You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.11.19 | মুকুন্দপুর যুদ্ধ (ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর) - সংগ্রামের নোটবুক

মুকুন্দপুর যুদ্ধ (ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর)

মুকুন্দপুর যুদ্ধ (ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর) সংঘটিত হয় ১৯শে নভেম্বর। এ-যুদ্ধে ২৮ জন পাকিস্তানি সেনার আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে মুকুন্দপুর এলাকা হানাদারমুক্ত হয়। এর আগে প্রায় ৭ মাস ধরে এখানে বহু খণ্ডযুদ্ধ হয়। তাতে উভয় পক্ষে অনেক হতাহতের ঘটনা ঘটে।
মে মাসের প্রথম দিকে প্রচণ্ড এক যুদ্ধে মুকুন্দপুর মুক্তিযোদ্ধাদের হাতছাড়া হয়। এরপর পাকিস্তানি বাহিনী মুকুন্দপুর এলাকায় শক্ত ঘাঁটি নির্মাণ করে অবস্থান করছিল। জুন মাস থেকে নভেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত এখানে বহু খণ্ডযুদ্ধ হয়। দ্বিতীয় বেঙ্গল রেজিমেন্টের লেফটেন্যান্ট জি এইচ মোরশেদ এবং লেফটেন্যান্ট মো. নাসিরউদ্দিনের নেতৃত্বে পরিচালিত এসব যুদ্ধে উভয় পক্ষেরই বহু সৈনিক হতাহত হয়। চূড়ান্ত পর্যায়ে ১৯শে নভেম্বর মুকুন্দপুর মুক্ত করার যুদ্ধে নেতৃত্ব দেন লেফটেন্যান্ট সাঈদ আহমেদ। এজন্য ইপিআর, পুলিশ, আনসার, মুজাহিদ, সেনাবাহিনীর বিভিন্ন কোর, বিমান ও নৌবাহিনীর সদস্য এবং স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে গঠিত হয়েছিল সেক্টর ট্রুপস-এর ২৮ ও ২৯ নং এমএফ কোম্পানি। এর একটির নেতৃত্বে ছিলেন লে. সাঈদ আহমেদ, অন্যটির নেতৃত্বে ছিলেন লে. এম আই মজুমদার। যৌথ কোম্পানি কমান্ড করেন লে. সাঈদ আহমেদ তাঁদের সহযোগিতার জন্য ভারতীয় মিত্রবাহিনীর আর্টিলারি সার্পোট ছিল। গোয়ালনগর গ্রামের সায়েরা খাতুন মুক্তিযোদ্ধাদের তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করেন, যদিও তার পিতা আজিজ চৌকিদার ছিল পাকিস্তানি বাহিনীর সহযোগী। সায়েরা খাতুন পাকসেনাদের দ্বারা নির্যাতিত হন। এরপর তিনি কৌশলে পাকসেনাদের সঙ্গে ভাব জমান এবং এ সুযোগে শত্রুকবলিত এলাকা ঘুরে-ঘুরে শত্রুদের যাবতীয় সংবাদ মুক্তিযোদ্ধাদের বলে দিতেন। তার দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে বহু পাকিস্তানি সৈন্যকে হতাহত করা সম্ভব হয়।
লে. সাঈদ আহমেদের নেতৃত্বে পরিচালিত মুকুন্দপুর যুদ্ধে নিয়মিত বাহিনীর সদস্য ছাড়াও স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা অংশগ্রহণ করেন। তাঁদের মধ্যে ছিলেন কান্দিপাড়ার আবদুল মন্নাফ, উলচাপাড়ার গাজীউর রহমান, সেজামুড়া গ্রামের মো. রফিকুল ইসলাম, মোতালেব মিয়া, মো. দবির আহমদ ভূঁইয়া, মো. আলী আজগর ভূঁইয়া, আবদুল বাছির, মো. শামসুদ্দিন ভূঁইয়া, আবদুল মোতালেব, আবদুল জব্বার, মো. ধন মিয়া, মো. ফিরোজ মিয়া, মো. ফুল মিয়া, সহিদ মিয়া, মো. নূরুল ইসলাম, মো. শাহ আলম ভূঁইয়া, রূপা গ্রামের মাজহারুল হক ওরফে মোজাম্মেল হক, মণিপুর গ্রামের রইছ মিয়া, আম্বাবিয়া গ্রামের ময়দ মিয়া, কামালমুড়া গ্রামের মো. তাজুল ইসলাম ওরফে এলু মিয়া, কুদ্দুছ মিয়া, জয়নাল আবেদীন, মো. ধন মিয়া, মো. আবদুল খালেক ভূঁইয়া, ছতরপুর গ্রামের তাজুল ইসলাম মীর, মহেশপুরের মো. জয়নাল আবেদীন, বক্তারমুড়ার মোজাম্মেল হক, চম্পকনগরের হামদু চৌধুরী প্রমুখ। এছাড়া অন্যান্য গ্রামের মুক্তিযোদ্ধারাও অংশগ্রহণ করেন। তাঁদের মধ্যে মো. বেনু মিয়া, আবদুল জব্বার, মো. মন্তু ভূঁইয়া, মো. হরমুজ মিয়া প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য। গ্রুপ কমান্ডার আবুল কালাম ভূঁইয়া তাঁর বাহিনী নিয়ে এ-যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন।
১৮ই নভেম্বর রাত ৪টার মধ্যে যুদ্ধের প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়ে যায়। অধিনায়ক লে. সাঈদ আহমেদ ভোর পর্যন্ত যুদ্ধের প্রস্তুতি ঘুরে-ঘুরে দেখেন। ১৯শে নভেম্বর ভোরের কুয়াশা কাটতেই লে. সাঈদ পাকসেনাদের ক্যাম্প লক্ষ করে প্রথম গুলি চালান। সঙ্গে-সঙ্গে ‘জয় বাংলা’ ধ্বনি দিয়ে সকল মুক্তিযোদ্ধা একযোগে আক্রমণ করেন। শুরু হয় প্রচণ্ড যুদ্ধ। উভয় পক্ষের গুলি, আর্টিলারির বিস্ফোরণ আর ‘জয় বাংলা’ ধ্বনিতে সমস্ত এলাকা প্রকম্পিত হয়ে ওঠে। বেলা ৩টা পর্যন্ত যুদ্ধ চলে। শেষ পর্যন্ত অনেক হতাহতের পর ২৮ জন পাকিস্তানি সৈনিক আত্মসমর্পণ করে। এ-যুদ্ধে অনেক অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ মুক্তিযোদ্ধাদের দখলে আসে। পাকিস্তানি বাহিনী শোচনীয়ভাবে পরাজয় বরণ করে এবং মুকুন্দপুর হানাদারমুক্ত হয়। [জয়দুল হোসেন]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৮ম খণ্ড