই, রাত নেই সারাক্ষণই তাদের ওপর অবর্ণনীয় নির্যাতন চলেছে। যখন যার মনে যা চেয়েছে, যেভাবে চেয়েছে সেভাবেই পাকিস্তানি হায়েনারা তাদের উদ্দেশ্য হাসিল করেছে। এসব নারীর কিছুই বলার বা নড়াচড়া করার কোনো সুযোগ ছিল না। একজন আরেকজনের দিকে শুধু চেয়ে-চেয়ে দেখতেন আর চোখ মুছতেন। তাঁদের মনে ছিল ঘৃণার আগুন। এক ঘরে এক সঙ্গে নির্যাতনের শিকার এঁরা।
অতিরিক্ত নির্যাতনের ফলে রক্তক্ষরণ হয়েছে এমন ঘটনাও ঘটেছে। সে অবস্থায়ও ঐ পশুর দল নিবৃত্ত হয়নি। নির্যাতিতা নারীর আর্তচিৎকারে পৃথিবী পর্যন্ত কেঁপে উঠত, কিন্তু দানবদের মন গলত না। কাউকে দূরে কোথাও ফেলে দিয়ে এসেছে। শুধু ধর্ষণই নয়, কাউকে-কাউকে দিয়ে তাদের রান্না-বান্না, কাপড় কাচা ইত্যাদি কাজও করাত। তাঁদের গোসল হতো না দিনের পর দিন এবং এক কাপড়েই কাটাতে হতো। উপর্যুপরি ধর্ষণ ও বিরামহীন অত্যচারের ফলে বহু নির্যাতিতা নারী কাতরাতে কাতরাতে রক্তাক্ত দেহে ইহলোক ত্যাগ করেছেন। তাঁদের লাশ অন্যদের সামনে ছুরি দিয়ে কেটে বস্তায় ভর্তি করে অন্যত্র ফেলে দেয়া হতো। এরূপ অবস্থা দেখে অন্যরা ভয়ে তাদের পাশবিক নির্যাতনে আর বাধা দিতেন না।
নির্যাতনের শিকার বহু নারী হয়েছেন দেশ ছাড়া, পরিবার ছাড়া। এমনকি সমাজ ও লোক-লজ্জার ভয়ে জন্মদাতা পিতাও অনেককে গ্রহণ না করে তাড়িয়ে দিয়েছে। মান- সম্মান হারিয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পারেননি বহু নারী। লজ্জা, ভয়ে অনেককে বেছে নিতে হয়েছে আত্মহত্যার পথ। অনেককে রাস্তায়-রাস্তায় ঘুরে বেড়াতে দেখা যায় পাগলের বেশে। ৭১-এ দেশ স্বাধীন হওয়ার পর এখন পর্যন্ত এরূপ এমন বহু নারী রয়েছেন, যারা সমাজ-জনসমক্ষে আসতে না পেরে ঐ সময়কার বীভিষিকাময় স্মৃতি গোপন করে শুধু বেঁচে আছেন। পাকহানাদাররা ১৬ই ডিসেম্বর আত্মসমপর্ণের পূর্বে কিছু সংখ্যক নারীকে পাকিস্তানে নিয়ে যায় এবং তাঁদের অনেককে গণিকাবৃত্তিতে নিয়োজিত করে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর যে-সমস্ত বীরাঙ্গনা যুদ্ধকালে পাকহানাদারদের ক্যাম্পে বন্দি ছিলেন, তাঁদের উদ্ধার করা হয়। তখন অনেকে ছিলেন বিবস্ত্র অবস্থায়। মুক্তিযোদ্ধারা জরুরি কাপড় সংগ্রহ করে তাদের শরীরে পড়িয়ে দেন। অনেকের আচরণ ছিল অসংলগ্ন। কেউ হাসছেন, কেউ পাগলের মতো আচরণ করছেন, কেউবা তাঁদের স্বজনদের কাছে ফিরে যাওয়ার জন্য অস্থির হয়ে দৌড়ে বেরিয়ে গেছেন। নির্যাতনের ফলে অনেকের পেটে বাচ্চা এসেছে। তাঁরা তাঁদের সেই অনাগত বাচ্চার ভবিষ্যৎ নিয়েও ছিলেন দুশ্চিন্তাগ্রস্ত। যাঁরা স্বজনদের কাছে ফিরে যাওয়ার জন্য ব্যাকুল চিত্তে ছুটে গেছেন, অনেককেই তাদের স্বামী, মা, বাবা, ভাই গ্রহণ করেনি।
সদ্য স্বাধীন যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে ফিরেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশ পুনর্গঠনের পাশাপাশি এ সমস্ত অসহায় নারীদের মর্যাদা সহকারে পুনর্বাসন ও তাঁদের কল্যাণে নানা ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। এসব নারীদের ‘বীরাঙ্গনা’ অভিধায় ভূষিত করা হয়; অপমান আর নির্যাতনের শিকার হিসেবে নয়, বরং সম্মান ও সাহসের প্রতীক রূপে। এও বিশ্বাস ছিল যে, এ স্বীকৃতির ফলে সমাজ তাঁদের সম্মানের সঙ্গে গ্রহণ করবে।
প্রথমে ১৯৭২ সালের জানুয়ারি মাসে ইস্কাটনের ২০নং একটি বাড়িতে (বর্তমান এনএসআই-এর অফিস) নির্যাতিতা নারীদের জন্য ‘নারী পুনর্বাসন কেন্দ্র’ খোলা হয়। এর সংগঠকদের মধ্যে ছিলেন ড. নীলিমা ইব্রাহিম, সাজ্জাদ চৌধুরী (আওয়ামী লীগ- নেত্রী), মোশফেকা মাহমুদ, বদরুন্নেসা আহমেদ, নূরজাহান মুরশিদ, মালেকা খান, মেহের কবীর, বাসনা হাজারী, ড. হালিমা খাতুন, শিল্পী সুফিয়া শহিদ, বেগম শামসুন্নাহার, ফিরোজা খাতুন প্রমুখ। একই বছর ১৮ই ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু সরকারের উদ্যোগে বিচারপতি কে এম সোবাহানকে চেয়ারম্যান করে ৮ সদস্যবিশিষ্ট ‘বাংলাদেশ নারী পুনর্বাসন বোর্ড’ প্রতিষ্ঠা করা হয়। ধানমন্ডির ৩নং সড়কের একটি বাড়ি এ বোর্ডের কর্ম পরিচালনার জন্য বরাদ্দ করা হয়। এখানে একটি বিশেষায়িত ক্লিনিকও স্থাপন করা হয়। এ বোর্ড প্রতিষ্ঠার প্রধান দুটি লক্ষ্য ছিল-
এক. তিন থেকে চার মাসব্যাপী ধর্ষিতাদের চিকিৎসা প্রদানের জন্য বাংলাদেশের সকল স্থানে প্রয়োজনীয় ক্লিনিক্যাল সেবা নিশ্চিত করা;
দুই. হাজার-হাজার অসহায় নারীকে তাৎক্ষণিকভাবে সাহায্য প্রদান করে পুনর্বাসিত করার জন্য বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বিশেষত ভকেশনাল কেন্দ্রের পরিকল্পনা, গঠন এবং প্রতিষ্ঠা করা।
এখানেই দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে নির্যাতিত নারীদের রাখা হয়েছিল। তাঁদের অনেকে গর্ভবতী ছিলেন। বাংলাদেশ নারী পুনর্বাসন বোর্ড এবং লন্ডনভিত্তিক ইন্টারন্যাশনাল প্ল্যান্ড প্যারেন্টহুড ফেডারেশনের (আইপিপিএফ) যৌথ উদ্যোগে ঢাকায় স্থাপিত ক্লিনিকে বহু নির্যাতিতা নারী তাদের গর্ভপাত ঘটান; অনেকে সন্তান প্রসব করেন। তাঁদের কেউ-কেউ অপ্রকৃতিস্থ হয়ে পড়েন। গর্ভের সন্তানকে নষ্ট করতে কেউ- কেউ উদ্যত হন। আবার কেউ দুস্থ নারী পুনর্বাসন কেন্দ্রে থাকা অবস্থায় আত্মহত্যা করেন।
১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু সরকার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। সকল সরকারি, আধাসরকারি, স্বায়ত্তশাসিত ও আধা-স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের শতকরা ১০টি শূন্যপদ মুক্তিযুদ্ধে নির্যাতিত নারী ও পরিবারের একমাত্র উপার্জক্ষম সদস্য মারা গেছেন সেই পরিবারের নারীদের জন্য বয়স ও শিক্ষাগত যোগ্যতা শিথিল করে সংরক্ষিত রাখার আদেশ দেন। যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত প্রত্যেক নারীর জন্য ২ হাজার টাকার সরকারি অনুদান বরাদ্দ দেয়া হয়। ১৯৭৪ সালে বঙ্গবন্ধু সরকার জাতীয় সংসদে আইন পাশের মাধ্যমে ১৯৭২ সালের ১৮ই ফেব্রুয়ারি প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ নারী পুনর্বাসন বোর্ডকে বাংলাদেশ নারী পুনর্বাসন ও কল্যাণ ফাউন্ডেশনে রূপান্তরিত করে, যা বিভিন্ন ধাপ অতিক্রম করে মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীনে মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরে পরিণত হয়।
১৯৭২ সালে অস্ট্রেলীয় চিকিৎসক ডা. জিওফ্রে ডেভিস সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে আসেন নির্যাতিত নারীদের চিকিৎসা সেবা দানের জন্য। তিনি ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে স্থাপিত ক্লিনিকসমূহে গিয়ে সেবিকাদের সহজ প্রসব ও গর্ভপাতের কৌশল শেখান। তাঁর মতে, পাকহানাদার বাহিনী দ্বারা ধর্ষিতা নারীদের বেশিরভাগই সিফিলিস বা গনোরিয়া কিংবা উভয় রোগের শিকার হয়েছেন। তাঁদের অনেকের ইতোমধ্যে ভ্রণ হত্যাজনিত ঘটনা ঘটেছে। এঁদের হয় বন্ধ্যা বা বাকি জীবন বারবার রোগে ভুগতে হবে। বাংলাদেশে এসব নারীদের জন্য কোনোরূপ সাহায্য এসে পৌঁছাবার আগেই পাকিস্তানি সৈন্যদের ধর্ষণের শিকার প্রায় ২ লাখ অন্তঃসত্ত্বা নারীর সংখ্যাগরিষ্ঠরা স্থানীয় গ্রামীণ অথবা হাতুড়ে ডাক্তারের সাহায্যে গর্ভপাত ঘটিয়েছেন। অন্যদিকে, প্রসব করানোর পর অনেক মা তাঁদের ওপর নির্যাতনের ফসল যুদ্ধশিশু দের নিয়ে বিব্রতকর অবস্থার মধ্যে পড়েন। কম সংখ্যক মা-ই আছেন, যাঁরা এরূপ বাচ্চাদের গ্রহণ করেছেন। যাঁরা গ্রহণ করেছেন, তাঁদের অধিকাংশকেই সমাজের নিষ্ঠুর আচরণ সহ্য করতে হয়েছে। অনেকে বিদেশীদের কাছে সন্তানদের দত্তক দিয়েছেন। উল্লেখ্য, গর্ভপাত ও স্বাভাবিক প্রসব করানো কাজে দেশী- বিদেশী বেশ কয়েকটি এনজিও সহায়তাদানে এগিয়ে আসে। তাদের মধ্যে যুদ্ধশিশুদের প্রতিপালন (গর্ভপাত নয়) ও পরিচর্যার জন্য মাদার তেরেসা ইসলামপুরের আমপট্টিতে ‘বেবি হোম’ নামে একটি কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনা করেন। সুইডেনের ইন্টারন্যাশনাল প্ল্যানড্ প্যারেন্টহুড ঢাকায় একটি গর্ভপাত কেন্দ্র চালু করে। এ কেন্দ্রে জন্ম নেয়া শিশুদের পরিচর্যার জন্য মাদার তেরেসার ‘বেবি হোমে’ তুলে দেয়া হতো। এভাবে জন্ম নেয়া যুদ্ধশিশুর সংখ্যা ছিল কমপক্ষে ৩ হাজার।
ঢাকা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর (তেজগাঁও) চালু হওয়ার পর ১৯শে জুলাই ১৯৭২ কানাডায় নতুন আশ্রয়ের পথে এয়ার ইন্ডিয়ার বিমানে চড়ে বাংলাদেশ ছেড়ে যায় ১৫টি যুদ্ধশিশু। মাদার তেরেসা হোম এবং সহযোগী আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থার উদ্দ্যোগে বিদেশে দত্তক যুদ্ধশিশুদের মধ্যে এরাই প্রথম দল। যুদ্ধশিশুদের প্রথম এ দলটি কানাডীয় মানবহিতৈষী প্রতিষ্ঠান ‘ফ্যামিলিজ ফর চিলড্রেন’-এর সৌজন্যে টরেন্টো ও মন্ট্রিয়ালের উদ্দেশে যাত্রা করে। সেখানে এ প্রতিষ্ঠান কর্তৃক ইতঃপূর্বে নির্বাচিত ১৪টি পরিবারে দত্তক হিসেবে আশ্রয়নের ব্যবস্থা হয় এসব শিশুর।
৭১-এর মুক্তিযুদ্ধকালীন দখলদার পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে নির্যাতিতা নারীর সংখ্যা প্রায় ৫ লক্ষ। তাঁদের মধ্যে ৩ লক্ষাধিক নারী স্পট ধর্ষণ, গণধর্ষণ, পথে-পথে ধর্ষণ (শরণার্থীদের ক্ষেত্রে), বন্দি ও নির্যাতন কেন্দ্রে ধর্ষণ, ক্যাম্প ও বাঙ্কারে যৌনদাসী হিসেবে দিনের পরদিন ধর্ষণের শিকার হন (দেখুন নারী নির্যাতন)। এক্ষেত্রে জয়পুরহাটের মনোয়ারা বেগম মলি, টাঙ্গাইলের বানু বেগম, নাটোরের ছাতনী গ্রামের জোহরা, দিনাজপুরের চিরিরবন্দর থানার আসমা খাতুন ও মরিয়ম বেগম, হবিগঞ্জের লস্করপুর চা বাগানের নারী শ্রমিক সুপ্রিয়া নায়েক ও প্রভারানী মালাকার, সিলেটের শ্রীমঙ্গলের চা বাগানের নারী শ্রমিক সালগী খাড়িয়া, বরিশালের গৌরনদীর বিভা রানী মজুমদার, বরগুনার ৭ম শ্রেণির ছাত্রী মালতী রানী রায়, খাগড়াছড়ির চেন্দাউ মার্মা, খাসিয়া আদিবাসী কাকন বিবি, কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামের আফিয়া খাতুন খঞ্জনী, বানারীপাড়া-স্বরূপকাঠি এলাকার শোভা রানী মণ্ডল, চট্টগ্রামের রমা চৌধুরী, ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণীসহ অনেকের নাম উল্লেখ করা যায়। এঁদের কয়েকজনের নির্মম নির্যাতনের শিকার হওয়ার ঘটনা এবং স্বাধীনতোত্তর কারো কারো করুণ জীবন-কাহিনি সম্বন্ধে এখন জানা যায়।
রমা চৌধুরী (১৯৪১-২০১৮) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকোত্তর, ৭১-এর বীরাঙ্গনা ও একাধিক গ্রন্থের লেখক। ১৯৪১ সালের ১৪ই অক্টোবর চট্টগ্রামের বোয়ালখালীর পোপাদিয়ায় জন্ম। ঢাকা
বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি বাংলা সাহিত্যে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন শিক্ষকতাকে। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তিনি ৩ সন্তান নিয়ে মায়ের সঙ্গে গ্রামের বাড়িতে ছিলেন। স্বামী প্রথম স্ত্রীকে নিয়ে চলে গিয়েছিল ভারতে। ৭১-এর ১৩ই মে স্থানীয় রাজাকারদের সহযোগিতায় পাকিস্তানি হানাদাররা তাঁর বাড়িতে হানা দেয়। রমাকে সকলের সামনেই পাকিস্তানি হানাদাররা ধর্ষণ করে। এরপর লুটপাট শেষে গানপাউডার দিয়ে বাড়িঘর পুড়িয়ে দেয়। শিশুসন্তান ও বৃদ্ধা মাকে নিয়ে জঙ্গলে লুকিয়ে কিছুদিন থাকার পর পোড়া ভিটায় এসে কোনোমতে খড়কুটো দিয়ে মাথা গোজার ঠাঁই করেন। এলাকাবাসীরা এগিয়ে এলেও আপনজনদের তদ্রূপ সহযোগিতা তাঁরা পাননি। রমা চৌধুরী তাঁর একাত্তরের জননী গ্রন্থে লিখেছেন, ‘আমার আপন মেজো কাকা সেদিন এমন সব বিশ্রী কথা বলেছিলেন, লজ্জায় কানে আঙুল দিতে বাধ্য হই। আমি লজ্জায় মুখ দেখাতে পারছি না, দোকানে গিয়ে খাবারও সংগ্রহ করতে পারলাম না মা ও ছেলেদের মুখে দেবার জন্য।’ সন্তানদের নিয়ে অনাহারে- অর্ধাহারে দিন কাটে। শীতে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে ২০শে ডিসেম্বর মারা যায় প্রথম পুত্র সন্তান। একইভাবে ১৯৭২ সালের ১৫ই ফেব্রুয়ারি মারা যায় দ্বিতীয় পুত্র। তাঁর সব স্বপ্ন-সম্ভাবনা দুমড়ে-মুচড়ে যায় একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে। স্বাধীনতার পর রমা চৌধুরী দ্বিতীয় বিয়ে করে প্রতারণার শিকার হন এবং সংসার ভেঙ্গে যায়। ১৯৯৮ সালে ৩য় ও সর্বশেষ সন্তানকে হারান। সব হারিয়েও তিনি জীবনযুদ্ধে পরাজয় মেনে নিতে পারছিলেন না। বাংলা সাহিত্যে পড়াশুনা থাকায় নিজের সৃষ্টিশীলতাকে অবলম্বন করে বেঁচে থাকার নতুন লড়াইয়ে নিজেকে নিয়োজিত করেন। তখন তাঁকে সাহায্য করতে অনেকেই চেয়েছিলেন, কিন্তু কারো দয়া- দাক্ষিণ্যে তিনি বাঁচতে চাননি। তিনি লেখালেখিতে মনোনিবেশ করেন। গল্প-উপন্যাস, কবিতা-প্রবন্ধ নিয়ে ১৮টি গ্রন্থ তিনি রচনা করেন। এসব দ্বারে- দ্বারে বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। প্রায় বছরখানেক অসুস্থ অবস্থায় শয্যাশায়ী থেকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ২০১৮ সালের ৩রা সেপ্টেম্বর রমা চৌধুরী মৃত্যুবরণ করেন। কাকন বিবি (মৃত্যু ২০১৮) খাসিয়া আদিবাসী সন্তান, পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী কর্তৃক পাশবিক নির্যাতনের স্বীকার, ‘বীর প্রতীক’ খেতাবপ্রাপ্ত ও একাধিক রণাঙ্গনে সক্রিয় অংশগ্রহণকারী যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা।
কাকন বিবি ভারতের মেঘালয় রাজ্যের নত্রাই খাসিয়া পল্লিতে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা-মাতার ৫ সন্তানের মধ্যে তিনি ছিলেন সবার ছোট। তাঁর মূল নাম কাঁতেক নিয়তা। ডাক নাম কাকন। তবে তিনি কাকন বিবি নামেই পরিচিত ছিলেন। তাঁদের পরিবার ছিল খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী।
শিশু বয়সে তিনি পিতৃ-মাতৃহারা হন। ১৫ বছর বয়সে আব্দুল মজিদ খান নামে এক পাঞ্জাবি ইপিআর সৈনিকের সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়। এক পর্যায়ে মজিদ খান কাকন বিবিকে ফেলে রেখে ইপিআর-এর অন্য ক্যাম্পে বদলি হয়ে পরে নিরুদ্দেশ হন। এরূপ অবস্থায় সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলার শহীদ আলী নামে এক কৃষকের সঙ্গে তাঁর দ্বিতীয় বিয়ে হয়। তখন থেকে তাঁর নাম রাখা হয় নূরজাহান বেগম। কিন্তু তাঁর ঐ বিয়েও বেশিদিন টেকেনি। এরপর কাকন পূর্বের স্বামীর খোঁজে পাকিস্তানি এক ক্যাম্প থেকে অন্য ক্যাম্পে ছুটে যান। জুন মাসে স্বামীর খোঁজে সিলেটের দোয়ারাবাজার সীমান্ত এলাকায় এলে তিনি পাকহানাদার বাহিনীর নজরে পড়েন। নরপিশাচরা তাঁকে আটক করে বাঙ্কারে রেখে তাঁর ওপর পাশবিক নির্যাতন চালায়। কয়েকদিন পর তাঁকে ছেড়ে দেয়। এ ঘটনায় বদলে যায় কাকন বিবির জীবন। প্রতিশোধের আগুন তাঁর অন্তরে দাউ-দাউ করে জ্বলতে থাকে। স্থানীয় এক মুক্তিযোদ্ধার সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ হয়। এরপর ৫নং সেক্টরের কমান্ডার মেজর মীর শওকত আলী তাঁকে মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষে শত্রুশিবিরের খবরাখবর সংগ্রহে গুপ্তচরবৃত্তির দায়িত্ব দেন। কাকন বিবি অত্যন্ত সাহসিকতা ও বিশ্বস্ততার সঙ্গে তাঁর সে দায়িত্ব পালন করতে থাকেন। সেক্ষেত্রে কখনো তিনি ভিক্ষুকের বেশ ধারণ করে পাকিস্তানি ক্যাম্পে গিয়ে খবর নিয়ে এসে মুক্তিযোদ্ধাদের দিতেন। মুক্তিযোদ্ধারা তাঁর তথ্যমতো বিভিন্ন অপারেশন পরিচালনা করেন এবং বহুক্ষেত্রে সফল হন। এরূপ দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে তিনি দোয়ারাবাজার উপজেলার বাংলাবাজারে পাকবাহিনীর হাতে পুনরায় ধরা পড়েন। এবার তাঁর ওপর চালানো হয় এক নাগাড়ে ৭ দিন চরম শারীরিক ও পাশবিক নির্যাতন। তাঁর শরীরের বিভিন্ন অঙ্গে গরম ছ্যাঁকা দেয়া হয়। এক পর্যায়ে অজ্ঞান হয়ে পড়লে মৃত ভেবে হানাদাররা তাদের ক্যাম্প থেকে কিছু দূরে তাঁকে ফেলে রেখে আসে। মুমূর্ষু অবস্থায় গ্রামের কিছু লোক তাঁকে উদ্ধার করে সীমান্তবর্তী মুক্তিযোদ্ধাদের বালাট ক্যাম্পে পৌঁছে দেন। সেখানে তাঁর চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়। কিছুদিন পর তিনি সুস্থ হয়ে ওঠেন। এবার তিনি শত্রুর বিরুদ্ধে সরাসরি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। এর পূর্বে তিনি অস্ত্র পরিচালনার প্রশিক্ষণ নেন। ৫নং সেক্টরের বিভিন্ন রণাঙ্গনে একাধিক সম্মুখ যুদ্ধে তিনি অংশগ্রহণ করেন। অক্টোবর মাসে আমবাড়ি যুদ্ধে শত্রুর ছোড়া গুলি তাঁর পায়ে বিদ্ধ হলে তিনি আহত হন।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর কাকন বিবি সুনামগঞ্জের দোয়ারাবাজার উপজেলার লক্ষ্মীপুর ইউনিয়নের ঝিরাগাঁও গ্রামে শহীদ আলীর বাড়িতে এক কুঁড়ে ঘরে মেয়ে সখিনাসহ আশ্রয় নেন। এ বীর নারী মুক্তিযোদ্ধা দীর্ঘদিন লোকচক্ষুর অন্তরালে ছিলেন। ১৯৯৬ সালে এক সাংবাদিকের মাধ্যমে তাঁর সন্ধান মেলে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রদত্ত জমির ওপর নির্মিত একটি কুঁড়ে ঘরে তিনি বসবাস করে আসছিলেন।
তিনি দীর্ঘদিন শ্বাসকষ্ট ও নিউমোনিয়ায় ভুগছিলেন। অবশেষে ২০১৮ সালের ২১শে মার্চ তিনি সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে শেষ নিঃশাস ত্যাগ করেন (দেখুন কাকন বিবি, বীর প্রতীক)।
ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী (১৯৪৭- ২০১৮) ৭১-এ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের সহযোগীদের দ্বারা উপর্যুপরি পাশবিক নির্যাতনের শিকার ও স্বাধীনতা সম্মাননা প্রাপ্ত প্রখ্যাত ভাস্কর। তিনি ছিলেন খুলনার মেয়ে। তাঁর জন্ম ১৯শে ফেব্রুয়ারি ১৯৪৭। পিতার নাম সৈয়দ মাহবুবুল হক এবং মাতার নাম রওশন হাসিনা। মুক্তিযুদ্ধের সময় তাঁর বয়স ছিল ২৪। খুলনায়ই তাঁর পড়াশুনা ও বিয়ে। ৩ সন্তান জন্মের পর স্বামীর সঙ্গে তাঁর বিবাহ বিচ্ছেদ হয়। মা-ভাইবোন এবং নিজের সন্তানসহ পরিবারের ১২ জন মানুষের ভরণপোষণের দায়িত্ব ছিল তাঁর ওপর। সে-সময় তিনি খুলনার শিল্প শহর খালিশপুরের আগাখান গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের মালিকানাধীন ক্রিসেন্ট জুট মিলে চাকরি করতেন। তিনি টেলিফোন অপারেটর ও রিসিপশনিস্ট ছিলেন। খালিশপুর এলাকার কলকারখানার মালিকানা ছিল আগাখানি, ইস্পাহানি, আদমজী, যোহরা, দিল্লিওয়ালা ইত্যাদি অবাঙালি গোষ্ঠীর হাতে। ৭১-এর ২৯শে মার্চ খালিশপুরে গণহত্যা শুরু হলে প্রিয়ভাষিণীর পরিবার অনেকের মতো সর্বস্ব হারিয়ে শহর ছাড়ে। চারদিকে লাশের স্তূপ। এ অবস্থায় পরিবারের সদস্যদের নিয়ে খুলনায় নানা এডভোকেট আবদুল হাকিমের বাড়িতে আশ্রয় নেন। আর্থিক অনটনের কারণে সেখান থেকে বাধ্য হয়ে তাঁকে খালিশপুরে ফিরে আসতে হয়। পরিবারের এতগুলো সদস্যদের নিয়ে অভাব-অনটনের মধ্যে কোনোরকমে দিন অতিবাহিত করছিলেন। এলাকার বিহারি মস্তান মোহাম্মদ আলি আহসানউল্লাহ আহমেদ (প্রিয়ভাষিণীর সহকর্মী, পরবর্তীতে স্বামী)-কে খুঁজছিল। তাঁর অপরাধ ছিল পাকিস্তানি হানাদারদের বিরুদ্ধে স্বাধীনতাকামী জনগণের প্রতিরোধে সহযোগিতা করা। এ অবস্থায় মাসহ তাঁর পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের যশোর পাঠিয়ে দেন। আহসানউল্লাহ এবং প্রিয়ভাষিণী অন্যান্য শরণার্থী পরিবারের সঙ্গে একটি পোড়া বাড়িতে আশ্রয় নেন। ডিভোর্সি ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী পরপুরুষের সঙ্গে থাকার অপবাদে (তখনো আহসানউল্লাহর সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়নি) ঐ বাড়ি থেকে অন্যান্য শরণার্থী পরিবারের সদস্যরা তাঁকে বের করে দেয়। এমতাবস্থায় ক্রিসেন্ট জুট মিলের অবাঙালি সহকারী পারচেজ অফিসার সহকর্মী জাহাঙ্গীর কেরেলার সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ হয়। সে তাঁকে অফিসে জয়ন করিয়ে দেয়ার আশ্বাস দেয়। পরে নির্জন একটি পরিত্যক্ত বাড়িতে নিয়ে তাঁর ওপর পাশবিক নির্যাতন করে। সেখান থেকে পালিয়ে ক্রিসেন্ট জুট মিলে আসেন প্রিয়ভাষিণী। সেখানে আগাখানি জেনারেল ম্যানেজার ফিদাই তাঁর অসহায় অবস্থা দেখে তাঁকে ৩০০ টাকা দিয়ে পরের দিন থেকে অফিসে যোগদান করতে বলে। পরের দিন অফিসে আসার পর জেনারেল ম্যানেজার ফিদাই তাঁকে রুমে ডেকে মিলের কোয়ার্টার্সে থাকার নিদের্শ দেয় এবং প্রিয়ভাষিণীকে সেখানে নির্যাতন করতে থাকে। এরপর সুলতান পিয়ার আলি নামে অপর এক অবাঙালি কর্মকর্তার দ্বারা তিনি নির্যাতিত হন। অফিসে প্রতিদিন নানা ধরনের অত্যাচারের মধ্যে তাঁর দিন কাটে। শান্তি কমিটির এক সদস্য হত্যার শিকার হলে ঐ ঘটনার দায় প্রিয়ভাষিণীর ওপর চাপানো হয়। এরপর নারীলিপ্সু নেভাল কমান্ডার গুলজারিনের হাতে তাঁকে তুলে দেয়া হয়। গুলজারিন প্রিয়ভাষিণীকে নেভী হেডকোয়ার্টার্সে নিয়ে তাঁকে ধর্ষণ করে। মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ আছে এ সন্দেহে তাঁকে ক্যান্টমেন্টে নিয়ে অত্যাচার চালানো হয় এবং ধর্ষণ করা হয়। যুদ্ধের নয় মাস সকল ধরনের নির্যাতনের মুখোমুখি হন প্রিয়ভাষিণী। এসব থেকে বোঝা যায় যে, ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের সহযোগীদের হাতে কার্যত বন্দি ছিলেন এবং একের পর এক ধর্ষণের শিকার হন। তিনিই প্রথম জনসম্মুখে জানিয়েছেন, তিনি হচ্ছেন ৭১-এর ধর্ষিতা নারীদের একজন। ২০১০ সালে বাংলাদেশ সরকার পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নির্মম পাশবিক নির্যাতনের শিকার বীরাঙ্গনা ভাস্কর ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণীকে ‘স্বাধীনতা সম্মাননা পদক’ প্রদান করে। তিনি ৬ই মার্চ ২০১৮ ঢাকার একটি হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন। সুপ্রিয়া নায়েক হবিগঞ্জের লস্করপুর চা বাগানের এক নির্যাতিতা কিশোরী নারী শ্রমিক। মে মাসে তাঁকে পাকিস্তানি সৈন্যরা ধরে নিয়ে যায়। তখন তাঁর বয়স ১৬ পেরোয়নি। প্রথম দিন চা বাগানের এক ক্যাম্পে নিয়ে কয়েকজন পাকিস্তানি আর্মি তাঁর ওপর বীভৎস যৌন নির্যাতন চালায়। সেই শুরু। তারপর পাকিস্তানি সৈন্যরা তাঁকে নিয়ে যায় এক ক্যাম্প থেকে অন্য ক্যাম্পে, এক বাগান থেকে অন্য বাগানে। দিনের পর দিন ঐসব ক্যাম্পের সেনা অফিসাররা তাঁর ওপর নির্দয় নির্যাতন চালিয়েছে। বন্দি হওয়ার পর থেকে দীর্ঘ সাড়ে ৭ মাসের প্রতি রাতে ৪-৫ জন করে হানাদার সেনা তাঁকে ধর্ষণ করেছে। একটি রাতের জন্যও নিষ্কৃতি দেয়নি তাঁকে। এর মধ্যে একবার ক্যাম্প থেকে পালিয়ে এলেও পাকহানাদাররা আবার তাঁকে ধরে নিয়ে যায়।
চেন্দাউ মার্মা এক নির্যাতিতা আদিবাসী নারী। বাড়ি খাগড়াছড়ি জেলায়। যুদ্ধের প্রথম দিকেই তিনি ধরা পড়েন পাকিস্তানি সৈন্যদের হাতে। তাঁকে প্রথমে একটি নির্জন স্থানে রাখা হয়। সেখানে তিনি বহুদিন গণধর্ষণের শিকার হন। অনেক দিন তিনি অজ্ঞান অবস্থায়ও ছিলেন। এরপর তিনি এক আর্মি মেজরের নজরে পড়েন। ঐ মেজর তাঁকে তার কাছে নিয়ে যায়। এভাবেই আটক থাকেন পুরো যুদ্ধকালীন সময়। দেশ স্বাধীন হলে তিনি ছাড়া পান। ছাড়া পাওয়ার পর তাঁর পিতার বাড়ি বা স্বামীর বাড়ি কোথায়ও আশ্রয় মেলেনি। তখন তিনি চলে যান নির্জন এক পাহাড়ে। সেখানে লতাপাতা দিয়ে তৈরি ডেরার মধ্যে মানবেতর জীবন যাপন করতে থাকেন। শুধু বাবা বা স্বামীর বাড়িতেই আশ্রয় মিলেনি তা নয়, এলাকার পরিচিতজনদের মাঝেও তাঁর ঠাঁই হয়নি। ক্ষোভ-দুঃখ-অভিমানে তিনি আশ্রয় নেন পাহাড়ে। বয়সকালে বিভিন্ন কাজকর্ম করে দিন কাটাতেন। এখন আর কাজকর্ম করতে না পারায় বলা যায় না খেয়েই তাঁকে বেশিরভাগ সময় থাকতে হয়। এমন নির্জন এক জায়গায় তিনি থাকেন, যা কোনো মানুষের পক্ষে ভাবাও দুষ্কর।
সালগী খাড়িয়া শ্রীমঙ্গলের (মৌলভীবাজার) সিন্দুরখান চা বাগানের এক নির্যাতিতা নারী শ্রমিক ও মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তাদানকারী। পিতা খাড়িয়ার বিধবা মেয়ে সালগী খাড়িয়া। একাত্তরে তাঁর ওপর নজর পড়ে শ্রীমঙ্গল-কমলগঞ্জ অঞ্চলের কুখ্যাত পাকিস্তানি সেনা কর্মকর্তা শের খানের। সে সালগী খাড়িয়াকে তুলে নিয়ে যায় তার আস্তানায় এবং দিনের পর দিন সেখানে রেখে ধর্ষণ করে। এক পর্যায়ে জোর করে বিয়ে করে। কিন্তু এ বৈবাহিক সম্পর্কও পাকিস্তানি হায়েনাদের হত্যা-নিপীড়নের প্রতি সালগীর ঘৃণাকে একটুও কমাতে পারেনি। তিনি বরং খুব কৌশলে যোগাযোগ রাখতেন মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে। ‘স্বামী’ শের খানের অবস্থান ও গতিবিধি তিনি নিয়মিতভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের জানাতেন। চা বাগান এলাকার মুক্তিযোদ্ধা উদয় ভূঁইয়া ছদ্মবেশে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ রেখে এসব তথ্য সংগ্রহ করে নিতেন সালগী খাড়িয়া খুব কৌশলে রাজঘাট চা বাগানের উত্তম কুমার তাঁতীর জীবন বাঁচিয়েছিলেন। পাকসেনাদের হাতে কেউ ধরা পড়লে শের খান সালগীর কাছে জানতে চাইতেন তিনি চেনেন কি-না। সালগী বহু অপরিচিত লোককে ‘চেনেন’.এবং ‘আত্মীয়’ বলে বাঁচিয়ে দিয়েছেন। সালগীর দেয়া তথ্যানুযায়ীই মুক্তিযোদ্ধারা শের খানের ওপর ‘একশন’ চালায়। ধলাই চা বাগানের একটি বটগাছের ওপর তৈরি মাচায় বসে শের খান মাঝে-মধ্যে সীমান্ত অঞ্চল পর্যবেক্ষণ করত। মুক্তিযোদ্ধারা সেখানে অভিযান চালিয়ে তাকে হত্যা করেন। অবমুক্ত সালগী এরপর নিজ পরিবারে ফিরে যান।
মালতি রাণী রায় একাত্তরে বরগুনা জেলার জেলখানায় হানাদার বাহিনীর নির্যাতনে পিষ্ট সপ্তম শ্রেণির ছাত্রী মালতি রাণী রায়। বর্বর পাকবাহিনী কারাগারের অভ্যন্তরে আটক সকল মহিলাকে পালাক্রমে বীভৎসভাবে ধর্ষণ করে। প্রতিরাতে আটক মহিলাদের মধ্য থেকে বেছে-বেছে কয়েকজনকে বের করে তাদের প্রমোদ কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত পার্শ্ববর্তী ডাকবাংলোতে নিয়ে যেত। সারারাত ধর্ষণ- নির্যাতন শেষে পরদিন সকালে তাদের জেলখানায় ফিরিয়ে আনা হতো। মালতি রাণী যেদিন পাকিস্তানি সেনাদের হাতে ধরা পড়েন, ঐদিনই মধ্যরাতে তারা তাকেসহ ৪ জন মহিলাকে পার্শ্ববর্তী ডাকবাংলোতে নিয়ে যায়। সেখানে ৪ জন পাকিস্তানি সৈন্য তাদের ৪ জনের ওপর রাতভর পাশবিক নির্যাতন চালায়। এই ৪ জনের ১ জন ছিলেন অন্তঃসত্ত্বা। নির্যাতনের ৩-৪ দিন পরে তাঁর গর্ভপাত হয়।
প্রভারাণী মালাকার মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ উপজেলার মির্জাপুর গ্রাম (মুন্সীবাজার ইউনিয়ন)-এর এক বীরাঙ্গনা নারী। ৭১-এ তাঁর বয়স ছিল ১৪ বছর। মুক্তিযুদ্ধের চার মাস পূর্বে তাঁর বিয়ে হয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধকালে তাঁর স্বামী কামিনী রাম মালাকার চলে যান ভারতে। প্রভারাণী পার্শ্ববর্তী গ্রাম বিক্রমকলসে বাবার বাড়ি চলে যান। একদিন বিক্রমকলস গ্রামের দুজন রাজাকার সন্ধ্যার সময় প্রভারাণীকে জোরপূর্বক তুলে নিয়ে যায় পার্শ্ববর্তী শান্তি কমিটির বাদল মাস্টারের বাড়ি। সে-রাতে বাদল মাস্টারের বাড়িতে অবস্থান নেয়া পাকিস্তানি সেনা সদস্যদের কর্তৃক গণধর্ষণের শিকার হন প্রভারাণী। পরদিন সকালে তাঁকে ছেড়ে দিলে তিনি পালিয়ে বোনের বাড়িতে আশ্রয় নেন। রাজাকাররা খোঁজ পেয়ে ঐ ঘটনার ২০-২৫ দিন পর তাঁর বোনের বাড়িতে হানা দেয়। নিজেকে রক্ষার জন্য ধানের জমির আইলের নিচে তিনি আশ্রয় নেন, কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। সেখান থেকে রাজাকাররা আবার তাঁকে ধরে নিয়ে যায় এবং তাঁর ওপর নির্যাতন করে। এরপর প্রভারাণীকে নিয়ে আসে শমশেরনগর ডাকবাংলোয়, যেটি ছিল পাকিস্তানি আর্মির ক্যাম্প। সারারাত পাকিস্তানি আর্মিরা তাঁকে পালাক্রমে ধর্ষণ করে। এক সময় তিনি জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। এরপর এক সুযোগে তিনি পালিয়ে পুনরায় বোনের বাড়ি চলে যান। দেশ স্বাধীনের পর এলাকার অনেকে তাঁকে উপহাস করে ডাকত ‘পাঞ্জাবির বউ’ বলে। তাঁর ছেলের জন্ম পরিচয় নিয়ে সবসময় খোঁচা দেয় এলাকাবাসী। যারা যুদ্ধের সময় তাঁর ওপর নির্যাতন করেছিল, সেই রাজাকারের দল পরবর্তীতে জেল খাটে। জেল থেকে বের হয়ে তারা প্রভারাণীর স্বামীর ওপর হয়রানি ও মিথ্যা মামলা দেয়, যে-কারণে প্রভারাণীর স্বামীকে জেল খাটতে হয়। কয়েক বছর পর প্রভারাণীর স্বামী মারা যান। প্রভারাণী বর্তমানে ৬০ বছর বয়সে গ্রামে-গ্রামে ফেরি করে পরিবার চালাচ্ছেন। একমাত্র ছেলে কাজলকে এলাকার মানুষ অপমান করে পিতৃপরিচয় নিয়ে। তাকে ডাকে পাঞ্জাবির সন্তান বলে। সে রিকশা চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করছে। ২০১৫ সালে বিধবা ভাতার জন্য নাম অন্তর্ভুক্ত হয় প্রভারাণীর। কিন্তু তিনি বীরাঙ্গনার স্বীকৃতি এখনো পাননি। বর্তমানে ছেলের বউ সন্তানসহ ৯ সদস্যবিশিষ্ট পরিবার নিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন বীরাঙ্গনা প্রভারাণী মালাকার (দেখুন প্রভারাণী মালাকার-)।
আফিয়া খাতুন খঞ্জনী কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম উপজেলার সোনাপুর গ্রামের মেয়ে। ৭১ সালের জুন মাসে এলাকার রাজাকারদের সহায়তায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী জোরপূর্বক দুই সন্তানের মা আফিয়া খাতুন খঞ্জনীকে ধরে নিয়ে যায় জগন্নাথদীঘি ক্যাম্পে। হানাদার ক্যাম্পে বন্দি থেকেও বহু পরিবারকে গোপনে খবর পাঠাতেন খঞ্জনী। তাঁর কারণেই রক্ষা পায় এলাকার অনেক নারী। জানা যায়, খঞ্জনীকে এক পাকিস্তানি হাবিলদার জোর করে বিয়ে করেছিল। জুলাই মাসে চিওড়া রাস্তার মাথায় মুক্তিযোদ্ধাদের একটি এম্বুশে পড়ে খঞ্জনীর সেই কথিত স্বামী নিহত হয়। তারপরেও খঞ্জনী ঐ ক্যাম্পে দেশ স্বাধীন হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত বন্দি অবস্থায় ছিলেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর খঞ্জনী বাড়িতে ফিরে আসেন। খঞ্জনীর শাশুড়ি সন্তানদের নিজের কাছে রেখে তাঁকে তাড়িয়ে দেয়। খঞ্জনীর একমাত্র পুত্র সন্তান ১৯৭২ সালে অর্ধাহার-অনাহারে মারা যায়। হানাদারদের ক্যাম্পে থেকেও তিনি যাদের রক্ষা করেছেন, সেসব মানুষের তাড়া খেয়ে খঞ্জনী নিরুদ্দেশ হয়ে যান। ভিক্ষা আর মানুষের বাসায় কাজ করে ফুটপাত ও বিভিন্ন রেলওয়ে স্টেশনে ২৭ বছর কাটিয়ে পরবর্তীতে আশ্রয় পান ভাই আবুদর রহমান চৌধুরীর বাড়িতে। খঞ্জনী তাঁর ভাইয়ের বাড়িতেও সকলের ঘৃণার পাত্র হয়েই জীবন কাটাচ্ছিলেন সাংবাদিকরা তাঁর খোঁজ পাওয়ার পর বিভিন্ন দৈনিকে তাঁর সম্বন্ধে সংবাদ প্রকাশিত হয়। ফলে খঞ্জনী সরকারের দৃষ্টিতে আসেন এবং মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি পান।
বিভা রাণী এক বীরাঙ্গনা কিশোরী। বরিশাল জেলাধীন গৌরনদী উপজেলার টকিরচর গ্রামের উমেশ মণ্ডল ও কালী তারার মেয়ে বিভা রাণী। মুক্তিযুদ্ধের সময় বিভা রাণীর বয়স ছিল ১৪ বছর। পড়াশুনা করেছেন পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত বাবা ছিলেন একজন সচ্ছল কৃষক। ২৫শে এপ্রিল বরিশাল শহরে হানাদার বাহিনী অনুপ্রবেশ করে। এর পর গ্রামের পর গ্রাম জ্বালাতে থাকে। যাকে সামনে পায় তাকেই গুলি করে হত্যা করে। বাড়িতে ঢুকে গ্রামের মেয়েদের ধর্ষণ করে। এমতাবস্থায় পরিবারসহ বিভার বাবা গ্রামের আরো ভেতরে গিয়ে পালানোর চেষ্টা করেন। এরই মধ্যে জুন মাসের এক বিকেলে তাঁদের বাড়িতে ৪ জন রাজাকার ও হানাদার বাহিনীর ৭-১০ জন, বিভার ভাষায়, কুত্তা ঢুকে পড়ে। ঢুকেই লুটপাট শুরু করে। তারপর আগুন দেয়। কিছু না বুঝেই বিভা দৌড় দেয়। ঐ অবস্থায় তাঁকে ধরে ফেলে তাদের মধ্যে একজন তাঁকে ধর্ষণ করে। সন্ধ্যায় অন্ধকার হয়ে আসায় রাজাকার ও হানাদাররা দ্রুত স্থান ত্যাগ করে চলে যায়। তাদের চলে যাওয়ার পর বিভাকে তাঁর নানার বাড়িতে রেখে আসা হয়। আগস্ট মাসের দিকে বিভার বাবা তাঁকে নানার বাড়ি থেকে নিজ বাড়িতে নিয়ে আসেন। সে-সময় এলাকায় ওঁৎ পেতে থাকা রাজাকাররা পুনরায় তাঁকে ধর্ষণ করে। বিভা এ ঘটনার পর আর বাড়িতে থাকতে না চেয়ে এলাকার মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে বিষয়টি জানান। এরপর থেকে তিনি মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করেন। দেশ স্বাধীনের পর তিনি বীরাঙ্গনার স্বীকৃতি পেয়েছেন বটে, তবে ভাতা পাননি।
শোভা রাণী মণ্ডল (১৯৫৩-২০০৯) বানারীপাড়া-স্বরূপকাঠি এলাকার ৯ম শ্রেণির ছাত্রী, এক বীরাঙ্গনা ও সাহসী নারী মুক্তিযোদ্ধা। তিনি ১৯৫৩ সালে পিরোজপুর জেলার স্বরূপকাঠি উপজেলার জলাবাড়ি
ইউনিয়নের গণপতিকাঠি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা সুরেশ চন্দ্ৰ মণ্ডল, মাতা মধুমালা। শোভা রাণী মণ্ডলের ৫ ভাই ১ বোন। ছোটবেলায় পিতার মৃত্যুর পর মা মধুমালা সংসারের হাল ধরেন। কিশোরী শোভা পড়াশোনার ফাঁকে বাড়ির আঙিনা ও পরিত্যক্ত জমিতে সবজি চাষ করে সংসারের ব্যয় নির্বাহ করতেন। ১৯৭০ সালের শেষের দিকে তাঁর সঙ্গে বিয়ে হয় নরেরকাঠি গ্রামের রাজেন্দ্র নাথ বিশ্বাসের।
এপ্রিলের শেষের দিকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বরিশাল শহর দখলে নিয়ে বানারীপাড়া-স্বরূপকাঠির প্রত্যন্ত গ্রাম গাভা, নরেরকাঠি, কাচাবালিয়া, বেরমহল, আটঘর, কুড়িয়ানা ইত্যাদি হিন্দু অধ্যুষিত এলাকায় চরম নির্যাতন ও হত্যাকাণ্ড চালায়। ৪ঠা মে শর্ষিণা পীরের সহযোগিতায় রাজাকার ও পাকিস্তানি বাহিনী ঐসব গ্রামে আক্রমণ চালিয়ে শোভা রাণীর স্বামী রাজেন্দ্র নাথসহ ২৭ জনকে ধরে নিয়ে যায়। পরে তাদের নরেরকাঠি সাঁকোর নিচে কুপিয়ে ও নির্যাতন করে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। মাত্র পাঁচ মাসের ব্যবধানে শোভা রাণী মণ্ডলের দাম্পত্য জীবনের অবসান ঘটে। এক পর্যায়ে স্বরূপকাঠির পেয়ারা বাগানে অবস্থান নেয়া পূর্ব বাংলা সর্বহারা পার্টির নেতা সিরাজ সিকদারের সঙ্গে শোভা রাণীর সাক্ষাৎ হয়। তাঁর উৎসাহে ও স্বামী হত্যার প্রতিশোধস্পৃহায় শোভা রাণী মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের কাছ থেকে অস্ত্র চালনা ও যুদ্ধের প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। একই সঙ্গে তিনি দুহাতে অস্ত্র চালাতে পারতেন। তিনি একাধিক সম্মুখ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। শত্রুঘাঁটিতে আক্রমণের উদ্দেশ্যে তিনি বিভিন্ন সময় ছদ্মবেশ ধারণ করতেন।
শোভা রাণীর সাহসিকতার কথা জানতে পেরে ৯ম সেক্টরের সাব-সেক্টর কমান্ডার ক্যাপ্টেন শাহজাহান ওমর তাঁকে তাঁর দলে অন্তর্ভুক্ত করেন। কিন্তু রাজাকার বাহিনী একদিন শোভাকে পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে ধরিয়ে দেয়। নির্যাতন শেষে তাঁকে বরিশাল কারাগারে পাঠিয়ে দেয়া হয়। ১৭ দিন বন্দি অবস্থায় নির্যাতনের পর তিনি মুক্তি পান। মুক্তি পেয়ে তিনি পুনরায় শাহজাহান ওমরের সঙ্গে যোগ দিয়ে বিভিন্ন অপারেশনে প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ করেন। পরবর্তীতে সুইসাইডাল স্কোয়াড গঠিত হলে শোভা রাণী মণ্ডল এতে অন্তর্ভুক্ত হন। শর্ষিণা পীরের বাড়ি যুদ্ধে শোভা রাণী সাহসিকতাপূর্ণ ভমিকা রাখেন।
স্বাধীনতা যুদ্ধের পর শোভা রাণীকে আত্মীয়-স্বজনরা আশ্রয় দেয়নি। কেউ-কেউ তাঁকে শুধু বীরাঙ্গনা বলে জানত। পরে তাঁর আশ্রয় হয় ঝালকাঠি নারী পুনর্বাসন কেন্দ্রে। এক সময় তিনি ভারত চলে যান। সেখানেও আশ্রয় না পেয়ে দুবছর পর আবার বাংলাদেশে চলে আসেন। ১৯৮২ সালে তিনি মন্ত্ৰী সুনীল গুপ্তের সহযোগিতায় বানারীপাড়া থানা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে মাস্টার রোলে ৪৫০ টাকা বেতনে স্লিপ দেয়ার চাকরি পান। একই বছর বানারীপাড়ার দলিল লেখক কুন্দিহার গ্রামের শাহজাহান মিয়ার সঙ্গে ধর্মান্তরিত হয়ে তিনি বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। তাঁর নতুন নাম হয় শাহানারা পারভীন শোভা। ২০০৯ সালের ১৪ই জানুয়ারি মুক্তিযোদ্ধা ও বীরাঙ্গনা শোভা রাণী মণ্ডল ওরফে শাহানারা পারভীন শোভা মৃত্যুবরণ করেন (দেখুন শোভা রাণী মণ্ডল)।
নির্যাতিত বীরাঙ্গনাদের সঙ্গে কথা বললে মনে হয়, চোখের সামনেই বুঝি এসব ঘটনা ঘটেছে। তাঁরা তাঁদের ঘটনার কথা বলতে গিয়ে আটচল্লিশ বছরের ফেলে আসা পূর্বের দিনগুলোতে চলে যান। তাঁরা বিন্দুমাত্রও ভুলতে পারেননি তাঁদের সেসব দুর্বিষহ দিনের কথা। কেউ-কেউ এখনো ভয়ে কেঁপে ওঠেন। কারো-কারো চোখে-মুখে প্রতিশোধের আগুন জ্বলছে। আবার কেউ-কেউ নীরবে চোখের জল ফেলছে।
স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে দেশের সার্বিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে বঙ্গবন্ধু সরকার মুক্তিযুদ্ধে নির্যাতিতা নারীদের চিকিৎসাসেবা ও পুনর্বাসনের জন্য যেসব পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন, ১৯৭৫-এ তাঁর নির্মম হত্যার পর ক্ষমতাসীন সামরিক শাসকদের দ্বারা ঐসব কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। অনেক সময় অতিবাহিত হবার পর শেখ হাসিনার নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সরকার গঠিত হলে পুনরায় তাঁদের ব্যাপারে নতুন করে চিন্তাভাবনা শুরু হয়। তারই ধারাবাহিকতায় ২৯শে জানুয়ারি ২০১৫ জাতীয় সংসদে তালিকা প্রণয়নের মাধ্যমে বীরাঙ্গনাদের মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি দানের একটি বিল পাস হয়। একই বছর ১২ই অক্টোবর মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় একটি গেজেট প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে ৪১ জন বীরাঙ্গনাকে মুক্তিযুদ্ধে অবদানের জন্য মুক্তিযাদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। এটি ছিল দীর্ঘ প্রতিক্ষিত। রাষ্ট্র তাঁদের নারী মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে মুক্তিযুদ্ধে তাঁদের অপরিসীম ত্যাগ ও অবদানের যথার্থ মূল্যায়ন করে নিজেকেই গৌরাবান্বিত করেছে।
আরো স্বস্তির কথা, স্বাধীনতার দীর্ঘ সময় পরে হলেও যারা গণহত্যায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে সহযোগিতা করেছে, মা-বোনদের সম্ভ্রম হানি ঘটিয়েছে, সেসব মানবতার শত্রু, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়া শেখ হাসিনা সরকারের উদ্যোগেই শুরু হয়ে কারো কারো রায় ইতোমধ্যে কার্যকর হয়েছে। এসব ঘৃণ্য অপরাধী, নরপশুর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হলে, তবে বীরাঙ্গনাদের চাপা কষ্ট ও দুঃখ-যন্ত্রণার কিছুটা হলেও লাঘব ঘটবে। [সুরমা জাহিদ, জান্নাত-এ-ফেরদৌসী ও হারুন-অর-রশিদ]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৮ম খণ্ড