You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.04.21 | মাধবপুর প্রতিরোধযুদ্ধ (মাধবপুর, হবিগঞ্জ) - সংগ্রামের নোটবুক

মাধবপুর প্রতিরোধযুদ্ধ (মাধবপুর, হবিগঞ্জ)

মাধবপুর প্রতিরোধযুদ্ধ (মাধবপুর, হবিগঞ্জ) সংঘটিত হয় ২১-২৮শে এপ্রিল। এতে পাকিস্তানি সেনাদের ২৭০ জনের মতো হতাহত হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যেও বেশ কয়েক জন শহীদ ও অনেকে আহত হন।
সিলেট জেলার সিংহদ্বার হিসেবে খ্যাত মাধবপুর উপজেলা। ঢাকা-সিলেট সড়ক ও রেলপথ মাধবপুরের মধ্য দিয়ে সিলেটে প্রবেশ করেছে। এর থানা সদর ঢাকা-সিলেট সড়কপথের পার্শ্বে এবং বর্তমান ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার সীমান্তবর্তী এলাকায় অবস্থিত। বাংলাদেশের যে-কোনো প্রান্ত থেকে সিলেট যেতে হলে মাধবপুর হয়েই প্রবেশ করতে হয়। তাই যোগাযোগের ক্ষেত্রে মাধবপুরের গুরুত্ব অপরিসীম। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাকবাহিনী সিলেট অঞ্চলে তাদের অবস্থান সুদৃঢ় রাখতে মাধবপুরকে অধিক গুরুত্ব দেয়। অপরদিকে একই বিবেচনায় মুক্তিবাহিনীও যে-কোনো মূল্যে মাধবপুরকে তাদের অধিকারে রাখতে বদ্ধপরিকর ছিল। তাঁরা এখানে একটি শক্ত প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে সচেষ্ট হন। কিন্তু শত চেষ্টা সত্ত্বেও শেষ পর্যন্ত তাঁরা এ অঞ্চলের অধিকার ধরে রাখতে পারেননি।
২৭শে মার্চ মেজর শাফায়াত জামিল কর্তৃক ব্রাহ্মণবাড়িয়া মুক্ত করার পর ঐদিনই মেজর খালেদ মোশাররফ ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় পৌঁছে ব্যাটালিয়নের দায়িত্ব গ্রহণপূর্বক অন্যান্য স্থানের বিদ্রোহী বাঙালি অফিসারদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেন। তখন থেকেই পাকসেনারা এ অঞ্চল নিয়ন্ত্রণে নেয়ার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে। ২৯শে মার্চ ব্রাহ্মণবাড়িয়ার দিকে অগ্রসরমাণ পাঞ্জাবি সৈন্যদের সঙ্গে মেজর খালেদের অগ্রবর্তী সৈন্যদের কোম্পানীগঞ্জে যুদ্ধ হয়। একই দিনে পাকিস্তানি সৈন্যরা ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় বিমান হামলা চালায়। মেজর খালেদ মোশাররফ যে-কোনো পরিস্থিতি মোকাবেলার উদ্দেশ্যে তাঁর সৈন্যদের সুবিন্যস্ত করেন। অতঃপর সার্বিক পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে তাঁর হেডকোয়ার্টার্স প্রথমে মাধবপুর এবং পরে তেলিয়াপাড়া চা বাগানে স্থানান্তর করেন।
তেলিয়াপাড়া হেডকোয়ার্টার্স থেকে ৩নং সেক্টর কমান্ডার মেজর কে এম সফিউল্লাহর নির্দেশে এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে ক্যাপ্টেন নাসিম এবং সুবেদার মান্নান ঢাকা থেকে অগ্রসরমাণ পাকসেনাদের প্রতিরোধকল্পে প্রথমে আশুগঞ্জে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলেন। এপ্রিলের দ্বিতীয় সপ্তাহে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর গানবোট, আর্টিলারি, মর্টার ইত্যাদি দ্বারা আক্রমণের সঙ্গে-সঙ্গে জঙ্গি বিমানগুলোও ব্যাপকভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থানের ওপর হামলা চালাতে থাকে। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর এই ব্যাপক আক্রমণে মুক্তিযোদ্ধারা পিছু হটতে বাধ্য হন। তাঁরা পেছনে সরে এসে শাহবাজপুরে পুনরায় প্রতিরক্ষা গড়ে তোলে। কিন্তু পাকবাহিনী শাহবাজপুরেও আক্রমণ করে। এই আক্রমণে টিকতে না পেরে মুক্তিযোদ্ধারা ১৫ই এপ্রিল মাধবপুরে এসে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অগ্রাভিযানকে রোধ করার সর্বাত্মক চেষ্টা করেন। তাঁরা প্রথমে আশুগঞ্জ ও পরে শাহবাজপুর থেকে পশ্চাদপসরণ করে সেক্টর কমান্ডারের নির্দেশে মাধবপুরে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তোলার ক্ষেত্রে মাধবপুর হচ্ছে বেশ উপযোগী এলাকা। পশ্চিম দিকে কয়েকটি গ্রামের পর হরিণবেড়ের কাছে তিতাস নদীর প্রশস্ত বাঁক। বর্ষাকাল ছাড়া অন্যান্য মৌসুমে শুষ্ক, ভগ্ন এবং তরঙ্গিত। মাধবপুরের পূর্বপাশেও গ্রামের পর গ্রাম ছাড়িয়ে পাহাড় বেষ্টিত আন্তর্জাতিক সীমান্ত। এটি হচ্ছে একটি বিচ্ছিন্ন এবং সংকীর্ণ এলাকা, যেখানে সহজেই প্রতিরোধ যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া যায়।
মুক্তিযোদ্ধারা মাধবপুরে প্রতিরোধ তৈরীর প্রস্তুতিকালে শাহবাজপুরেও একটি অস্থায়ী ব্যবস্থা নেয়া হয়। সেখানকার সেতুটি উড়িয়ে দিয়ে ক্যাপ্টেন মতিনের ইপিআর সৈন্যদের মাধ্যমে গঠিত কোম্পানিকে মোতায়েন করা হয়। মুক্তিযোদ্ধারা পিছু হটে শাহবাজপুর এসে শত্রুসেনাদের অগ্রগতি ঠেকানোর চেষ্টা করেন। ১৫ই এপ্রিল আশুগঞ্জ থেকে আসার পর শত্রুরা ধারণা করেছিল যে, মুক্তিযোদ্ধারা পিছু হটে হয়তো ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় অবস্থান নেবে। তাই দুদিন ধরে তারা ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় গোলাবর্ষণ করে। কিন্তু সেদিক থেকে কোনো সাড়া না পেয়ে তারা তখন শাহবাজপুরের দিকে এগিয়ে যায়। মুক্তিযোদ্ধারা শত্রুপক্ষের আগমন বার্তা পেয়ে শাহবাজপুরে সুদৃঢ় প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তোলেন। তাদের আগমন ঠেকানোর জন্য কেবল মাত্র নিজেদের প্রয়োজনে একটি নৌকা রেখে নদীবক্ষ থেকে সব ধরনের নৌকা সরিয়ে ফেলা হয়।
২১শে এপ্রিল শত্রুরা দুই ব্যাটালিয়ন শক্তি নিয়ে নৌ ও সড়ক পথে এগিয়ে আসে। এর সঙ্গে চলে গোলন্দাজ বাহিনীর গোলাবর্ষণসহ বিমান আক্রমণ। বেপরোয়া বিমান আক্রমণের ফলে মুক্তিযোদ্ধারা সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েন। হানাদারদের এই আক্রমণ প্রতিরোধ করার মতো শক্তি মুক্তিযোদ্ধাদের ছিল না। তাই তাঁরা শত্রুদের অগ্রগতি যতটা সম্ভব বিলম্বিত করে ধীরে-ধীরে পশ্চাদপসরণ করতে থাকেন।
এক পর্যায়ে সোনাই নদীর লাগোয়া এলাকা মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার অন্তর্ভুক্ত হয়। ডান পাশে ক্যাপ্টেন মতিন কৈতরা গ্রামে তাঁর কোম্পানিকে মোতায়েন করেন। ক্যাপ্টেন নাসিম সেতু রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত। তাঁর কোম্পানিকে দেয়া হয় তিনটি ৮২ মিলিমিটার মর্টার। সুবেদার মুজিবুর রহমানকে তাঁর ইপিআর কোম্পানিকে দুটি শাখায় বিভক্ত করে রাস্তার মোড়ে অবস্থান করার নির্দেশ দেয়া হয়। উদ্দেশ্য হচ্ছে ক্যাপ্টেন নাসিম এবং ক্যাপ্টেন মতিনকে সম্ভাব্য ক্ষেত্রে পেছনে ফেরার সুযোগ করে দেয়া। আরো পেছনে লে. মান্নানের নেতৃত্বে হেলিকপ্টারে অবতরণকৃত সৈন্যবিধ্বংসী একটি প্লাটুনকে মোতায়েন করা হয়।
তেলিয়াপাড়া শিবির থেকে প্রেরিত প্রথম ব্যাচ-এর প্রশিক্ষণপ্রাপ্তদের সহ বিভিন্ন উপাদানে গঠিত একটি প্রাটনের নেতৃত্বে লে. মোর্শেদকে পাঠিয়ে দেয়া হয় শাহবাজপুরে শত্রুদের নির্মিত সেতুবন্ধের পরিস্থিতি নির্ণয়পূর্বক আকস্মিকভাবে হানা দেয়ার জন্য। এপ্রিলের ২৬ তারিখ রাতের অন্ধকারে প্লাটুনটি সাফল্যের সঙ্গে অর্পিত দায়িত্ব পালন করে এবং ২৭ তারিখ অপরাহ্ণে মাধবপুরে প্রত্যাবর্তন করে। এ-সময় পাকিস্তান বাহিনীর কিছু সংখ্যক সৈন্য হতাহত হয়। ২৮শে এপ্রিল সকাল ৮টার দিকে মাধবপুরে মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থানে শত্রুদের গোলন্দাজ বাহিনী গোলাবর্ষণ শুরু করে। তারা উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন বিস্ফোরকসহ আগুন বোমার বেপরোয়া ব্যবহার করে। এতে মুক্তিবাহিনীর প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার চারদিকে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড শুরু হয়। শত্রুদের প্রধান অংশ দুপুর ১২টার দিকে মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থান এলাকার সামনে এসে দাঁড়ায়। তারা তিনটি কলামে বিভক্ত হয়ে আক্রমণ করে। একটি কলাম ডান পাশে ক্যাপ্টেন মতিনের কোম্পানিকে, আরেকটি কলাম অগ্রবর্তী দুটি কোম্পানির মাঝামাঝি স্থানের দিকে আক্রমণ চালায়। তৃতীয় কলামটি ক্যাপ্টেন নাসিমের ওপর সামনা-সামনি আক্রমণ করে। এভাবে সূত্রপাত হয় ব্যাটালিয়ানের মুখোমুখি সংঘর্ষ। তার পেছনে অনুসরণ করে আরেকটি পাকিস্তানি ব্যাটালিয়ন। বিশেষভাবে তৈরি পরিখা থেকে মুক্তিবাহিনী এলএমজি, মর্টার এবং রাইফেল নিয়ে আক্রমণ প্রতিহত করে। শুরু হয় ভয়াবহ যুদ্ধ। মুহুর্মুহু গোলা বর্ষণে কেঁপে ওঠে এলাকার আকাশ-বাতাস। এক বিস্তীর্ণ এলাকায় আতঙ্কগ্রস্ত মানুষের কান্না, বাঁচার তাগিদে নিরাপদ আশ্রয়ের লক্ষ্যে ছুটাছুটির কী ভয়ঙ্কর রূপ তার বর্ণনা দিতে গিয়ে আজো মানুষ ভয়ে শিউরে ওঠে।
মাধবপুর প্রতিরোধযুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর মর্টার-ডিটাচমেন্ট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। শত্রুদের মধ্যবর্তী কলাম ক্যাপ্টেন নাসিম এবং ক্যাপ্টেন মতিনের সম্মিলিত অবস্থানে ভাঙ্গন সৃষ্টি করে। কিন্তু তাদের দুটি কোম্পানিই শত্রুদের আক্রমণ ক্ষমতা খর্ব করে দেয়। শত্রুরা প্রচণ্ড ক্ষয়ক্ষতি স্বীকার করেও ডানদিকে অগ্রসরমাণ ক্যাপ্টেন নাসিমের প্লাটুন এবং বামদিকে এগিয়ে যাওয়া ক্যাপ্টেন মতিনের প্লাটুনের মধ্যবর্তী স্থান দিয়ে আংশিকভাবে ভেতরে ঢুকে যায়। তখন বেলা ৩টা, যখন এ কলামটি আরো উত্তর দিকের অভ্যন্তরে আসে এবং ডান পাশের প্রধান সড়কে মোড় নিয়ে ক্যাপ্টেন নাসিমের অবস্থানে আঘাত করে। এ অবস্থায় অগ্রবর্তী দুটি কোম্পানির পারস্পরিক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। আক্রমণকারী সৈন্যদের প্রবল চাপে ক্যাপ্টেন মতিনের বাম পার্শ্বের অবস্থান ভেঙ্গে যায় এবং তাঁর অবস্থান অকেজো হয়ে পড়ে। এ অবস্থায় মুক্তিযোদ্ধারা শত্রু পরিবেষ্টিত হওয়ার আশঙ্কায় সেক্টর কমান্ডার মেজর সফিউল্লাহ তাঁদের পেছনে সরে যাবার নির্দেশ দেন।
মুক্তিবাহিনী তাদের বাঙ্কার ও ট্রেঞ্চের ভেতর থেকে রিকয়েললেস রাইফেল, মেশিনগান, হালকা মেশিনগান, মর্টার, রাইফেল প্রভৃতি অস্ত্রশস্ত্র থেকে পাকিস্তানিদের আক্রমণের যথোপযুক্ত জবাব দিতে থাকে। এ-যুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর মর্টার প্লাটুন বিশেষ ভূমিকা পালন করে। পাকিস্তানিদের কেন্দ্রীয় কলাম মুক্তিবাহিনীর ডান ও বাম প্রান্তের আক্রমণভাগে আঘাত হানতে সক্ষম হয়। মুক্তিবাহিনীর প্রতিরক্ষা ভাগের এই অগ্রগামী আক্রমণকে পাকিস্তান সৈন্যবাহিনী অত্যন্ত কঠিনভাবে মোকাবেলা করে। এই যুদ্ধের পর মুক্তিবাহিনীর ডান ও বাম পাশের মধ্যবর্তী ফাঁকা জায়গায় পাকিস্তানি সৈন্যরা এগিয়ে আসতে সক্ষম হয়। মুক্তিবাহিনী ও পাকিস্তানি বাহিনীর মধ্যবর্তী এই এলাকাটি ছিল মাধবপুর বাজারের দক্ষিণ-পশ্চিম এলাকা।
ক্যাপ্টেন মতিন তাঁর সমস্ত শক্তি দিয়ে ভয়ানক একটি আক্রমণ রচনা করেন। কিন্তু তাঁর রিজার্ভকৃত যুদ্ধ সরঞ্জাম নিঃশেষ হয়ে যাওয়ায় আকস্মিকভাবে তাঁর আক্রমণ থেমে যায়। এ ব্যাপারে তিনি প্রয়োজনীয় সাহায্য চেয়ে ব্যাটালিয়ন সদর দফতরে যোগাযোগের চেষ্টা করেন। কিন্তু বেতার যোগাযোগে প্রতিবন্ধকতা থাকায় যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। ফলে কোনো সাহায্যও পাওয়া যায়নি। এ অবস্থার সুযোগ নিয়ে পাকিস্তানি বাহিনী ক্যাপ্টেন মতিনের পেছনে এসে পড়ে, যে কারণে তাঁর সৈন্য প্রত্যাহার করার মতো সুযোগও ছিল না। তিনি সাঙ্ঘাতিক বিপর্যয়ের মুখোমুখি হয়ে হতবিহ্বল হয়ে পড়েন। কোনো উপায় না দেখে তাঁর বাহিনীর সকল সদস্য নিশ্চিত মৃত্যুর অপেক্ষায় প্রহর গুণতে থকেন। মাত্র কয়েকটি অস্ত্র ব্যবহার করে সীমিত পর্যায়ে গোলাবর্ষণ চালিয়ে যান। এমনি অবস্থায় অলৌকিকভাবে তাঁদের ভাগ্য সুপ্রসন্ন হয়। তাঁরা অকস্মাৎই লক্ষ্য করেন যে, পাকিস্তানি সৈন্যরা পশ্চাদপসরণ করছে। অর্থাৎ তাদের গোলাবারুদও নিঃশেষ হয়ে যাওয়ায় তারাও পশ্চাদপসরণ করতে বাধ্য হয়। দিকবিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে পলায়মান পাকিস্তান বাহিনীর একটি দল ক্যাপ্টেন মতিনের প্রতিরক্ষা অবস্থানে ঢুকে পড়ে। শুরু হয় উভয় পক্ষের মধ্যে হাতাহাতি যুদ্ধ। ক্যাপ্টেন মতিনের কোম্পানির সিপাহি মফিজ এ সময় মারাত্মক সাহসী ভূমিকা রাখেন। তিনি একাই শত্রুদের ১৪ জনকে হতাহত করেন।
কিছুক্ষণের মধ্যে পাকিস্তানি একটি কলাম আরো খানিকটা উত্তর দিকে ঢুকে পড়ে। তারা এবার মেইন রোডে আঘাত হানে। ফলে সেখানে ক্যাপ্টেন নাসিমের প্রতিরক্ষা অবস্থানের অংশের সঙ্গে সংঘর্ষ শুরু হয়। এক পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধাদের এই অংশটি দুই ভাগে বিভক্ত এবং পাস্পরিক বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এ-সময় পাকিস্তানিদের অপর একটি অংশ মুক্তিবাহিনীর দক্ষিণভাগে আক্রমণ করে। মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানি সেনাদের একটি বেষ্টনীতে আটকা পড়ে যান। এ অবস্থায় লেফটেন্যান্ট মোর্শেদ অত্যন্ত বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে তাঁর রিজার্ভে রাখা প্লাটুন নিয়ে আলীনগর গ্রামের দিক থেকে পাকিস্তানিদের অবস্থানের পেছন দিকে প্রচণ্ড আক্রমণ রচনা করেন। পাকবাহিনী এ আক্রমণে অপ্রস্তুত হয়ে পিছু হটলে মুক্তিযোদ্ধারা পাকবাহিনীর বেড়াজাল থেকে বেড়িয়ে আসতে সক্ষম হন।
পাকিস্তানি সেনাদের চতুর্মুখী আক্রমণে শত চেষ্ঠার পরও মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরোধ টিকিয়ে রাখা সম্ভব হয়নি। ২৮শে এপ্রিল বিকেল ৪টায় শত্রুরা মাধবপুরে তাদের দখল প্রতিষ্ঠা করে। মুক্তিযোদ্ধারা মাধবপুরের পূর্বদিক দিয়ে মৌজপুরের পাশ দিয়ে পশ্চাদপসরণ করে তেলিয়াপাড়া হেডকোয়ার্টার্সে এসে পরবর্তী আক্রমণের প্রস্তুতি নেন। মাধবপুর পতনের ফলে এ অঞ্চলে মুক্ত এলাকার পরিধি ক্ষুদ্র হয়ে পড়ে। তখন মুক্ত এলাকা বলতে উত্তরে শ্রীমঙ্গল থেকে শায়েস্তাগঞ্জ হয়ে দক্ষিণে তেলিয়াপাড়া, মনতলা, মুকুন্দপুর ও সিঙ্গারবিল পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল।
এ-যুদ্ধে মুক্তিবাহিনী অসীম সাহস এবং দৃঢ়তার পরিচয় দেয়। এক্ষেত্রে ক্যাপ্টেন নাসিম, ক্যাপ্টেন মতিন, লে. মোর্শেদ, সুবেদার নূরুল আজিম চৌধুরী, সুবেদার আব্দুল করিম, হাবিলদার কেরামত, হাবিলদার মোহাম্মদ আরশাদ, হাবিলদার মোহাম্মদ মনীর, ল্যান্স নায়েক মান্নান, সিপাহি মফিজ, শাহজাহান (শহীদ), খায়রুজ্জামান, ওয়াহেদ প্রমুখের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এ-যুদ্ধে পাকিস্তানি সেনাদের ২৭০ জনের মতো হতাহত হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যেও বেশ কয়েক জন শহীদ ও অনেকে আহত হন। [মুহম্মদ সায়েদুর রহমান তালুকদার]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৭ম খণ্ড