মিলিশিয়া বাহিনী
মিলিশিয়া বাহিনী ছিল পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর সঙ্গে যুক্ত একটি প্যারা-মিলিটারি ফোর্স। ১৯৭১ সালে অধিকৃত বাংলাদেশে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সহযোগী হিসেবে গণহত্যা সংঘটন, ধর্ষণ ও অগ্নিসংযোগসহ সব ধরনের যুদ্ধাপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে তারা অংশ নেয়। মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে পাকিস্তান থেকে প্যারা মিলিশিয়া (আধাসামরিক) বাহিনীর অন্তর্ভুক্ত ঝিলাম রেঞ্জার্স, রাভি রেঞ্জার্স, সতলুজ রেঞ্জার্স, নর্দার্ন স্কাউটস, টচি স্কাউটস, থল স্কাউটস, পাকিস্তানি ডিফেন্স স্কাউটস ইত্যাদি বাহিনীকে পূর্ব পাকিস্তানে নিয়ে আসা হয়। তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানে মিলিশিয়া বাহিনী একটি নিয়মিত ফোর্স হিসেবে কাজ করত এবং এর প্রধান হিসেবে নিয়োগ দেয়া হতো পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একজন ঊর্ধ্বতন অফিসারকে। রাইফেলসহ হালকা ধরনের যুদ্ধাস্ত্র ব্যবহারের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত এ বাহিনীর সদস্যরা সরকারিভাবে বেতন, ভাতা ও রেশন পেত।
২৬শে মার্চ বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার পর ইপিআর (ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস)-এর বাঙালি সৈন্যরা বিদ্রোহ ঘোষণা করে মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করায় মিলিশিয়া বাহিনীকে নিয়ে আসার প্রয়োজন দেখা দেয়। ইপিআর-এর শূন্যতা পূরণের লক্ষ্যে পাকিস্তানি সামরিক জান্তা ‘ইস্ট পাকিস্তান সিভিল আর্মড ফোর্সেস (EPCAF) নামেও একটি আধা সামরিক বাহিনী গঠন করেছিল, যা ৩রা এপ্রিল থেকে কার্যকর হয়েছিল (দ্রষ্টব্য ইস্ট পাকিস্তান সিভিল আর্মড ফোর্সেস )। এর প্রধান ছিল মেজর জেনারেল মোহাম্মদ জামশেদ খান।
পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর EPCAF পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের অধীনে রেঞ্জার্স ও মিলিশিয়া বাহিনী পরিচালিত হতো। এর সদস্য সংখ্যা ছিল প্রায় ২৪ হাজার। এদের পোশাকের রং ছিল কালো। পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে একযোগে বিভিন্ন যুদ্ধাভিযান পরিচালনা বা প্রতিরক্ষামূলক কর্মকাণ্ডে এরা অংশ নিত। এদের বিশেষ কাজ ছিল গ্রামাঞ্চলের রাস্তাঘাটগুলো সম্পর্কে তথ্য জোগাড় করা, কোন রাস্তা কি অবস্থায় রয়েছে তা বিভিন্ন সোর্স থেকে জেনে নেয়া, মিলিটারি অপারেশনের সময় রাস্তাঘাট চিনিয়ে নেয়া ইত্যাদি। অপারেশনে যাবার আগে এদের দায়িত্ব ছিল রেকি করা।
রেকি করা ছাড়াও ছোটোখাটো যুদ্ধে অংশগ্রহণ করা ও গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা, অফিস, যানবাহন, জাহাজ ইত্যাদি পাহারার দায়িত্বে তাদের নিযুক্ত করা হতো। তাদের কখনো- কখনো অস্ত্র, রসদ ও ঔষধপত্র বহনকারী জাহাজ বা লঞ্চ পাহারার দায়িত্ব প্রদান করা হতো। মুক্তিযুদ্ধকালে মিলিশিয়া বাহিনীর বেশ কয়েকজন সদস্যকে সুন্দরবনের অভ্যন্তরে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ‘নালশিরা’ জাহাজ পাহারায় নিয়োজিত করা হয়েছিল। জাহাজটি মূলত পাকিস্তানিদের চিকিৎসার জন্য সুন্দরবনের অভ্যন্তরে নোঙর করা ছিল। জাহাজে প্রচুর পরিমাণ ঔষধ ও খাদ্যসামগ্রী থাকলেও পর্যাপ্ত নিরাপত্তা-ব্যবস্থা ছিল না। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ধারণা ছিল যে, গভীর অরণ্যে হয়ত মুক্তিযোদ্ধারা জাহাজ আক্রমণের সাহস করবে না। কিন্তু তাদের সে ধারণাকে ভ্রান্ত প্রমাণ করে ২০শে অক্টোবর গভীর রাতে ৪ জন দুঃসাহসী নৌকমান্ডো সফল অপারেশন পরিচালনার মাধ্যমে নালশিরা জাহাজ ধ্বংস করতে সক্ষম হন। এ অপারেশনে বেশ কয়েকজন মিলিশিয়া সদস্য হতাহত হয় এবং মুক্তিযোদ্ধারা বিপুল পরিমাণ ঔষধ, প্রচুর খাদ্যসামগ্রী, অস্ত্র ও গোলাবারুদ হস্তগত করেন।
সীমান্ত এলাকা পাহারার কাজেই প্রধানত মিলিশিয়া বাহিনীকে নিযুক্ত করা হয়েছিল। বাংলাদেশের অধিকাংশ চা- বাগান মূলত সীমান্তবর্তী এলাকায় অবস্থিত। সামরিক দিক থেকে এ বাগানগুলো দখলে রাখা পাকিস্তানিদের কাছে ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ কারণে এসব বাগানে দুই স্তরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়েছিল পাকিস্তানি হানাদাররা। প্রথম স্তরে মিলিশিয়া বাহিনীর সদস্যদের ব্যবহার করা হয়েছিল। ব্যাকআপে ছিল পাকিস্তানি সেনাবাহিনী। মিলিশিয়া সদস্যরা মুক্তিবাহিনী-কে মোকাবেলা করত নিষ্ঠুরভাবে। যেকোনো ব্যক্তিকে মুক্তিযোদ্ধা বলে সন্দেহ হলে এরা গ্রেপ্তার, এমনকি হত্যা পর্যন্ত করতে পারত। চা-বাগানের কারো সঙ্গে মুক্তিবাহিনীর সম্পৃক্ততার কথা শুনলেই তারা গুলি করে তাকে হত্যা করত। তবে, বাগানগুলোতে নিজেদের নিরাপত্তা রক্ষায় পাকিস্তানি বাহিনীকে ব্যতিব্যস্ত থাকতে হতো। মিলিশিয়া বাহিনীকে ব্যবহার করা হতো নিরাপত্তা বলয় হিসেবে।
সিন্দুরখান চা-বাগান থেকে ভারতের সীমান্তের দূরত্ব ছিল মাত্র দেড় কিলোমিটার। এখানে মুক্তিবাহিনীকে মোকাবেলার জন্য অসংখ্য বাংকার খনন করেছিল পাকিস্তানি সেনা ও মিলিশিয়া বাহিনী এবং এর মাধ্যমে তারা জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টি করেছিল। অনেক চা-শ্রমিককে অকথ্য নির্যাতন করে তারা হত্যা করেছিল। এপ্রিল মাসের শুরুতেই সিন্দুরখান চা-বাগানে পূর্বতন ইপিআর ক্যাম্পে তারা আস্তানা গড়ে তুলেছিল। অনুরূপভাবে, রাজঘাট চা-বাগানে দুই স্তরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়েছিল পাকিস্তানি বাহিনী, যাতে বাগান দিয়ে মুক্তিবাহিনী দেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করতে না পারে। রাজঘাট স্কুল ঘরে মিলিশিয়া বাহিনীর অর্ধশতাধিক সদস্যের অবস্থান ছিল। আর ফ্যাক্টরিতে অবস্থান নিয়েছিল প্রায় ১০০ পাকিস্তানি সৈন্য। সুবেদার মেজর শের খান সিন্দুরখান ক্যাম্প থেকে রাজঘাট চা- বাগানের দুটি ক্যাম্প নিয়ন্ত্রণ করত। তার কাছে মুক্তিযোদ্ধাদের হত্যা বা মুক্তিযোদ্ধা সন্দেহে কাউকে হত্যা ছিল হাতের নিশানা প্রাকটিসের সামিল এবং নারীধর্ষণ ছিল নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। শের খানকে মুক্তিযোদ্ধারা হত্যা করেছিলেন। চা-শ্রমিক মুক্তিযোদ্ধারা প্রাণপণ লড়াই করেছেন হায়েনাদের বিরুদ্ধে। ভয়াবহ নির্যাতনের ফলে প্রাণ হারিয়েছেন অসংখ্য নারী চা-শ্রমিক।
মুক্তিযুদ্ধের সময় কমলগঞ্জের মঙ্গলপুর গ্রামের মণিপুরি তমাল সিংহকে মিলিশিয়া বাহিনী আটক করেছিল। তমাল সিংহ বাজারে যাচ্ছিলেন চিড়া বিক্রি করতে। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল, তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের খাবারের জন্য চিড়া দিয়ে সাহায্য করতেন। সলিমবাজারের বড়চেক নামক স্থানে মিলিশিয়ারা তার কাছ থেকে চিড়ার বস্তা কেড়ে নিয়ে গুলি করে তাকে হত্যা করে লাশ নদীতে ফেলে দেয়। রাতের অন্ধকারে তার ছেলে লাশ নিয়ে বাড়ির পেছনে দাফন করে। এছাড়াও, মিলিশিয়া বাহিনী অত্র এলাকার মণিপুরি বাড়িগুলোতে হানা দিয়ে মেয়েদের গহনা, মূল্যবান জিনিসপত্র, এমনকি হাঁড়ি-পাতিল পর্যন্ত লুট করেছিল। বেশ কয়েকজন মণিপুরি নারীকে তারা ধর্ষণ করে। মিলিশিয়া বাহিনীর অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে বেশকিছু মণিপুরি পরিবার সব কিছু ফেলে ভারতে চলে গিয়েছিল। এ এলাকায় মণিপুরিদের জন্য মিলিশিয়ারা ছিল এক ভয়ঙ্কর আতঙ্ক। সীমান্তবর্তী এলাকা ছাড়াও মিলিশিয়া বাহিনীকে পূর্ব বাংলার অন্যত্র মোতায়ন করা হয়েছিল। এর মধ্যে ঢাকার নিকটস্থ আমিনবাজার, রাজশাহী জেলার নাটোর মহকুমা (বর্তমানে জেলা), ফরিদপুর জেলার রাজবাড়ী মহকুমা (বর্তমানে জেলা) ও বোয়ালমারী থানা, গোপালগঞ্জ মহকুমার (বর্তমানে জেলা) কাশিয়ানি থানা, ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল, জামালপুর, শেরপুর প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। এসব স্থানে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে পাকহানাদার বাহিনী, তাদের দোসর রাজাকার ও মিলিশিয়াদের যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে অনেক মিলিশিয়া হতাহত হয় এবং অনেকে আত্মসমর্পণ করে। তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের দরিদ্র পরিবার থেকে আসা মিলিশিয়া বাহিনীর সদস্যরা চা বা খাবারের দোকান, মিষ্টির দোকান, কিংবা আম বা কলা-বিক্রেতা দেখামাত্র টাকা-পয়সা চ ছাড়াই এসব তারা খেত আর ধমক দিয়ে নিজেদের ক্ষমতা জাহির করত।
পাকিস্তানের উপজাতীয় অঞ্চলে ব্যাপক হারে নেশাজাতীয় ২ দ্রব্য গ্রহণের প্রবণতা ছিল। মিলিশিয়া বাহিনীর বিশাল অংশ পাকিস্তানের উপজাতীয় অঞ্চল থেকে এসেছিল বলে তারাও নেশাজাতীয় দ্রব্য গ্রহণে অভ্যস্ত ছিল। তাদের সঙ্গে একই স্থানে বসবাস ও মেলামেশা করার ফলে পাকিস্তান ই সেনাবাহিনীর অনেক সৈন্যের মধ্যেও এ অভ্যাস পরিলক্ষিত হয়। নেশাগ্রস্তদের মধ্যে মনুষ্যত্ববোধ বলতে কিছু থাকে না এবং যেকোনো ধরনের নিকৃষ্ট কাজ করতে তারা দ্বিধাবোধ করে না। এমনটাই ঘটেছিল পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও মিলিশিয়া বাহিনীর সদস্যদের অনেকের ক্ষেত্রে।
EPCAF-এর মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মোহাম্মদ জামশেদ খান দ্বারা পরিচালিত মিলিশিয়া বাহিনী চ মুক্তিযুদ্ধকালে বাংলাদেশে গণহত্যা, নারীনির্যাতন, লুটপাট, অগ্নিসংযোগসহ নানাবিধ অপরাধমূলক ও মানবতাবিরোধী কর্মকাণ্ডে লিপ্ত ছিল। এ বাহিনী ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল, জামালপুর, শেরপুর ও আশপাশের বিভিন্ন এলাকাসহ দেশব্যাপী মানবতাবিরোধী বহু অপরাধ সংঘটিত করে। মিলিশিয়া বাহিনীর বর্বরতার এক নিকৃষ্ট উদাহরণ খুলনা জেলাধীন ডুমুরিয়া থানার চুকনগর গণহত্যা। এখানে ভারতের উদ্দেশে শরণার্থী হিসেবে জমায়েত হওয়া ভীত-সন্ত্রস্ত প্রধানত হিন্দু সম্প্রদায়ভুক্ত বিপুল সংখ্যক নিরীহ মানুষের মধ্যে কমপক্ষে ১০ হাজার নারী-পুরুষ-শিশু-বৃদ্ধকে ২০শে মে অত্যন্ত নির্মম-নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হয়। পাকিস্তানি সেনাসদস্যদের পাশাপাশি মিলিশিয়ারা এ নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করে। [কাজী সাজ্জাদ আলী জহির ও মেসবাহ কামাল
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৮ম খণ্ড