মুক্তিযুদ্ধে মাদারীপুর সদর উপজেলা
১৯৭১ সালের ১লা মার্চ পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত ঘোষণা করলে মাদারীপুরের ছাত্র-জনতা এর প্রতিবাদে শহরে বিশাল বিক্ষোভ মিছিল বের করে। মিছিলটি সারা শহর প্রদক্ষিণ করে। ২রা মার্চ ছাত্রনেতা শাজাহান খান (বর্তমান নৌপরিবহণ মন্ত্রী)-এর নেতৃত্বে ছাত্ররা নাজিমউদ্দিন কলেজ প্রাঙ্গণে পাকিস্তানের পতাকা পুড়িয়ে দেন। ৪ঠা মার্চ কলেজ প্রাঙ্গণে ছাত্র-জনতSavedশে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয়।
৭ই মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানের জনসভায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান- ঘোষণা করেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। এ ঘোষণার পর বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে সারাদেশে চলমান অসহযোগ আন্দোলন তীব্রতর হয়। মাদারীপুরে স্থানীয় আওয়ামী লীগ এর নেতৃত্বে এ আন্দোলন পরিচালিত হয়। আওয়ামী লীগের সভাপতি আসমত আলী খান এমপিএ আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন। এ-সময় মাদারীপুরে ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিলেন সরওয়ার হোসেন মোল্লা, শাজাহান খান, সরদার সাজাহান, হাবিবুর রহমান আজাদ, আব্দুল মোতালেব মিয়া, হাবিবুর রহমান সূর্য (মুক্তিযুদ্ধে শহীদ), মাহবুব সাঈদ (মুক্তিযুদ্ধে শহীদ), জিলুর রহমান, হারুনর-রশিদ নীরু হাওলাদার, হাবিবুল হক খোকন, হারুন-অর- রশিদ মোল্লা, সিরাজুল ইসলাম (বাচ্চু ভূঁইয়া) প্রমুখ। এঁদের নেতৃত্বে একটি ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতৃত্বে ১০ই মার্চ জয় বাংলা বাহিনী গঠিত হয়। এ বাহিনীকে প্রশিক্ষণ দেয়ার জন্য ছাত্রনেতা সরওয়ার হোসেন মোল্লাকে আহ্বায়ক করে একটি কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির সদস্যদের মধ্যে ছিলেন সরদার সাজাহান, শাজাহান খান, হাবিবুর রহমান আজাদ, জলিল বেপারী, হাবিবুল হক খোকন, মাহবুব সাঈদ, আব্দুল মোতালেব মিয়া, চান মিয়া মাতব্বর, বাকী মিয়া, হাবিবুর রহমান সূর্য, বদিউজ্জামান বদু (মুক্তিযুদ্ধে শহীদ), সিরাজুল ইসলাম (বাচ্চু ভূঁইয়া), আবদুল জলিল, হারুনর-রশিদ নীরু হাওলাদার, সানু প্রমুখ।
বঙ্গবন্ধুর ভাষণের পর আন্দোলন পরিচালনার জন্য আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে একটি সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। ২৫শে মার্চ রাতে পাকিস্তান সেনাবাহিনী বাঙালি নিধনে অপারেশন সার্চলাইট নামে মানব ইতিহাসে জঘন্যতম গণহত্যার নীলনক্সা বাস্তবায়ন শুরু করে। এর পরিপ্রেক্ষিতে ২৬শে মার্চ প্রথম প্রহরে পাকসেনাদের হাতে বন্দি হওয়ার পূর্বে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। এ ঘোষণা সঙ্গে-সঙ্গে ইপিআর-এর ওয়ারলেস ট্রান্সমিশন থেকে সারাদেশে প্রচারিত হয়। বঙ্গবন্ধুর ঘোষণা অনুযায়ী সমগ্র বাঙালি জাতি ‘যার যা আছে তাই নিয়ে’ হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। বাঙালিদের হাতে তখন তেমন কোনো অস্ত্র ছিল না। তাদের যুদ্ধেরও প্রশিক্ষণ ছিল না। তাই সারাদেশে ছুটিতে বাড়িতে আসা এবং অবসরপ্রাপ্ত বাঙালি সৈনিক, ইপিআর ও পুলিশ সদস্যদের প্রশিক্ষক নিয়োগ করে হাটে-মাঠে-বন্দরে প্রশিক্ষণ কার্যক্রম শুরু হয়। ঢাকায় গণহত্যার পর সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ ও ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ জরুরি বৈঠকে বসে। বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুসারে ২৭শে মার্চ থেকে নাজিমউদ্দিন কলেজ মাঠে ছাত্র-যুবকদের নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের সামরিক প্রশিক্ষণ শুরু হয়। সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ ও ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতৃত্বে এ প্রশিক্ষণ চলে। প্রথমে প্রশিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেন নাজিমউদ্দিন কলেজের প্রধান করণিক মো. খলিলুর রহমান। মার্চের শেষদিকে প্রশিক্ষক হিসেবে যোগ দেন ছুটিতে বাড়ি আসা বিমান বাহিনীর সদস্য আলমগীর হোসাইন ও মতিয়ার রহমান হাওলাদার। সেনাবাহিনীর সুবেদার আবদুল হকও প্রশিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেন। ৩০শে মার্চ প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে যোগ দেন ক্যাপ্টেন শওকত আলী এবং স্টুয়ার্ড মুজিবর রহমান। এ দুজনই ঐতিহাসিক আগরতলা মামলার আসামি ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য মিলন সিনেমা হলের পেছনে একটি নিয়ন্ত্রণ কক্ষ খোলা হয়। গোপন ও গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ সভাগুলো এখানে অনুষ্ঠিত হতো। ডা. রকিব উদ্দিন এবং বাদল ভূঁইয়া সার্বক্ষণিকভাবে নিয়ন্ত্রণ কক্ষে দায়িত্ব পালন করতেন। নিয়ন্ত্রণ কক্ষ পরিচালনার সার্বিক দায়িত্বে ছিলেন আওয়ামী লীগ নেতা আব্দুল মান্নান ভূঁইয়া। আসমত আলী খান এমপিএ-র সভাপতিত্বে নিয়ন্ত্রণ কক্ষে অনুষ্ঠিত এক সভায় গৃহীত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ক্যাপ্টেন শওকত আলীকে মাদারীপুর মহকুমার মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য সামরিক ইউনিটের প্রধান নিয়োগ করা হয়। এরপর পুরোদমে চলতে থাকে প্রশিক্ষণ। মাদারীপুর মহকুমার এসডিও সৈয়দ রেজাউল হায়াত প্রশিক্ষণের জন্য সরকারি ট্রেজারি থেকে কয়েকটি রাইফেল সরবরাহ করেন। এক সময় প্রশিক্ষণের জন্য আরো বন্দুকের প্রয়োজন হয়। তখন নাজিমউদ্দিন কলেজের রোভার স্কাউটের কিছু ডামি বন্দুক প্রশিক্ষণে ব্যবহার করা হয়।
এক পর্যায়ে ক্যাপ্টেন শওকত আলী ও স্টুয়ার্ড মুজিব ভারতে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি এম এ জি ওসমানী – এবং ২নং সেক্টর কমান্ডার মেজর খালেদ মোশাররফ, বীর উত্তম-এর সঙ্গে আলোচনা করে প্রথম ব্যাচে ১৫০ জন ছাত্র- যুবকের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেন। এরপর ১৬ই এপ্রিল নাজিমউদ্দিন কলেজ মাঠে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণেচ্ছু ছাত্র- যুবকদের সমবেত হওয়ার জন্য আহ্বান জানানো হয়। এ উদ্দেশ্যে প্রতিনিধি হিসেবে ছাত্রনেতা শাজাহান খান নড়িয়া থানায়, হাবিবুল হক আকন জাজিরা থানায়, মাহবুব সাঈদ ভেদরগঞ্জ থানায়, জলিল বেপারী ও সিরাজুল ইসলাম (বাচ্চু ভূঁইয়া) কালকিনি থানায়, চৌধুরী মুজিবর রহমান পান্না শিবচর থানায় এবং সরদার সাজাহান রাজৈর থানায় গেলে প্রত্যেক থানায় ব্যাপক সাড়া মেলে। নির্ধারিত দিনে সমবেত প্রায় আড়াইশ ছাত্র- যুবকের মধ্য থেকে ১৬৫ জনকে চূড়ান্তভাবে বাছাই করা হয়। নাজিমউদ্দিন কলেজে রাত্রি যাপনের পর ১৭ই এপ্রিল ভোরে স্টুয়ার্ড মুজিব সালমা ওয়াটারওয়েজ কোম্পানির একটি লঞ্চে করে তাঁদের নিয়ে মাদারীপুর থেকে চাঁদপুর নীলকমল ঘাটের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। মাদারীপুরের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এটি ছিল একটি ঐতিহাসিক অভিযাত্রা।
সামরিক প্রশিক্ষণ গ্রহণের জন্য মাদারীপুর মহকুমার নয়টি থানা থেকে নির্বাচিত ১৬৫ জনের মধ্যে মাদারীপুর সদর থেকে ছিলেন ৬৯ জন। তাঁরা হলেন- খলিলুর রহমান খান, সিরাজুল ইসলাম (বাচ্চু ভূঁইয়া), কাজী মাহাবুব আহামেদ (মিলন কাজী), মো. আনোয়ার হোসেন কাঞ্চন, মো. বেলায়েত হোসেন মানিক, মো. হাবিবুল হক খোকন, সাজেদুল হক চুন্নু, আবদুল হাই মোড়ল, মো. নাসির উদ্দিন জমাদার, তসলিম আহমেদ হাওলাদার, আব্দুল হাই হাওলাদার, এফ এম জাহাঙ্গীর হোসেন, শেখ বজলুর রশিদ, মজিবর রহমান হাওলাদার, এস এম হারুন-উর-রশিদ, কাজী মফিজুল আলম (কামাল কাজী), কাজী আলী হোসেন, মো. মোনাচ্ছেফ হোসেন শরীফ, আবুল বাশার চৌধুরী, মো. হারুন-অর-রশিদ (কেন্দুয়া), গৌরাঙ্গ চন্দ্র বিশ্বাস, নগেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, মো. আতিয়ার রহমান খান, আব্দুস ছালাম হাওলাদার, আসমত আলী বয়াতি, আমির হোসেন চৌধুরী, আব্দুর রব বেপারী, আব্দুল গফুর খান, মো. সেকান্দার আলী চৌধুরী, টি এম শহীদুল্লাহ রাজা, ডা. কাঞ্চন, সেলিম, কাজী আতিয়ার রহমান, ওয়াজেদ আলী খান, মো. শাহজাহান, বদিউজ্জামান (বাদল), আশরাফ হোসেন হাওলাদার, আব্দুল মান্নান হাওলাদার, আব্দুস সালাম, মো. লুৎফর রহমান, আব্দুর রহমান হাওলাদার, মুজাম্মেল হক (মুজাম), লোকমান হোসেন শরীফ, মতিয়ার রহমান মাতুব্বর, আব্দুল জলিল বেপারী, আলমগীর হোসেন (তোতা জমাদার), আব্দুল করিম হাওলাদার, সাহাবুদ্দিন ভূঁইয়া (খোকন), আব্দুল মান্নান, আব্দুল জলিল মাতুব্বর, চিত্তরঞ্জন মণ্ডল, হারুন হাওলাদার, জিয়াউল আলম বাদল, মো. জহিরুল হক (বিশু), মো. খন্দকার ওয়াহিদ, কাজী আব্দুল হক, মো. আবু বকর সিদ্দিক, মো. জাহাঙ্গীর হোসেন (বাবুল), আব্দুল হান্নান হাওলাদার, মো শহিদুল আলম (সোহরাব), সৈয়দ আফজাল হোসেন (দবির), অনীল চন্দ্র দাস, শ্যামল কুমার কর্মকার, মো. সাইদুর রহমান (মনু), মো. মনিরুজ্জামান (মনি), মো. আক্তার হোসেন হাওলাদার, মো. জামাল ভূঁইয়া (চরমুগরিয়া) এবং মো. শাহজাহান মনি। এ দলটি ২৩শে এপ্রিল ত্রিপুরা রাজ্যের বেলুনিয়া সীমান্ত দিয়ে ভারতে প্রবেশ করে। আগরতলার কাঠালিয়া ক্যাম্পে ৭ দিন প্রশিক্ষণের পর এঁদের আসামের অম্পিনগর ক্যাম্পে স্থানান্তর করা হয়। সেখানে প্রশিক্ষণ সমাপ্ত করে ২৮শে মে খলিলুর রহমান খানের নেতৃত্বে ২০ জন মুক্তিযোদ্ধার একটি সশস্ত্র দল সর্বপ্রথম মাদারীপুরে প্রবেশ করে।
মাদারীপুর সদর উপজেলায় মুক্তিযুদ্ধের শীর্ষস্থানীয় সংগঠকরা হলেন— আসমত আলী খান এমপিএ, ফণী ভূষণ মজুমদার এমপিএ, ফজলুর রহমান খান, আলী আহম্মেদ খান (খাগদি), ডা. এ এ কাশেম এমএনএ, ডা. সিরাজুল হক তোতা, ডা. এম এ মান্নান (চরমুগরিয়া), আব্দুর রাজ্জাক তালুকদার, এ টি এম নুরুল হক খান, আব্দুল মান্নান শিকদার (খোয়াজপুর ইউনিয়ন), মতিউর রহমান চৌধুরী, নূর মহম্মদ, আমিন উদ্দিন দফাদার (ছিলারচর ইউনিয়ন), আকরাম মাস্টার, আনোয়ার হোসেন ফরাজী (কালিকাপুর ইউনিয়ন), আজাহার আকন্দ, আব্দুল খালেক খান, নুরুল হক হাওলাদার, মালেক হাওলাদার (পাঁচখোলা ইউনিয়ন), আব্দুস সামাদ দরবারী, হাবিবুর রহমান মোল্লা (ধুরাইল ইউনিয়ন), আব্দুল খালেক হাওলাদার, করিম মাতুব্বর, ভালু পোদ্দার (শিরখাড়া ইউনিয়ন), আব্দুল মান্নান মোল্লা, মধুসূদন সাহা, আব্দুল লতিফ খান, ডা. কানাই লাল শীল, এডভোকেট মজিবর রহমান খান, এরফান মাতুব্বর, আব্দুর রহমান হাওলাদার, আব্দুস ছাত্তার বেপারী, আব্দুর রশিদ মাতুব্বর, মোফাজ্জেল শিকদার (দুধকালী ইউনিয়ন), মো. হাসেম চৌধুরী, জালাল উদ্দিন জমাদ্দার, বাদশা বেপারী (রাস্তি ইউনিয়ন), খোরশেদ আলম মৃধা, সামসুল হক মোল্লা (মোস্তফাপুর ইউনিয়ন), আব্দুল মালেক হাওলাদার, যতীশ পুইস্তা, সূর্যকান্ত ভক্ত, বৈকুণ্ঠ ভক্ত, বেনী বাড়ৈ, কেস্ট বৈদ্য, সর্বেশ্বর বৈদ্য, হরেন্দ্রনাথ বৈদ্য (কেন্দুয়া ইউনিয়ন), জিনাত আলী খান (ঘটমাঝি ইউনিয়ন), আব্দুল আজিজ হাওলাদার (ঝাউদি ইউনিয়ন) প্রমুখ।
মাদারীপুর সদর উপজেলায় মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারদের মধ্যে ছিলেন স্টুয়ার্ড মুজিবর রহমান (মাদারীপুর মহকুমা কমান্ডার, মুক্তি বাহিনী), শাজাহান খান (সহকারী মহকুমা কমান্ডার, মুজিব বাহিনী), আলমগীর হোসাইন (১নং এরিয়া কমান্ডার, মুক্তি বাহিনী), মতিয়ার রহমান হাওলাদার (মাদারীপুর থানা কমান্ডার, মুক্তি বাহিনী; ৮নং সেক্টর কর্তৃক নিযুক্ত), খলিলুর রহমান খান (মাদারীপুর থানা কমান্ডার, মুক্তি বাহিনী; ২নং সেক্টর কর্তৃক নিযুক্ত), হারুন-অর-রশিদ, নীরু হাওলাদার (মাদারীপুর থানা কমান্ডার, মুজিব বাহিনী), তসলিম আহমেদ হাওলাদার (প্লাটুন কমান্ডার, মুক্তি বাহিনী), হুমায়ুন কবীর মোল্লা (প্লাটুন কমান্ডার, মুক্তি বাহিনী), এস এম হারুন-উর-রশিদ (প্লাটুন কমান্ডার, মুক্তি বাহিনী), গোলাম মাওলা (প্লাটুন কমান্ডার, মুক্তি বাহিনী), আব্দুস সালাম হাওলাদার (প্লাটুন কমান্ডার, মুজিব বাহিনী), সিরাজুল ইসলাম বাচ্চু ভূঁইয়া (প্লাটুন কমান্ডার, মুজিব বাহিনী) এবং মো. শাহজাহান হাওলাদার (অপারেশনাল কমান্ডার, মুজিব বাহিনী) মাদারীপুর সদর উপজেলায় খলিল বাহিনী নামে একটি স্থানীয় মুক্তিবাহিনী ছিল। কমান্ডার খলিলুর রহমান খানের নেতৃত্বে গঠিত এ বাহিনী এলাকায় একাধিক যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে।
২২শে এপ্রিল পাকবাহিনী মাদারীপুর শহরে বিমান হামলা চালায়। এর দুদিন পর ২৪শে এপ্রিল তারা মাদারীপুর শহরে অনুপ্রবেশ করে। স্থানীয় কয়েকজন স্বাধীনতাবিরোধী টেকেরহাট বন্দরে গিয়ে তাদের অভ্যর্থনা জানায়। পাকবাহিনী ইটেরপুলস্থ এ আর হাওলাদার জুট মিলস্-এর একটি ভবনে ক্যাম্প স্থাপন করে।
২৪শে এপ্রিল মাদারীপুর শহরের পতনের পর ২৬শে এপ্রিল মাদারীপুর কোর্ট মসজিদের ইমাম মাওলানা আব্দুল সাত্তার ইসলামাবাদীকে আহ্বায়ক করে শান্তি কমিটি গঠিত হয়। এর সদস্য ছিল আব্দুল হামিদ খন্দকার (কনভেনশন মুসলিম লীগ), মহিউদ্দিন খন্দকার ( জামায়াতে ইসলামী), এডভোকেট জাহাঙ্গীর উকিল (জামায়াতে ইসলামী), আব্দুল খালেক মোক্তার, আব্দুল খালেক চৌধুরী, আব্দুর রহমান হাওলাদার (মুসলিম লীগ), ডা. সালাউদ্দিন খান, গোলাপ খান, লুৎফর রহমান হাওলাদার, আব্দুর রাজ্জাক হাওলাদার, মুছাই মোল্লা, হায়দার বক্স মোল্লা, কালাম বেপারী, হামিদ সরদার, আব্দুস সাত্তার আকন, আব্দুল জব্বার হাওলাদার, আব্দুল কাদের মিয়া, আমির আলী মোক্তার, আব্দুর রশিদ খান, আনোয়ার উকিল, ফয়জর হাওলাদার, মোস্তফা মৌলভী, ছয়জদ্দিন মোক্তার, মুজাহার মুন্সী, সামচু মোক্তার, এডভোকেট আব্দুল হাকিম, আলী আহম্মেদ খাঁ, ডা. মজিবর রহমান (কেন্ট হোমিও হল), আব্দুল আজিজ হাওলাদার, মীর মজিদ মোক্তার, আব্দুর রশিদ কাজী, আব্দুল খালেক তালুকদার (মুসলিম লীগ), শামসুল হক তালুকদার (মুসলিম লীগ) প্রমুখ। এদের দ্বারা পরে রাজাকার বাহিনীও গঠিত হয়। আলবদর কমান্ডার ছিল ডা. জাফল উল্লাহ দাদন, রাজাকার বাহিনীর মাদারীপুর মহকুমা কমান্ডার ছিল রুহুল আমিন খান।
মাদারীপুরে লুটের সম্রাট হিসেবে কুখ্যাত মুন্সী আবু বকর (সিদ্দিকের (আবু মুন্সী) নেতৃত্বে এপ্রিল, মে ও জুন মাসে চরমুগরিয়া বন্দর, হাজরাপুর, মিঠাপুর ও কুমড়াখালি গ্রামে হিন্দুদের বাড়িঘরে ব্যাপক লুটপাট চালানো হয়। ২২শে এপ্রিল পাকিস্তানি বিমান হামলার পর মাদারীপুর শহরের অনেক হিন্দু ব্যবসায়ী মূল্যবান মালামাল, স্বর্ণালঙ্কার ও টাকা- পয়সাসহ পরিবার-পরিজন নিয়ে নৌকায় মিঠাপুর এলাকার দিকে রওনা হন। নৌকাগুলো হাজরাপুরের কাছে পৌঁছলে ১০-১২টি নৌকায় চড়ে আবু মুন্সী দলবল নিয়ে তাঁদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং সব মালামাল, সোনা-দানা ও টাকা-পয়সা লুট করে নিয়ে যায়।
আবু মুন্সীর নেতৃত্বে হিন্দু অধ্যুষিত কুমড়াখালি গ্রামেও লুটপাট চালানো হয়। রাজাকাররা কুমারটেকে বিনোদ চন্দ্র সাহা ও ঘাঘর চন্দ্র সাহাসহ অনেকের বাড়িতে লুটপাট চালায়। তারা চরমুগরিয়া কালি মন্দিরের সকল টিন লুট করে নেয়। আবু মুন্সী চরমুগরিয়ার স্বর্ণকার পট্টিতে ও খাগদী কুণ্ডু বাড়িতে লুটপাটে নেতৃত্ব দেয়। এ-কাজে তার সহযোগী ছিল আপন ভাই ধলু মুন্সী ও গামা হাবিবসহ অনেকে।
২৫শে এপ্রিল জব্বার হাওলাদারের সহযোগিতায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনী কুলপদ্দী গ্রামের দোলখোলায় ১৬ জন মানুষকে গুলি করে হত্যা করে। একই দিন তারা নমোপাড়ার ঘুলিরপাড়ে ১১ জনকে গুলি করে হত্যা করে। এ ঘটনা কুলপদ্দী গণহত্যা নামে পরিচিত।
এপ্রিল মাসের শেষভাগে রাস্তি ইউনিয়নের লক্ষ্মীগঞ্জ এলাকার জালাল উদ্দিন জমাদার ও আবুল হাসেম চৌধুরীর বাড়িতে স্থানীয় রাজাকাররা ব্যাপক ভাংচুর ও লুটপাট চালায়। এ মাসেই পেয়ারপুর পৌর অংশের অধিবাসী স্কুল শিক্ষক ঘাগর চন্দ্র সাহা ও ব্রজ গোপাল সাহার বাড়িতে লুটপাট হয়। লুটপাটে নেতৃত্ব দেয় কুখ্যাত আবু মুন্সী ও তার সহযোগীরা। পাকিস্তানি বাহিনী ২০শে মে ও ২৭শে জুলাই দুদফা হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ উত্তর দুধখালী ও মিঠাপুর গ্রামে অভিযান চালিয়ে নৃশংস গণহত্যা, অগ্নিসংযোগ ও ব্যাপক লুটপাট চালায়। এ- সময় তারা শতাধিক মানুষকে হত্যা করে সাহাবাড়ির কাছে গণকবর দেয়। এ ঘটনা দুধখালী ও মিঠাপুর গণহত্যা নামে পারিচিত।
২৩শে মে পাকিস্তানি সেনারা ছিলারচর ইউনিয়নের চরলক্ষ্মীপুর গ্রামে লক্ষ্মণ নামে এক ব্যক্তিকে গুলি করে হত্যা করে। ঐদিন তারা আজিজুর রহমান বাদশা হাওলাদারের ৫টি ঘর ও লক্ষ্মীপুর গ্রামের সেকেন্দার চৌধুরী, আউয়াল চৌধুরী ও হামিদ চৌধুরীর বাড়ি আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়। সেপ্টেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহে মুক্তিযোদ্ধারা চোকদার ব্রিজ ধ্বংস করে দিলে পাকবাহিনী এখানে নির্বিচারে গুলি চালায়। এতে আবুল হাসেম চোকদার, হারুনুর রশিদ বেপারী, তসলিম হাওলাদার ও আবদুস সামাদ দর্জি শহীদ হন। স্থানীয় রাজাকার বাহিনী মোস্তফাপুর ইউনিয়নের ছোটো বাড্ডা গ্রামের নিত্যানন্দ সাহা ও আমবাড়ি গ্রামের হাজী রুপাই হাওলাদারের বাড়ি পুড়িয়ে দেয়।
২৫শে মে পাকসেনা ও রাজাকাররা ঘটমাঝি গ্রামের পালপাড়া ও সংলগ্ন এলাকার প্রায় ৯০টি ঘর আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়। পাকসেনারা শরৎ পালকে গুলি করে হত্যা করে এবং তাদের দোসররা পাঁচখোলা গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা চিত্তরঞ্জন মণ্ডলের বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে। রাজাকাররা বডুবিবি নামে একজন মহিলাকে ধরে নিয়ে যায়।
১৪ই আগস্ট উকিলবাড়ি গণহত্যা সংঘটিত হয়। মাদারীপুর-মস্তফাপুর রোডের পাশের গ্রাম উকিলবাড়িতে এ গণহত্যা সংঘটিত হয়। এতে ১৭ জন সাধারণ মানুষ শহীদ হন। আগস্ট মাসের মধ্যভাগে ঝাউদি ইউনিয়নের হোগলপাতিয়া এলাকার আড়িয়াল খাঁ নদে গানবোটে অবস্থান করে পাকবাহিনী গ্রামাবাসীদের লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে। এতে হোগলপাতিয়া গ্রামের নিজামউদ্দিন খান ও ইস্কান্দার তালুকদার শহীদ হন।
পাকবাহিনী ও তাদের দোসররা ২রা সেপ্টেম্বর ছিলারচরের চৌধুরীহাটে পানবিক্রেতা লক্ষ্মণ দাসকে গুলি করে হত্যা করে। পাঁচখোলা ইউনিয়নের আবদুল জলিল বেপারীকে (পিতা গয়জদ্দিন বেপারী) রাজাকাররা বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে হত্যা করে। পাকবাহিনীর গুলিতে নিহত হন মোস্তফাপুর গ্রামের মাজেদ খান ও জাহাঙ্গীর হোসেন খান। সমাদ্দার ব্রিজসংলগ্ন হিন্দু অধ্যুষিত গ্রামগুলোতে রাজাকার ও পাকসেনারা ব্যাপক লুটপাট চালায় এবং অগ্নিসংযোগ করে।
২রা নভেম্বর পাকবাহিনী ও রাজাকাররা হামলা চালিয়ে কেন্দুয়া ইউনিয়নের বাহাদুরপুর, কলাগাছিয়া ও চৌহদ্দি গ্রামের শতাধিক লোককে হত্যা করে। এ ঘটনা বাহাদুরপুর-কলাগাছিয়া-চৌহদ্দি গণহত্যা নামে পরিচিত। বিভিন্ন জায়গা থেকে অসংখ্য স্বাধীনতাপ্রিয় সাধারণ মানুষ ও মুক্তিযোদ্ধাকে ধরে এনে এ আর হাওলাদার জুট মিলস্-এ নির্যাতনের পর হত্যা করা হয়। হত্যার পর লাশগুলো মিল এলাকায়ই কবর দেয়া হয়। এ কারণে এটি ‘এ আর হাওলাদার জুট মিলস্ নির্যাতনকেন্দ্র বধ্যভূমি ও গণকবর’ হিসেবে পরিচিত।
মাদারীপুর সদর উপজেলায় নির্যাতিত বীরাঙ্গনাদের দুজন হলেন কানন বালা সাহা (পেয়ারপুর, আশ্রয়ণ কেন্দ্ৰ, মাদারীপুর) এবং সোনাই মালো (চতুরপাড়া, মোস্তফাপুর)। এছাড়া আরো রয়েছেন মাদারীপুর সদর থানার কালিকাপুরের দুজন এবং মাদারীপুর পৌরসভার খাগদি গ্রামের এক কিশোরী।
মাদারীপুর সদর উপজেলায় এ আর হাওলাদার জুট মিলস্- এর একটি দ্বিতল ভবন ছিল পাকবাহিনীর নির্যাতনকেন্দ্র ও বন্দিশিবির।
মাদারীপুর সদর উপজেলায় তিনটি গণকবর রয়েছে আর হাওলাদার জুট মিলস্ গণকবর, মিঠাপুর সাহাবাড়ি গণকবর ও চরকুলপদ্দী নমোপাড়া গণকবর।
মাদারীপুর সদর উপজেলায় জুন থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মুক্তিযোদ্ধারা পাকবাহিনী ও তাদের দোসরদের ওপর বেশ কয়েকটি গেরিলা হামলা চালান। সেগুলোর মধ্যে ইটের পুল বিদ্যুৎ কেন্দ্র অপারেশন চরমুগরিয়া পাটগুদাম অপারেশন, উকিলবাড়ি ব্রিজ অপারেশন মাদারীপুর ৯নং ব্রিজ অপারেশন, চোকদার ব্রিজ অপারেশন, কলাবাড়ি ব্রিজ যুদ্ধ, ঘটকচর হাইস্কুল রাজাকার ক্যাম্প অপারেশন, কমলাপুর ও কলাগাছিয়া যুদ্ধ, মস্তফাপুর বড়ব্রিজ যুদ্ধ, কলাবাড়ি যুদ্ধ এবং সমাদ্দার ব্রিজ যুদ্ধ উল্লেখযোগ্য। ১০ই ডিসেম্বর মাদারীপুর সদর উপজেলা হানাদারমুক্ত হয়।
মাদারীপুর সদর উপজেলার শহীদ মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে যাঁদের নাম জানা গিয়েছে, তাঁরা হলেন- সরোয়ার হোসেন বাচ্চু (পিতা আব্দুর রব শরীফ, কলেজ রোড, মাদারীপুর শহর), মানিক শরীফ (পিতা গগন শরীফ, কলেজ রোড, মাদারীপুর শহর), মো. নুর ইসলাম মোল্লা (পিতা নাজেম মোল্লা, ভদ্রখোলা, ঘটমাঝি), রইস উদ্দিন (পিতা হাচেন উদ্দিন, বাহাদুরপুর), রমিজ উদ্দিন শেখ (পিতা চাঁন খালাসী, কোটবাড়ি), ক্যাপ্টেন আবুল কালাম (পিতা নাজির আহমেদ, চরমুগরিয়া), হায়াত আলী (পিতা লাল মিয়া, শ্রীনদী), গোলাম মোর্তজা বেপারী (পিতা আজিম উদ্দিন বেপারী, রায়েরকান্দি), মাহবুব সাঈদ (পিতা মাজহারুল হক, শহীদ সাঈদ সড়ক, মাদারীপুর শহর), হাবিবুর রহমান সূর্য (পিতা এ কে এম লতিফুর রহমান, চরমদন রায়, মাদারীপুর পৌরসভা সংলগ্ন বটতলা), সিপাহি মো. হাবিবুর রহমান (পিতা মো. আদিল উদ্দিন, পূর্ব শহরালি), তোরাব উদ্দিন ভূঁইয়া (পিতা মো. কালাই ভূঁইয়া, খাটপাড়া, হুগলি), মো. আব্দুল মান্নান সরদার (পিতা আব্দুর রশিদ সরদার, ছিলারচর) ও আব্দুস সামাদ মোল্লা (পিতা মো. জৈনদ্দিন মোল্লা, ঝিকরহাটি)। এছাড়া শরিয়তপুর জেলার নড়িয়া থানার অধিবাসী বদিউজ্জামান বদু (পিতা আফছার উদ্দিন বেপারী, গোমপাড়া; ওয়ারলেস অফিস এলাকা, মাদারীপুর শহর) এ উপজেলায় শহীদ হন।
জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনে শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের নামসহ একটি স্মৃতিস্তম্ভ রয়েছে। এছাড়া সমাদ্দার ব্রিজ যুদ্ধে শহীদদের স্মরণে ব্রিজের পাশে একটি স্মারকস্তম্ভ নির্মিত হয়েছে। [মো. শহীদুল কবীর খোকন]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৭ম খণ্ড