মুক্তিযুদ্ধে মান্দা উপজেলা (নওগাঁ)
মান্দা উপজেলা (নওগাঁ) নওগাঁ জেলা সদরের পশ্চিম দিকে অবস্থিত। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে এখান থেকে ইমাজ উদ্দিন পারমানিক এমপিএ নির্বাচিত হন। পাকবাহিনী ২৫শে মার্চ ঢাকায় নির্বিচারে যে গণহত্যা চালায়, তার বিরুদ্ধে মান্দায় তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। ছাত্র-জনতা মিছিল সমাবেশের মাধ্যমে হত্যার নিন্দা জানায়। এ হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে এবং দেশকে শত্রুমুক্ত করার লক্ষ্যে মান্দায় সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়। ইমাজ উদ্দিন পারমানিক এমপিএ সংগ্রাম পরিষদের নেতা নির্বাচিত হন।
মান্দায় এপ্রিলের শেষদিকে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি ও প্রাথমিক প্রশিক্ষণ শুরু হয়। মুক্তিবাহিনী ও মুজিব বাহিনীর তত্ত্বাবধানে ছাত্র-যুবকদের রিক্রুট করা হয়। ন্যাপ নেতা কছিমুদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বে ন্যাপ, ছাত্র ইউনিয়ন – ও কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যদের গেরিলা বাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা ও বামপন্থী সংগঠক ওহিদুর রহমানের নেতৃত্বে মান্দার অনেক মুক্তিযোদ্ধাকে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। আব্দুল্লাহ আল মামুন-সহ ১১ জনকে নিয়ে গঠিত একটি মুক্তিযোদ্ধা দল মান্দা উপজেলার প্রসাদপুর ইউনিয়নের পুঁজাঘাটি, এনায়েতপুর, খুদিয়া ডাঙ্গা, গণেশপুর ইউনিয়নের দুর্গাপুর, শ্রীতমপুর-সহ বিভিন্ন গ্রামে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ প্রদান করে। মান্দার কিছু মুক্তিযোদ্ধা ভারতের শিলিগুড়ি ও হাফলং (আসাম)-এ প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন।
মান্দায় মুক্তিযুদ্ধের কমান্ডার ছিলেন মোখলেছুর রহমান রাজা। তাঁর নেতৃত্বে এখানে মুক্তিযোদ্ধারা যুদ্ধ করেন। তাছাড়া এখানে মুজিব বাহিনী সক্রিয় ছিল। ওহিদুর রহমানের নেতৃত্বে আত্রাই, রানীনগর, বাগমারা, সিংড়া, নাটোর সদরের কিছু অংশ এবং মান্দায় প্রায় দুহাজার মুক্তিযোদ্ধা প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। মান্দায় তাঁর নামে ওহিদুর বাহিনী গঠিত হয়। মান্দার বিস্তীর্ণ এলাকায় ওহিদুর বাহিনীর ব্যাপক প্রভাব ছিল।
রাজশাহী ও নওগাঁ থেকে দুই দল পাকসেনা ২২শে এপ্রিল কোনো প্রতিরোধের মুখোমুখি না হয়ে মান্দায় অনুপ্রবেশ করে। তারা মান্দা থানায় এবং মৈনম উচ্চ বিদ্যালয়ে ক্যাম্প স্থাপন করে।
মান্দায় শান্তি কমিটি গঠনে প্রধান ভূমিকা ছিল ফয়েজুর রহমান প্রাং মাস্টার, সাখাওয়াত হোসেন, মালা বক্স, মোয়াজ্জম দিয়ারা, আবুল কাশেম, হাবিব রহমান, হবির হাজি (বারিল্যা) প্রমুখের। এরা উপজেলার বিভিন্ন স্থানে গণহত্যা, মুক্তিযোদ্ধাদের বাড়িঘর চিনিয়ে দেয়া ও পাকসেনাদের কাছে স্বাধীনতার পক্ষের লোকজনকে ধরিয়ে দেয়ার ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে।
২৮শে আগস্ট পাকবাহিনী রাজশাহী ও মান্দা থানা থেকে পাকুড়িয়া গ্রামে আসে। গ্রামের স্কুল মাঠে সভার কথা বলে তারা বহু মানুষকে একত্রিত করে। তারপর তাদের ওপর গুলি চালায়। পাকুড়িয়া গণহত্যায় ১২৮ নারী-পুরুষ প্রাণ হারান। বহু বাড়িতে পাকবাহিনী অগ্নিসংযোগ করে। এখানে অনেক নারী পাকবাহিনীর পাশবিক নির্যাতনের শিকার হন। পাকুড়িয়া গ্রামে নিহত ৭৩ জনের পরিচয় পাওয়া গেছে।
পাকবাহিনী ও রাজাকাররা সাতবাড়িয়া ও পারইল গ্রামে গণধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ ও লুটতরাজ চালায়। নভেম্বর মাসের মাঝামাঝি কালিকাপুর বাজারে রাজাকার ও শান্তি কমিটির লোকেরা জোড়পূর্বক ডা. পরেশ-সহ হিন্দু সম্প্রদায়ের ২০ জনকে ধর্মান্তরিত করে।
১৪ই ডিসেম্বর পাকবাহিনী মনোহরপুর গ্রামে আক্রমণ করে। তারা গ্রামের সাধারণ মানুষের ওপর নির্বিচারে গুলি চালায় এবং নির্মম গণহত্যা সংঘটিত করে। মনোহরপুর গণহত্যায় ১৬ জন নিহত হয়।
মান্দা থানা, দেলুয়াবাড়ি ও মৈনম হাইস্কুলে বন্দিশিবির ও নির্যাতনকেন্দ্র ছিল। এখানে পাকবাহিনী ও রাজাকাররা অনেক নিরীহ মানুষকে নির্যাতন করে। মহিলাদের ধরে এনে তাদের ওপর পাশবিক নির্যাতন ও অত্যাচার চালাত।
২৪শে অক্টোবর রাতে মুক্তিযোদ্ধারা মান্দার মৈনম উচ্চ বিদ্যালয়ের পাকসেনাদের ক্যাম্পে আক্রমণ করেন। পাকবাহিনী প্রতি-আক্রমণ করলে দুপক্ষের মধ্যে তীব্র যুদ্ধ হয়। এখানে ৩ জন পাকসেনা নিহত হয়। মুক্তিযোদ্ধা সেলিম চৌধুরী পাকবাহিনীর গুলিতে আহত ও আটক হন। পরে তাঁকে হত্যা করা হয়।
১৬ই আগস্ট মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল্লাহ আল মামুন মান্দার কালিকাপুর গ্রামে শান্তি কমিটির সদস্যদের ওপর গ্রেনেড চার্জ করেন। পরপর দুটি গ্রেনেড চার্জ করা হয়। কিন্তু কোনোটিই বিস্ফোরিত না হওয়ায় মামুন ধরা পড়েন। পরে তিনি শহীদ হন। ১৫ই ডিসেম্বর রাতে পাকবাহিনী মান্দা থেকে পালিয়ে যায় এবং ১৬ই ডিসেম্বর মান্দা হানাদারমুক্ত হয়।
মান্দার শহীদ মুক্তিযোদ্ধারা হলেন- আব্দুল্লাহ আল মামুন (পিতা ডা. নজরুল ইসলাম, নওগাঁ শহর), সেলিম চৌধুরী (মাতা সৈয়দা বেগম, কানাই খালি, নাটোর), ময়েন উদ্দিন সরকার (পিতা তায়েজ সরকার, গ্রাম মৈনম) এবং শহীদ হাসান (মৈনম)।
আব্দুল্লাহ আল মামুন ১৯৭১ সালে রাজশাহী ক্যাডেট কলেজের নবম শ্রেণির ছাত্র ছিলেন। মার্চ-এপ্রিলে মামুন ও তাঁর বড় ভাই মুজাহিদ নওগাঁ ইপিআর ক্যাম্পে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। কালিকাপুরে শান্তি কমিটির সদস্যদের ওপর গ্রেনেড চার্জ করতে গিয়ে শত্রুদের হাতে ধরা পড়লে চরম শারীরিক নির্যাতনের ফলে ২৭শে আগস্ট তিনি শহীদ হন। সেলিম চৌধুরী মুক্তিযুদ্ধের সময় নাটোর নবাব সিরাজউদ্দৌলা কলেজের উচ্চ মাধ্যমিকের ছাত্র ছিলেন। তিনি বালুরঘাট ও শিলিগুড়িতে মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। ২৪শে অক্টোবর মৈনম উচ্চ বিদ্যালয়ে পাকসেনাদের ক্যাম্পে আক্রমণের সময় আহত ও আটকের পর তাঁকে জিপের সঙ্গে বেঁধে টেনে-হিঁচড়ে হত্যা করা হয়।
পাকুড়িয়ায় গণহত্যার শিকার শহীদদের স্মরণে এ গ্রামে একটি স্মৃতিফলক নির্মিত হয়েছে। ১৯৯৬ সালে মনোহরপুর গ্রামে শহীদদের স্মরণে একটি স্মৃতিফলক নির্মিত হয়েছে। ১৯৭৩ সালে শহীদ মামুনের স্মরণে গোট গাড়ি শহীদ মামুন হাইস্কুল ও কলেজ প্রতিষ্ঠা করা হয়। শহীদ মামুন যে স্থানে ধরা পড়েন, সেখানে একটি বাজারের নামকরণ করা হয়েছে মামুন বাজার। নওগাঁ-রাজশাহী সড়কে সবাই হাটের ঠিক আগে একটি মোড় রয়েছে। এই মোড়টি ‘জয় বাংলার মোড়’ নামে পরিচিত। কুসুম্বা গ্রামের পশ্চিমে একটি হাট বসে। এর নাম জয় বাংলার হাট। [এম এম রাসেল]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৮ম খণ্ড