You dont have javascript enabled! Please enable it! ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর কেন্টিনের স্বত্বাধিকারী মধুসূদন দে - সংগ্রামের নোটবুক

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর কেন্টিনের স্বত্বাধিকারী মধুসূদন দে

মধুসূদন দে (১৯১৯-১৯৭১) মধু দা হিসেবে সমধিক পরিচিত। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর কেন্টিনের স্বত্বাধিকারী এবং ৭১-এর ২৬শে মার্চ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর গণহত্যায় পরিবারের অধিকাংশ সদস্যসহ শহীদ। তিনি ১৯১৯ সালে মুন্সীগঞ্জ জেলার শ্রীনগর উপজেলার বিক্রমপুরে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম আদিত্য চন্দ্র দে এবং মাতার নাম মিরোদা সুন্দরী দেবী।
১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর পিতা আদিত্য চন্দ্ৰ দে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগে ফেরি করে চা ও খাবার বিক্রি করতেন। এভাবে ফেরি করে চলতে অসুবিধা হওয়ায় বিশ্ববিদ্যালয়ের সিঁড়ির নিচে একটি দোকান খোলেন। তখন বিশ্ববিদ্যালয় ছিল বর্তমান ঢাকা মেডিকেল কলেজ ভবনে। ১৯২২-২৩ সালে তিনি বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় একটি অস্থায়ী দোকান তৈরি করেন। এ-সময় ব্রিটিশ পুলিশ ক্যাম্পাস থেকে ব্যারাক ও ক্যাম্প উচ্ছেদ শুরু করলে আদিত্য চন্দ্র দে ৩০ টাকার বিনিময়ে ব্রিটিশ পুলিশের কাছ থেকে দুটি ছনের ঘর কিনে নেন এবং তার একটিতে বসবাস শুরু করেন।
ছোটবেলা থেকে মধুসূদন দে পিতা আদিত্য চন্দ্রের সঙ্গে খাবারের ব্যবসায় জড়িত ছিলেন। ১৯৩৯ সালে পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে পিতা আদিত্য চন্দ্র মৃত্যুবরণ করলে মধুসূদন পারিবারিক ব্যবসার হাল ধরেন। ১৯৬৫-৬৬ শিক্ষাবর্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বর্তমান অবস্থানে স্থানান্তরিত হয়। শিক্ষার্থীদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ডাকসু-র কার্যক্রম শুরু হয় এবং কলা ভবন সংলগ্ন পূর্ব পাশে মধুসূদন দে-র দায়িত্বে ‘মধুর ক্যান্টিন’ চালু হয়। উল্লেখ্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ অনেক আগেই মধুর ক্যান্টিন এবং মধুসূদন দে-কে ক্যান্টিন পরিচালনার বৈধতা দিয়েছিল।
মধুসূদন দে-র আন্তরিক ব্যবহার ও সততার জন্য খুব অল্প সময়ের মধ্যে শিক্ষার্থীদের মাঝে তিনি বিশ্বস্ত হয়ে ওঠেন। তিনি সকলের কাছে ছিলেন প্রিয় ‘মধু দা’। ক্রমেই মধুর কেন্টিন হয়ে ওঠে ছাত্ররাজনীতির সূতিকাগার এবং অনেক শিক্ষার্থীর ভরসার স্থল। ৪৮ ও ৫২-র ভাষা-আন্দোলন-, ৪৯-এ বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪র্থ শ্রেণির কর্মচারীদের আন্দোলন, ৬২ ও ৬৪-র শিক্ষা আন্দোলন, ৬৬-র ৬ দফা দাবি, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান – ৭০-এর নির্বাচন, সর্বোপরি বাঙালির স্বাধীনতা যুদ্ধ প্রতিটি ক্ষেত্রে ছাত্রনেতৃবৃন্দ এ কেন্টিনে বসে অনেক গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেন। ৬৯-৭১ সময়ে বহু সভা হয়েছে এ ক্যান্টিনে। সভায় গৃহীত অনেক সিদ্ধান্ত সম্বন্ধে মধুদা জানতেন। স্বাভাবিকভাবেই পুলিশ ও ইপিআর বাহিনীর চোখে পড়ে যান মধু দা। এভাবেই প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক ছাত্র-আন্দোলনের নিরাপদ আশ্রয়কেন্দ্র হয়ে ওঠে মধুর ক্যান্টিন|
অনেক ছাত্রের সকালের নাস্তা, দুপুরের খাবার আবার বিকেলের নাস্তা মধু দা-র কেন্টিনেই হতো।
রাজনীতির পাশাপাশি সংস্কৃতির চর্চাও চলত মধুর কেন্টিনে। সংস্কৃতি সংসদ এবং নাট্য কেন্দ্রের মতো প্রতিষ্ঠানগুলোর শুরু হয়েছিল মূলত এখানেই, ছাত্রদের চায়ের কাপের আড্ডায়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান –তাজউদ্দীন আহমদ, জয়নুল আবেদীন, কামরুল হাসান, শামসুর রাহমান, হাসান হাফিজুর রহমান, আলাউদ্দীন আল আজাদ, আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ, আব্দুল গাফ্ফারর চৌধুরী, জহির রায়হান, সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহ এবং শহীদুল্লাহ কায়সারের মতো ব্যক্তিবর্গের যাত্রা শুরু হয়েছিল এখান থেকেই।
একদিকে শিক্ষার্থীদের জন্য মধুসূদনের ভালোবাসা, অন্যদিকে মধু দা-র প্রতি শিক্ষার্থীদের শ্রদ্ধা- এসব কিছু পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর কাছে মধু দা-কে সন্দেহভাজন করে তুলেছিল। স্বাধীনতার অনেক আগেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সপরিবারে বসবাসের জন্য মধুসূদন দে-কে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিব মন্দিরের নিকট নির্মিত কর্মচারীদের স্টাফ কোয়ার্টারে একটি বাসা বরাদ্দ করেছিল। ৭১-এর ২৫শে মার্চ কালরাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী নিরস্ত্র বাঙালিদের হত্যায় শুরু করে অপারেশন সার্চলাইট। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছিল এর অন্যতম প্রধান টার্গেট। ২৬শে মার্চ সকালবেলা পাকিস্তানি সৈন্যদের গুলিতে মধুসূদন দে শহীদ হন। এ-সময় তাঁর সঙ্গে শহীদ হন তাঁর অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী প্রতিভাময়ী (যোগমায়া), পুত্র রনজিত এবং নবপরিণীতা পুত্রবধূ রানী। মধুসূদনের মেয়ে রানু আহত হন।
হানাদার বাহিনীর নির্দেশে উপাচার্যের বাড়ির কর্মচারী শ্যামলাল এবং চান্দ দেবরায় মধুসূদনের দেহ নিয়ে আসেন জগন্নাথ হল মাঠে। শেষ পর্যন্ত তাঁর স্থান হয় জগন্নাথ হলের গণকবরে। তাঁর স্ত্রী, পুত্র এবং পুত্রবধূর মরদেহ ঘরের মধ্যেই পড়ে থাকে। কয়েকদিন পর পৌরসভার সুইপার এসে পঁচাগলা মরদেহগুলো নিয়ে যায়।
পরবর্তী সময়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী যখন জানতে পারে যে, শহীদ মিনার, বটতলা ও মধুর ক্যান্টিন ছাত্রদের জমায়েত হবার স্থান এবং সকল ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্র ছিল, তখন এগুলো তারা ধ্বংসের চেষ্টা চালায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষকের অনুরোধে মধুর কেন্টিন ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা পায়। আজো এ কেন্টিন তাঁর নামে পরিচিত। মধুর ক্যান্টিনের সম্মুখে মধুসূদন দে’র একটি আবক্ষ ভাস্কর্য স্থাপন করা হয়েছে। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্যভাবে যুক্ত হয়ে আছেন। [মনিরুজ্জামান শাহীন]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৭ম খণ্ড