You dont have javascript enabled! Please enable it! বীর প্রতীক মাহবুব-উল-আলম - সংগ্রামের নোটবুক

বীর প্রতীক মাহবুব-উল-আলম

মাহবুব-উল-আলম, বীর প্রতীক (জন্ম ১৯৫০) বীর মুক্তিযোদ্ধা। তিনি ১৯৫০ সালের ১৭ই জুন ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার নবীনগর উপজেলার আহমেদপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম আবু মুসা মো. মসিহা এবং মাতার নাম বেগম রোকেয়া মসিহা। তিনি ১৯৬৬ সালে কুষ্টিয়া জেলা স্কুল থেকে এসএসসি এবং ১৯৬৮ সালে রংপুর কারমাইকেল কলেজ থেকে এইচএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ১৯৬৯ সালের অক্টোবর মাসে তিনি পাকিস্তান সামরিক বাহিনীতে ৪৭তম লং কোর্সে ক্যাডেট হিসেবে যোগদান করেন।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরুর প্রাক্কালে মাহবুব-উল-আলম পশ্চিম পাকিস্তানের এবোটাবাদের কাকুলস্থ পাকিস্তান মিলিটারি একাডেমিতে সামরিক প্রশিক্ষণরত ছিলেন -অপারেশন সার্চলাইট-এর নামে ২৫শে মার্চ রাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ঢাকাসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে নিরস্ত্র বাঙালিদের ওপর নির্বিচার গণহত্যা ও নির্মম নির্যাতন শুরু করে। মাহবুব-উল-আলম ও তাঁর বাঙালি সহ-সৈনিকরা এ খবর জানতে পেরে এর প্রতিবাদে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেয়ার সিদ্ধান্ত নেন এবং পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পালিয়ে আসার সুযোগ খুঁজতে থাকেন। ২২শে মে তিনিসহ ১২জন সহ-সৈনিক পাকিস্তান মিলিটারি একাডেমির সেনাদের চোখকে ফাঁকি দিয়ে পালাতে সক্ষম হন। ২রা জুন দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে তিনিসহ ৪ জন ভারতের আগরতলায় পৌঁছান। সেখানকার হরিনা ক্যাম্পে কিছুদিন থাকার পর তাঁকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর যুদ্ধকালীন প্রথম ব্যাচ ফার্স্ট বেঙ্গল ওয়ার ফোর্সে ক্যাডেট হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ২৫শে জুন থেকে ৯ই সেপ্টেম্বর পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গের জলপাইগুঁড়ি জেলার মূর্তিতে অবস্থিত বাংলাদেশ মিলিটারি একাডেমি থেকে সফলতার সঙ্গে প্রশিক্ষণ সমাপ্তির পর তিনি কমিশন প্রাপ্ত হন। উল্লেখ্য যে, মোট ৬১ জনের প্রথম ব্যাচে তাঁর সহ-সৈনিকদের মধ্যে ছিলেন শেখ কামাল, আবু মঈন মো. আশফাকুস সামাদ, বীর উত্তম, খন্দকার আজিজুল ইসলাম, বীর বিক্রম, মো. নজরুল ইসলাম ভূঁইয়া বীর প্রতীক মমতাজ হাসান, বীর প্রতীক প্রমুখ।
কমিশন প্রাপ্তির পর মাহবুব-উল-আলম নিয়মিত বাহিনীর অন্তর্ভুক্ত হয়ে ৮ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে যোগদান করেন। তাঁর ইউনিট ব্রিগেড আকারে গঠিত ‘জেড’ ফোর্সের অধীনে পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে বিভিন্ন যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। সেসব যুদ্ধের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য মৌলভীবাজার জেলার কুলাউড়া উপজেলার ফুলতলা-সাগরনাল চা-বাগান যুদ্ধ এবং শ্রীমঙ্গল উপজেলার ভানুগাছ যুদ্ধ। মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারত- বাংলাদেশ সীমান্তে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী অনেকগুলো প্রতিরক্ষা ঘাঁটি স্থাপন করে। নভেম্বর মাসে সীমান্ত সংলগ্ন এলাকা থেকে পাকিস্তানি সেনাদের বিতাড়ন করে সিলেটের দিকে অগ্রসর হওয়ার জন্য মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানি বাহিনীর ঘাঁটিতে ঝটিকা আক্রমণ পরিচালনা করার সিদ্ধান্ত নেন। ৩০শে নভেম্বর মাহবুব-উল-আলম তাঁর সহযোদ্ধাদের নিয়ে ফুলতলা সাগরনাল চা-বাগানে স্থাপিত পাকিস্তানি সেনাঘাঁটি আক্রমণ করেন। এতে পাকবাহিনীর ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয় এবং ফুলতলা ও সাগরনাল চা-বাগানের উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায়। ১লা ডিসেম্বর তাঁর ইউনিট শ্রীমঙ্গল উপজেলার আলীনগর চা-বাগানে পাকিস্তানি সেনাঘাঁটি আক্রমণ করে। দুই পক্ষের মধ্যে প্রচণ্ড যুদ্ধের এক পর্যায়ে পাকিস্তানি বাহিনী পিছু হটে তাদের ভানুগাছ ঘাঁটিতে আশ্রয় নেয়। মাহবুব-উল-আলম ও তাঁর ইউনিটের মুক্তিযোদ্ধারা পাকসেনাদের অনুসরণ করতে থাকেন। সিলেট দখলের জন্য ভানুগাছ থেকে পাকসেনাদের হটানো অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়ে। ডিসেম্বরের ৬ তারিখ মুক্তিযোদ্ধারা ভানুগাছ পাক সামরিক ঘাঁটি আক্রমণ করেন। পাকিস্তানি সেনারাও পাল্টা আক্রমণ করে। শুরু হয় প্রচণ্ড লড়াই। মাহবুব-উল আলম ও তাঁর সহযোদ্ধারা বীরত্ব ও সাহসের সঙ্গে যুদ্ধ করতে থাকেন। এক পর্যায়ে বিপর্যস্ত পাকসেনারা ভানুগাছ থেকে সিলেটের দিকে পালিয়ে যায়।
মহান মুক্তিযুদ্ধে বীরত্ব ও সাহসিকতাপূর্ণ অবদানের জন্য বাংলাদেশ সরকার মাহবুব-উল-আলমকে ‘বীর প্রতীক’ খেতাবে ভূষিত করে (গেজেট নং ২৭৫, খেতাবের সনদ নং ২৫)। মুক্তিযুদ্ধের পর তিনি তাঁর ইউনিট ৮ম বেঙ্গল রেজিমেন্টের সঙ্গে চট্টগ্রাম সেনানিবাসে যোগদান করেন এবং ১৯৮০ সালে লে. কর্নেল পদে উন্নীত হন। ২০০১ সালে তিনি সেনাবাহিনী থেকে অবসর গ্রহণ করে নিজস্ব ব্যবসা পরিচালনা শুরু করেন। ব্যক্তিজীবনে তিনি দুই পুত্র সন্তানের জনক। তাঁর স্ত্রীর নাম বেগম সালমা মাহবুব। [সাজাহান মিয়া]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৮ম খণ্ড