মাকালকান্দি গণহত্যা (বানিয়াচঙ্গ, হবিগঞ্জ)
মাকালকান্দি গণহত্যা (বানিয়াচঙ্গ, হবিগঞ্জ) সংঘটিত হয় ১৮ই আগস্ট। এতে শতাধিক নিরীহ মানুষ প্রাণ হারায়। বানিয়াচঙ্গ উপজেলার একটি প্রত্যন্ত গ্রাম মাকালকান্দি। ১৬ই আগস্ট নজিপুর গ্রামের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পর পার্শ্ববর্তী মাকালকান্দি গ্রামের লোকজন আতঙ্কিত হয়ে আত্মরক্ষার জন্য ১৭ই আগস্ট শান্তি কমিটির নেতা সৈয়দ ফয়জুল হকের সঙ্গে যোগাযোগ করে। ফয়জুল হক তাদের গ্রামে পাকবাহিনী যাতে কোনো হামলা না চালায় সে ব্যাপারে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালানোর প্রতিশ্রুতি দেয়। এ – আশ্বাসের পরিপ্রেক্ষিতে গ্রামের লোকজন নিরাপদে থাকার প্রত্যাশা নিয়ে স্বগৃহে ফিরে যায়। কিন্তু তারা বাড়ি যাবার পরপরই মেজর দুররানীর কথা বলে পুলিশ এসে সৈয়দ ফয়জুল হককে থানায় নিয়ে যায়। সেখানে তাকে সারারাত রেখে পরদিন ১৮ আগস্ট ভোররাতে পাকবাহিনী ঐ গ্রামে অভিযান পরিচালনার প্রস্তুতি নিয়ে বের হলে সে অভিযানে ফয়জুল হককে পথ প্রদর্শক হিসেবে কাজ করতে দেখা যায় ভোরবেলা অঝোর ধারায় বৃষ্টি হচ্ছিল। তার মধ্যে মেজর দুররানীর নেতৃত্বে ৩০-৩৫টি নৌকা পাকিস্তানি বাহিনী এবং রাজাকারদের নিয়ে যাত্রা করে। স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রসজ্জিত পাকবাহিনীর এ নৌবহর বানিয়াচঙ্গের বড়বাধ পার হয়ে বাগহাতা গ্রাম অতিক্রম করার পর তাদের কমান্ডার সকলকে অস্ত্র হাতে তৈরি হতে নির্দেশ দেয়। মাকালকান্দি গ্রামের নিকট পৌছার সঙ্গে-সঙ্গে কমান্ডারের নির্দেশে সৈন্যরা গোলাবর্ষণ শুরু করে। ঘুম থেকে জেগে ওঠার সঙ্গে-সঙ্গে প্রচণ্ড গোলার আওয়াজে গ্রামের মানুষ হতবিহ্বল হয়ে পড়ে। বাইরে তখন মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছিল।
হানাদারদের এই অপ্রত্যাশিত আক্রমণে ভীত হয়ে গ্রামবাসীরা তাদের স্বজনদের নিয়ে প্রাণ বাঁচানোর চেষ্টা করে। যাদের নৌকা ছিল তারা উত্তর পাশের হাওরের দিকে চলে যায়। যাদের নৌকা ছিল না তারা পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে পালাবার চেষ্টা করে। হানাদাররা পলায়নরত অসহায় মানুষদের লক্ষ করে গুলি করতে থাকে। তারা পানিতে ভাসমান অবস্থায় গুলিবিদ্ধ মানুষের মৃত্যুযন্ত্রণা দেখে বিকৃত উল্লাস করে। অতঃপর তারা গ্রামের ভেতরে প্রবেশ করে চিরুনি অভিযান চালিয়ে অর্ধশতাধিক মানুষকে ধরে পশ্চিমপাড়ার মন্দিরের সামনে জড়ো করে। সকলকে এক লাইনে দাঁড় করিয়ে ভীত-সন্ত্রস্ত নিরীহ মানুষদের গুলি করে হত্যা করে। গুলিবিদ্ধ হয়ে অসহায়ভাবে যারা কাতরাচ্ছিল, তাদের বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে-খুঁচিয়ে মৃত্যু নিশ্চিত করা হয়। পাশাপাশি চলে ধর্ষণ, লুণ্ঠন ও অগ্নিসংযোগ। প্রায় দুঘণ্টাব্যাপী এ বর্বর হামলায় গ্রামের অধিকাংশ মানুষই নিহত হয়। সামান্য যে কজন প্রাণ নিয়ে পালাতে সক্ষম হয়েছিল, এ বীভৎস ঘটনার পর তারাও আর গ্রামে ফিরে যেতে সাহস করেনি। ফলে লাশগুলোরও সৎকার করা সম্ভব হয়নি। এলোমেলো পড়ে থাকা মৃতদেহগুলো শিয়াল-শকুনের খাবারে পরিণত হয়। বিজয় অর্জন না হওয়া পর্যন্ত গ্রামটি পরিত্যক্তই ছিল। মাকালকান্দি গ্রাম গণহত্যায় শতাধিক মানুষ শহীদ হন। পরবর্তী সময়ে এখানে শহীদদের স্মরণে তাঁদের নামাঙ্কিত একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হয়।
এ গণহত্যার শিকার ৬৫ জন মানুষের পরিচয় জানা যায়। তারা হলেন— মাকালকান্দি গ্রামের কর্ণমোহন চৌধুরী, কৃপেন্দ্র চৌধুরী, কানু চৌধুরী, গিরীন্দ্র চৌধুরী, ধীরেন্দ্র চৌধুরী, নকুল দাশ, প্রমোদ চৌধুরী, অন্নদা চৌধুরী, মীরালাল চৌধুরী, জহরলাল দাশ, গুণেন্দ্র দাশ, হরেন্দ্র চৌধুরী, ক্ষীরেন্দ্র চৌধুরী, গুরুচরণ চৌধুরী, রবীন্দ্র চৌধুরী, ফণীলাল দাশ, ইন্দ্রলাল দাশ, সরীন্দ্র দাশ, সূর্যমণি দাশ, অভিনয় চৌধুরী, গিরিশ চৌধুরী, জ্যোতিষ চৌধুরী, খোকা চৌধুরী, কুমুদ চৌধুরী, নৃপেন্দ্র দাশ, লবুরাম দাশ, তরণী দাশ, দীনেশ দাশ, ঠাকুরচান দাশ, মনোরঞ্জন দাশ, খতন দাশ, সদয়চান দাশ, কুমুদিনী চৌধুরী, সরলাবালা চৌধুরী, ছানুবালা চৌধুরী, মিনাবালা চৌধুরী, তমাল রানী চৌধুরী, সুশীলা সুন্দরী, নিত্যময়ী চৌধুরী, মুক্তলতা চৌধুরী, স্বপ্নারানী চৌধুরী, ললিতা রানী চৌধুরী, মিলুরানী চৌধুরী, পিলুরানী চৌধুরী, উজ্জ্বলা রানী দাশ, সত্যময়ী দাশ, উন্মাদিনী দাশ, হেমলতা দাশ, সুচিত্রা বালা দাশ, ব্রহ্মময়ী দাশ, সুশীলা বালা দাশ, চিত্রাঙ্গ দাশ, বিপদনাশিনী চৌধুরী, সোহাগী বালা দাশ, শৈলজবালা দাশ, শোভারানী দাশ, অঞ্জুরানী দাশ, মলিরানী দাশ, লক্ষ্মীরানী দাশ, সোমেশ্বরী দাশ, চিত্রময়ী চৌধুরী, শ্যামলা চৌধুরী, তরঙ্গময়ী চৌধুরী, স্বরস্বতী চৌধুরী ও সরুজনী চৌধুরী। [মুহম্মদ সায়েদুর রহমান তালুকদার]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৭ম খণ্ড