মিয়াবাজার যুদ্ধ (চৌদ্দগ্রাম, কুমিল্লা)
মিয়াবাজার যুদ্ধ (চৌদ্দগ্রাম, কুমিল্লা) ২৫শে মার্চ থেকে ২৬শে আগস্ট পর্যন্ত কয়েকবার সংঘটিত হয়। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের এ-যুদ্ধে শতাধিক পাকিস্তানি সৈন্য নিহত হয় এবং কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন।
২নং সেক্টরের যে কয়েকটি সীমান্ত এলাকায় মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নিয়মিত যুদ্ধ হতো ও গেরিলা তৎপরতা চলত, তার মধ্যে কুমিল্লা জেলার চৌদ্দগ্রাম থানার মিয়াবাজার অন্যতম। এ এলাকায় মুক্তিযোদ্ধারা সার্বক্ষণিক প্যাট্রলে থেকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ওপর আঘাত হানতেন। এখানে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীরও একটি শক্তিশালী ক্যাম্প ছিল। পাকহানাদার বাহিনী ২৫শে মার্চ কালরাত্রিতে কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট থেকে বের হয়ে সারাদেশের মতো কুমিল্লার নিরীহ মানুষের, ওপর নির্বিচারে গুলি চালাতে থাকে। তারা কুমিল্লা শহর থেকে ক্রমে পূর্বদিক দিয়ে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক দিয়ে চট্টগ্রামের দিকে রওয়ানা হলে চৌয়ারা, সুয়াগঞ্জ ও মিয়াবাজারে ব্যারিকেডের জন্য খুব এগুতে পারেনি। তাছাড়া মুক্তিযোদ্ধারা মিয়াবাজার ব্রিজটি ধ্বংস করায় হানাদার বাহিনীর চট্টগ্রাম যাওয়ার একমাত্র রাস্তা বন্ধ হয়ে যায়।
৩রা এপ্রিল সকাল ১০টায় হানাদার বাহিনী কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট থেকে ৮ লরি আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ নিয়ে চৌদ্দগ্রাম যাওয়ার পথে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে মিয়াবাজার এলাকায় যুদ্ধের সম্মুখীন হয়। পূর্ব থেকে আবদুল কাদের চৌধুরী, প্রমোদ চক্রবর্তী, আনসার, সেনাবাহিনী ও পুলিশ সদস্যের নেতৃত্বে দেড় শতাধিক মুক্তিযোদ্ধার একটি দল কাঁকড়ী নদীর দুই ধারে ট্রেন্স বানিয়ে ডিফেন্স তৈরি করেছিলেন। এ-যুদ্ধে ১২ জন পাকিস্তানি সৈন্য নিহত ও তাদের ৩টি লরি বিধ্বস্ত হয়। অপরদিকে ৭ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। ৭ই এপ্রিল মুক্তিযোদ্ধারা মিয়াবাজার ব্রিজ ধ্বংস করেন।
২৯শে এপ্রিল ভোরবেলা পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম থানার মিয়াবাজার এলাকায় আক্রমণ করে। তারা মিয়াবাজার এলাকা থেকে গুলি চালাতে-চালাতে উত্তর দিকে অগ্রসর হতে থাকে। কালিকাপুর ইউনিয়নের রাজাকার কোব্বত চেয়ারম্যানের পরামর্শক্রমে তারা চান্দুল ও চান্দশ্রী গ্রাম পার হয়ে কোমারডোগা গ্রামে এসে আওয়ামী লীগ সমর্থক আবদুল আজিজের বাড়িতে হামলা চালায়। হানাদারদের বেয়নেটের খোঁচা এবং রাইফেলের গুলিতে সত্তরোর্ধ্ব আবদুল আজিজ, তাঁর বড় ছেলে মোসলেম মিয়া, তাঁর মা, পাশের বাড়ির আক্রাম আলীসহ ৮ জন শহীদ হন। হত্যাকাণ্ডের পরপরই হানাদার বাহিনী পুরো বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেয়। শহীদ সকলের মৃতদেহ আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে যায়।
২৯শে মে চতুর্থ বেঙ্গল ‘ব্রাভো’ কোম্পানির এক প্লাটুন বাঙালি সৈন্য ২টি মর্টারসহ চৌদ্দগ্রাম থানায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর অবস্থানে হামলা করলে মর্টারের গোলার আঘাতে হানাদারদের যথেষ্ট ক্ষয়ক্ষতি হয়।
৩০শে মে মিয়াবাজারে চতুর্থ বেঙ্গল রেজিমেন্টের ‘বি’ কোম্পানির এক প্লাটুন বাঙালি সদস্য পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ওপর আক্রমণ চালায়। এদিন সকাল ৬টায় পাকিস্তানি বাহিনী ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক চালু করার জন্য দুই কোম্পানি সৈন্য নিয়ে সামনের দিকে অগ্রসর হয়। বেলা ১১টায় মুক্তিযোদ্ধাদের একটি এম্বুশ দল মিয়াবাজারের উত্তর পাশে পাকিস্তানি সৈন্যদের ওপর অতর্কিতে হামলা চালায়। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রচণ্ড হামলায় হানাদার সৈন্যরা হকচকিত হয়ে পড়ে। প্রায় ৩ ঘণ্টা যুদ্ধের পর হানাদার বাহিনী ছত্রভঙ্গ হয়ে কুমিল্লা শহরের দিকে পালিয়ে যায়। এ-যুদ্ধে পাকিস্তানিদের প্রায় ৫০ জন সৈন্য হতাহত হয়, দুটি ৩ টনের গাড়ি গোলাবারুদসহ ধ্বংস হয় এবং একটি গাড়ি মুক্তিযোদ্ধারা দখল করে নেন। এ-যুদ্ধে দুজন মুক্তিযোদ্ধাদা শহীদ ও একজন আহত হন।
জুন মাসের প্রথমদিকে মুক্তিযোদ্ধাদের নিকট খবর আসে যে, পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর প্রায় এক কোম্পানি সৈন্য মিয়াবাজারের উত্তরে একটি গোডাউনে অবস্থান করছে। লেফটেন্যান্ট মাহবুবুর রহমানের নির্দেশে ৩৩ জন মুক্তিযোদ্ধার একটি কমান্ডো প্লাটুন ব্লাকসাইড ও মর্টারসহ গভীরে রাতে গোডাউনটি আক্রমণ করে। এ আক্রমণে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর অনেকেই হতাহত হয়। তাদের পাল্টা আক্রমণের চেষ্টা মুক্তিযোদ্ধারা কৌশলে ব্যর্থ করে দেন।
১৮ই জুন রাত ৯টায় মিয়াবাজারের দক্ষিণে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি প্লাটুন পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ২টি বাঙ্কারের ওপর আক্রমণ চালায়। এ আক্রমণে ৭ জন পাকিস্তানি সৈন্য নিহত হয়। এরপর তারা সারারাত অবিরাম মর্টারের গোলা ছুড়তে থাকে। মুক্তিযোদ্ধাদের এ দলটি খিলা রেলওয়ে স্টেশনের কাছে কয়েকটি ট্যাঙ্ক বিধ্বংসী মাইন রাস্তায় পুঁতে রাখেন। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর একটি জিপ রাতে ঐ রাস্তায় যাওয়ার পথে মাইনের আঘাতে সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস হয় এবং জিপে থাকা ৫ জন পাকিস্তানি সৈন্য নিহত হয়।
এদিন সন্ধ্যায় লেফটেন্যান্ট মাহাবুবুর রহমানের পাঠানো মুক্তিযোদ্ধাদের অপর একটি দল কুমিল্লা-লাকসাম রোডের বিজয়পুর রেলওয়ে ব্রিজ ও কুমিল্লা-বাগমারা রোডের সেতু উড়িয়ে দেয়। এ সেতুদুটি ধ্বংস করার ফলে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর কুমিল্লার দক্ষিণে সড়ক ও রেলওয়ে দিয়ে যাতায়াত বন্ধ হয়ে যায়। এ দলটি বিজয়পুর ও মিয়াবাজারের কাছে কয়েকটি বৈদ্যুতিক খুঁটি ধ্বংস করলে কাপ্তাই থেকে ঢাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়। সন্ধ্যায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর একটি প্লাটুন চৌয়ারার কাছে প্যাট্রলিং-এ আসে। মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর এ দলটি এম্বুশ করলে ২ জন পাকিস্তানি সৈন্য নিহত হয়। এ ঘটনার পর হানাদার বাহিনী চৌয়ারার পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলো আগুন লাগিয়ে জ্বালিয়ে দেয়।
১৯শে জুন মুক্তিযোদ্ধারা পরিকল্পনা অনুযায়ী মিয়াবাজারে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ক্যাম্পের ওপর আক্রমণ চালান। হানাদাররা পাল্টা আক্রমণ করলে উভয় পক্ষের মধ্যে যুদ্ধ হয়। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধাদের প্রচণ্ড আক্রমণে হানাদার বাহিনী পিছু হটতে বাধ্য হয়। এ-যুদ্ধে কয়েকজন হানাদার সৈন্য নিহত হয়।
জুলাই মাসের প্রথমদিকে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল মিয়াবাজার থেকে ফুলতলী সড়কে টহল দিতে যায়। রাত ৩টায় তাঁরা পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ১টি জিপ ও ২টি ট্রাক কুমিল্লা থেকে দক্ষিণ দিকে টহল দিতে দেখতে পান। মুক্তিযোদ্ধাদের এ দলটি কুমিল্লা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের ওপর এম্বুশ করে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ফিরে আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে থাকে। রাত সাড়ে ৪টার দিকে হানাদার বাহিনীর গাড়িগুলো মিয়ারবাজারের অবস্থানে ফিরে আসার পথে মুক্তিযোদ্ধাদের এম্বুশে পড়ে। মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণে হানাদার বাহিনীর একজন লেফটেন্যান্ট কর্নেলসহ ৩ জন অফিসার এবং ১২ জন সৈন্য নিহত এবং ১৫ জন আহত হয়। এ খবর কুমিল্লায় পৌঁছলে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী কামানসহ ঘটনাস্থলের দিকে অগ্রসর হয় এবং রাস্তার উভয় পাশের জনবসতির প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি করে। এ-সময় মুক্তিযোদ্ধারা পিছু হটে নিরাপদ স্থানে চলে যান।
২রা আগস্ট মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল মিয়াবাজারে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর অবস্থানের ওপর আক্রমণ করে। এতে ২৬ জন পাকিস্তানি সৈন্য নিহত এবং ২১ জন আহত হয়। এছাড়া সুয়াগাজি এলাকায় ৩রা আগস্ট মুক্তিযোদ্ধারা ৩ জন পাকিস্তানি সৈন্য ও ২ জন রাজাকারকে হত্যা করেন।
একই দিন মুক্তিযোদ্ধারা মিয়াবাজার এলাকায় টহলরত পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে আক্রমণ করেন। রাস্তা থেকে মাত্র ৪০০-৫০০ গজ দূর থেকে মুক্তিযোদ্ধারা এ আক্রমণ চালান। এ আক্রমণে ৪ জন পাকিস্তানি সৈন্য নিহত এবং কয়েকজন আহত হয়। আক্রমণের পর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী পিছু হটতে বাধ্য হয়। ২৬শে আগস্ট মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর অবস্থান মিয়াবাজার ও চৌদ্দগ্রাম এলাকায় রেইড দেন। এতে ৭ জন পাকিস্তানি সৈন্য নিহত ও ৬ জন আহত হয়। [মোতাহার হোসেন মাহবুব]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৮ম খণ্ড