You dont have javascript enabled! Please enable it! বীর বিক্রম মহসিন উদ্দিন আহমেদ - সংগ্রামের নোটবুক

বীর বিক্রম মহসিন উদ্দিন আহমেদ

মহসিন উদ্দিন আহমেদ, বীর বিক্রম (১৯৩৯-১৯৮১) বীর মুক্তিযোদ্ধা। তিনি ১৯৩৯ সালে বর্তমান মুন্সীগঞ্জ জেলার শ্রীনগর উপজেলার দামলা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম মহিউদ্দিন আহমেদ এবং মাতার নাম বেগম নূরুন নাহার। মহসিন উদ্দিন আহমেদ ঢাকার আরমানিটোলা হাইস্কুল থেকে মেট্রিকুলেশন এবং ঢাকা কলেজ থেকে এইচএসসি ও স্নাতক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ১৯৬৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভূগোল বিভাগে এমএ শ্রেণিতে অধ্যয়নরত অবস্থায় তিনি পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর পিএমএ লং কোর্সে ক্যাডেট হিসেবে যোগদান করেন। এবোটাবাদের কাকুলস্থ পাকিস্তান মিলিটারি একাডেমি থেকে সফলতার সঙ্গে প্রশিক্ষণ শেষ করে ১৯৬৫ সালে তিনি কমিশনপ্রাপ্ত হন এবং পাকিস্তান সামরিক বাহিনীতে সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট পদে তৃতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে যোগদান করেন।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরুর প্রাক্কালে মহসিন উদ্দিন আহমেদ চট্টগ্রাম সেনানিবাসে ক্যাপ্টেন পদে ইস্ট বেঙ্গল সেন্টারে এডজুট্যান্ট হিসেবে কর্মরত ছিলেন। ২৫শে মার্চ রাতে অপারেশন সার্চলাইট-এর নামে পাকিস্তানি বাহিনী ঢাকাসহ দেশের বিভন্ন স্থানে ব্যাপক হত্যাকাণ্ড শুরু করে। এরই অংশ হিসেবে ২৬শে মার্চ তারা চট্টগ্রাম সেনানিবাসের ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট সেন্টারে গুলি চালিয়ে অনেক বাঙালি সেনাকে হত্যা করে। এমতাবস্থায় ক্যাপ্টেন মহসিন উদ্দিন চট্টগ্রাম সেনানিবাস থেকে পালিয়ে এসে ৮ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অধিনায়ক জিয়াউর রহমান, বীর উত্তম-এর নেতৃত্বে পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র প্রতিরোধযুদ্ধ শুরু করেন। পরবর্তীতে ৭ই জুলাই ব্রিগেড আকারে ‘জেড ফোর্স’ গঠন করা হলে তিনি এই ফোর্সের তৃতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের চার্লি কোম্পানির অধিনায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে তিনি মেজর পদে উন্নীত হন এবং জেড ফোর্সের সেকেন্ড-ইন-কমান্ড হিসেবে পোস্টিং পান। তিনি নকশী বিওপি অপারেশন, লামাকাজি ঘাঁটি অপারেশন, ছাতকের টেংরাটিলা অপারেশনসহ বিভিন্ন যুদ্ধে সাহসিকতাপূর্ণ অবদান রাখেন। এ-সকল অপারেশনের মধ্যে টেংরাটিলা অপারেশন বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এখানে ছিল পাকবাহিনীর একটি শক্ত প্রতিরক্ষা ঘাঁটি। এ ঘাঁটির উত্তরদিকে সীমান্তবর্তী বাঁশতলায় ছিল মুক্তিবাহিনীর ৫নং সেক্টর এবং এর অন্তর্গত শেলা সাব-সেক্টরের হেডকোয়ার্টার্স। ১২ই অক্টোবর বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান সেনাপতি এ হেডকোয়ার্টার্স পরিদর্শন করে মুক্তিযোদ্ধাদের ছাতক সিমেন্ট ফ্যাক্টরি এলাকায় পাকিস্তানি ঘাঁটি আক্রমণের নির্দেশ দেন। এরই মধ্যে ‘জেড’ ফোর্সের তৃতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট তেলঢালা ক্যাম্প থেকে এসে এখানে যোগ দেয়। অপারেশনের পরিকল্পনামতে পাকিস্তানি সেনাদের অবস্থানের ওপর মূল আক্রমণে থাকবে আলফা কোম্পানির অধিনায়ক ক্যাপ্টেন মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন, বীর প্রতীক, ব্রাভো কোম্পানির অধিনায়ক ক্যাপ্টেন আকবর হোসেন, বীর প্রতীক এবং কমান্ডার আখতারের ছাত্র কোম্পানি। দোয়ারা বাজারের টেংরাটিলায় অবস্থান নিয়ে কাট অব পার্টি হিসেবে অপারেশনে থাকবে মহসিন উদ্দিন আহমেদের চার্লি কোম্পানি। পর্যাপ্ত পূর্ব রেকি না করেই ১৪ই অক্টোবর মহসিন উদ্দিনের কোম্পানি চারটি নৌকায় করে সুরমা নদী দিয়ে টেংরাটিলায় পৌছানোমাত্রই পাকসেনারা অতর্কিতে আক্রমণ করে ক্যাপ্টেন মহসিনের চারটি নৌকাই পানিতে ডুবিয়ে দেয়। এতে অনেক মুক্তিযোদ্ধা হতাহত হন। নদীতে ভাসমান অবস্থায়ও মহসিন উদ্দিন বীরত্বের সঙ্গে ফায়ার ওপেন করেন। ফলে, বেশ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা নিরাপদে তীরে পৌঁছতে সক্ষম হন। এ-যুদ্ধে মহসিন উদ্দিনের কপাল ঘেঁষে একটি বুলেট চলে গেলে তিনি সামান্য আহত হন।
মুক্তিযুদ্ধে বীরত্ব ও অসামান্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ বাংলাদেশ সরকার মহসিন উদ্দিন আহমেদকে ‘বীর বিক্রম’ খেতাবে ভূষিত করে। মুক্তিযুদ্ধ শেষে তিনি তাঁর কর্মক্ষেত্র বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে যোগদান করেন এবং পদোন্নতি পেয়ে ১৯৭৮ সালে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল পদে উন্নীত হন ১৯৮১ সালের ৩০শে মে তিনি চট্টগ্রাম সেনানিবাসে ৬৯ ব্রিগেড কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করা অবস্থায় প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান এক সেনাবিদ্রোহে নিহত হন। এ হত্যা মামলায় অভিযুক্ত করে মহসিন উদ্দিনকে ২রা জুন গ্রেফতার করা হয় এবং বিচারে তাঁকে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেয়া হয়। ২৩শে সেপ্টেম্বর এ বীর মুক্তিযোদ্ধার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। ব্যক্তিজীবনে তিনি দুই কন্যা ও এক পুত্র সন্তানের জনক। তাঁর স্ত্রীর নাম হোসনে আরা। [সাজাহান মিয়া]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৭ম খণ্ড