মুক্তিযুদ্ধে মির্জাপুর উপজেলা (টাঙ্গাইল)
মির্জাপুর উপজেলা (টাঙ্গাইল) ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর সাতই মার্চের ভাষণ শুনে মির্জাপুরবাসী স্বাধীনতার চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে ওঠে। ছাত্রলীগ নেতা পুলক সরকারের নেতৃত্বে গঠিত হয় মির্জাপুর সংগ্রাম পরিষদ। পরিষদের অন্য সদস্যরা ছিলেন একাব্বর হোসেন, মোশারফ হোসেন মনি, মীর আবদুল অদুদ, মাখন লাল সরকার, বাদশা মিয়া, গাজী লুৎফর রহমান, জুমারত আলী দেওয়ান, বিপ্লব কুমার বোস, দুর্লভ বিশ্বাস, ভবেশ সরকার প্রমুখ। তৎকালীন প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য ও টাঙ্গাইল জেলা হাইকমান্ডের নেতা ফজলুর রহমান খান ফারুক তখন আন্দোলনে উত্তাল ঢাকার নেতৃবৃন্দের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন এবং সেখানকার অবস্থা সম্বন্ধে মির্জাপুর সংগ্রাম পরিষদের নেতৃবৃন্দকে নিয়মিত অবহিত করতেন। প্রতিদিন ছাত্র-জনতার মিছিল ও স্লোগানে মির্জাপুর শহর মুখরিত হয়ে ওঠে। সংগ্রাম পরিষদের নেতৃবৃন্দের সঙ্গে মিলে ছাত্র-জনতা মির্জাপুর থানায় পাকিস্তানি পতাকা নামিয়ে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করে।
মিটিং-মিছিলের পাশাপাশি মির্জাপুরের সংগ্রামী জনতা মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতিস্বরূপ প্রশিক্ষণ নিতে শুরু করে। মির্জাপুর সদরের সদয়কৃষ্ণ হাইস্কুলে স্থাপিত হয় প্রশিক্ষণ কেন্দ্র। এখানে প্রশিক্ষণ দেন এই স্কুলেরই শরীরচর্চার শিক্ষক নিরঞ্জন কুমার সাহা। এছাড়া সাটিয়াচড়া ও নাগরপাড়ার কালীবাড়ি মাঠেও প্রশিক্ষণ চলে।
মির্জাপুরে যাঁরা মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকের দায়িত্ব পালন করেন, তাঁরা হলেন- প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য ও টাঙ্গাইল জেলা গণমুক্তি পরিষদের অন্যতম নেতা ফজলুর রহমান খান ফারুক (নতুন কহেলা), ব্যারিস্টার শওকত আলী খান (নাগরপুর), আওয়ামী লীগ নেতা নছিবর রহমান ছানা (জামুর্কী), আবুল হোসেন (পোস্টকামুরী), পুলক সরকার (মির্জাপুর), ডি এম সুলতান (জামুর্কী), কোম্পানি কমান্ডার আজাদ কামাল (বাইমহাটি), প্রীতিশবরণ মিত্র (বাইমহাটি), ময়নুল হক (পোস্টকামুরী) প্রমুখ।
২৬শে মার্চ বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার কথা জানার পরপরই টাঙ্গাইল জেলা স্বাধীন বাংলা গণমুক্তি পরিষদ ও মির্জাপুর সংগ্রাম পরিষদের নেতৃবৃন্দ টাঙ্গাইলে পাকবাহিনীর প্রবেশ প্রতিহত করার সিদ্ধান্ত
নেন। এজন্য ইপিআর সুবেদার আবদুল আজিজের নেতৃত্বে দেড় শতাধিক মুক্তিযোদ্ধা ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কে মির্জাপুরের জামুর্কী ইউনিয়নের সাটিয়াচড়া- গোড়ান এলাকায় অবস্থান নেন। ৩রা এপ্রিল ভোরে পাকবাহিনী ঐ এলাকা অতিক্রম করার সময় মুক্তিযোদ্ধারা আক্রমণ করেন। একটানা প্রায় ৭ ঘণ্টা যুদ্ধ চলে। কিন্তু পাকবাহিনীর ভারী অস্ত্রের সামনে টিকতে না পেরে মুক্তিযোদ্ধারা পিছু হটেন।
এ-যুদ্ধে ৩৬ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। মির্জাপুরের এ-যুদ্ধ সাটিয়াচড়া-গোড়ান প্রতিরোধযুদ্ধ নামে পরিচিত। যুদ্ধশেষে পাকবাহিনী সাটিয়াচড়া ও গোড়ান গ্রামে নির্মম গণহত্যা চালিয়ে মির্জাপুরে প্রবেশ করে এবং ৭ই মে মির্জাপুর থানায় ক্যাম্প স্থাপন করে। মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকবাহিনীকে সহায়তাদানকারীদের মধ্যে আবদুল ওদুদ মাওলানা (বাইমহাটি), মাহবুব মাওলানা (মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে ফাঁসির দন্ডাদেশপ্রাপ্ত আসামী, বাইমহাটি), খন্দকার আজিজুল হক (বানিয়ারা), জিয়ারত আলী (জামুর্কী), মজিবর রহমান (ধল্লা), বেল্লাল খান (কাটোরা), হাজি রাজ্জাক (মির্জাপুর), হাবিবুর রহমান (পাথরঘাটা), হাবিবুর রহমান (তরফপুর), বাচ্চু মৃধা (গোড়াই), হাসেন আলী (ফতেপুর), আবদুল মান্নান (মির্জাপুর), ভানু মিয়া (মির্জাপুর), মাখন মিয়া (রাজনগর), জয়নাল কমান্ডার প্রমুখ উল্লেখযোগ্য। আবদুল ওয়াদুদ মাওলানার নেতৃত্বে রাজাকার বাহিনী গঠিত হয়। এ বাহিনী মির্জাপুরের বিভিন্ন গ্রাম থেকে নিরীহ বাঙালিদের ধরে এনে হত্যা করে।
পাকবাহিনী ও তাদের স্থানীয় দোসররা মির্জাপুরে দুটি গণহত্যা চালায় সাটিয়াচড়া-গোড়ান গণহত্যা এবং মির্জাপুর গণহত্যা। ৩রা এপ্রিল সাটিয়াচড়া-গোড়ান এবং ৭ই মে মির্জাপুর গণহত্যা সংঘটিত হয়। এদুটি গণহত্যায় অর্ধশতাধিক গ্রামবাসী শহীদ হন। এছাড়া বিভিন্ন সময়ে সরিষাদাইর, কাষ্ঠালিয়া, পোস্টকামুরী, বাগজান, ভাতগ্রাম, পাঠানপাড়া, লক্ষিন্দা, জগতভাররা, নবগ্রাম প্রভৃতি গ্রামের বহু লোককে হত্যা করা হয়। বিভিন্ন গ্রামের অর্ধশতাধিক লোককে ধরে নিয়ে মধুপুর সদরের বংশাই নদীতীরে হত্যা করা হয়। ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কের শুভল্যা ব্রিজটি ছিল পাকবাহিনী ও তাদের দোসরদের একটি কসাইখানা। এ ব্রিজের নিচ দিয়ে নৌকায় যাতায়াতের সময় নিরীহ মানুষদের ধরে হত্যা করা হয়। এর মূল হোতা ছিল রাজাকার কমান্ডার জয়নাল। হায়েনার দল মাধববাড়ি মন্দিরসহ ১২টি বাড়িঘর পুড়িয়ে দেয় এবং একজন নারীর ওপর পাশবিক নির্যাতন চালায়। ১৯শে নভেম্বর মুক্তিযোদ্ধারা পরিকল্পনা করে শুভল্যা ব্রিজ অপারেশন চালায়।
মির্জাপুর উপজেলায় তিনটি বধ্যভূমির সন্ধান পাওয়া গেছে। সেগুলো হলো গোড়াই-সোহাগপাড়া ব্রিজ বধ্যভূমি, বংশাই নদীতীর বধ্যভূমি ও শুভল্যা ব্রিজ বধ্যভূমি। এসব বধ্যভূমিতে বহু সংখ্যক নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করা হয়। এ উপজেলায় চারটি গণকবরের সন্ধান পাওয়া গেছে। সেগুলো হলো সাটিয়াচড়া গণকবর, গোড়ান গণকবর, লৌহজং গণকবর ও আন্ধরা গণকবর। এসব গণকবরে অসংখ্য স্বাধীনতাকামী বাঙালিকে হত্যার পর কবর দেয়া হয়। মির্জাপুর উপজেলায় পাকবাহিনীর সঙ্গে মুক্তিবাহিনীর একাধিক সম্মুখ যুদ্ধ হয়। সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য রামপুর যুদ্ধ, পাথরঘাটার যুদ্ধ, নয়াপাড়ার যুদ্ধ ও মির্জাপুর যুদ্ধ। ১৩ই আগস্ট রামপুর যুদ্ধে পাঁচজন পাকসেনা নিহত হয় এবং একজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। সেপ্টেম্বরের প্রথম দিকে পাথরঘাটার যুদ্ধে পাকবাহিনী মুক্তিযোদ্ধাদের পাথরঘাটা ক্যাম্প দখল করে নেয়। নয়াপাড়ার যুদ্ধ সংঘটিত হয় ৩০শে অক্টোবর। এ-যুদ্ধে পাকবাহিনীর ক্যাপ্টেন আইয়ুব নিহত হয় এবং তিনজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। মির্জাপুর যুদ্ধ সংঘটিত হয় দুবার – ১৮ই নভেম্বর ও ১২ই ডিসেম্বর। প্রথমবারের যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধারা পাকবাহিনীর মির্জাপুর থানা ক্যাম্প দখল করেন, যদিও দুদিন পরে পাকবাহিনী তা পুনর্দখল করে। এ- যুদ্ধে পাকসেনা ও রাজাকারসহ ২৮ জন নিহত এবং ৭ জন পাকসেনাসহ দেড়শ রাজাকার মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে বন্দি হয়। দ্বিতীয়বারের যুদ্ধে পাকসেনারা আত্মসমর্পণ করে এবং ১৩ই ডিসেম্বর মির্জাপুর শত্রুমুক্ত হয়।
মির্জাপুর উপজেলার শহীদ মুক্তিযোদ্ধারা হলেন- জুমারত আলী দেওয়ান (পিতা আবদুর রাজ্জাক দেওয়ান, সাটিয়াচড়া), সানাউর রহমান খান (পিতা আবদুল বারেক খান, পারদীঘি; সেনাসদস্য), রফিকুল ইসলাম (পিতা মুজিব উদ্দিন, মীর দেওহাটা), আবুল বারেক (পিতা মোকাদ্দেস আলী মিয়া, উফুলকী), সাইফুল ইসলাম (পিতা মনসুর রহমান, ইচাইল), তরফ আলী (পিতা ওয়াহেদ বক্স, লক্ষিন্দা), জাহাঙ্গীর আলম (পিতা দবির উদ্দিন, গোড়ান), মোকছেদ আলী (পিতা খোদাবক্স, লক্ষিন্দা), সাইফুল ইসলাম (পিতা নায়েব খান, কুড়ালিয়াপাড়া), আলী আহমেদ মিয়া (পিতা দেলোয়ার হোসেন মিয়া, কাউয়ালীপাড়া), নূর উদ্দিন আহমেদ (পিতা শামসুদ্দিন আহমেদ, গোড়ান), আবুল কাশেম মিয়া (পিতা নথু মিয়া, গোড়ান), আকবর হোসেন (পিতা মফিজ উদ্দিন, পাকুল্লা; পুলিশসদস্য), কে এইচ আজিজুল ইসলাম (পিতা খন্দকার নূরুল ইসলাম, বানিয়ারা; সেনাসদস্য), সাদেক খান (পিতা মহসিন আলী মিয়া, পাইখার ভাওড়া), আজাদ খান (পিতা আব্দুল মুন্নাফ, নতুন কহেলা), দেলোয়ার হোসেন (পিতা গোলাম মোস্তফা, নতুন কহেলা), আমজাদ হোসেন খান (পিতা আবদুল মান্নাফ খান, নতুন কহেলা), সাহেব আলী (পিতা মহসিন আলী মিয়া, গল্লী), কোরবান আলী খান (পিতা জব্বার খান, হিলড়া), খোরশেদ আলম (পিতা আবদুল গফুর দফাদার, মহেড়া), আলম মিয়া (পিতা . মজিবর রহমান সরকার, পাইকপাড়া) এবং আওলাদ হোসেন (পিতা আবুল হোসেন, আদাবাড়ী)।
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে টাঙ্গাইল জেলার মধ্যে মির্জাপুর উপজেলায় সবচেয়ে বেশি মানুষ হত্যার শিকার হলেও তাঁদের স্মৃতি রক্ষার্থে তদ্রূপ কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি। সম্প্রতি টাঙ্গাইল জেলা পরিষদের অর্থায়নে মির্জাপুরে প্রথম প্রতিরোধ যুদ্ধের স্থান সাটিয়াচড়া-গোড়ানে শহীদদের স্মরণে একটি মুক্তিযুদ্ধ কমপ্লেক্স নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে এবং ইতোমধ্যে ভবনের একতলার কাজ শেষ হয়েছে। [দুর্লভ বিশ্বাস]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৮ম খণ্ড