You dont have javascript enabled! Please enable it! মুক্তিযুদ্ধে মাগুরা সদর উপজেলা - সংগ্রামের নোটবুক

মুক্তিযুদ্ধে মাগুরা সদর উপজেলা

বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষণ-এ উদ্বুদ্ধ হয়ে সারাদেশ প্রকম্পিত করে দেশের মানুষ একতাবদ্ধ হয় এবং যুদ্ধে অংশগ্রহণের প্রস্তুতি নেয়। ৮ই মার্চ মাগুরা মহকুমার জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যদের নেতৃত্ব ও পৃষ্ঠপোষকতায় সংগ্রাম কমিটি গঠিত হয়। সংগ্রাম কমিটির উপদেষ্টা নিযুক্ত হন আওয়ামী লীগ-এর কেন্দ্রীয় নেতা এডভোকেট সোহরাব হোসেন এমএনএ (মুজিবনগর সরকার-এর পুনর্বাসন ও যুব অভ্যর্থনা দপ্তরের অন্যতম সদস্য এবং স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম মন্ত্রিপরিষদের বন, মৎস্য ও পশুপালন মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী) এবং সৈয়দ আতর আলী এমপিএ। এডভোকেট আসাদুজ্জামান এমপিএ সংগ্রাম কমিটির আহ্বায়ক হন। কমিটির অন্যান্য নেতৃবৃন্দের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন- নাসিরুল ইসলাম, ছাত্রনেতা আলতাফ হোসেন, এডভোকেট আবুল খায়ের, আলোকদিয়া গ্রামের সৈয়দ তৈয়বুর রহমান (চেয়ারম্যান, বগীয়া ইউনিয়ন), শিবরামপুর গ্রামের আলহাজ্ব খোন্দকার আব্দুল মাজেদ (সাবেক পৌরসভা চেয়ারম্যান), শ্রীপুরের টুপিপাড়া গ্রামের চেয়ারম্যান আলহাজ্ব মিয়া মো. আকবর হোসেন (আকবর বাহিনীর প্রধান), বেলনগর গ্রামের এ এফ এম এ ফাত্তাহ, পারনান্দুয়ালী গ্রামের আফসার উদ্দিন মৃধা, আবদুল জলিল মৃধা, আবদুল হাফিজ মাস্টার, কাজী ইউসুফ আলী, মোল্লা নবুয়ত আলী, কাজী ফয়েজুর রহমান প্রমুখ। সংগ্রাম কমিটির ন্যায় একইভাবে সকল ছাত্র সংগঠনের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে গঠিত হয় স্টুডেন্টস একশন কমিটি (স্যাক)। ২৩শে মার্চ পাকিস্তান প্রজাতন্ত্র দিবসের পরিবর্তে মাগুরায় প্রতিরোধ দিবস পালিত হয়। ২৫শে মার্চ পাকিস্তানি বাহিনীর গণহত্যার খবর ছড়িয়ে পড়লে সংগ্রাম কমিটি হানাদার বাহিনীর বর্বরোচিত হামলা প্রতিরোধের উদ্যোগ নেয়। মহকুমা প্রশাসক ওয়ালিউল ইসলাম সংগ্রাম কমিটির সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। তাঁর বাসভবন সংগ্রাম কমিটির অস্থায়ী কার্যালয় হিসেবে ব্যবহৃত হয়। সংগ্রাম কমিটির অন্যান্য কার্যালয়গুলো স্থাপিত হয় মাগুরা নোমানী মাঠ এবং আনসার ক্যাম্প ভবনে। এভাবে সর্বসাধারণের সর্বাত্মক অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে মাগুরা সদর উপজেলায় মুক্তিযুদ্ধের পটভূমি তৈরি হয়।
২৬শে মার্চ স্বাধীনতা ঘোষণার পর মানুষের ব্যাপক আস্থা ও সহযোগিতায় স্থানীয়ভাবে সংগৃহীত আগ্নেয়াস্ত্র ও গোলাবারুদের ওপর নির্ভর করে মাগুরার বিভিন্ন স্থানে মুক্তিযোদ্ধা গ্রুপ গঠিত হতে থাকে। এসময় ছাত্র-জনতা মাগুরা ট্রেজারির অস্ত্র পুলিশ ইন্সপেক্টর আবদুল হাকিমের ওপর চাপ সৃষ্টি করে ছিনিয়ে নেয়। সংগ্রাম কমিটি অবসরপ্রাপ্ত এবং ছুটিতে আসা সেনা, পুলিশ ও আনসার সদস্যদের দ্বারা নোমানী ময়দান, পারনান্দুয়ালী আমবাগান, কলেজ মাঠ প্রভৃতি স্থানে ছাত্র-যুবকদের প্রশিক্ষণ প্রদানের ব্যবস্থা করে। ছাত্রনেতা আবু নাসের বাবুলের পরামর্শে মুজাহিদ ট্রেনিং প্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা আবু বক্কার খান ২০ জন স্থানীয় যুবককে নিয়ে মাগুরা সদরের আলমখালীতে রাধাকান্ত কুণ্ডুর সহযোগিতায় প্রথম প্রশিক্ষণ ক্যাম্প স্থাপন করেন। এ দলে ২০ জন মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। প্রত্যেকের জণ্য ১টি করে রাইফেল ছিল। দলের কমান্ডার ছিলেন আনসার কমান্ডার হারেছার রশিদ। ঐতিহাসিক নোমানী ময়দান সংলগ্ন আনসার ক্যাম্পে প্রশিক্ষণের দায়িত্বে ছিলেন আকবর বাহিনীর প্রধান মিয়া মো. আকবর হোসেন। এখানে প্রশিক্ষক হিসেবে পুলিশের হাবিলদার শাহজাহান (রাজশাহী), আনসার কমান্ডার হারেছার রশিদ (ছোনগাছা, শ্রীপুর), বিমান বাহিনীর সদস্য মো. আবু জাহিদ (বেলনগর, মাগুরা) এবং আবদুল মান্নান দায়িত্ব পালন করেন। প্রশিক্ষণ ক্যাম্প পরিচালনায় আরো সহায়তা দেন হরিন্দির শাহাদাত আলী, সুধীর কুমার, শ্রীপুরের মুকুল, আলাউদ্দিন, গোয়ালপাড়ার আবু বকর, টুপিপাড়ার আবদুল হোসেন মিয়া, খামারপাড়ার খন্দকার আবু হোসেন, সিরাজুল ইসলাম, হোগলডাঙ্গার নাসির প্রমুখ। স্টুডেন্টস একশন কমিটির পক্ষে ছাত্রদের প্রশিক্ষণে সহায়তা দেন কামরুজ্জামান, জাহেদুল ইসলাম, ওয়াহেদ মিয়া, মিলন খান, কামরুজ্জামান চাঁদ, আবু নাসের বাবুল প্রমুখ। অপরদিকে ভারত থেকে আসা সশস্ত্র মুক্তিযোদ্ধারা গ্রামাঞ্চলে বেশ কয়েকটি ক্যাম্প গড়ে তোলেন। মাগুরায় মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ছিলেন- এডভোকেট মোহাম্মদ সোহরাব হোসেন এমএনএ, সৈয়দ আতর আলী এমপিএ, এডভোকেট মো. আসাদুজ্জামান, কমরেড আবুল কুদ্দুস খাঁন, মুজিব বাহিনীর কমান্ডার এডভোকেট আবুল খায়ের, সৈয়দ তয়বুর রহমান (আলোকদিয়া, চেয়ারম্যান, বগায়া ইউনিয়ন), খোন্দকার আব্দুল মাজেদ (শিবরামপুর; সাবেক পৌর চেয়ারম্যান), আকবর হোসেন মিয়া (টুপিপাড়া; আকবর বাহিনীর প্রধান), এ এফ এম এ ফাত্তাহ (বেলনগর), আফসারউদ্দিন মৃধা (পারনান্দুয়ালী) প্রমুখ। মাগুরা সদর থানায় মুজিব বাহিনীর কমান্ডার ছিলেন মো. আবুল খায়ের, আনসার বাহিনীর কমান্ডার হারেছার রশিদ, মো. আয়েন উদ্দিন, মো. আব্দুর রশিদ (ইংলুচ মোল্লা), হারেজ উদ্দিন আকবর বাহিনীর প্রধান মিয়া মো. আকবর হোসেন, গেরিলা বাহিনীর কমান্ডার মো. জহুর-ই আলম, এফএফ কমান্ডার বি এম তকব্বর, যুদ্ধকালীন ডেপুটি কমান্ডার মো. তোজাম্মেল হোসেন, ইয়াকুব বাহিনীর কমান্ডার গোলাম ইয়াকুব এবং মাজেদ খোন্দকার বাহিনীর কমান্ডার ছিলেন খোন্দকার মাজেদ। এছাড়া যুদ্ধকালীন কমান্ডার ছিলেন মেজর মো. শমসের আলী, এফএফ গেরিলা কমান্ডার মো. আবদুল হাই চৌধুরী, এম এম আবদুর রহমান, শহীদ অধীর চন্দ্র রায় ও মো. আয়েন উদ্দিন। মুজিব বাহিনীর কমান্ডার ছিলেন এডভোকেট আবুল খায়ের, মো. লিয়াকত আলী, মুন্সী আব্দুর রউফ, মো. সৈয়দ আলীI
মাগুরা সদর জেলায় আকবর বাহিনী- নামে একটি স্থানীয় মুক্তিবাহিনী ছিল। মাগুরার মুক্তিযোদ্ধাদের রিক্রুটিং সেন্টার, প্রশিক্ষণ ক্যাম্প ইত্যাদি পরিচালনার পাশাপাশি এলাকায় শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষায় এ বাহিনী তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রাখে। কুষ্টিয়া, ঝিনাইদহ, মাগুরা, রাজবাড়ী ও ফরিদপুর জেলার বিস্তীর্ণ এলাকায় এ বাহিনীর জোর তৎপরতা ছিল। এছাড়া মাগুরায় সেনাবাহিনীর ক্যাপ্টেন (পরবর্তীতে মেজর জেনারেল) মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল ওহাবের নেতৃত্বে গঠিত ঈগল বাহিনী, ইয়াকুব বাহিনী, মাজেদ খোন্দকার বাহিনী, মুজিব বাহিনীর ছোট ও বড় গ্রুপের মুক্তিযোদ্ধারা কখনো একক দলে কখনো অন্য দলের সঙ্গে যৌথভাবে হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তোলেন।
২৬শে মার্চ স্বাধীনতা ঘোষণার পর ২৭শে মার্চ সংগ্রাম কমিটির সভায় মাগুরায় পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত হয়। নেতৃবৃন্দ মাগুরার প্রবেশপথ খাজুরা- লেবুতলা ও সীমাখালী এলাকায় মুক্তিকামী জনগণকে নিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। ঝিনাইদহ হয়ে মাগুরা প্রবেশের সড়ক পথে আলমখালী ব্রিজ দখল করেন আকবর বাহিনীর মুক্তিযোদ্ধারা। তাঁরা স্থানীয় জনগণকে সঙ্গে নিয়ে বিষয়খালী ব্রিজের ওপর গর্ত করে পাটকাঠী ও গাছের ডাল ফেলে ফাঁদ তৈরি করেন, যাতে পাকিস্তানি বাহিনী এই ফাঁদে পড়ে এ আটকে যায়। মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানি বাহিনীকে প্রতিরোধে মাগুরার উত্তর দিকে কামারখালী এবং লাঙ্গলবাঁধ এলাকায় নদীর পাড়ে গোপন ক্যাম্প স্থাপন করেন।
২৩শে এপ্রিল শুক্রবার দুপুরে ঝিনাইদহ থেকে আলমখালী হয়ে এবং যশোর থেকে সীমাখালী পথে পাকিস্তানি বাহিনী একযোগে মাগুরার দিকে অগ্রসর হয়। ঝিনাইদহ থেকে আগত পাকসেনাদের বিশাল গাড়িবহর মাগুরার আলমখালী বাজার সংলগ্ন রাস্তায় থামিয়ে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করতে থাকে। তাদের সাঁজোয়া গাড়ির বহর শহরে প্রবেশ না করে পারনান্দুয়ালী গ্রামে (বর্তমান বাস টার্মিনাল সংলগ্ন) মাগুরা- কামারখালী সড়কে অবস্থান নেয়। ২৪শে এপ্রিল পাকিস্তানি সেনারা শহরে অনুপ্রবেশ করে মাইক্রোওয়েভ সেন্টার, ভোকেশনাল ইন্সটিটিউট, পিটিআই, নিউ কোর্ট বিল্ডিং ও এসডিও ভবনে ক্যাম্প স্থাপন করে। ওয়াপদা ডাকবাংলোয় পাকিস্তানি বাহিনীর সদর দপ্তর ছিল। পিটিআই-এর পেছনে পাকবাহিনী বিমান অবতরণের অস্থায়ী রানওয়ে নির্মাণ করে। পরবর্তী সময়ে তারা আড়পাড়া ডাকবাংলোতে ক্যাম্প স্থাপন করে। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর মেজর রিয়াজ খান, ক্যাপ্টেন আজমল, সিপাহি ইউসুফ খান, আবদুস সালাম খান, মোসলেম খান, হাবিলদার ওহিদ খান, নায়েব লতিফ খান, নাসির খান, ইউনুস প্রমুখ মাগুরাকে ধ্বংসের জনপদে পরিণত করেছিল।
পাকিস্তানি বাহিনী মাগুরা শহরে অনুপ্রবেশের পর তাদের পৃষ্ঠপোষকতায় শান্তি কমিটি রাজাকার, আলবদর ও আলশামস বাহিনী গঠিত হয়। মাগুরার মুসলিম লীগ নেতা এডভোকেট মশিউল আজম (সাবেক ডেপুটি স্পিকার), জামায়াতে ইসলামী- নেতা ওবাইদুর রহমান (শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান), এডভোকেট নাসিরুল ইসলাম আবু মিয়া, হাজীপুরের কুখ্যাত রাজাকার লতিফ, কবির, রিজু, মওলানা শামছুল হক (নতুন বাজার), আয়ুব চৌধুরী (লক্ষ্মীকোল) প্রমুখ ছিল পাকিস্তানি বাহিনীর সহযোগী এবং স্বাধীনতাবিরোধী। এদের সহযোগিতায় শহরের দত্ত বিল্ডিং ও গোল্ডেন ফার্মেসি ভবন থেকে শান্তি কমিটির কার্যক্রম পরিচালিত হতো। থানার পাশে যজ্ঞেশ্বর রামতারক দত্তের বিশাল দোতলা ভবন, নোমানী ময়দান, আনসার ক্যাম্প, রেনুকা ভবন ও জেলা পরিষদ বাংলোয় রাজাকার ক্যাম্প স্থাপিত হয়। আলবদর ও আলশামস বাহিনী শহরের কালী মন্দিরসহ বিভিন্ন মন্দিরে অগ্নিসংযোগ এবং মূর্তি ভাংচুর করে। তারা পাকবাহিনীর হত্যা, বিভিন্ন বাজার ও বাড়িঘর লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগ ও নারীনির্যাতনে সহযোগিতা করে। ২৩শে এপ্রিল মাগুরায় অনুপ্রবেশকালে পাকিস্তানি বাহিনী আলমখালী ব্রিজ সংলগ্ন উত্তর পাশের বাড়ির বাসিন্দা কুলু সম্প্রদায়ের সুরেন্দ্রনাথ (সুরেন কুলু) ভয়ে দৌড়ে পালানো চেষ্টা করলে তার আঙিনায় তাকে গুলি করে হত্যা করে। বাগবাড়িয়া গ্রামের সুঠামদেহী লালু পাগলা ‘জয় বাংলা’ বলে পাকিস্তানি সেনাদের গাড়ির কাছে এগিয়ে গেলে পাকসেনারা তাকে গুলি করে হত্যা করে। ২৪শে এপ্রিল পাকিস্তানি সেনারা ৫-৬টি খোলা জিপ নিয়ে মাগুরা নতুন বাজারে হিন্দু মালিকানাধীন কয়েকটি পাটের গুদামে আগুন ধরিয়ে দেয়। সন্ধ্যায় তারা টাউন হল ক্লাবের সামনে ধনাঢ্য ব্যবসায়ী জগবন্ধু দত্তের বাড়ির সামনে এসে বৃদ্ধ জগবন্ধু দত্তকে হত্যা করে স্বর্ণালঙ্কার ও টাকা-পয়সা লুণ্ঠন করে নিয়ে যায়। ৫ই অক্টোবর শিক্ষিকা মিসেস লুৎফুন নাহার হেলেন- (ছাত্র ইউনিয়ন- কর্মী)-এর ওপর পাকিস্তানি সেনারা নৃশংস নির্যাতন চালায়। মহম্মদপুর উপজেলা থেকে তাঁকে ধরে এনে পিটিআই ক্যাম্পে অমানুষিক নির্যাতন করে। জীবন্ত অবস্থায় তাঁর পায়ে দড়ি বেঁধে জিপ গাড়ির পেছনে সারা শহর ঘোরায়। রক্তে রঞ্জিত হয় মাগুরার রাজপথ। এক সময় নিথর-নিস্তব্ধ হয়ে পড়ে তাঁর দেহটি। ৩ থেকে ৪ ঘণ্টা এভাবে ঘোরানোর পর গুলি করে তাঁকে হত্যা করে পাকিস্তানি বাহিনী। মাগুরার ইতিহাসে এটি ছিল হৃদয় বিদারক পাশবিক ঘটনা।
২৬শে নভেম্বর মাগুরার মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে একটি বিষাদঘন দিন। দিনটি কামান্না ট্রাজেডি হিসেবে পরিচিত। বিজয় অর্জনের মাত্র ২০ দিন পূর্বে পাকিস্তানি সেনারা কামান্না (ঝিনাইদহ)-য় অতর্কিতে আক্রমণ করে কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধাসহ ২৭ জন মানুষকে হত্যা করে। এটি কামান্না ট্রাজেডি নামে পরিচিত।
পাকিস্তানি বাহিনীর সহায়তায় কুখ্যাত ডাকাত রব্বানী, কাউছার, লালু, লাল, বারিক, মজিদ, মকবুল, রাজ্জাক, রুস্তম, ইমান আলী, জয়নাল, হামেদ, মক্কা প্রমুখের দস্যুবৃত্তি পাকিস্তানি বাহিনীকেও হার মানিয়েছিল। লুট করার সময় তারা ঘরের দরজা-জানালা, আলমারি, চেয়ার-টেবিল, লেপ- কাঁথা, চাল-ডাল, বাসন-কোসন সব নিয়ে যেত।
মাগুরায় পাকিবাহিনীর হাতে নির্মম নির্যাতনের শিকার হন মো. সিরাজুল ইসলাম (মাগুরা কলেজের ২য় বর্ষের ছাত্র), আবদুল মজিদ খান, ইপিআর সদস্য মো. সিরাজুল ইসলাম, মো. আবদুল হালিম মোল্লা, মোশারফ হোসেন, নান্টু মিয়া প্রমুখ। হানাদাররা নহাটা বাজারে কয়েকটি গুদামে অগ্নিসংযোগ করে। মুক্তিযোদ্ধা আবু বক্কার খানকে পাকবাহিনী রাইফেল ও গুলিসহ ধরে নিয়ে পিটিআই নির্যাতনকেন্দ্রে ২-৩ দিন আটকে রেখে নির্যাতন করে শরীরের ১১টি হাড় ভেঙ্গে ফেলে এবং কাপড় খুলে পরীক্ষা করে হিন্দু না মুসলমান।
পাকিস্তানি বাহিনীর পিটিআই ক্যাম্প, গোল্ডেন ফার্মেসি ভবন, রেনুকা ভবন, জগবন্ধু দত্তের বাড়ি ও চৌধুরী বাড়ি ছিল নির্যাতনকেন্দ্র ও বন্দিশিবির। এ-সকল ক্যাম্পে পাকবাহিনী বিভিন্ন শ্রেণির মানুষকে ধরে এনে নির্যাতন ও হত্যা করত। মাগুরা শহরের পিটিআই ক্যাম্প, ওয়াপদা ব্যারেজ, ক্যানেল ও কুমার নদীর পাড় ছিল পাকবাহিনীর বধ্যভূমি। বিশেষ করে পিটিআই ক্যাম্প বধ্যভূমিতে তারা বিভিন্ন স্থান থেকে ধরে আনা সহস্রাধিক মানুষকে হত্যা করে পিটিআই-র মধ্যেই গণকবর দেয়।
মাগুরা সদর উপজেলায় পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের কয়েকটি যুদ্ধ হয়। ২৬শে সেপ্টেম্বর রাতে মুক্তিযোদ্ধারা ইছাখাদা রাজাকার ক্যাম্প আক্রমণ করেন।
আক্রমণে ৭-৮ জন রাজাকার মারা যায়। এ-যুদ্ধে নেতৃত্ব দেন বেলনগরের মুক্তিযোদ্ধা বদরুল আলম। পরদিন রাতে মুক্তিযোদ্ধারা মাগুরা আনসার অফিস রাজাকার ক্যাম্পে আক্রমণ চালান। এ-সময় পিটিআই ক্যাম্প থেকে হানাদার বাহিনী গোলাগুলি শুরু করে। দীর্ঘ সময় ধরে গোলাগুলি চলাকালে রাজাকাররা ছোটাছুটি করতে গিয়ে অনেকেই গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হয়। এ-যুদ্ধে কাঠেরপুলের কাছে কর্তব্যরত ৭ জন রাজাকারসহ ক্যাম্পের ২৭ জন নিহত হয়। কোনোরকম ক্ষয়ক্ষতি ছাড়াই মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানি বাহিনীকে শহর থেকে বিতাড়িত করতে সক্ষম হন। মাগুরা জেলার রণাঙ্গন ৮নং সেক্টরের অধীনে ৩ ভাগে বিভক্ত ছিল, যার উত্তরে ছিল আকবর বাহিনী।
মাগুরায় মুজিব বাহিনী প্রধান ছিলেন হাজীপুরের আবুল খায়ের। সদর থানার আডুয়াকান্দি ব্রিজের কাছে স্থলমাইন স্থাপন করে পাকবাহিনীকে প্রতিরোধসহ বিভিন্ন জায়গায় সম্মুখ যুদ্ধে তিনি অংশ নেন। ঈগল বাহিনী প্রধান এ টি এম এ ওহাবের পরামর্শে আকবর হোসেন মিয়া নিজ দলীয় বাঁশি জোয়ারদারকে গোপনে মাগুরা শহরে পাঠিয়ে হানাদার বাহিনীর অবস্থানের একটি মানচিত্র তৈরি করে সেক্টর হেডকোয়ার্টার্সে পাঠান। ৬ই ডিসেম্বর শ্রীপুর বাহিনী পারনান্দুয়ালী গ্রামে বেলায়েতসহ ৫ জন রাজাকারকে আটক করে। তাঁরা বেলায়েতকে ছেড়ে দিয়ে বাকি ৪ জনকে নলিয়ারডাঙ্গীতে কুমার নদীর পাড়ে গুলি করে হত্যা করে। অপরদিকে মিত্রবাহিনী – মাগুরা শহরের বিভিন্ন শত্রু ক্যাম্পে বিমান হামলা শুরু করে। একদিকে বিমান হামলা চলে, অপর দিকে মুক্তিযোদ্ধারা শহরের উত্তর-পশ্চিম দিক দিয়ে নতুন বাজার এলাকায় প্রবেশ করেন। এ অবস্থায় পাকসেনারা কামারখালীর দিকে পালাতে থাকে। এ সময় পারনান্দুয়ালী গ্রামে অবস্থানকালে একদল পাকসেনা এ গ্রামের বাটুল মিয়ার (ওয়াপদায় চাকরিরত) মাধ্যমে আকবর হোসেনের কাছে আত্মসমর্পণের প্রস্তাব পাঠায়। প্রস্তাবে রাজি হয়ে আকবর হোসেন মিয়া পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর মেজরের নিকট চিঠি পাঠান। কিন্তু তারা প্রস্তাব প্রত্যাখান করে। ৬ই ডিসেম্বর সন্ধ্যায় পাকসেনারা শহর ত্যাগ করে। ৭ই ডিসেম্বর সকালে শ্রীপুর বাহিনী, অন্যান্য বাহিনীর সদস্য এবং সাধারণ জনগণ গগণবিদারী স্লোগানে চতুর্দিক প্রকম্পিত করে মাগুরা শহরে প্রবেশ করে। এদিনই মাগুরা সদর উপজেলা হানাদারমুক্ত হয়।
মাগুরা সদর উপজেলার শহীদ মুক্তিযোদ্ধারা হলেন- ইপিআর সদস্য মো. শহীদুল ইসলাম (পিতা নুরুল কাদের মিয়া, পশ্চিম বাড়েলা, আঠারখাদা), পুলিশ সদস্য রিয়াত মণ্ডল (পিতা উজির আলী মণ্ডল, আলীধানী, আঠারখাদা), পুলিশ সদস্য সেলিম (পিতা আব্দুল মজিদ, শিবরামপুর), পুলিশ সদস্য হোসেন আলী (পিতা মো. আবদুল বারিক বিশ্বাস, হাজীপুর), আনসার সদস্য মো. ওয়াহিদুজ্জামান (পিতা আবদুল জলিল বিশ্বাস, হাজীপুর), আনসার সদস্য আব্দুল মোতালেব (পিতা কাদের মুন্সী, ইছাখাদা, হাজরাপুর), আনসার সদস্য মুন্সী আলীমুজ্জামান (পিতা আব্দুল বারী, বিষ্ণুপুর, হাজীপুর), মুজাহিদ বাহিনীর সদস্য গোলজার খাঁ (পিতা লাল খাঁ, :: মালিগ্রাম, মঘী), আনসার সদস্য মাছিম মিয়া (পিতা মুন্সী খেলাফত হোসেন, হৃদয়পুর, হাজীপুর), মুজাহিদ বাহিনীর সদস্য মো. গোলাম কাওছার মোল্লা (পিতা বাহাদুর মোল্লা, মির্জাপুর, হাজীপুর), মুজাহিদ বাহিনীর সদস্য রাশেদ হোসেন (পিতা খন্দকার আব্দুল মাজেদ, শিবরামপুর), মনিরুজ্জামান মনি খাঁ (পিতা সুরত খাঁ, হাজীপুর), আলী হোসেন (পিতা আব্দুল হামিদ মিয়া, হাজীপুর), অধীর কুমার শিকদার (পিতা দয়াল কুমার শিকদার, হাজীপুর), আলমগীর মৃধা লুলু (পিতা মতিয়ার মৃধা, হাজীপুর), তাজরুল ইসলাম তাজু (পিতা শরাফৎ হোসেন বিশ্বাস, পারনান্দুয়ালী), মো. সলেমন শিকদার (পিতা আবু বক্কার শিকদার, নরসিংহাটি), গৌরচন্দ্র রায় (পিতা পুলিন চন্দ্র রায়, হাজীপুর), নির্মল কুমার মণ্ডল (পিতা নরহরি বিশ্বাস, বাগডাঙ্গা, আঠারখাদা) ও আনিসুর রহমান (পিতা কাজী আব্দুর রাজ্জাক, হৃদয়পুর, হাজীপুর)।
মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণে মাগুরা শহরের ভায়না মোড়ে স্মৃতিসৌধ নির্মিত হয়েছে। মাগুরার ঐতিহাসিক নোমানী ময়দানে নির্মিত হয়েছে শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের নামফলক। হাজীপুর স্কুলে নির্মাণ করা হয়েছে মুক্তিযোদ্ধা স্মৃতিস্তম্ভ। পিটিআই-র সামনে বধ্যভূমির স্মরণে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়েছে। মাগুরা জেলার মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক মুক্তিযোদ্ধা সৈয়দ আতর আলীর নামে স্থাপন করা হয়েছে শহীদ সৈয়দ আতর আলী গণগ্রন্থাগার। ঢাকা রোড থেকে চৌরঙ্গী মোড় পর্যন্ত সড়কের নামকরণ করা হয়েছে সৈয়দ আতর আলী সড়ক। মুক্তিযোদ্ধা আছাদুজ্জামান স্মরণে নির্মিত হয়েছে বীর মুক্তিযোদ্ধা আছাদুজ্জামান স্টেডিয়াম ও আছাদুজ্জামান মিলনায়তন। ভায়না মোড় থেকে মাগুরা-ঢাকা রোড পর্যন্ত সড়কটির নামকরণ করা হয়েছে বীর মুক্তিযোদ্ধা আছাদুজ্জামান সড়ক। এছাড়া মহম্মদপুরে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বীর মুক্তিযোদ্ধা আছাদুজ্জামান কলেজ। [মো. দেলোয়ার হোসেন খান]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৭ম খণ্ড