বীর বিক্রম মতিউর রহমান
মতিউর রহমান, বীর বিক্রম (১৯৫০-১৯৮১) বীর মুক্তিযোদ্ধা। তিনি ১৯৫০ সালের ১৭ই সেপ্টেম্বর বর্তমান ঝিনাইদহ জেলার শ্রীপুর উপজেলার শ্রীপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম রোয়াজেস আলী জোয়ারদার এবং মাতার নাম হাজেরা খাতুন। পিতার চাকরিস্থল চট্টগ্রামে হওয়ায় তিনি চট্টগ্রাম পাহাড়তলী রেলওয়ে সরকারি স্কুলে সপ্তম শ্রেণি পর্যন্ত অধ্যয়ন করেন। তারপর তিনি পশ্চিম পাকিস্তানের রাওয়ালপিন্ডি জেলার মারী হিলস-এর লোয়ার টোপায় অবস্থিত পাকিস্তান এয়ারফোর্স পাবলিক স্কুলে ভর্তি হন। এ স্কুল থেকে তিনি ১৯৬৫ সালে এসএসসি এবং ১৯৬৭ সালে এইচএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। বছরই তিনি পাকিস্তান সামরিক বাহিনীতে ক্যাডেট হিসেবে যোগদান করেন। পশ্চিম পাকিস্তানের এবোটাবাদের কাকুলে অবস্থিত পাকিস্তান মিলিটারি একাডেমি থেকে সফলতার সঙ্গে প্রশিক্ষণ সমাপ্তির পর তিনি কমিশনপ্রাপ্ত হন এবং সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট হিসেবে কোয়েটা সেনানিবাসে পোস্টিং পান।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের প্রাক্কালে মতিউর রহমান পশ্চিম পাকিস্তানের কোয়েটা সেনানিবাসে লেফটেন্যান্ট পদে কর্মরত ছিলেন। ২৫শে মার্চ রাতে ঢাকাসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী অপারেশন সার্চলাইট-এর নামে নিরস্ত্র বাঙালিদের ওপর ব্যাপক গণহত্যা ও নির্যাতন শুরু এবং পাকসেনাদের হাতে গ্রেপ্তার হওয়ার পূর্বে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার পরপর বাঙালিরা মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। এমতাবস্থায় মতিউর রহমান জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পালিয়ে রংপুর অঞ্চলে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। তিনি প্রথমে মোহাম্মদ খাদেমুল বাশার, বীর উত্তম-এর নেতৃত্বাধীন ৬ নং সেক্টরে সাহেবগঞ্জ সাব-সেক্টরে যুদ্ধ করেন। পরবর্তীতে তিনি একই সেক্টরের পাটগ্রাম সাব- সেক্টরের কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এই সাব-সেক্টরে তাঁর নেতৃত্বে অনেকগুলো যুদ্ধ সংঘটিত হয়। তার মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য বড়খাতা তিস্তা রেলসেতু যুদ্ধ ও হাতীবান্ধা পাকিস্তানি ক্যাম্প অপারেশন।
লালমনিরহাট ও পাটগ্রামের মধ্যবর্তী বড়খাতা গ্রামে তিস্তা নদীর ওপর অবস্থিত রেলসেতুটি পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এই সেতুর ওপর দিয়েই পাকসেনারা রেলগাড়িতে করে রংপুর জেলার উত্তর অঞ্চলে, বিশেষ করে পাটগ্রাম ও হাতীবান্ধায় সমরাস্ত্র ও খাদ্যসামগ্রী সরবরাহ করত। তাই তারা এই সেতু রক্ষার জন্য এখানে শক্ত প্রতিরক্ষা ঘাঁটি স্থাপন করে। সেতুর দুই প্রান্তে পাকসেনাদের ক্যাম্প ছিল। এছাড়া সেতুর ওপরে তাদের একটি পোস্ট ছিল। কৌশলগত কারণে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য এ সেতুটি ধ্বংস করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। কারণ, এ সেতুটি ধ্বংস করতে পারলে রংপুরকে বিচ্ছিন্ন করে হাতীবান্ধা থেকে বুড়িমাড়ী পর্যন্ত সমগ্র এলাকা তাঁদের নিয়ন্ত্রণে রাখা সহজ হবে।
তিস্তা সেতুর গুরুত্বের কথা মনে করে সেক্টর কমান্ডার এম কে বাশার মে মাসের শেষদিকে সেতুটি ধ্বংসের পরিকল্পনা করেন। কিন্তু মে মাসের শেষ সপ্তাহ, জুলাই মাসের মাঝামাঝি এবং আগস্ট মাসের ৪ তারিখ তিনবার চেষ্টা করেও তাঁরা সেতুটি ধ্বংস করতে পারেননি। তারপর ১২ই আগস্ট ক্যাপ্টেন মতিউর রহমানের নেতৃত্বে পুনরায় বড়খাতা রেলসেতু অভিযানের পরিকল্পনা করা হয়। ঐদিন রাত ৮টায় মতিউর রহমান ১২ জন সহযোদ্ধা নিয়ে এই সেতু অপারেশনে আসেন। তাঁদের দলকে কভারিং ফায়ার দেয়ার জন্য লেফটেন্যান্ট মেসবাহ উদ্দিন আহমেদ, বীর বিক্রম ও সুবেদার আব্দুল মালেকের নেতৃত্বে দুটি ফ্রন্টিয়ার ফোর্স কোম্পানি তাঁদেরকে অনুসরণ করে। মতিউর রহমান মূল সেতু থেকে একটু দূরে জীপ রেখে পায়ে হেঁটে রাত ১২টার দিকে সেতুর কাছাকাছি পৌঁছান। তখন মুষল ধারে বৃষ্টি হচ্ছিল। বৃষ্টির কারণে পাকিস্তানি সৈন্যরা বাংকারের মধ্যে অবস্থান করছিল। এই ফাঁকে মুক্তিযোদ্ধারা সেতুর তিনটি স্থানে দ্রুত এক্সপ্লোসিভ বসান। রাত দুটার দিকে ক্যাপ্টেন মতিউর রহমান ব্রিজের ওপর থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের তুলে এনে ডেটোনেটরে আগুন লাগান। মুহূর্তের মধ্যে সেতুটি ভেঙ্গে পড়ে। সঙ্গে-সঙ্গে মেজবাহ উদ্দিনের দল কভারিং ফায়ার করে। ঘটনার আকস্মিকতায় পাকসেনারা হতভম্ব হয়ে পড়লেও মুহূর্তের মধ্যে তারা পাল্টা আক্রমণ শুরু করে। তুমুল গুলি বিনিময়ের পর এক পর্যায়ে তারা ১৫টি লাশ ফেলে পিছু হটে গেলে মুক্তিযোদ্ধাদের বিজয় সম্পন্ন হয়।
ক্যাপ্টেন মতিউর রহমানের বীরত্বপূর্ণ নেতৃত্বে পরিচালিত আর একটি বড় যুদ্ধ হলো হাতীবান্ধা পাকিস্তানি ক্যাম্প আক্রমণ। এখানে পাকবাহিনীর অবস্থান ছিল হাতীবান্ধা কলেজ, সিও ডেভেলপমেন্ট অফিস ও চিন্তাপাড় বাংকারে। তাদের ছিল দুই কোম্পানি রেগুলার ফোর্স, দুই কোম্পানি ইপিসিএএফ (ইস্ট পাকিস্তান সিভিল আর্মড ফোর্সেস) এবং ১৪০০ রাজাকার। ২৭শে সেপ্টেম্বর ভোররাতে ক্যাপ্টেন মতিউর রহমানের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা হাতীবান্ধা ক্যাম্প আক্রমণ করেন। সারাদিন যুদ্ধের পর বিকেলবেলা কিছুক্ষণের জন্য যুদ্ধ বন্ধ থাকে। কিন্তু সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার দিকে পাকিস্তানি আর্টিলারি ফোর্স প্রচণ্ড বেগে গোলাবর্ষণ শুরু করলে মুক্তিযোদ্ধারা ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়েন। এমতাবস্থায় ক্যাপ্টেন মতিউর রহমান মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবল ফিরিয়ে আনেন এবং পুনরায় যুদ্ধ শুরু হয়। তিনদিন প্রচণ্ড যুদ্ধের পর পাকসেনারা পিছু হটলে হাতীবান্ধা মুক্তিযোদ্ধাদের দখলে আসে। এ-যুদ্ধে কোম্পানি কমান্ডার সুবেদার ফজলুর রহমান, বীর উত্তম-সহ সাতজন বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন এবং আহত হন ৩০ জনেরও অধিক। অপরদিকে বহু পাকসেনা হতাহত হয় এবং নয়শতাধিক রাজাকার আত্মসমর্পণ করে।
মুক্তিযুদ্ধে বীরত্ব ও অসীম সাহসিকতাপূর্ণ অবদানের জন্য বাংলাদেশ সরকার ক্যাপ্টেন মতিউর রহমানকে ‘বীর বিক্রম’ খেতাবে ভূষিত করে (গেজেট নং ৯৩, খেতাবের সনদ নং ১৮)। মুক্তিযুদ্ধ শেষে মতিউর রহমান তাঁর কর্মস্থল বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে যোগদান করেন এবং পদোন্নতি পেয়ে লেফটেন্যান্ট কর্নেল পদে উন্নীত হন। ১৯৮১ সালের ৩০শে মে জিয়াউর রহমান, বীর উত্তম-এর হত্যা ঘটনার পর ২রা জুন জেনারেল জিয়ার অনুগত সেনাদের হাতে তিনি নিহত হন। ব্যক্তিজীবনে মতিউর রহমান এক কন্যা সন্তানের জনক। তাঁর স্ত্রীর নাম ফারহানা রহমান। [সাজাহান মিয়া]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৭ম খণ্ড