মহালছড়ি যুদ্ধ (মহালছড়ি, খাগড়াছড়ি)
মহালছড়ি যুদ্ধ (মহালছড়ি, খাগড়াছড়ি) সংঘটিত হয় ২৭শে এপ্রিল। এতে শত্রুপক্ষের বহু হতাহত হয়। অপরপক্ষে একজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন।
খাগড়াছড়ি জেলা সদর থেকে ২৫ কিলোমিটার দূরে মহালছড়ি থানার পাশে সিএন্ডবি-র ডাকবাংলোয় মুক্তিযোদ্ধাদের হেডকোয়ার্টার্স ছিল। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে সাধারণ মানুষ মহালছড়ি থেকে সম্মিলিতভাবে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। তবে ২৭শে এপ্রিল মহালছড়ি যুদ্ধটি ছিল উল্লেখযোগ্য। চেঙ্গীনদীর ওপার থেকে পাকিস্তানি বাহিনী আক্রমণ চালায়। সেদিন মহালছড়িতে পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে সম্মুখ যুদ্ধে প্রাণ হারান ক্যাপ্টেন আফতাবুল কাদের, বীর উত্তম। অপরদিকে ২০ জনের মতো পাকিস্তানি সেনা নিহত ও অনেকে আহত হয়। পাকিস্তানি হানাদারদের সহযোগী মিজোবাহিনীর অনেকেও হতাহত হয়।
এদিকে আওয়ামী লীগ-এর নেতৃত্বে হানাদার প্রতিরোধ সংগ্রাম কমিটি গঠন করা হয়। মুক্তিযোদ্ধোদের আশ্রয় এবং খাবারের ব্যবস্থা করেন স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা ও সহযোগীরা। মুক্তিযোদ্ধারা মহালছড়িতে আসার পর থেকে শত্রুর মোকাবেলায় বিভিন্ন স্থানে বাংকার খোঁড়া হয়। মাইসছড়ি এলাকার চিত্ত রঞ্জন চাকমা ছিলেন হানাদার প্রতিরোধ সংগ্রাম কমিটির সক্রিয় সদস্য। মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য অর্থ সংগ্রহ, খাদ্য সংগ্রহ ও তাঁদের সংগঠিত করা সব কাজেই তিনি ছিলেন অগ্রণী। তাঁর এ তৎপরতা চোখে পড়ে রাজাকারদের। তাই রাজাকাররা চিত্ত রঞ্জন চাকমাসহ স্থানীয় পাহাড়ি ও বাঙালি মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে নানা কূটকৌশল গ্রহণ এবং পাকিস্তানি আর্মিদের কাছে তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করে। স্থানীয় রাজাকার জাকারিয়া ও জাকির বিহারি পাকিস্তানিদের কাছে ১২৩ জনের যে হিটলিস্ট দিয়েছিল, এসব পাহাড়িদের নামও সে তালিকায় ছিল।
তৎকালীন মহালছড়ি আওয়ামী লীগের সংগঠক মংসাথোয়াই মাস্টার সিঙ্গিনালার তাঁর এক বন্ধুর কাছ থেকে খবর পান পাকবাহিনী ও মিজোবাহিনী- খাগড়াছড়ির দিকে অগ্রসর হচ্ছে এবং তারা মহালছড়ি আক্রমণ করবে। এ খবর পেয়ে তিনি ২৫শে এপ্রিল ক্যাপ্টেন আফতাবুল কাদেরকে লোক মারফত খবর পাঠান যে, পাকিস্তানি বাহিনী নানিয়ারচর থেকে মুবাছড়ি হয়ে মহালছড়ি আক্রমণ করতে আসছে। এ সংবাদ পেয়ে মহালছড়ি হেডকোয়ার্টার্সের মুক্তিযোদ্ধারাও শত্রুর আক্রমণ ঠেকাতে প্রস্তুতি গ্রহণ করেন। পুলিশ, সেনাবাহিনী, ইপিআর ও মুক্তিযোদ্ধাসহ এ গ্রুপে ২১০ জনের মতো যোদ্ধা ছিলেন। স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে মোবারক মাস্টার, সাবের আলী, হরিপদ বিশ্বাস, ওসমান আলী, সিরাজ মিয়া, সোলায়মানসহ ৩১ জন ছিলেন।
২৭শে এপ্রিল সকাল সাড়ে ১০টার দিকে মুক্তিযোদ্ধারা নাস্তা করছিলেন। ঠিক সে-সময় শত্রুবাহিনী মুবাছড়ি ইউনিয়নের সিঙ্গিনালা ব্রিকফিল্ড (চেঙ্গী খালের পূর্ব পাড়) থেকে মহালছড়ির মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরক্ষাব্যূহের ওপর ক্রমাগত তিন ইঞ্চি মর্টারের গোলাবর্ষণ শুরু করে। একই সঙ্গে মর্টারের ধোঁয়া-সৃষ্টিকারী গোলার সাহায্যে পাকিস্তানি বাহিনী মুক্তিবাহিনীর প্রতিরক্ষার সামনে ধূম্রকুণ্ডলী সৃষ্টি করে। মুহূর্তেই মুক্তিসেনারাও পাল্টা আক্রমণ শুরু করেন। শুরু হয় প্রচণ্ড যুদ্ধ। পাকিস্তানি বাহিনী এবং মিজোদের আক্রমণের ধরন ছিল প্রচলিত আক্রমণরীতির বাইরে ঢেউয়ের মতো একটির পর একটি। শত্রুরা ইতোমধ্যে গোপনে হেলিকপ্টারে দ্বিতীয় কমান্ডো ব্যাটালিয়নের এক কোম্পানিকে মিজো ব্যাটালিয়নের দুটি অবস্থানে নামিয়ে রেখেছিল। শত্রুবাহিনী একের পর এক মিজোদের পাঠাতে থাকে। মুক্তিযোদ্ধারা মিজোদের আক্রমণ প্রতিহত করে চলছিলেন। তাঁদের গুলিতে অনেক মিজো হতাহত হয়। পাকিস্তানি বাহিনী এমনভাবে মিজোদের পেছনে অবস্থান নিয়েছিল যে, কোনো মিজো পালাতে চেষ্টা করলেই তাকে গুলি করে হত্যা করা যায়। পেছনে ফেরার কোনো পথ না থাকায় মিজোরা প্রাণপণে যুদ্ধ করতে থাকে এবং এক পর্যায়ে তাদের ছোট-ছোট কয়েকটি দল জঙ্গলের আড়ালে কিছু সুবিধাজনক জায়গায় অবস্থান নেয়। সেখান থেকে তারা যে শুধু মুক্তিযোদ্ধাদের ডিফেন্স স্থানগুলো দেখতে পাচ্ছিল তা-ই নয়, বরং গুরুত্বপূর্ণ মহালছড়ির রাস্তাও দেখা যাচ্ছিল। ফলে সমস্ত এলাকা শত্রুর ফায়ারিং রেঞ্জের ভেতরে চলে আসে। পাহাড়ি এলাকায় যুদ্ধ চালানোর জন্য যে বিশেষ ধরনের প্রশিক্ষণ দরকার, সে-প্রশিক্ষণ না থাকায় এবং যুদ্ধ চালানোর প্রয়োজনীয় রসদ না থাকায় মুক্তিযোদ্ধা দল মহালছড়িতে বিপর্যের সম্মুখীন হয়।
প্রথমদিকে শত্রুর হতাহতের সংখ্যা বাড়লেও পরবর্তী পর্যায়ে তাদের পক্ষ থেকে আরো আক্রমণ আসতে থাকে। এত শক্তিশালী আক্রমণ ছিল মুক্তিবাহিনীর কল্পনার বাইরে। এমতাবস্থায় শত্রুর বেষ্টনী থেকে বেরিয়ে আসার জন্য মুক্তিযোদ্ধারা অসীম সাহসের সঙ্গে যুদ্ধ করতে থাকেন। কিন্তু তখনই বামে বসানো সবচেয়ে কার্যকর মেশিনগানটির যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে ফায়ার বন্ধ হয়ে যায়। শত্রু প্রায় ২০০ গজ দূরত্বের মধ্যে চলে আসে। কিছু দূরে ডাকবাংলোয় সামনের অবস্থানে ছিলেন মেজর মীর শওকত আলী। তিনি মেশিনগানটি ফায়ার করছে না দেখে দ্রুত পাশের এলএমজি থেকে অগ্রসরমাণ শত্রুর দিকে ফায়ার করার জন্য ক্যাপ্টেন আফতাবুল কাদেরকে নির্দেশ দেন। ক্যাপ্টেন আফতাবুল কাদের দেখলেন মেশিনগানার প্রাণপণ চেষ্টা করছেন সেটিকে ঠিক করার, কিন্তু ফায়ার হচ্ছে না। কিছু দূরে অবস্থান নেয়া এলএমজির সঙ্গের সৈনিক শত্রুপক্ষের প্রচণ্ড মর্টার ফায়ারের নিচে পড়ে ফায়ার করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেন। ইতোমধ্যে শত্রুর মর্টার ফায়ারের তীব্রতা আরো বেড়ে যায়। সম্মুখ লাইনের সৈনিকরা দেখতে পান যে, প্রায় ২০০ গজ দূরে কালো পোশাক পরিহিত মিজোরা ধেয়ে আসছে। তাদের নিয়ন্ত্রণ করছে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কমান্ডো সৈনিকরা। আফতাবুল কাদেরের মনে হলো এলএমজির অপারেটর সৈনিকের শেল্শক্ হয়েছে এবং সেজন্য তিনি আর সঠিকভাবে ফায়ার করতে পারছেন না। এমনি সময় শত্রুদের আরো একটি বাহিনী তাদের দিকে আক্রমণের উদ্দেশ্যে এগিয়ে আসছিল। এরূপ পরিস্থিতিতে সাহসী অফিসার ক্যাপ্টেন আফতাবুল কাদের গোলাগুলির মধ্যে দৌড়ে এলএমজির কাছে গিয়ে এর অপারেটরকে সরিয়ে দিয়ে নিজে ক্রমাগত ফায়ার করতে থাকেন। দেখতে-দেখতে তিনটি ম্যাগাজিন গুলি অগ্রসরমাণ শত্রুসৈনিকদের ওপর ছোড়েন। প্রতিটি গুলি ছিল লক্ষ্যভেদী। ফলে অগ্ররসমাণ পাকিস্তানি কমান্ডো ব্যাটালিয়নের সদস্যরা এবং মিজোরা আর অগ্রসর হতে পারছিল না। আফতাবুল কাদেরের আক্রমণে ২০ জনের মতো শত্রুসেনা নিহত হয়, আহত হয় অনেক। মুহূর্তের মধ্যে আরো শত্রুসৈন্য ঘটনাস্থলে এসে আবার আক্রমণ করার প্রস্তুতি নেয়। মনে হচ্ছিল, শত্রুসৈন্য ঢেউয়ের মতো অগ্রসর হচ্ছিল। আফতাবুল কাদের একটু সামনে এগিয়ে যান। কারণ, পূর্বের পজিশন থেকে শত্রুদের ভালোমতো পর্যবেক্ষণ করা যাচ্ছিল না এবং শত্রুরা একটু নিচুতে অবস্থান নিয়ে অগ্রসর হচ্ছিল। তিনি এলএমজি নিয়ে জীবন বিপন্ন করে শত্রুর ওপর ক্রমাগত ফায়ার করতে থাকেন। তিনি কোনো ট্রেঞ্জে অবস্থান না নিয়ে খোলা জায়গায় অবস্থান নিয়েছিলেন। সে সুযোগে শত্রুবেষ্টনী থেকে কিছু মুক্তিযোদ্ধার পক্ষে নিরাপদে বেরিয়ে আসা সম্ভব হয়। ক্যাপ্টেন খালেকুজ্জামান ইতোমধ্যে শত্রুদের ঘেরাওয়ের মধ্যে পড়ে যান। ক্যাপ্টেন আফতাবুল কাদেরের ফায়ারিংয়ের মুখে শত্রুর আক্রমন বিলম্বিত হয়। এ-সময় শত্রুর অগ্রযাত্রা প্রতিহত করতে প্রতিরক্ষা বেষ্টনী গড়ে তোলার নতুন সিদ্ধান্ত নেন মেজর মীর শওকত। ক্যাপ্টেন আফতাবুল কাদেরের কার্যকর ফায়ার এবং দুঃসাহসী ভূমিকার জন্যই মুক্তিযোদ্ধারা নিরাপদে পশ্চাদপসরণ করতে সক্ষম হন৷
এক পর্যায়ে শত্রুর একটি গুলি এসে ক্যাপ্টেন আফতাবুল কাদেরের বুকে লাগে। সঙ্গে-সঙ্গে তিনি এলএমজি হাতে দাঁড়িয়ে পড়েন এবং বলেন ‘আই হ্যাভ বিন হিট’। সবাই অবিশ্বাসের সঙ্গে তাঁর দিকে তাকান এবং তিনি এলএমজি হাতেই মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। হাতের এলএমজি তিনি জোরে ধরে রেখেছিলেন তখনো। সবাই দেখে অবাক যে, এমন মুমূর্ষু অবস্থায়ও ক্যাপ্টেন আফতাবুল কাদের মেশিনগান থেকে হাত সরাননি। তখন চারদিকে প্রচণ্ড গোলাগুলি চলছিল। সে-সময় মুক্তিযোদ্ধা শওকত আলী ও ফজলুর রহমান ফারুক ক্রলিং করে ফায়ারিং লাইনের নিচ দিয়ে আফতাবুল কাদেরকে নিচু জমিতে নিয়ে আসেন। পাশের পজিশনে অবস্থানরত মেজর শওকতকে তাঁরা জানান যে, ক্যাপ্টেন আফতাব গুলিতে আহত। তাঁরা চিৎকার করতে থাকেন জিপ পাঠানোর জন্য। যুদ্ধক্ষেত্রের একটু দূরে নিচু জমিতে মুক্তিযোদ্ধাদের কয়েকটি জিপ ও পিআপ ছিল। একজন সৈনিক দৌড়ে গিয়ে ড্রাইভার আব্বাসকে গাড়ি নিয়ে আসার জন্য খবর দেন। ড্রাইভার আব্বাস ছিলেন ইপিআর বাহিনীর আর এক দুর্দান্ত সাহসী সৈনিক। তিনি গোলাগুলির মধ্যে প্রচণ্ড বেগে জিপ নিয়ে পাহাড়ের নিচে এসে দাঁড়ান এবং সঙ্গে-সঙ্গে আফতাবুল কাদেরকে জিপে তোলা হয়।
তাঁরা ৩টা ৪৫ মিনিটের দিকে একটি সাদা জিপে করে গোলাগুলির মধ্যে রওনা হন রামগড়ের দিকে। মুক্তিযোদ্ধা শওকত আলী ও ফজলুর রহমান এবং মাসুদুর রহমান নামে অপর এক মুক্তিযোদ্ধা এ ৩ জন জিপে করেই আফতাব কাদেরকে রামগড় নিয়ে যান। গাড়ির ঝাঁকুনিতে তাঁরা বুঝতে পারেননি আফতাবুল কাদের আদৌ বেঁচে আছেন কি-না রামগড় হাসপাতালে নেয়ার পর জানতে পারেন সেখানে কোনো ডাক্তার নেই। তাঁরা উপয়ান্তর না দেখে মেজর জিয়ার হেডকোয়ার্টার্স শহরের পোস্ট অফিস বিল্ডিংয়ে তাঁকে নিয়ে যান। সেখানে পৌঁছার সঙ্গে-সঙ্গে কিছু সৈন্য দৌড়ে মহকুমা মেডিকেল অফিসার সিরাজুল ইসলামের বাসভবনে ছুটে যান। সিরাজুল ইসলাম দ্রুত এসে দেখেন আফতাবুল কাদের আর বেঁচে নেই। রামগড় শহরের প্রধান সড়কের পাশেই চিরনিদ্রায় শুয়ে আছেন বাংলার এই বীর সন্তান ক্যাপ্টেন আফতাবুল কাদের। সেদিন নিজের জীবনের বিনিময়ে হানাদার পাকিস্তানি সৈন্যদের অনেককে হতাহত করে তিনি কমপক্ষে ২০০ মুক্তিসেনার জীবন বাঁচিয়েছিলেন। যদি তিনি সেখানেই হানাদারদের ঠেকিয়ে না রাখতেন, তাহলে অনেক মুক্তিযোদ্ধা প্রাণ হারাতেন।
মুক্তিবাহিনীর মাত্র দুই কোম্পানি সৈন্য পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ ছাড়াই হালকা অস্ত্র নিয়ে শত্রুবাহিনীর প্রতিরোধে অংশ নেয়। প্রাথমিকভাবে প্রতিরোধ গড়ে তুললেও তাঁরা পরবর্তী সময়ে বিপদের সম্মুখীন হন। রি-ইনফোর্সমেন্টের অভাব ছিল মুক্তিবাহিনীর। এতদ্সত্ত্বেও মিজো লায়ন ব্যাটালিয়ন, যারা ঢেউয়ের মতো করে একের পর এক আক্রমণ পরিচালনা করছিল, তাদেরও বহু সদস্য হতাহত হয়। এ সংঘর্ষে পাকিস্তানি কমান্ডো কোম্পানিরও বেশকিছু সৈন্য হতাহত হয়। তবে ক্যাপ্টেন আফতাবুল কাদের ছাড়া আর কোনো মুক্তিসেনা হতাহত হননি।
এদিকে পাকিস্তানি হানাদাররা মহালছড়ি বাজারে আগুন দেয়। সারা বিকেল আগুন জ্বলে। দোকান ও ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয়া হয়। এরপরই শুরু হয় পাকিস্তানি বাহিনীর নারকীয় হত্যাকাণ্ড ও ধ্বংসলীলা। [ইয়াছিন রানা সোহেল]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৭ম খণ্ড