You dont have javascript enabled! Please enable it! স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা দল মহসিন খান গ্রুপ (পটিয়া, চট্টগ্রাম) - সংগ্রামের নোটবুক

স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা দল মহসিন খান গ্রুপ (পটিয়া, চট্টগ্রাম)

মহসিন খান গ্রুপ (পটিয়া, চট্টগ্রাম) চট্টগ্রাম জেলার পটিয়া উপজেলার বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা মহসিন খান (নাইখাইন, পটিয়া)-এর নামে গড়ে ওঠা একটি স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা দল। এটি অত্র এলাকার মুক্তিযুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বীরত্বের সঙ্গে লড়াই করে এ গ্রুপের একাধিক মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। এ গ্রুপের কাছে পাকিস্তানি হানাদার সৈন্য ও রাজাকাররা পরাজিত ও বিপর্যস্ত হয়।
ফ্লাইট সার্জেন্ট মহিউল আলম চট্টগ্রাম থেকে ভারতে যাওয়ার পর তাঁকে ১নং সেক্টরের হরিণা ক্যাম্প থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের ৩৬টি গ্রুপের প্রধান ও দক্ষিণ চট্টগ্রামের কমান্ডার নিযুক্ত করা হয়। তাঁকে বঙ্গোপসাগরে নৌ-কমান্ডো অপারেশন পরিচালনার দায়িত্বও দেয়া হয়। ৩রা আগস্ট তিনি তাঁর অধীনস্থ মুক্তিযোদ্ধাদের সকল গ্রুপ নিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেন। তাঁর সঙ্গে ছিলেন হাফেজ মৌলভী আহমদুল হক (নাইখাইন, পটিয়া), জহুরুল হক ও নুর মোহাম্মদ (লড়িহরা)। চট্টগ্রামের মিরসরাই, ফটিকছড়ি, আনোয়ারা, বোয়ালখালী ও পটিয়াসহ বিভিন্ন স্থানে তিনি বিভিন্ন গ্রুপকে নিযুক্ত করেন। পটিয়ায় দায়িত্বপ্রাপ্ত গ্রুপ ছিল ৩৩ নম্বর মহসিন খান গ্রুপ। এ গ্রুপ পটিয়ায় আসার পর আরো অনেক স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা এতে যোগ দেন। এক্ষেত্রে সংগঠক হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন হাফেজ মৌলভী আহমদুল হক, জহুরুল হক ও নুর মোহাম্মদ। এছাড়া জিরির মধুসূদন নাথ ও আবদুস সবুর, নাইখাইনের ডা. ফারুক আহমদ, আবদুস সালাম সিদ্দিকি এবং ব্রজেন সেনের নামও উল্লেখযোগ্য।
মহসিন খান গ্রুপের মুক্তিযোদ্ধারা পটিয়া অঞ্চলে যৌথ ও এককভাবে অনেক অপারেশন পরিচালনা করেন। এসব অপারেশনের মধ্যে পটিয়া ইন্দ্রপুল অপারেশন, গৈড়লার টেক অপারেশন ও জিরি কাজির হাট যুদ্ধ উল্লেখযোগ্য। ইন্দ্রপুল অপারেশন সংঘটিত হয় ১৯শে নভেম্বর। শাহজাহান ইসলামাবাদী গ্রুপ, আবদুল গফুর গ্রুপ, এ কে এম সামছুল আলম গ্রুপ ও শাহ আলম গ্রুপের সঙ্গে মহসিন খান গ্রুপ যৌথভাবে এ অপারেশনে অংশ নেয়। মুক্তিযোদ্ধারা এখানকার ব্রিজ ধ্বংস করেন। জিরি কাজির হাট যুদ্ধ সংঘটিত হয় ২রা ডিসেম্বর। ১লা ডিসেম্বর রাতে শাহজাহান ইসলামাবাদী গ্রুপ কাজির হাটের পূর্বদিকে এবং মহসিন খান গ্রুপ কাজির হাটের পশ্চিমে কাজি বাড়িতে এম্বুশ করে। ২রা ডিসেম্বর ভোরে অধ্যাপক গৌরাঙ্গ প্রসাদ মিত্র গ্রুপের মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ লোকমান জিরি এলাকার নিজ বাড়ি থেকে আশিয়ায় তাঁদের ক্যাম্পে ফিরছিলেন। আশিয়ায় আহমদ নবী (পিতা নূর বকসু মাঝি)-র ঘরের সম্মুখস্থ ক্লাব-ঘরে এ ক্যাম্প ছিল। কাজির হাটের পূর্বদিকে শাহজাহান ইসলামাবাদী গ্রুপকে এম্বুশ অবস্থায় দেখে এ গ্রুপ থেকে একটু দূরে ধানক্ষেতের আড়ালে মুক্তিযোদ্ধা লোকমানও এম্বুশ করেন। লোকমানের সঙ্গে ছিল একটি স্টেনগান। ভেল্লাপাড়ায় পাকিস্তানি বাহিনী অবস্থান নিয়েছিল। রাতভর এম্বুশে থাকার পরও পাকিস্তানি সৈন্যদের আসতে না দেখে দিনের এক পর্যায়ে এম্বুশ প্রত্যাহার করে শাহজাহান ইসলামাবাদী তাঁর গ্রুপ নিয়ে বরমায় নিজেদের ক্যাম্পে যান। কিন্তু এটা টের না পেয়ে লোকমান ধানগাছের আড়ালে এম্বুশ অবস্থায় থেকে যান। শাহজাহান ইসলামাবাদী গ্রুপ চলে যাওয়ার পর দুটি জিপে করে পাকিস্তানি বাহিনী ও রাজাকার মুজাহিদরা জিরি কাজির হাটে আসে। তাদের উদ্দেশ্য ছিল এখানে জ্বালাও-পোড়াও ও গণহত্যা সংঘটিত করা। কিন্তু তারা হাটে আসতেই মহসিন খান গ্রুপ ও মোহাম্মদ লোকমানের আক্রমণের মুখে পড়ে। পাকিস্তানি বাহিনী ও রাজাকার মুজাহিদরা পাল্টা আক্রমণ করলে দুপক্ষের মধ্যে তীব্র যুদ্ধ হয়। যুদ্ধ প্রায় দুঘণ্টা ধরে চলে। এ-যুদ্ধে কাজির হাটের পূর্বদিকে একা এম্বুশে থাকা মোহাম্মদ লোকমান বীরত্বের সঙ্গে লড়াই করেন। তাঁর স্টেনগানের দুই ম্যাগাজিন গুলি শেষ হলে তিনি পুনরায় গুলি ভর্তি করার সুযোগ না পাওয়ায় পাকিস্তানি সেনারা তাঁকে গুলিবিদ্ধ করতে সক্ষম হয়। ফলে তিনি মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। যুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীর গুলিতে মোহাম্মদ লোকমান, মহসিন গ্রুপের বদিউল আলম (ছনহারা, পটিয়া) এবং জিরি এলাকার ধীরেন্দ্র লাল শীল, আবদুস সালাম ও ব্রজেন্দ্র লাল শীল এ ৩ জন গ্রামবাসীসহ মোট ৫ জন শহীদ হন। এছাড়া মহসিন গ্রুপের হাবিলদার আবু তাহের গুলিবিদ্ধ হয়ে মারাত্মক আহত হন। অপরদিকে কয়েকজন পাকিস্তানি সৈন্য এ-যুদ্ধে নিহত হয়।
মহসিন খান গ্রুপের উল্লেখযোগ্য মুক্তিযোদ্ধারা হলেন- কমান্ডার মহসিন খান, সুনিল দে (মুজাফ্ফরাবাদ, পটিয়া), মোহাম্মদ ইউসুফ (চরলক্ষ্যা, কর্ণফুলী), হাবিলদার আহমদ ছফা (নাইখাইন), বিন্দু নাথ (জিরি, পটিয়া), মুহাম্মদ মুছা (চরলক্ষ্যা), স্বপন দত্ত (কেলিশহর, পটিয়া), গোপাল দে (ধলঘাট, পটিয়া), বদিউল আলম (ছনহরা, পটিয়া; জিরি কাজিরহাট যুদ্ধে শহীদ), সুজিত পাল (পাইরোল, পটিয়া), বনমালী দে (মুজাফ্ফরাবাদ), আবদুস সালাম (নাইখাইন), কামরুল ইসলাম (পেরলা, পটিয়া), চন্দন দে (নাইখাইন), আবুল হোসেন (গাছবাড়িয়া, চন্দনাইশ), হাবিলদার আবদুস সবুর (চরলক্ষ্যা), মোহাম্মদ ইসহাক (গৈড়লা, পটিয়া), মো. হারুন অর রশিদ (নাইখাইন), মোহাম্মদ জালাল (মালিয়ারা, পটিয়া), সাইফুদ্দিন ছগির (নাইখাইন), আবদুস সবুর (নাইখাইন), আহমদ ছগির (নাইখাইন), মো. নাছির উদ্দিন শরীফ (পেরলা), মো. ইউনুছ চৌধুরী (লড়িহরা, পটিয়া), আলী আহমদ (হুলাইন, পটিয়া), আহমদ হোসেন (নাইখাইন), মো. আবু তাহের (নাইখাইন), জবল আহমদ (তেকোটা, পটিয়া), আবু তাহের চৌধুরী (জিরি), দিল মোহাম্মদ (জিরি), নুরুল আলম (গৈড়লা), হাবিলদার হাফেজ আহমদ চৌধুরী (জঙ্গলখাইন, পটিয়া), জাফর উল্লাহ (নাইখাইন), খোকন নন্দী (কেলিশহর, পটিয়া), অনিল দে (কেলিশহর), হাবিলদার শরীফ (নাইখাইন), দুদু মিয়া (নাইখাইন), আইয়ুব আলী (নাইখাইন), নুরুল আলম (গোরনখাইন), মো. আবু তৈয়ব চৌধুরী (লড়িহরা), চন্দন লালা (গৈড়লা), হাবিলদার আবু তাহের (নাইখাইন) ও মোহাম্মদ ইলিয়াস (পেরলা)। [শামসুল আরেফীন]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৭ম খণ্ড