You dont have javascript enabled! Please enable it! মুক্তিযুদ্ধে মহেশখালী উপজেলা (কক্সবাজার) - সংগ্রামের নোটবুক

মুক্তিযুদ্ধে মহেশখালী উপজেলা (কক্সবাজার)

মহেশখালী উপজেলা (কক্সবাজার) ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণের খবর বিবিসি, আকাশবাণী ও পত্র-পত্রিকার মাধ্যমে জানার পর মহেশখালীর আপামর জনসাধারণ মুক্তিযুদ্ধের লক্ষ্যে সংগঠিত হয় এবং আওয়ামী লীগ, ন্যাপ ও কমিউনিস্ট পার্টি-র নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে থাকে।
২৮শে মার্চ থানা আওয়ামী লীগের নেতা আব্দুল্লাহ খানকে সভাপতি, মোহাম্মদ ইসহাক বিএ-কে সাধারণ সম্পাদক এবং মোস্তাক আহমদকে সাংগঠনিক সম্পাদক করে একটি সংগ্রাম কমিটি গঠিত হয়। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন- ফয়েজুল করিম, এস এম রফিক উল্লাহ, ইসমাঈল নূর, অভিনাষ চন্দ্র দে, খায়রুল্লাহ, ডা. নুরুল আমিন, মোক্তার আহমদ, ডা. আমান, আনোয়ার পাশা চৌধুরী, সিরাজুল মোস্তফা ও পূর্ণ চন্দ্র দে (দপ্তর সম্পাদক)। এছাড়া একরামুল হক, নেছারুল হক (কুতুবদিয়া), এম আজিজুর রহমান, নেয়ামত আলী, আবদুর রশিদ (ছোট মহেশখালী), মীর কাশেম (হোয়ানক), দিলীপ মাস্টার, নীহার কান্তি চৌধুরী, হাবিবুল হক, নারায়ণ চক্রবর্তী, শেখ আবদুল জব্বার, আবদুল হক, এলাহী বক্স, মোস্তফা কামাল ও আহমদ উল্লাহকে নিয়ে ছাত্র সংগ্রাম কমিটি গঠিত হয়। ২৮শে মার্চ সংগ্রাম কমিটির নেতৃত্বে থানা কার্যালয় থেকে পাকিস্তানি পতাকা নামিয়ে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয়। ছাত্রনেতা সিরাজুল মোস্তফা মাইকযোগে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে প্রচারণা চালান। পরবর্তীকালে উল্লিখিত ব্যক্তিবর্গই এ উপজেলায় মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকের দায়িত্ব পালন করেন।
৬ই মে পাকবাহিনী মহেশখালীতে প্রবেশ করে এবং স্থানীয় ডাকবাংলো ও স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ক্যাম্প স্থাপন করে। এরপর স্বাধীনতাবিরোধীরা তাদের সঙ্গে হাত মেলায়। উপজেলায় পাকবাহিনীর প্রধান সহযোগী ছিল নেজামে ইসলামী-র মৌলভী জাকারিয়া এবং মৌলভী অলি আহমদ। অন্যান্য সহযোগীরা হলো- নুরুল ইসলাম, হোছন আহমদ (রাজাকার ও আনসার কমান্ডার), জিন্নাহ, মোহাম্মদ জালাল, এজাহার মিয়া, মাহমুদুল করিম ও এখলাস। এ অঞ্চলের শান্তি কমিটির সদস্যরা হলো- রশিদ মিয়া (চেয়ারম্যান), আবুল হোসেন, সাহেব মিয়া চৌধুরী, আলী হোছন মিয়া, আবদুল আজিজ, জালাল আহমদ, আক্তার কামাল, ছালামত উল্লাহ খান (জামায়াতে ইসলামী-র সম্পাদক), সোলেমান ডাক্তার ও মৌলভী রশিদ
(কুলালপাড়া)।
৫ই মে মহেশখালীর কয়েকজন রাজাকার কক্সবাজার পাকসেনা ক্যাম্পে মহেশখালীতে আসার জন্য আহ্বান জানায়। এর ভিত্তিতে ৬ই মে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী মহেশখালী উপজেলায় অনুপ্রবেশ করে। পাকসেনা এসে স্থানীয় ডাকবাংলো ও গোরকঘাটা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে অবস্থান নেয়। সেখান থেকে রাজাকারআলবদরদের সহযোগিতায় সংখ্যালগু হিন্দু ও বৌদ্ধ অধ্যুষিত এলাকায় ব্যাপক নির্যাতন ও গণহত্যা সংঘটিত করে। বিশেষ করে গোরকঘাটা বাজার গণহত্যা, গোরকঘাটা দক্ষিণ হিন্দুপাড়া গণহত্যা, আদিনাথ মন্দির সংলগ্ন ঠাকুরতলা গণহত্যা, মহেশখালী হিন্দুপাড়া ও মুন্সির ডেইল গণহত্যা, হোয়ানক পুঁইছড়া ও দেবঙ্গপাড়া গণহত্যা, কায়স্থপাড়া গণহত্যা, গণহত্যা ও কালামারছড়া বাজার গণহত্যা উল্লেখযোগ্য।
পাকিস্তানি বাহিনী ৬ই মে গোরকঘাটার নিকটবর্তী রাখাইন পাড়ার বৌদ্ধ বিহার জ্বালিয়ে দেয় এবং বিহারের ভান্তে ও তাঁর দুই সহযোগীকে হত্যা করে। তারা আদিনাথ মন্দির (ভৈরব মন্দির) সংলগ্ন রাখাইন বিহারও পুড়িয়ে দেয় এবং এখানে ২০-২৫ জনকে হত্যা করে। এ ঘটনা রাখাইনপাড়া বৌদ্ধ বিহার গণহত্যা নামে পরিচিত। ৭ই মে পাকবাহিনী বড় মহেশখালীর আওয়ামী লীগ নেতা আবুল খাইর, মোহাম্মদ জাফর, শামশু ও আব্দুস সাত্তারকে গুলি করে হত্যা করে। এছাড়া তারা হোয়ানকের ইছড়া গ্রামের ভুতা ও তার ভাইকে হত্যা করে।
াকবাহিনী তাদের দোসর রাজাকারদের প্ররোচনায় পারকঘাটা হিন্দুপাড়া, পালপাড়া (পুটিবিলা), দেবাইঙ্গা াড়া (হিন্দুপাড়া), কেরোনতলী, বড়ছড়া, পুইছড়া ও দ্মপুকুর পাড়ায় হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ ও ণ্ঠন চালায়। পাকিবাহিনীর অন্যতম দোসর মৌলভী জাকারিয়া নির্যাতন, ধর্ষণ ও হিন্দুদের ধর্মান্তরিত করার অপতৎপরতায় লিপ্ত ছিল। অপর দোসর মৌলভী অলি আহমদের ইন্ধনে পাকবাহিনী কমল সাধু ও বিমল চৌধুরী নামে দুজনকে হত্যা করে। রাজাকার কমান্ডার হোছন আহমদ, জিন্নাহ ও নুরুল ইসলাম পাকহানাদার বাহিনীকে হিন্দুদের বাড়িঘর দেখিয়ে দিত। পাকবাহিনীর সহযোগী মাহমুদুল করিম হিন্দুদের মন্দির মসজিদে রূপান্তর করার কাজে প্ররোচনা দিত।
মুক্তিযুদ্ধের শেষ দিকে ১৩ই ডিসেম্বর ক্যাপ্টেন আবদুস ছোবহান বাহিনীর মুক্তিযোদ্ধারা কয়েকজন স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধার সমন্বয়ে মহেশখালী থানা অপারেশন পরিচালনা করেন। এ অপারেশনে ১৬৬টি রাইফেল ও ৭৪৮৫ রাউন্ড গুলি উদ্ধার করা হয়।
মহেশখালী উপজেলায় তিনটি বধ্যভূমির সন্ধান পাওয়া গেছে— আদিনাথ মন্দির বধ্যভূমি, গোরকঘাটা হিন্দুপাড়া বধ্যভূমি এবং পালপাড়া ও কায়স্থপাড়া মন্দির সংলগ্ন খালপাড় বধ্যভূমি। স্বাধীনতার তিনদিন আগে ১৩ই ডিসেম্বর মহেশখালী উপজেলা হানাদারমুক্ত হয়। মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণে মহেশখালী উপজেলা সদরে একটি মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্স নির্মাণ করা হয়েছে। [মোহাম্মদ জসীম উদ্দিন]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৭ম খণ্ড