মনোহরদী সদর যুদ্ধ (মনোহরদী, নরসিংদী)
মনোহরদী সদর যুদ্ধ (মনোহরদী, নরসিংদী) সংঘটিত হয় ২০শে অক্টোবর। এতে পাকবাহিনী পরাজিত হয় এবং মুক্তিযোদ্ধারা পাকসেনাদের ক্যাম্প দখল করে নেন। মনোহরদী সদরের যুদ্ধের প্রস্তুতিস্বরূপ ১৯শে অক্টোবর রাতে ইপিআর জেয়ানদের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের এক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। রাত ১০টার দিকে ডা. শামসুল হকের বাসায় ঐ বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা মো. ইয়াকুব আলী, আওরঙ্গজেব ও ইয়াকুব মোল্লা। বৈঠকে বাঙালি ইপিআর সদস্যরা মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে যোগ দিয়ে পাকহানাদারদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে সম্মত হন। গোপন সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বাঙালি ইপিআর সদস্যরা ২০ তারিখ মনোহরদী ক্যাম্প থেকে পালিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের দলে যোগ দেন। ইপিআর জোয়ানরা জানান তাঁদের ডিফেন্স ব্যবস্থা খুবই মজবুত। ক্যাম্পের চতুর্দিক দিয়েই রয়েছে দুর্ভেদ্য ব্যাংকার। কিন্তু তাদের একটি বড় গ্রুপ রেশন আনতে নরসিংদী চলে যাবে ঐদিন। ক্যাম্পে অবশিষ্ট ২৫-২৬ জন পাকিস্তানি সেনার মধ্যে মিলিশিয়াই ছিল বেশি। কাজেই ক্যাম্প আক্রমণ করার এটাই মোক্ষম সময়। সঙ্গে-সঙ্গে পাকবাহিনীর ক্যাম্প আক্রমণের সিদ্ধান্ত হয়। তখন লাখপুরের মুক্তিযাদ্ধা ক্যাম্পে মুক্তিযোদ্ধাদের সংখ্যা ছিল ৬০-৭০ জনের মতো। অস্ত্রহাতে মুক্তিযোদ্ধারা লাখপুর গ্রামের ভেতর দিয়ে অগ্রসর হয়ে চন্দনবাড়ী গ্রামের উত্তর পাশে অবস্থিত বৈকুণ্ঠ জীবন বীরের বাড়ির কাছে পৌঁছার পর জানতে পারেন যে, পাকিস্তানি ক্যাম্পের কমান্ডার মেজর জুলফিকার আলী কয়েকজন পাকসেনা নিয়ে পালিয়ে যাওয়া। ইপিআর জোয়ানদের খুঁজতে অর্জুনচরের তালুকদার বাড়ি অতিক্রম করেছে এবং পথিমধ্যে তারা চন্দনবাড়ীর নাজীর আহাম্মদ সেকান্দর আলী পাইলট হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক ও কাপাসিয়া থানার ঘাগটিয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান, খিরাটী হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক আ. হামিদ বিটি-র জ্যেষ্ঠ পুত্র আ. হালিম ননী এবং চন্দনবাড়ী গ্রামের ইউনুছ ফরেস্টারের ছেলে মতিউরকে ধরে ফেলে। তাদেরকে বেঁধে মুক্তিবাহিনীর খবর এবং পালিয়ে যাওয়া ইপিআর সদস্যদের সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করছিল। এ সংবাদ পেয়ে চন্দনবাড়ী গ্রামের পশ্চিম পাশের বিলের পূর্ব তীরে মুক্তিযোদ্ধারা অবস্থান গ্রহণ করেন এবং পশ্চিম দিকে অর্থাৎ অর্জুনচরের দিকে তাক করে পজিশন নেন। ফলে বেশির ভাগ লোক বিল পেরিয়ে অর্জুনচর গ্রামে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিল। এমতাবস্থায় ২-৩ জন পাকিস্তানি সেনাসদস্য তালুকদার বাড়ির পূর্ব পাশে এসে বাইনোকুলার দিয়ে পূর্ব দিকের চন্দনবাড়ী গ্রামের দিক দেখতে থাকে। তারা এম্বুশ করা মুক্তিবাহিনীর সদস্যদের দেখতে পেয়ে দ্রুত ছুটে গিয়ে মেজর জুলফিকারকে খবর দেয়। মেজর জুলফিকার আলী বন্দি ৩ যুবককে ছেড়ে দিয়ে দ্রুত মনোহরদী ক্যাম্পে ফিরে যায়। এ খবর জানতে পেরে মুক্তিযোদ্ধারা অবস্থান ত্যাগ করে দক্ষিণ দিকে অগ্রসর হয়ে নামাপাড়া পেছনে ফেলে লাল মিয়া মিলিটারির বাড়ির নিকটস্থ রিফিউজি পাড়ায় গিয়ে অবস্থান গ্রহণ করেন।
রিফিউজি পাড়ার ছোট-ছোট কাঁচা ঘরের সংকীর্ণ ফাঁকে- ফাঁকে অস্ত্রধারী মুক্তিযোদ্ধারা পশ্চিম দিকে অস্ত্র তাক করে শুইয়ে গুলি চালানোর জন্য তৈরি থাকেন। শতশত জনতা একইভাবে অবস্থান নেয়। সংকেত ফায়ারিংয়ের পর যুদ্ধ শুরু হওয়ার কথা। কিন্তু ইতোমধ্যে লাল মিয়া মিলিটারির বাড়ির পূর্ব পাশের আখক্ষেতের উঁচু আইল সংলগ্ন নীচু ভূমিতে যেসব মুক্তিযোদ্ধা অবস্থান নিয়েছিলেন, তাঁদের সামনের আখক্ষেতের দিক থেকে দুজন পাকসেনা বাইনোকুলার দিয়ে লক্ষ করতে-করতে প্রায় তাদের সামনে এসে পড়ায় তারা ফায়ারিং ওপেন করেন। ঐ দুই পাকসেনা মাটিতে শুয়ে ক্রলিং করে পেছনে চলে যায়। আর ঠিক ঐ মুহূর্তেই পাকসেনারা ফায়ারিং ওপেন করে। মুক্তিযোদ্ধারা বেপরোয়াভাবে গুলি ছুড়তে থাকে। অস্ত্রহীন জনতা ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিয়ে আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত করে তোলে। থেমে-থেমে প্রচণ্ড গোলাগুলি চলতে থাকল। মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে মেশিনগান ছিল। পাকবাহিনীর কাছে কোনো মেশিনগান ছিল না। পরের দিন মুক্তিযোদ্ধারা পাকসেনা ক্যাম্প দখল করেন। মনোহরদী যুদ্ধে পাকবাহিনীর পরাজয় মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবল বাড়িয়ে দেয়। [এম আর মাহবুব]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৭ম খণ্ড